ইতিহাসের গল্পঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

শাহজাদী জাহানারার প্রেমকথা
সুভাষ মুখোপাধ্যায়


অশ্বপৃষ্ঠে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসছে শাহজাদা খুররম। তাঁকে পৌঁছাতে হবে অমৃতসরে যুদ্ধরত পিতা জাহাঙ্গীরের কাছে। বিদেশী ইংরেজ বনিকেরা অমৃতসরে এসে তাদের কলা কৌশল দ্বারা বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেবে তাঁর আব্বাজানের কাছ থেকে তা তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।
কিন্তু শাহজাদা খুররম তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারলেন না। তাঁর পৌঁছনোর আগেই ইংরেজ বনিকেরা সম্রাট জাহাঙ্গীরকে উপটৌকন দিয়ে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসার সুযোগ আাদায় করে নিয়েছে। শাহজাদা খুররম দাঁতে দাঁত চেপে এই অসহ্য আগমন মেনে নিতে বাধ্য হলেন
কিন্তু আর নয়, ইংরে জ বনিকদের এই চাতুরীকে তিনি কোনদিনই মেনে নেবেন না।
**
জাহাপনা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর পুত্র খুররম হয়েছে সম্রাট শাহজাহান। তাঁর আমলে সবাই সুখে- শান্তিতে বসবাস করছে। রাস্তা ঘাট নির্মান ও শিল্পকলায় হয়েছে প্রভূত উন্নতি। কিন্তু বেশিদিন এই সুখ তার কপালে সইল না। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা, তাঁর বিদুষী ও রূপসী কন্যা জাহানারা একদা তাঁরই হারেম পরিদর্শন করতে এসে অকস্মাৎ মোমবাতির আলোতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পড়লেন। শোকে দুঃখে সম্রাটের অবস্থা পাগলের মত- তিনি তাঁর প্রিয় কন্যাকে বাঁচাতে পারবেন তো? মসজিদে গিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করলেন।
কন্যা জাহানারা অপূর্ব সুন্দরী কিন্তু অবিবাহিতা। কন্যার বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ কিন্তু মুঘলদের মধ্যে ছিলনা। মুঘল কন্যাদের অবিবাহিত হয়ে আজীবন থাকতে হত। কনিষ্ঠা কন্যা রোশনারাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। মুঘলদের ধারণা ছিল তারা বিশ্ব শ্রেষ্ঠ সম্রাট, কাজেই তাঁদের থেকে কোন উচ্চ ঘরানার কোন পুরুষ না থাকায় তাঁরা নিজ কন্যাদের অবিবাহিত করে রাখতেন।
তাঁরা বলতেন দিল্লীশ্বর বা জগদীশ্বর। অন্যদিকে পুরুষদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা একাধিক বিয়ে করতেন এবং তার চেয়েও বড় কতা তাঁদের হারেমে থাকত শত শত মহিলা, এই সংখ্যাটা কোন সময়েই এক হাজারের কম ছিলনা। দেশের যেখানে সুন্দরী মহিলা দেখতেন তাদেরকে জোরপূর্বক ধরে এনে হারেমে ভরে দিতেন।
কন্যা জাহানারা একদিন হারেম পরিদর্শন করতে এসে মোমবাতির আগুনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরের অনেকাংশ পুড়ে যায়। সম্রাট শাহজাহান ব্যাকুল হয়ে পড়েন, কিভাবে কন্যাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তুলবেন। ফলে সমস্ত রাজ্যে ফতোয়া জারি করলেন- হাকিম বৈদ্যদের কাছে আবেদন রাখলেন কন্যাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। বিনিময়ে হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। উপযুক্ত দেশীয় পাওয়া না গেলে তিনি পারস্য ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে আবেদন করলেন চিকিৎসকদের কাছেও আবেদন করলেন। অনেকেই এলেন চিকিৎসার জন্য কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে এলো।
এই সময় সম্রাটের কাছে খবর এল যে সুরাটে বসবাসকারী ইংরেজদের মধ্যে কিছু ভালো ভালো, চিকৎসক আছেন, সম্রাট তাঁদের খবর পাঠালেন। ঘোষণা করলেন শাহাজাদীকে সুস্থ করতে পারলে তিনি রাজ্যের কিছু অংশ চিকিৎসককে দান করবেন। ফলে সুরাট থেকে এলেন ড: গ্যাব্রিয়েল বাউটন। বাউটন আগ্রায় এসে ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তে তাদের ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসার কথা বললেন। ভারতীয় পদ্ধতিতে তৎকালীন রোগীনিকে দেখার কোন উপায় চিকিৎসকের ছিলনা। দেওয়াল ছিদ্র করে এক প্রান্তে চিকিৎসক আর অন্য প্রান্তে রোগীনি দন্ডায়মান থাকতেন। সেই ছিদ্রের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চিকিৎসক তাঁর রোগীনির হাতের নাড়ি দেখতেন মাত্র। বিড়ম্বিত শাহজাহান আর অন্য কোন উপায় নেই দেখে জাহানারাকে চিকিৎসকের সামনে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন।
এরপর শুরু হল ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতি। এখানে রোগীনি ও চিকিৎসক সামনা সামনি। চিকিৎসক নিজে হাতে রোগীনির ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রথম প্রথম মোঘল সম্রাটদের রক্তের আভিজাত্য রেখে জাহানারা গম্ভীর রূপ ধারণ করতেন। আবার কোন কোন সময় চিকিৎসকের উপর বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। কিন্তু দীর্ঘ ছয়মাস চিকিৎসার পর জাহানারার মুঘল আভিজাত্য বিলুপ্ত হয়ে পড়লো। দুজনে তখন হয়ে উঠলেন সুখী ও হাস্য কৌতুকে পরিপূর্ণ নায়ক নায়িকার মত। সুস্থ শাহজাদীর রূপ লাবন্য এর ফলে শতগুণ বৃদ্ধি পেল।

দেওয়ানি আম এ শুরু হল উৎসব অনুষ্ঠান। অনন্য যাম জলসায় ছেয়ে গেছে সম্রাটের দরবার। উপস্থিত হলেন চিকিৎসক বাউটন সাহেব। মহিলারা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট অন্তরালে চিকের মধ্য থেকে সব কিছু লক্ষ্য করে চললেন। শাহজাদী জাহানারা তাঁদের মধ্যমণি। তিনি আজ আনন্দমুখর। নির্নিমেষ চোখে দেখে যাচ্ছেন বাউটন সাহেবের মুখমণ্ডল।
সম্রাট শাহজাহান বাউটন সাহেবের কাছ থেকে তার মনোনীত পুরষ্কারের কথা জানতে চাইলেন। দরাজ সম্রাট এক্ষণে বাউটন সাহেবকে রাজ্যের কিছু অংশ দিতেও প্রস্তুত। নতজানু হয়ে বাউটন সাহেব তার পুরষ্কারের কথা বলতে চাইলে আনন্দে বিহ্বল জাহানারার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে এক্ষণে সাহেব তাঁকেই সম্রাটের কাছ থেকে চেয়ে নেবেন। নতজানু হয়ে বাউটন প্রার্থনা করলেন, সম্রাট যদি আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে আমার প্রার্থনা যেন বঙ্গদেশে ব্যবসা করার অধিকার সম্রাট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদান করেন।
সম্রাট বললেন, — ‘তথাস্তু’।
অন্তরাল বর্তিনী জাহানারা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন।

2 thoughts on “ইতিহাসের গল্পঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

  1. ভাল লাগল ঐতিহাসিক এই গল্পটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *