সাম্প্রতিক ৭ : অনিরুদ্ধ সুব্রত

হোক বাজি-বর্জনের উৎসব

উৎসবে আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম বড়ো বৈচিত্র্যময়। অন্তরের আবেগ আর অনুভূতি যখন সুখ ব্যক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন মানুষ বিভিন্ন অজুহাত নিজের থেকেই খুঁজে নেয়। প্রচলিত শব্দবাজি বা আতসবাজি উভয়ই তেমনই একটি আনন্দ উল্লাস প্রকাশের মাধ্যম। তথ্য বলছে, প্রায় দু’হাজার বছর আগে বাজির জন্ম। আবার আর একটি মত হল, খ্রিস্টীয় নবম শতকে চীনদেশে আতসবাজির আবিষ্কার। যদিও প্রথম ধারণায় নাকি গানপাউডার থেকেই আতসবাজির সৃষ্টি। পরবর্তীকালে চীনারা গানপাউডারের সঙ্গে বারুদ ব্যবহার করে আতসবাজির অনেক উন্নতি সাধন করেছে। এবং এক সময়ে খ্যাতনামা পরিব্রাজক মার্কোপোলোর হাত ধরে আতসবাজি তৈরির ফরমূলা ইউরোপীয়দের হাতে পৌঁছয়। ত্রয়োদশ শতকে ইংরেজ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন এই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে (পঞ্চদশ শতক থেকে) আতসবাজি তৈরির উপকরণে বিশেষ রদবদল ঘটেনি।সল্ট পিটার, চারকোল আর সালফারের মিশ্রণ এখনও মূল উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে বৈচিত্র্য আনতে বিভিন্ন প্রকার দাহ্য, অতি দাহ্য ও বিস্ফোরক কিছু রাসায়নিক দ্রব্য দক্ষতার সঙ্গে মেশানো হয়। যা আতসবাজির শব্দ,ঔজ্জ্বল্য এবং রঙের আকর্ষণীয়তা বর্ধনে অংশ নেয়। পটাশিয়ামনাইট্রেট,সালফার, লৌহচূর্ণ এবং মিহি কাঠকয়লার গুড়ো গতিবেগ ও স্ফূলিঙ্গ সৃষ্টি করে। আর বিস্ফোরণ তীব্রতর করতে মেশানো হয় বারুদ। আবার আলোর ঔজ্জ্বল্যের জন্য নাইট্রেট অব লেড এবং বোরিয়াম ও অ্যালুমিনিয়াম চূর্ণ যেমন সংযুক্ত করা হয়, তেমনি ঘূর্ণায়মান রঙিন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সৃজনের জন্য মেশানো হয়ে থাকে পটাশিয়ামক্লোরেট ও বিভিন্ন ধাতব লবন। মনে রাখতে হবে একমাত্র কাঠকয়লার গুড়ো ছাড়া এর অধিকাংশ উপাদানই রাসায়নিক।
রাস্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ'(আইপিসিসি)-এর সাম্প্রতিক রীপোর্ট বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।যা লাগাতার বিশ্বউষ্ণায়নের জের বলেই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক-গবেষকদের মত। এবং এই চরম বিপর্যয়ের সামনে খানিকটা আশ্বস্ত হতে হলে এই মুহুর্তে করণীয় বলে যে সাবধানী তা হল, মানব জীবনের দৈনন্দিন দূষণ-অভ্যাসে দ্রুত রাশটানা। ২০১৬-এর একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে,ভারতের রাজধানী শহর দিল্লিতে দিওয়ালির পর বাতাসে নিরাপদ মাত্রার তুলনায় প্রায় ১০গুণ দূষণমাত্রা বৃদ্ধি পায়। যার প্রধান কারণ আতসবাজির দহন। ২০১৫ তে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের মতে আতসবাজি বাতাসে বাড়িয়ে দিতে পারে মানব শরীরে নিউরোব্লাস্টিক টিউমারের সম্ভাবনা। এটি এমন এক জাতীয় ক্যান্সার সম্ভাবনা যা সাধারণত স্নায়ুতন্ত্র গঠনের উপযোগী কোষের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের শরীরেই এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সুতরাং প্রসঙ্গটা পরিবেশের পাশাপাশি মারাত্মকভাবে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিতও।
শুধু দিল্লি নয়, সারা ভারতে বাজি উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হওয়ার আন্দোলনে বাঙালি পরিবেশবিদের সক্রিয়তা আমাদের জানা। কিন্তু সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির তর্ক শুধুমাত্র ৯০ ডেসিবেল আর ১২৫ ডেসিবেল নিয়ে। তাদের যুক্তি, ৯০ ডেসিবেলের সীমার মধ্যে শব্দ বাজিতে আইন রক্ষা হয় তাই তা স্বাভাবিক এবং প্রচলিত। ফলে সেখানে শব্দ দূষণের প্রসঙ্গই একমাত্র বিবেচ্য। এবং এই প্রসঙ্গেই আলোচনার টেবিলে উঠে আসে রাজ্যে বাজি কারখানার বৈধ ও অবৈধতা নিয়ে। কার লাইসেন্স আছে আর কার লাইসেন্স নেই এ নিয়ে বাকযুদ্ধে কেটে যায় দীর্ঘ সময়। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দবাজির উপর হয়তো নজরদারি চালাচ্ছে। কিন্তু যেটা আদৌ দেখা হচ্ছে না তা হল এ রাজ্যের শারদোৎসব থেকে কালীপূজা,দীপাবলি অথবা কোনও একটি নির্বাচনের ফলঘোষণার পর বাতাসে সাধারণ দূষণমাত্রার পার্থক্য কী ঘটলো।
একসময় বাজি কারখানা গুলোতে আকছার শিশুদের কাজকরতে দেখাগেছে। কিন্তু শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হবার পর হয়তো সেখানে চোদ্দ বছরের নীচে শিশুরা কাজ করছে না। কাজ করছে সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ এবং মহিলা, বয়স্ক শ্রমিক। যারা শুধুমাত্র দীর্ঘদিনের বংশপরম্পরার ধারাবাহিকতায় এই কাজে এসেছে অথবা উৎসবের মরশুমে কিছু সচ্ছলতা প্রাপ্তির আশায়। পিছনে কিন্তু মুনাফা ভোগী মহাজন যথারীতি সক্রিয়। কোনও কারখানায় আকস্মিকভাবে (যদিও সম্ভাবনা থাকে সর্বক্ষণ) যখন অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটে, তখন শুধুমাত্র তখনই আলোচনা শুরু হয় শ্রমিকদের দক্ষতা আর অদক্ষতা নিয়ে। ঠিক এই সমস্যা সমাধানে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তর নাকি বাজি তৈরির সঠিক নিয়ম মেনে কর্মশালার মাধ্যমে বাজি শিল্পী-শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। যেখানে দেখানো হচ্ছে হাতে-কলমে বাজি তৈরির বিভিন্ন উপাদান সঠিক পরিমাণ কিভাবে মিশ্রিত করতে হবে। এবং প্রশিক্ষকদের তালিকায় থাকছে দূষণনিয়ন্ত্রণ পর্ষদ,পুলিশ, পরিবেশবিজ্ঞানী সহ কর্তাব্যক্তিরা। রীপোর্টে বলছে বারুইপুরে এই প্রশিক্ষণ দেবার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েও গেছে। এমনকি বাজি তৈরির এলাকা ভিত্তিক শিল্পতালুক করার পরিকল্পনাও নাকি সরকারের রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, যে দেশে হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট না বললে কোনও তর্কের সমাধান ভাবতে বসা প্রায় বৃথা,সেখানে কে বুঝবে শব্দবাজি বা আতসবাজি কোনও ফর্মেই বাজিকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। না কি এটা একটা জীবীকা বলে, বহু মানুষের অন্নসংস্থানের যুক্তি দিয়ে শিল্পদক্ষতার সাধনায় নিমগ্ন থাকা হবে ? যারা বাজি তৈরি করছে তাদের শরীরে রাসায়নিকের কুপ্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। অথচ বৈধ লাইসেন্সের বাকবিতন্ডা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভুলে থাকা হবে শব্দ ও বায়ু দূষণ প্রসঙ্গ ? একটা মৃত্যু, একাধিক আহতের পরিসংখ্যানে ডুবে থেকে আমরা কি বিপজ্জনক বস্তুর প্রেমে বিন্দুমাত্র রেহাই দেবো না ? আমরা কি পৃথিবীর আসন্ন বিপর্যয় সংকেতে একটুও ভীত হবো না ? তাজা তরুণের মৃত্যু অথবা শরীরের সিংহভাগ দগ্ধ মানুষ গুলোর কথা কালকের নতুন খবরের আড়ালে চিরতরে ভুলে যাবো ?
আর যারা শুধুমাত্র উৎসব আনন্দে আতসবাজি পটকা ফাটিয়ে উল্লাসে আটখানা, মনে রাখবেন পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা তাদেরও ছাড়বে না। গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রভাব আধারকার্ড দেখে দেখে পড়বে না। শব্দবাজির দাপট কার হৃদয়কে কখন বিদ্ধ করবে কে বলতে পারে! তাই শুধুমাত্র বারুদ পোড়া রঙিন আলোর দৃশ্য-সুখ অথবা ‘ঠাস ঠাস্ দ্রুমদ্রাম’ তীব্র শব্দ-সুখ যদি আমাদের ইচ্ছে থেকে একবার বাতিল বলে ভাবতে শিখি —তাতে অনেক বড়ো লাভ। বলতেই পারি, বাজি না পোড়ালে কী হয়! উৎসবের আনন্দ প্রকাশের অগণিত উপায় তো আছে। যদি আর একটু বাঁচি, আরও অনেকে বাঁচে। আর কর্মসংস্থানের প্রশ্ন ? সে তো দেশী মদ তৈরির কারখানা বন্ধ হলেও অনেকে বেকার হয়েছিল। তারা যথারীতি বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। আর মাথার উপর সরকার আছেন, ‘আতসবাজির প্রয়োজনীয়তাই নেই’ এমন আপ্তবাক্য উপর থেকে বলা হোক একবার। গড়িয়ে আসুক নীচে, সব মানুষের চেতনায়। যা ধ্বংস আর মৃত্যু আনে তার শিল্প-মাহাত্ত গাইলে শিল্পেরই অপমান।
আজ ২০২০ যখন করোনা মহামারীতে অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী, তখন দীর্ঘ লকডাউনে পৃথিবীর পরিবেশ মানুষের সংযত পদচারণায় অনেকখানিই দূষণমুক্ত । সমুদ্রের জলে নীলাভ আভা, কালো আকাশ কাটিয়ে উঠেছে অনেকটা কার্বন স্তর। ফুল আর পাখির যেন মুক্তির দিন। মারণ ভাইরাসের এই আক্রমণ অন্তত পরোক্ষে আমাদের একটা শিক্ষা দিয়েছে। আমারা বহুদিন বাদে খুঁজে পেতে পারি বাতাসে হিমের গন্ধ । ঠিক এই দিক থেকে তাই একটা প্রবল অনুরোধ রাখা যায়, কোনও রকম আতসবাজি যেন এই চরম সময়ে আমরা উৎসবের আনন্দ প্রকাশের অঙ্গ করে না তুলি। শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থেকে এর সমাধান সম্ভব নয়, দরকার আমাদের প্রত্যেকের একটা দৃঢ় অঙ্গীকার ।
—- অনিরুদ্ধ সুব্রত

One thought on “সাম্প্রতিক ৭ : অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. সমাজের স্বার্থে সমস্ত মানুষের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান লেখাটি। ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *