সাম্প্রতিক ১৩ঃ ভোটারের সমর্থন বনাম দলত্যাগ, বিশ্বাস হারাচ্ছে রাজনীতি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

ভোটারের সমর্থন বনাম দলত্যাগ, বিশ্বাস হারাচ্ছে রাজনীতি
অনিরুদ্ধ সুব্রত

অবেক্ষণ পত্রিকার সাম্প্রতিক কলামটি মোটামুটি অরাজনৈতিক লেখার অঙ্গীকার নিয়েই সূচনা । অতএব কোনও রাজনৈতিক দল, মত, বক্তব্য নিয়ে মন্তব্যের বিন্দুমাত্র আকাঙ্খা বা আগ্রহ আমার নেই । বরং আমরা যারা ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিক, এবং যারা ভোটারও বটে, নিশ্চিত ভাবে তাদের নিয়ে এক আধটু আলোচনা চলতে পারে ।
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসই বড়ো ইতিহাস । তার অতীত যেমন লম্বা চওড়া, তেমনি বর্তমানও ভীষণ পরিবর্তনশীল । সভ্যতার বহু বহু প্রাচীন কাল থেকে আজকের দিনে আসতে নানান রাজনৈতিক চেতনা ও ক্ষমতাকে অতিক্রম করতে হয়েছে মানুষকে ।
দার্শনিকের দেখানো রাজনৈতিক নীতির দর্শন রাতারাতি জনপ্রিয় হয়েছে, তা বলা যায় না। সেই নীতির উপর যেমন দীর্ঘ বিশ্লেষণ চলেছে, তেমনি প্রত্যেক রাজনৈতিক দর্শনের সুফল কুফল নিয়ে এক শ্রেনির চর্চাকারী চিরকাল চর্চা করে গেছেন। ক্ষমতার অধিকার যেমন রাজনৈতিক আদর্শ গুলোর বিশেষ লক্ষ্য, তেমনি ক্ষমতার সুব্যবহারও ঐ সকল আদর্শ গুলোর অন্যতম আলোচ্য । সুতরাং সেই রাজ আমল থেকে শুরু করে, সম্রাট, সুলতান, অথবা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বা সাম্রাজ্যেবাদের কাল — সব, সবটাই এক একটি রাজনৈতিক আদর্শগত ভাবধারা ।
১৬০৭ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য করতে এলো, তখন এদেশে মোগল সাম্রাজ্যের একেবারে শেষ প্রান্ত বলা যায় না । কিন্তু একদিকে মোগল সম্রাট আর অন্য দিকে বিভিন্ন অঞ্চলের নানান ছোটো বড়ো দেশীয় রাজন্যবর্গ। যার মধ্যে সমন্বয় বলতে বিশেষ কিছু ছিল না । কোনও কোনও অঞ্চলের রাজা প্রায় সমান্তরাল এবং স্বাধীন ভাবে রাজত্ব চালাতেন । এমনকি ঐ প্রকার রাজাদের পরস্পরের প্রতি শত্রুতা, যুদ্ধ বিগ্রহও চলত। একটা বিরাট বড়ো দেশের এই যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং পারস্পরিক দ্বেষ ও বৈরী মনোভাব— ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির নজর এড়ায় নি। ফলে বাণিজ্যের পাশাপাশি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র তারা গোপনে গোপনে চালিয়ে যেতে শুরু করেছে অনেক আগেই । তার পর ১৭৫৭ এর ইতিহাস আমাদের তো জানা ।
মোট কথা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সুযোগ পেলে শক্তি, বুদ্ধি ও কৌশলী তা অবশ্যই গ্রহণ করবে এবং শাসন শোষণ শুরু করবে, ইতিহাস মতে এটাই স্বাভাবিক ।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে আধুনিক পৃথিবী, সেখানে উন্নত তর বা উন্নয়নশীল প্রত্যেক দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ও পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলো আলাদা আলাদা মতাদর্শ আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিগত আদর্শ । তবু আজকের পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার দিকেই মানুষের ঝোঁক কিছুটা বেশিই। এই আদর্শের অন্যতম আমাদের ভারতবর্ষ । যদিও আমাদের স্বাধীন ভারতের সংবিধান মতে ‘সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ‘ব্যাপারটাও প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে । তবু পৃথিবীর বৃহত্তর এই সংবিধান নাগরিকের কর্তব্য ও মৌলিক অধিকার রক্ষার নির্ধারিত কিছু প্রসঙ্গ রেখেছে। সর্বোপরি এটি আদর্শগত দিক থেকে হয়ে উঠেছে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার দেশ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতা পূর্ব কাল থেকেই এদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে । স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে গণভোট রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে । একটু একটু করে বহুদলীয় রাজনৈতিক বাজার তৈরিও হয়েছে এই দেশে। একদিন একক রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য কমে শুরু হয়েছে সমন্বয়ী গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতার রাশ।
আর আজকের ভারতবর্ষ দেখতে শুরু করেছে ভিন্ন এক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের হঠাৎ হঠাৎ দলত্যাগ ও ভিন্ন দলে নাম লেখানোর ট্রেন্ড। ভোটার মাত্রেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক । আর সেই সমর্থন দল অর্থে জনৈক জন প্রতিনিধির প্রতি। এখন কথা হলো যারা জনগনের ভোট পেয়ে জিতে যান এবং গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব করতে লোকসভা বা বিধানসভায় চেয়ার দখল করেন, তাদের প্রাথমিক দায়বদ্ধতা কী ?
যেহেতু এটা বহুদলীয় দেশ, সুতরাং সাধারণ জনগণ বা ভোটারের একটা নূন্যতম রাজনৈতিক আদর্শগত ভাব আছে বলেই ধরে নিতে হবে। প্রতিটি ভোটারই রাজনৈতিক সচেতন বলেও মনে করতে হবে। তো সেই লক্ষ সম মতাদর্শের সমর্থনকারী ভোটার যখন জনৈক ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠায়, তখন শুধু কি ক্ষমতাই লক্ষ্য ? রাজনৈতিক নীতিগত লক্ষ্য কিছুই থাকে না ? নাকি জনগনের ভোট সারা হলে নেতা নেত্রীই সব ভোটার পুরোপুরি ফালতু ? যাদের রাজনৈতিক সচেতন ও আদর্শ সচেতন ভাবার অভ্যাস এই দেশের জনপ্রতিনিধিদের আজ অবধি হয় নি ?
আধুনিক ভারতবর্ষের আধুনিক রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের এতটুকু দায়বদ্ধতা থাকার আশা কি করতে পারবে না ভোটাররা , যেখানে বিজয়ী নেতা বা নেত্রী পুরনো দল ও রাজনৈতিক আদর্শ ছেড়ে ভিন্ন দল ও রাজনৈতিক মতাদর্শকে গ্রহণ করার আগে সেই সব ভোটার দের মত,ইচ্ছে একটু জেনে নেয়, যারা তাকে সমর্থন জানিয়ে জনপ্রতিনিধির রূপ দিয়েছিল । চাকরি বদলাতে গেলেও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে মানুষ, যদিও তা ব্যক্তিগত বৃত্তের ভিতর । অথচ বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্র, যেখানে দেশ কাল জনগণের বৃহত্তম জায়গা । সেখানে গণতান্ত্রিক পথের গণমত কোনও বিষয় নয় !
ব্যাপারটা যদি ধীরে ধীরে এই দিকেই ধাবিত হয়, তবে জনপ্রতিনিধিত্বেরই চরম ক্ষতির দিন আসন্ন । সাধারণ ভোটারদের বিশ্বাস অর্জনের পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। রাজনৈতিক আদর্শগত বুলি কপচানো মাইক্রোফোন গুলো হয়তো হেসে উঠতে পারে যেকোনও দিন।

One thought on “সাম্প্রতিক ১৩ঃ ভোটারের সমর্থন বনাম দলত্যাগ, বিশ্বাস হারাচ্ছে রাজনীতি – অনিরুদ্ধ সুব্রত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *