গল্পঃ খোঁজ – দেবাংশু সরকার

পাঁচ বছর পর লন্ডন থেকে ফিরছে গৌরব। ব্যাঙ্গালুরু থেকে এম বি এ করার পর স্বদেশ বাবু তার একমাত্র ছেলে গৌরবকে লন্ডনে পাঠান বিজনেস ম্যানেজমেন্টের হায়ার স্টাডির জন্য। কেবল নিছক একটা ডিগ্রি বা বিলেত ফেরত তকমা পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। স্বদেশ বাবু চান আধুনিক বাণিজ্যের খুঁটিনাটি দিকগুলো যেন তার ছেলের নখদর্পনে থাকে। না হলে বাণিজ্যের এই বিশাল সাম্রাজ্য সে সামলাবে কি করে?

স্বদেশ বাবুর বাবা বিভুতি ধর প্রায় সত্তর বছর আগে একটা তেল কল খুলেছিলেন, ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। সর্ষে পিসে তেল বের করে, সেই তেল বাজারজাত করাই ছিল বিভুতি বাবুর ব্যবসা। তিনি নিজেই তেল কলে সর্ষে পিসতেন। নিজেই সেই তেল মহাজনের গোডাউনে পৌঁছে দিতেন। তেলের ব্যবসা করে কিছু টাকা হাতে আসায়, একটা ধান ভাঙ্গার মেশিন কেনেন বিভুতি বাবু। এভাবেই শুরু হয় ‘ধর অ্যান্ড সন্স’ এর ব্যবসা। তারপর স্বদেশ বাবু এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন তাদের পারিবারিক ব্যবসাকে। সত্তর বছর আগে যে চারা গাছটার জন্ম হয়েছিল, বর্তমানে সেই চারা গাছ মহীরূহে পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন প্ল্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান্ট থেকে আই টি সেক্টর সব ক্ষেত্রেই ‘ধর অ্যান্ড সন্স’ এক বিশেষ জায়গা অধিকার করেছে।

স্বদেশ বাবুর ইচ্ছা দেশে ফিরে গৌরব যেন তাদের দিল্লীর উপকন্ঠে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান্টের দায়িত্ব নেয়। সেই সঙ্গে তার বাস্তব অভিজ্ঞতাও বাড়ায়। কারণ যতই ডিগ্রি অর্জন করুক, পুঁথিগত বিদ্যাই শেষ কথা নয়, ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ।

গৌরব দেশে ফিরতেই তার পুরানো বন্ধু বান্ধবদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে তার বাড়িতে। গত পাঁচ বছরে কারও সাথে দেখা হয়নি, সেভাবে কথাও হয়নি। তাই গৌরবও এতদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার জন্য। পুরানো বন্ধুদের হাত ধরে অনেক নতুন বন্ধুও আসতে থাকে গৌরবের সংস্পর্ষে। কোটিপতি বাবার একমাত্র সন্তান। তার বন্ধু বান্ধবীর সংখ্যা একটু বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কেবল বন্ধু নয় বান্ধবীর সংখ্যাও বাড়ছে দিনে দিনে।

আগামী এপ্রিল মাস থেকে গৌরব কাজে যোগ দেবে। এখন শীতকাল, অর্থাত আগামী কয়েক মাস গৌরবের হাতে অফুরন্ত সময়। গল্প, আড্ডা, পার্টি নিয়েই তার দিন কাটছে। এরপর কাজে ঢুকে গেলে, গল্প আড্ডাতো দুরের কথা, নাওয়া খাওয়ার সময় বের করাই তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাবে। সেইজন্য স্বদেশ বাবু ছেলেকে একটু স্বাধীনতা দিচ্ছেন। জীবনটাকে উপভোগ করে নিতে দিচ্ছেন। এক্ষুনি তাকে কড়া ডিসিপ্লিনের বাঁধনে বাঁধতে চাইছেন না। গৌরবের মা অবশ্য চাইছেন দিল্লী যাওয়ার আগে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে। তিনি বুঝতে পেরেছেন ছেলে পাঁচ বছর বিদেশে থাকার ফলে একটু আধটু গলায় ঢালতে শিখেছে। কিন্তু এখন আর কিছু বলা যাবে না। পাঁচ বছরের অভ্যাস রাতারাতি ছাড়ানো যাবে না। বলে বুঝিয়ে আজে বাজে নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কথা শুনলে ভালো। আর না শুনলে কিছু করার নেই, মেনে নিতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর নেশা করে বাড়াবাড়ি করলেও মেনে নিতে হবে। মদ খাওয়া অবধি ঠিক আছে। কিন্তু তারপর যদি আরও খারাপ কোনও কিছুতে আসক্ত হয় বা খারাপ কারও পাল্লায় পড়ে, তাহলেতো বড় কোনও বিপদ গৌরবের জীবনে নেমে আসতে পারে। এরমধ্যে গৌরবের বন্ধু বান্ধবীর সংখ্যাও অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে গেছে। সবকিছুতেই এবার একটা লাগাম দেওয়া দরকার। ঘরের বৌ এলে হয়ত ছেলের উড়ে বেড়ানোটা কমবে। হয়ত গৌরবের মন ঘরবসা, সংসারী হবে। সেইজন্য তিনি স্বদেশ বাবুকে বলেন ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা। স্বদেশ বাবুও রাজি হন। পাত্রী দেখতে বলেন।

বাবা মা মেয়ে দেখা শুরু করলেও গৌরবের সে সব দিকে নজর নেই। সে মেতে রয়েছে তার বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে। বন্ধু বান্ধবীদের জন্য সে দুহাতে টাকা ওড়াচ্ছে। জয়, রিকি, সানি, দিয়া, সনিয়া, রাখীদের নিয়ে সে দিনরাত হৈ হুল্লোড় করে চলেছে। কোনও কোনও দিন গাড়ি চালিয়ে লং ড্রাইভে যায়। কখনো সঙ্গী হয় দিয়া, কখনো সনিয়া, কখনো আবার রাখী। রাতের পার্টিতে জয়, রিকি, সানিরা তার প্রতি রাতের সঙ্গী। দিয়া, সনিয়ারাও মাঝে মাঝে রাতের পার্টিতে গৌরবের কোমর জড়িয়ে ধরে উদ্দাম নাচে মেতে ওঠে। উজ্জ্বল নিয়ন আলো, নেশাতুর অর্ধনিমীলত চোখ, আবেদনময় গান, রঙিন পানীয় আরও রঙিন করে তোলে রাতগুলোকে।

  • “দিয়া কাল কি করছো?”
  • “সেরকম কোনও প্রোগ্রাম নেই।”
  • “আমারও কোনও প্রোগ্রাম নেই। চলো কোথাও ঘুরে আসি।”
  • “কোথায় যাবে?”
  • “সে কাল সকালে ভাবব। বলো যাবে?”
  • “তুমি ডাকলে আমি না বলতে পারি?”
  • “ওকে রেডি থেকো। তোমাকে তোমাদের বাড়ি থেকে তুলে নেব। গুড নাইট। “

পরের দিন সকালেই গৌরব গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দিয়াকে তার বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে, গাড়ি ছুটিয়ে দেয় দক্ষিণের দিকে। গন্তব্য বকখালি। রাস্তায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাওয়া, কেনাকাটা, হাসি, গল্প, কিছুটা কাছে আসা, কিছুটা কাছে পাওয়া, কিছুটা ঘনিষ্ঠতা, দুটো শরীরের পেলব স্পর্শ। দিয়া শরীরের ছোঁয়া দিয়ে কাছে টানতে চায় গৌরবকে। কামাতুর পুরুষকে বস করার এই আদিম কৌশল যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে চলেছে কিছু স্বার্থান্বেষী নারী।

  • “দেখো গৌরব, জুয়েলারি দোকানটাতে কি ভিড়। সত্যিই মানুষের গয়নাগাটির প্রতি আকর্ষণ কোনও দিন কমবে না!”

দিয়ার কথা শুনে গাড়ি থামিয়ে দেয় গৌরব। দুজনে গিয়ে ঢোকে জুয়েলারির দোকানে। কিছু স্বর্ণালঙ্কার কেনে গৌরব। উপহার দেয় দিয়াকে। দু একবার ‘না’ ‘না’ করলেও, দামী গয়নার বাক্সটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। তারপর গৌরবের হাত ধরে। গৌরবও দিয়ার কোমরে হাত রাখে। প্রায় গৌরবের কণ্ঠলগ্না হয়ে দিয়া বেরিয়ে আসে দোকান থেকে। ওঠে গাড়িতে। গৌরবকে জোরে গাড়ি চালাতে বলে। এবার তার ফেরার তাড়া। কারণ যে জন্য সে এতটা সময় দিল গৌরবকে, সেই কাজটা হয়ে গেছে।

সন্ধ্যার কিছু পরেই কলকাতায় পৌঁছে যায় তারা। দিয়াকে ড্রপ করে দেয় তার বাড়িতে।

  • “আজ আর কোনও ক্লাবে প্রোগ্রাম আছে?”
  • “না দিয়া, এই জার্নিতেই ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার বাড়ি গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেব। কাল অন্য কাজে ব্যস্ত থাকব। আবার দেখা হবে উইক এন্ড পার্টিতে। গুড নাইট।”

বিদায় নেয় গৌরব। দিয়া নিজের মনে ভাবতে থাকে – কাল তুমি কোন কাজে ব্যস্ত থাকবে আমি ভালোই জানি। সনিয়া নয়ত রাখীর সঙ্গে সারাদিন আড্ডা মারবে। বাপের অগাধ আছে, তার কিছু খসাবে। ঠিক আছে আমার কোনও আপত্তি নেই। আজ যা হাতিয়েছি, এক সপ্তাহ তোমাকে রিলিফ দিলাম। উইক এন্ড পার্টিতে গা ঘষাঘষি করে পরের সপ্তাহে আবার কিছু আদায় করব। এই ক’দিন যত খুশি সনিয়া আর রাখীকে চুমু খাও। ইচ্ছা হলে ওদের সঙ্গে শুয়েও পড়তে পারো। আমার কোনও আপত্তি নেই।

সত্যিই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল গৌরব। পরের দিন বেশ বেলাতে ঘুম ভাঙে। একটু ফ্রেশ হয়ে সে ফোন করে সনিয়াকে।

  • “হ্যালো সনিয়া, কোথায় আছো? কি করছ?”
  • “একটা দরকারে নিউ টাউনে এসেছি। কেন, কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
  • “না না, তেমন কিছু নয়। ঘরে বসে বোর হচ্ছি। তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু আড্ডা মারব। কখন ফিরবে?”
  • “এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরছি। তারপর তোমার বাড়ি যাব।”

না, এক ঘন্টা লাগেনি। আধ ঘন্টার মধ্যেই সনিয়া হাজির হয় গৌরবের বাড়িতে। গৌরব কিছুক্ষণের জন্য বাড়ির বাইরে গিয়েছিল। সনিয়া গৌরবের মায়ের সাথে ‘আন্টি’ ‘আন্টি’ করে গল্প জুড়ে দেয়। গৌরবের মায়েরও বেশ ভালো লাগে সনিয়াকে। অনেক কিছু কল্পনা করতে থাকেন। অবশ্য দিয়া বা রাখীকেও খারাপ লাগে না। তবে সনিয়াকে যেন একটু বেশি ভালো লাগে। ভাবেন সনিয়াকে যদি পুত্রবধু করা যায় তাহলে ভালো হয়। সনিয়ার পরিবার সম্বন্ধে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করে জানতে থাকেন।

বাড়ি ফিরে গৌরব আবার বেরিয়ে পড়ে সনিয়াকে নিয়ে।

  • “কোথায় গিয়েছিলে সকাল বেলায়?”
  • “নিউ টাউনের দিকে একটা ফ্ল্যাট দেখতে। একটু বড় ফ্ল্যাট না হলে চলছে না। দাদার মেয়েটা বড় হচ্ছে। বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। একটু খোলামেলা জায়গা হলে বাবার পক্ষে ভালো হয়।”
  • “কেমন ফ্ল্যাট দেখলে, পছন্দ হল?”
  • “ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে। তবে দামটা বেশি। পুরানো ফ্ল্যাট বিক্রি করে অত টাকা হবে না। কিছুটা লোন নিতে হবে। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিলে আবার অনেক টাকা সুদ গুনতে হবে। ব্যাপারটা আমাদের চিন্তায় রেখেছে।”
  • “কত টাকা এক্সট্রা লাগবে?”
  • “প্রায় পনেরো লাখ। গৌরব তোমার চেনাশোনা কোনও মানি লেন্ডার আছে, যে একটু কম সুদে ধার দেবে?”
  • “পনেরো লাখ। ঠিক আছে চিন্তা করো না। কবে লাগবে?”
  • “সামনের মাসে হলে ভালো হয়। আমাদের ফ্ল্যাটটা বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পনেরো লাখ টাকা ধার হিসেবে পেলে, সামনের মাসেই শিফট করব।”
  • “সামনের মাস। মানে ফেব্রুয়ারি মাস। ডোন্ট ওরি ম্যাম, কারও থেকে ধার নিতে হবে না। ঐ টাকা আমি তোমাকে দেব অ্যাজ ভ্যালেন্টাইন গিফট।”
  • “এই না না। গৌরব এরকম করতে নেই। অতগুলো টাকা!”
  • “আই লাভ ইউ সনিয়া। টাকা দিয়ে ভালোবাসার হিসেব করতে যেও না প্লিজ।”

সনিয়াকে নিয়ে বের হতে হতে বেলা হয়ে গেছে। তাই গৌরব আজ বেশি দুরে যায়নি। জানুয়ারি মাসের বিকেল। গঙ্গার ধারটা মনোরম। আসে পাশে অনেক কাফে রেস্টুরেন্ট আছে। সময় কাটানোর পক্ষে একেবারে আদর্শ জায়গা। সনিয়াকে নিয়ে একটা কাফেতে ঢোকে গৌরব।

  • “তুমি দিল্লী কবে যাবে গৌরব?”
  • “কামিং এপ্রিলে গিয়ে চার্জ বুঝে নেব। তারপর ওখানেই থাকতে হবে। ঘনঘন কলকাতায় আসার সুযোগ হবে না। একা থাকতে হবে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে? যদি রাজি থাকো, তাহলে ব্যবস্থা করতে পারি।”
  • “আমি কিভাবে যাব?”
  • “বাবাকে বলে আমাদের প্ল্যান্টে তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। এরমধ্যে অফার লেটার তৈরি করে নেব।”

সনিয়া ভাবতে থাকে কি বলবে। সরাসরি না বলাটা এই মুহূর্তে মুশকিল। কারণ সামনেই পনেরো লাখ টাকা হাতানোর একটা সুযোগ এসেছে। সরাসরি না বললে গৌরব অসন্তুষ্ট হতে পারে। টাকাটা পাওয়ার পর কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। একটু ভেবে রাজি হয় সনিয়া।

ফেব্রুয়ারি মাসে কেনা হয় সনিয়াদের ফ্ল্যাট। ধুমধাম করে গৃহ প্রবেশ হয়। নতুন ফ্ল্যাট, নতুন পরিবেশ, কিন্তু একই উদ্দামতা। সেখানেও মধ্যমণি গৌরব। চটুল মিউজিকের তালে নাচছে গৌরব। নাচছে তার সঙ্গিনীরা। দিয়া, রাখীও এসেছে সেই গৃহ প্রবেশের পার্টিতে। তিনজনের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে, কে গৌরবের বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পারে। কে তার কোমর জড়িয়ে বেশিক্ষণ নাচতে পারে।

হঠাত গৌরবের মাথা ঘুরে ওঠে। অসুস্থ বোধ করতে থাকে। একটা সোফায় বসে পড়ে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। তখনই কে যেন বলে ওঠে – গৌরব এরা তোমাকে ঘিরে নাচছে না। এরা তোমার টাকাকে ঘিরে নাচছে। এদের কাছে তুমি কেউ নও, তুমি কিছু নও। যতক্ষণ তোমার টাকা আছে, ততক্ষণ তুমি মূল্যবান। তোমার কদর আছে এদের কাছে। যেদিন তোমার টাকা থাকবে না বা তুমি এদের জন্য টাকা খরচ করবে না, সেদিন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে এদের এক মিনিটও লাগবে না। চোখ খোলো গৌরব। চোখ খুলে দেখো। বোঝার চেষ্টা করো এরা কেউ তোমার প্রকৃত শুভাকাঙ্খী, প্রকৃত সুহৃদ নয়।

অতিরিক্ত মদ্যপান, লেট নাইটের ধকলের ফলে ইদানিং গৌরবের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মাথা ধরছে। শরীর জুড়ে একটা আড়ষ্টভাব। মার্চ মাসের মাঝামাঝি। হাতে বেশি সময় নেই। এবার দিল্লী যাওয়ার তোড়জোড় করতে হবে। গৌরবকে একাই দিল্লী যেতে হবে। সনিয়া জানিয়ে দিয়েছে এই মুহূর্তে সে কোথাও যেতে পারবে না। কারণ তার বাবার শরীর খারাপ।

দুর্বল শরীর নিয়ে সারাদিন ঘরে থাকে গৌরব। মার্চ মাস পড়ার পর থেকেই দিয়া, সনিয়ারা গৌরবের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখে না। গৌরবেরও এখন অত এনার্জি নেই ওদের সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু সারাদিন ঘরে বসে থাকতে কার ভালো লাগে! গৌরব বেরিয়ে পড়ে। আজ সে গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। গাড়ি চালানোর মত এনার্জি তার নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দুরে চলে যায় সে। কিছুটা হাঁটার পর সে বুঝতে পারে, দুর্বল শরীরে এতটা দুর হেঁটে আসা তার ঠিক হয়নি। এর মধ্যেই বেশ গরম পড়ে গেছে। মার্চ মাসেই লু বইতে শুরু করেছে। সারাক্ষণ এসিতে থাকা গৌরবের পক্ষে রাস্তার এই গরম যেন প্রাণান্তকর হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরতে গৌরব নিজেকে নার্সিংহোমের বেডে আবিস্কার করে। রক্তচাপ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। রাস্তাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। লোকজনেরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক নার্সিংহোমে ভর্তি করে। বাড়িতেও খবর পাঠানো হয়। দৌড়ে আসেন গৌরবের বাবা মা এবং অন্যান্যরা। ডাক্তার বাবু অবশ্য আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে ভয়ের কিছু নেই। তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। আপাতত কিছুদিন নার্সিংহোমে থাকতে হবে। গৌরবের বাবা ডাক্তার বাবুর সঙ্গে কথা বলে গৌরবের জন্য স্পেশাল কেবিনের ব্যবস্থা করেন। সঙ্গে অ্যাটেন্ডিং নার্সের ব্যবস্থা করা হয়। ডাক্তার বাবু অদিতিকে গৌরবের দেখাশোনার বিশেষ দায়িত্ব দেন।
অদিতি সেন একজন কমবয়সী ট্রেন্ড নার্স। দু বছর হল এই নার্সিংহোমে চাকরি করছে। নিজের কাজের প্রতি, নিজের দায়িত্বের প্রতি সে সম্পুর্ণ সচেতন। একজন কেয়ারিং নার্স হিসেবে তার সুনাম আছে। সেবা, যত্ন, মিষ্টি হাসি, মিষ্টি ব্যবহারের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে অদিতির জুড়ি মেলা ভার। গরীব ঘরের মেয়ে অদিতি, কাজের ক্ষেত্রে তার মমত্বের সঙ্গে তার পেশাদারীত্বকে সঠিক মাত্রায় মিশিয়ে দিতে পারে। রোগীদের দিক থেকে তার প্রতি কোনও অভিযোগ থাকে না। বরং প্রশংসাই পায় সে সব ক্ষেত্রে। তেমনি কখনই সে তার পেশাদারীত্বকে বিসর্জন দেয় না। নিজেকে অন্যের কাছে সস্তা করে তোলে না। প্রশংসা আর আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই সে রোগীদের থেকে গ্রহন করে না। এ ব্যাপারে তার মেরুদন্ড বরাবর সোজা এবং শক্ত থাকে।

