হূবনাথ পান্ডের চারটি কবিতা
মূল হিন্দি থেকে অনুবাদ : স্বপন নাগ

এই শহরে
এখন আর
এই শহরে কেউ
খালিপেটে ঘুমোবে না।
সব্বার জুটবে দু’বেলার রুটি,
মাথার ওপর ছাদ,
হাতে রোজগার
আর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন !
ঝাঁ চকচকে রাস্তায়
হাওয়ার সঙ্গে কথা বলবে
সার সার গাড়ি,
শহরের এ প্রান্তকে জুড়বে
ও প্রান্তের সাথে
অজস্র ফ্লাইওভার ব্রীজ,
রাস্তায় আকাশে জলে
ছুটবে গাড়ি —
মুহূর্তে পৌঁছে যাবে
এ মাথা থেকে ও মাথায়।
থাকবে চকচকে হাসপাতাল
সমস্ত সুবিধেযুক্ত,
নধর সুস্বাস্থ্য বাচ্চাদের কলরবে
মুখরিত হবে স্কুল চত্বর,
বাগানে বাগানে হাসবে নানারঙা ফুল
পুকুরে পুকুরে ফুটে থাকবে পদ্ম,
ভিখিরিশূন্য হবে ফুটপাত
ঝকঝক করবে রেল স্টেশন,
বাসস্ট্যান্ডগুলো হবে পরিষ্কার, ঝকমকে।
মলে-বাজারে ঝলমল করবে সুন্দরীরা,
মোহিনীরা ঢেউ তুলবে ক্যাম্পে,
গরু-কুকুর বিহীন নিরুপদ্রব হবে গলি।
মন্দির মসজিদ ভরে উঠবে ভক্তে
ভক্ত ভরে উঠবে ভক্তিভাবে,
ধন আর রাশিতে ভরে উঠবে
ব্যাংক, সেনসেক্স ….
বিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়িত এই শহরে
কোত্থাও থাকবে না আর
অভাব নোংরা ও বিপন্নতার নামগন্ধ !
এখন আর
এই শহরে কেউ
খালিপেটে ঘুমোবে না।
কারণ, নিরন্নদের জন্যে
এই শহরেরই বাইরে নির্মিত হতে যাচ্ছে
আর একটি শহর !
এমনিতেই
ভুখা মানুষের ঘুম আর আসে কই !
সব মনে রাখা থাকবে
রাজনীতির এই প্রচার যে অর্থহীন,
তা আজ প্রমাণিত —
লোকের স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল !
রুটিরুজির তাড়নায় নাকি
সুলতানের জুলুমও তারা ভুলে থাকে,
অন্তরের আঘাতও নাকি
সময়ের সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়।
যারা খেটে খায়
আত্মজাহির কিংবা বিশ্বাস
কোনোটিরই নাকি দরকার নেই,
শক্তির কাছে ক্ষমতার কাছে
নতজানু হয় সবাই,
এবং ভেঙেও পড়ে !
সবকিছুই নাকি ঠিক করে দেবে
ছল, বল আর দল …
যখন কেটে নেওয়া হবে জিভ,
আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হবে হাত-পা,
এমনকি বাঁধা হবে হিম্মতও —
কিছুই নাকি মনে রাখবে না কেউ !
যদি সত্যিই এমন কারোর মনে হয়,
তবে তার এই স্বপ্নবিলাসকে অভিনন্দন !
শ্মশানবৈরাগ্য
শত্রু একজনই, একলা
আর অন্যদিকে সমগ্র মানবজাতি।
এই সংকটের দিনে সবাই ভীত, সংঘর্ষরত
সব্বাই একা, নিতান্তই একাকী —
আর এজন্যই দুর্বল, এজন্যই ভয়ে কাঁটা !
যুদ্ধের শুরু শুরুতে মনে হয়েছিল
একদিকে অদৃশ্য শত্রু
আর অন্যদিকে পুরো মনুষত্বের সঙ্গে
মানুষ, শুধু মানুষ।
কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে এলো রং,
খসে পড়তে লাগলো আবরণ —
দেখা গেল কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
কেউ খ্রীষ্টান তো কেউ জৈন
কেউ দেহাতি মজদুর, চাকরিজীবী কেউ
কেউ-বা শিল্পপতি
কেউ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় কায়স্থ শুদ্র আদিবাসী
কেউ চাষি কেউ ক্ষেতমজুর
কেউ আফ্রিকান কেউ চীন দেশের
কেউ পাকিস্তানী ইতালীয় স্পেনিশ আমেরিকান
মানুষেরই টুকরো টুকরো প্রতিমা
ধরাশায়ী হয়ে ছড়িয়ে আছে বিচ্ছিন্ন ভাবে …
আর বিজয়ী একমাত্র
এক এবং একলা শত্রু —
কোনো বাইরে নয়, সে ছিল
প্রত্যেক মানুষেরই ভিতরে !
ঘনঘোর এই সংকটকালে
কে আর ছাই জিতবে !
শত্রু একাই সক্রিয় থাকবে কিছুদিন
তারপর কোটি কোটি এই পৃথিবীবাসীকে
পোকামাকড়ের মত বেঁচে থাকতে অথবা
মরার জন্যে ছেড়ে চলে যাবে।
তার চলে যাবার পর
প্রতিবারের মতো আবার
ভাবতে বসবো আমরা সবাই —
হায় ! মানুষের মতোই সবাই মিলে
লড়াই করতাম যদি
অন্তত ক্ষতি তো কিছু কম করা যেত !
সনাতন সত্য
ভয়ঙ্কর হড়কা বানে
পুরাতন মন্দিরও যখন ভেসে যায় যায়
সবার আগে পালালো পুরোহিত।
প্রিয় সর্বশক্তিমান দেবতাকে
নোংরা ঘোলা জলের স্রোতে ফেলে
তারপর পালালো ভক্তদল,
পালালো ফুল মালার দোকানদার,
একে একে ভিখারিরাও।
বন্যার জল নেমে গেলে একসময়
জেগে উঠবে পচা থিকথিকে কাদা —
ফিরবে বক, কাক, কিছু জন্তুও
ফিরে আসবে পুরোহিত, পান্ডা,
দোকানদার, কুকুর, ভিখারি আর ভক্ত।
তারপর শুদ্ধ জল আর মন্ত্রে
তামাম যজ্ঞ হোম আর শ্লোকে
পবিত্র করা হবে দেবতাকে !
দেবতার কৃপাতেই
বিধ্বংসী বন্যায় বেঁচে-যাওয়া মানুষ
পরমেশ্বরকেই একা অসহায় ফেলে রেখে
চলে যায় সকলে।
প্রাণে বাঁচার জন্যে ঈশ্বরসঙ্গ ত্যাগই তো
সংকট-মুহূর্তের সমঝদারি !
প্রাণ যদি বাঁচে
এমন ঈশ্বর তো বানানো যেতেই পারে
আবারও, বারবার !
হূবনাথ পান্ডে
কবি হূবনাথ পান্ডের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৩ ই এপ্রিল ভারতের বেনারস শহরে। এই সময়ের হিন্দি কবিতার জগতে হূবনাথ পান্ডে বহুচর্চিত একটি নাম। সমসময়, সামাজিক বৈষম্য, রাজনীতিকদের নীতিহীনতা, জাতপাতে দীর্ণ ভারতীয় সমাজ — এ সবই তাঁর কবিতার বিষয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ‘কৌয়ে’, ‘লোয়ার পরেল’, ‘মিট্টী’, ‘অকাল’ প্রমুখ। বর্তমানে তিনি মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক।
এ কবির বলিষ্ঠ কলম মনে থাকবে। ইয়াদ রাক্খা জায়গা। হড়কা ডানে পুরোহিত পালালেও ঈশ্বর অন্তর্হিত হলেও কবি থাকবেন। 🙏
শুভবুদ্ধি আর সুন্দর কল্যাণকর স্বপ্ন দেখা কবিকে ধন্যবাদ , শুভেচ্ছা , অভিনন্দন।
অপূর্ব চারটি কবিতা। “এই শহরে” এবং “সনাতন সত্য” মন ছুঁয়ে গেল। অসাধারণ।