যাঁরা আমার স্মরণে থাকবেন
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

‘মনে পড়ে যাঁদের’ নামে একটা লেখা কিছুদিন আগে লিখেছিলাম। তাতে কাছের, দূরের, নিজের বাসস্থানের চারপাশের ও এপাড়া-ওপাড়ার কিছু কিছু পরিচিত জনদের স্মরণ করেছিলাম কেননা তাঁরা আমায় অহেতুক ভালোবাসতেন বা আমিও তাঁদের ভালোবাসতাম। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বহাল তবিয়তে নিজের মত করে আছেন বা কেউ কেউ চলেও গেছেন।
তবে অনেক নাম বাদও পড়েছিল। তাঁরা বেশ কয়েকজন আমায় যেন বলছেন এবার তো আমাদের কথা লিখে ফ্যাল, কেউবা বলছেন ফেলুন।
জানি, আজ যাঁরা আমার স্বপ্নে এসেছেন তাঁরাই সব নন। তবু এঁদের কথা দিয়ে শুরু করা যাক।
ছোট বেলায় যখন ক্লাস নাইনে পড়ি একজন নাট্যকারকে দেখেছি দেবদত্তদা যিনি আসানসোলের চাঁদমারী রেল কোয়ার্টার্সের প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করতেন আর স্থানীয় লিপি নামক পত্রিকায় প্রায়ই লিখতেন। তাঁরই লেখা নাটক ‘আরেক দিন’ নাটকের দুটি বা তিনটি পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি লেখা হলেই নিয়ে এসে আমরা রিহার্সাল দিতাম। চাঁদমারী রেল কলোনির জবরদস্ত শিবুদা আমাদের রিহার্সাল করাতেন। আর সে নাটকের প্রধান চরিত্র ‘অশেষ’ করার জন্য আমাকেই বেছে নেয়া হয়েছিল। নাট্যাভিনয়ের সন্ধ্যেবেলা স্বয়ং লেখক আমাদের মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। যাঁদের লেখা পড়ি বা অভিনয় করি তাঁদের একজন, যতদূর মনে পড়ে প্রথম ব্যক্তিত্ব, ছিলেন তিনি। তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ ও আশীর্বাদ যেন আজও আমার উপর ঝরে পড়ে।
এরপর আসানসোল ছেড়ে কলকাতায় চলে এলে একটা কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কাকিমার দিকে তাঁর এক ভগ্নিপতি অর্থাৎ মেসোমশায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁর নাম সুনীল চক্রবর্তী। তাঁর রচনা ‘ টাকার রঙ কালো’ আর ‘আমি মন্ত্রী হব’ দুটি নাটক রঙমহল থিয়েটার হলে অনেক দিন ধরে নিয়মিত অভিনীত হত। আমার সামনে অনেক গল্প-উপন্যাস-নাটকের লেখক সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সুধা মাসী উপস্থিত ! আমি যেন দুষ্প্রাপ্য কিছু লাভ করলাম। সেই থেকে অনেক দিন পর্যন্ত, চাকরি পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের উল্টোডাঙ্গার ফ্ল্যাট বাড়িতে গিয়ে যোগাযোগ রাখতাম। অনেক কিছু শিখতে জানতে পারতাম।মেসোমশায়ের ও মাসীমার অঢেল স্নেহ বর্ষণে আমি কলকাতার আদপ কায়দার সঙ্গে, সংস্কৃতি র সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখলাম। তাঁদের স্নেহ কোনো দিন ভুলবোনা। তাঁদের কথা, আগেই অনেকটা বলেছি, হয়তো পরেও প্রসঙ্গক্রমে বারবার তাঁদের স্মরণ করতে পেরে ধন্য হবো।
১৯৬৭ সাল নাগাদ আমি একটু আধটু লিখে থাকি জেনে আমাদের অফিসের শিবকুমার গুহদা একদিন বললেন – চলো ভাই, তোমাকে একজন এখনকার জবরদস্ত কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। বেশী দূরে নয়, তোমার বাড়ির পথেই বরানগর ফাঁড়ি, ওখানেই নামতে হবে।”
সেই থেকে কবি পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতি প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। তাঁর বয়েস একশো এক এখন। বহু জায়গায় বারবার সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর পরিচালিত সারা বাংলা সাহিত্য মেলা, তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য মেলা পত্রিকা, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, শ্রীঅরবিন্দের বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন প বঙ্গ রিজিওনাল সেন্টার, অখিল ভারতীয় ভাষা সাহিত্য সম্মেলনের একাধিক বার্ষিক সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে কত যে জায়গায় এই প্রায় অর্ধশতাধিক বৎসর ধরে গিয়েছিলাম, তার ইয়ত্তা নেই।
তাঁর সঙ্গে ১৯৭২ সালে আমরা চল্লিশ জন নিজের দাদার মত শ্রদ্ধেয় কবি গোবিন্দ ভট্টাচার্য সহ কবি লেখক পাঠক গবেষক গিয়েছিলাম সদ্য স্বাধীনতা আদায় করা নবগঠিত বাংলাদেশের যশোর, কুষ্টিয়া হয়ে লালন ফকিরের মাজারে ও শিলাইদহে। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রবীন্দ্র জয়ন্তীতে যোগ দিতে পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছিলাম। যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের আহূত দুই বাংলার সাহিত্য সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে খুব গর্ববোধও করেছিলাম। উল্লেখ করা যেতে পারে ওই একই মাসের বাইশ তারিখে কবি কন্যা ভূমিকার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল এবং ফিরে এসে তা সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। তাই কান্তকবি জয়দেবের নামে চিহ্নিত ও বছরভর যাওয়া আসা করা দেশবিদেশের বাউলদের শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান কেন্দুলিতে কবিতার জন্য গবেষণাগার গড়ে তুলবেন। সে জন্য বাউল মেলার মাঠের কাছে জমি কিনে ছোট্ট একটা বাড়িও করেছিলেন। সামনে পুকুর, পুকুরে ভাসছে সাদা হাস লাইন করে, মাঝে মাঝে জলে মুখ ডুবিয়ে মাছ বা গেড়ি-গুগলি তুলে খাচ্ছে এ দৃশ্য দেখতে এবং বিভিন্ন জেলার কবিদের কবিতার চর্চা শুনতে বারবার তাঁর সঙ্গে চলে গিয়েছি বোলপুর-শান্তিনিকেতন, সেখান থেকে
বাসে ইলামবাজার হয়ে জয়দেব-কেন্দুলি।
মনে হয়, তাঁর স্বপ্নের গবেষণার কথা তিনিই একসময় রাজ্য সরকারকে জানানোর ফলশ্রুতিতে কেন্দুলিতে গড়ে উঠেছিলো জয়দেব মঞ্চ। সেখানে তিনি প্রতি বছর জয়দেব মেলায় কবিতা, গল্প পাঠ ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন।
বীরভূম জেলার নানান বয়েসী কবি লেখকরাও আসতেন বাউল মেলায়। যেতেন কলকাতার অনেক কবি-সাহিত্যিক আর নানান জায়গার অজস্র মানুষ। নানান পসরা সাজিয়ে বসতেন দূর দূরের বিক্রেতা ব্যবসায়ীরা। আসতেন গ্রাম গঞ্জের মানুষ বড় বড় গাড়ি নিয়ে, গরুর গাড়ি করেও আসতেন অনেক মানুষ বাউল গান শুনতে। আসতেন তাঁরা থলে বা টিন ভরে মুড়ি, খাবার দাবার নিয়ে সদলবলে। এমনকি এক বছর বয়েসী শিশুকে কোলে নিয়ে চাষ আবাদী কাজ করা মায়েরাও আসতেন বাউল মেলায়। কবি পূর্ণেন্দু প্রসাদ চোখ ভরে মেলার ভীড় দেখতেন, অনেকের সঙ্গে নিজে থেকেই আলাপ করতেন। কে ধনী বা গরীব বা অশিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত তার বাছবিচার তিনি করতেন না। এজন্য তিনি প্রচুর মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ভালোবাসাও পেয়েছেন। অথচ রক্ষণাবেক্ষণের লোকের অভাবে শেষ পর্যন্ত জলের দামে সুন্দর জায়গার বাড়িটা বিক্রি করে দিতে প্রায় বাধ্য হয়েছিলেন।
তিনি বোলপুরের কাছে সিয়ান বাস স্টপে নেমে তিলুটিয়া গ্রামে উদয়ন কল্যাণ কেন্দ্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন বা আজও আছেন। এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কবি এনামুল হক। বাংলা ও ইংরেজিতে সুন্দর কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতার বইও ছিল।এই কবি আধ্যাত্মিকতার পূজারী ছিলেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ পছন্দ করতেন না। কবি এনামুল হক সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করতে চাইতেন শুধু কথার কথা নয়, একেবারে বাস্তবে তার প্রয়োগ করতেও বদ্ধপরিকর ছিলেন। একবার তাঁদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করতে সামান্য দূরের কয়েকটা গ্রাম থেকে কয়েকশো মানুষ (মানুষ আখ্যা পাবার যোগ্য ?) এনামুল কবির তিলুটিয়া গ্রামে এসে বাড়িগুলি লুট, অত্যাচার, হত্যার জন্য মারমুখী হয়ে এগিয়ে আসতেই এনামুল হক কবি নিজের ছেলেদের আর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুখে দাঁড়ালেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে। দাঙ্গাবাজদের ফিরিয়ে দিতে তাঁকে নিজস্ব বন্দুক পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিল। দুদিকে হতাহত কিছু হয়েছিল এবং তার ফলে হাজতবাস ও কলকাতা হাইকোর্টে চলেছিল মামলা। কবি পূর্ণেন্দু প্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী কবিতা ভট্টাচার্য তিলুটিয়া গ্রামবাসীরা মামলার জন্য কলকাতায় এলে তাঁদের আশ্রয় খাদ্যের ব্যবস্থা নিজের ভাড়া করা বাসস্থানেই করতেন। তাঁরা দুজনে কোন ভেদাভেদ মানতেন না। তাঁরা দজনে অবলীলায় গ্রামবাসীদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন।
মামলার নিষ্পত্তির পর কবি এনামুল হক গড়ে তুললেন উদয়ন কল্যাণ কেন্দ্র এবং তিনি এক ঈশ্বর আর ত়াঁর সন্তানরা, তিলুটিয়া গ্রামবাসীরা এক জাতি এক প্রাণ এক ধর্মের মানুষ হবার সাধনায় মগ্ন হলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরের সন্তানরা জাতি ধর্ম ভুলে সবাই একসঙ্গে ভাই ভাই হয়ে মিলেমিশে থাকবে এই আশ্রমে, আশ্রম ছাড়িয়ে সারা রাজ্যে, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে, দেশ ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে। শুরু হবে এখান থেকেই। হবে এই তিলুটিয়া গ্রাম থেকেই। তিলুটিয়ার এই উদয়ন আশ্রমের প্রধান তিনি শূদ্রোত্তম নামে গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধা ভালবাসা পেতে লাগলেন। চলতে লাগলো প্রয়াস, সাধনা। এক এক করে গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের পদবী বাদ দিয়ে শুধু অজিত, মঞ্জু, ঝুমা, সমরেন্দ্র, বীরেন্দ্র ইত্যাদি নামে পরিচিত হতে লাগলেন। এখানে যেন শূদ্রোত্তম পরিচালিত একটা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের জন্ম নিলো।
আমরা কবি পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার আগের দিন রাত দশটায় আমরা বোলপুর-শান্তিনিকেতন স্টেশনে নামতেই একদল গ্রামীণ মানুষ ফুল আর মালা নিয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত থাকতেন। সেখান থেকে নির্দিষ্ট বাসে সিয়ান বাসস্টপে। সেখান থেকে জ্যোৎস্নালোকিত ধান বা গম কাটা ক্ষেতের মধ্য দিয়ে কখনো বা আলপথে গরুর গাড়ি করে তিলুটিয়া গ্রামের দিকে আমরা যেতাম। কেউ জোরে জোরে নিজের কবিতা বা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা বা গান করতেন।
আমাদের সঙ্গে কোনো কোনো বার থাকতেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন বসুও। তিনি ও পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য দুজনে বন্ধুর মত ছিলেন। একবার, দক্ষিণারঞ্জন বসুর মিল্ক কলোনির বাড়িতে সাহিত্য পাঠের জন্য আমরা আমন্ত্রিতও হয়েছিলাম। সেখানে তাঁর এক যুবক ছেলেও আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করতে এগিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ফসল কাটা মাঠের মধ্যে দিয়ে গরুর গাড়ি চলছে না ঘোড়ার গাড়ি চলছে তা গাড়ির গতিতে বোঝা যেত না। আমরা বিস্ময়ে নিজেরা বলাবলি করতে করতে পৌঁছে যেতাম তিলুটিয়া গ্রামে। সেখানে এক গুচ্ছ মেয়ে-বৌরা ও অনেক গ্রামবাসীর প্রস্তুত থাকতেন দ্বিতীয় প্রস্থ স্বাগত জানাতে, সঙ্গে তাঁদের থাকতো বিভিন্ন মাঙ্গলিক সরঞ্জাম। তিন দিন ধরে চলত সাহিত্যের নানান শাখার স্বরচনা পাঠ ও বিশেষ বিষয়ে আলোচনার আসর।
আমরা ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকে আসতেন বাউলের দল, পালাগানের দল, ব্রতচারী নৃত্যের দল আরও কত কী! সকলকে সার দিয়ে মাটিতে বসিয়ে ডাল-ভাত তরকারী পরিবেশন করতেন আশ্রমের ছেলে মেয়েরা খুব আন্তরিক ভাবে। আমাদের মনে হতো যেন আমরা ভোজ খেলাম পেটপুরে। পরদিন, সকালের চায়ের সঙ্গে দুতিন ঘন্টার অধিবেশনের পর দশটা নাগাদ আবার সারি দিয়ে মাটিতে বসিয়ে শালপাতায় পরিবেশন করা হোত সদ্যভাজা মুড়ি অনেকটা করে। সঙ্গে ছোলার ডাল, কাঁচা লঙ্কা আর ঝোলা গুঁড়। পরেরদিন ব্রেকফাস্টে মুড়ির সঙ্গে আলুর ঝোল আর ঝোলা গুঁড় সঙ্গে লাড্ডু থাকতো একটা করে। তবে মুড়ি ভাজা চলছে আর আমরা গরম মুড়ি যতটা খেতাম তা আমাদের কলকাতায় অন্তত পনের দিনেও খেয়ে শেষ করতে পারতাম না।
সম্মেলনের পর ফিরে আসার তোড়জোর করতেই আশ্রমের মাটি যেন ভিজে যেত ওখানকার ছেলে মেয়েদের চোখের জলে। আমাদের চোখ ছলছল করতো নিশ্চয়ই।
খুব খুব ভালো লাগলো । কতকিছু জানতে পারলাম ।
জীবন কথা ও তার সাথে যুক্ত বহু মানুষের জীবনী । পড়তে ভাল লাগল।
খুব ভালো লাগলো। মনে হল সেই সময়ে পৌঁছে গিয়েছি। কি সুন্দর অনুভূতি!