ডাক্তার বাবুর চিকিৎসায় এবং সিস্টার অদিতির যত্নে, সেবায় কিছুদিনের মধ্যেই সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে গৌরব। এবার বাড়ি ফেরার পালা। নার্সিংহোম ছাড়ার আগে গৌরব দশ হাজার টাকা দিতে যায় অদিতিকে। নার্সিংহোমের নার্স বা অন্যান্য কর্মীদের সুস্থ হওয়ার পর রোগীরা টাকা দেয়। এটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু অদিতি সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করে। সে বলে, “আমিতো কাজের জন্য একটা স্যালারি পাই স্যার। এভাবে আমি কারও থেকে টাকা নিই না।”

  • “এটাকে টাকা বলবেন না সিস্টার। এটা আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার। আপনি নিলে আমি খুশি হব।”
  • “কিন্তু আমি যে দুঃখ পাব স্যার।”
  • “কেন? দুঃখ পাবেন কেন?”
  • “কারণ এভাবে টাকা নিলে আমি যে পরিশ্রম করে উপার্জন করার, খেটে খাওয়ার আনন্দটা আর উপভোগ করতে পারব না। আপনি স্যার এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আবার আপনার পুরানো জীবনে ফিরে যান। জীবনটাকে উপভোগ করুন। জীবন যে বড় মূল্যবান স্যার।”
  • “ঠিক বলেছেন। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। শরীর, মন সব দিক দিয়ে সুস্থ। আজ অনুভব করলাম জীবন বড় মূল্যবান। তার থেকেও মূল্যবান জীবনের সুক্ষ অনুভুতিগুলো। টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না। আমিও জীবনকে উপভোগ করব। তবে পুরানো জীবনে কতটা ফিরতে পারব জানিনা। যে হীরের খোঁজ পেলাম, সেই হীরেকে ছেড়ে আর কাচের পেছনে ছুটব না।”

সব সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সকলকে খুশি করতে পারে না। গৌরবের বিয়ের সিদ্ধান্তে অনেকেই অখুশি। এক কোটিপতি ঘরের ছেলে শেষ পর্যন্ত এক দুটাকার নার্সকে…!

ফুলসজ্জার রাত। গৌরব দরজা বন্ধ করতেই অদিতি বলে ওঠে, “এটা কি ঠিক করলে গৌরব? তোমার আশেপাশে কত উর্বশী, রম্ভা ঘুরে বেড়ায়। তাদের রূপের ছটায় হীরকদ্যুতিকেও ম্লান মনে হয়। তাদের ছেড়ে একটা কাল পেত্নি, দুটাকার নার্সকে বিয়ে করলে! এটা কি ঠিক হল?”

  • “তোমার মনে বিয়ের কোন ডেফিনেশন আছে জানিনা অদিতি। তবে আমি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে একজন মানুষকে খুঁজেছিলাম। পরিপূর্ণ মানুষ। পেয়ে গেছি। আমার কোনও সেক্স ডলের প্রয়োজন নেই। “

One thought on “গল্পঃ খোঁজ – দেবাংশু সরকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *