কবিতা কি – গদ্য
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
আমরা হয়তো অনুভব করতে পারি কবিতাকে। সে যাই হোক, অনুভব করাটাকে ‘হয়তো’ কেন বললাম ? কারণ সবসময় যে কবিতার শব্দগুলো যা কোন এক কবিতা লেখকের অনুভুতি প্রসূত তা এতোটাই বিমূর্ত যে আমরা তাকে উপলব্ধি করতে নাও পারি। ফলত কবিতা বিমূর্ত হওয়ার কারণেই আমরা জানি, হয়তোবা অনুভব করতে পারি কিন্তু তাকে সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না, যা মনকে তৃপ্তি দেয়। আর এই কথা শুধু কবিতা নয় যে কোন ফাইন আর্টের ক্ষেত্রেও ঠিক ততটাই সত্য, যেমনটা বলা যায়, প্রেম বা বিদ্যুৎ এর বিষয়ে। আমেরিকান কবিতা লেখক এমিলি ডিকিনসন, যদিও কবিতার সংজ্ঞা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, একবার একটি চিঠিতে গোপনে বলেছিলেন, “If I feel physically as if the top of my head were taken off, I know that is poetry.” একজন সুপরিচিত ব্রিটিশ কবিতা লেখক, A.E. Houseman, একই রকম প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কবিতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, সকালে দাড়ি কামানোর সময় তাকে তার চিন্তাভাবনার উপর কড়া নজর রাখতে হত, কারণ যদি কবিতার একটি লাইন তার স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করত তাহলে তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটি কাঁপুনি নেমে যেত এবং তার ত্বক এমনভাবে ঝাঁকুনি দিত যে তার রেজারটা গালে বসে গিয়ে গাল কেটে দিত। তাহলে কবিতা, এই বিষয়টা বা জিনিসটি কী এমন যা মুষ্টিমেয় কিছুব্যক্তিকে শারীরিকভাবে এতোখানি প্রভাবিত করতে পারে!
একজন কবিতা লেখক একটি কবিতাকে “a thought, caught in the act of dawning” বলে অভিহিত করেছিলেন। অন্য একজন বলেছিলেন যে একটি কবিতা হলো ঘাসের বাতাস ঘরের মধ্যে আনার একটি মাধ্যম। আবার অন্য একজন আরও রহস্য করে কবিতা কী এই নিয়ে বলেছিলেন যে, “Poetry is pheasant disappearing in the brush” কথা গুলো এমন ভাবে বলা হয়েছে লক্ষ্য করুন একেবারে যেন কোন কবিতায় কথা বলা যেমন ঠিক কবিতা লেখকদের মতো করে হয় তেমনই কাব্যিকভাবে। প্রায়শই মনে হয় কবিতা লেখকরা তাঁদের লেখাকে একটু জটিল করে বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সহজ সরল ভাবে বলার থেকে। কিন্তু কবিতা লেখকরা, যারা সকল অর্থে কবিতাটা লেখেন তাঁরা প্রত্যেকেই যে কাজটা করেন সেটা হল, কবিতাকে তাঁরা বুনে তুলতে কোথাও যেন একটা বলা আর না বলার খেলা খেলেন, আর এই ‘খেলা’ যাকে আমি বলি প্রকাশ আর না-প্রকাশ। আর এই প্রবণতা মগ্ন পাঠককে একটি ভালো অভিধান কিনতে বাধ্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস, যেখানে তথ্যগুলো থাকে। আর এই অভিধান বা কবিতার ক্লাস বা গাইড গুলোর সমস্যা হল, বেশিরভাগ অভিধানে কবিতার সংজ্ঞা এতটাই শুষ্ক, সীমাবদ্ধ, অস্পষ্ট, অথবা অন্যথায় অসন্তোষজনক যে, তারা অবশেষে শ্রোতা ও পাঠককে সেই অধরা, সুন্দর প্রজাপতির জন্য ঝোপঝাড় মারতে বাধ্য করবে। কবিতার সাধারণ উপাদানগুলি বর্ণনা করা সম্ভব এবং অন্তত এই প্রাচীন, নব্য শিল্পরূপের শক্তি, পরিসর এবং জাদু নির্দেশ করা সম্ভব, একমাত্র যার যার নিজ আভ্যন্তরীণ অনুভূতির দৌলতে। সাহিত্যের অন্যান্য রূপের মতো, কবিতাও গল্প বলতে, নাটকে অভিনয় করতে, ধারণা প্রকাশ করতে, প্রাণবন্ত, অনন্য বর্ণনা দিতে বা আমাদের অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক, আবেগগত বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা প্রকাশ করতে পারে। তবুও, কবিতা বিশেষভাবে শব্দের প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। কবিতার শব্দ, গঠন, ধরণ এবং অর্থ সেই ভাষার অন্তর্নিহিত ভাষার মৌলিক সুর ও ছন্দবদ্ধ একটা প্রবাহ যা মনকে আনন্দ দেয়।
আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি বা শুনি, তখন আমরা কিছু নির্দিষ্ট ধরণ চিনতে পারি, যেমন একটি নিয়মিত তাল, একটি ক্রমবর্ধমান ছন্দ, বা ছন্দের একটি সিরিজ। যখন আমরা একটি পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি কবিতা দেখি, তখন আমরা অন্য ধরণের ধরণ লক্ষ্য করতে পারি যা আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে আমরা আদর্শ গদ্যের দিকে তাকাচ্ছি না। ডান হাতের সেই ছিন্নভিন্ন প্রান্ত, যা নির্দেশ করে যে লাইনগুলি সেখানেই থামবে এবং অন্য কোথাও নয়। আমরা একটি কবিতা যখন আবৃতি করি বা কবিতা পড়তে শুনি বা একটি মুদ্রিত পৃষ্ঠায় কবিতা পড়ি, এটি স্পষ্ট হওয়া উচিত যে আমরা সাধারণ বক্তৃতা বা গদ্য লেখা থেকে কবিতার আলাদা ভাষা এবং একটি বিশেষ প্যাটার্নযুক্ত শব্দবন্ধের বিন্যাসের সঙ্গে যাপন করি বা যাপন করার চেষ্টা করি।
কবিতা হল নিয়ম মাফিক মাত্রা অনুযায়ী শব্দবন্ধের কাব্যিক রচনা, তা সে ছন্দময় হোক বা না হোক। যদি অছন্দময় হয়, তবে এটিকে ফাঁকা কবিতা বলা হয়, যেমন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট বা শেক্সপিয়ারের নাটকীয় কবিতা। এর ব্যতিক্রম হল মুক্ত কবিতা , যা ছন্দময় নিয়মধারাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে লেখা কবিতা । আমেরিকান কবিতা লেখক ওয়াল্ট হুইটম্যানের দীর্ঘ, ঘূর্ণায়মান, পুনরাবৃত্তিমূলক পংক্তি এবং পবিত্র বাইবেলে পাওয়া আবেগঘন হিব্রু গীতসংহিতা মুক্ত পদ্যের সুপরিচিত প্রাচীন উদাহরণ। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে মুক্ত কবিতা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ওই সময় কবিতা লেখক স্ট্যানলি কুনিৎজ যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন যার ফলে তার মনে “swept in the field” যা উনি সে সময়ের কবিতার বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে এমনি একটা মনোভাব বা বলা ভাল অনুভূতি যুক্ত মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। আজকের বেশিরভাগ কবিতা লেখক মুক্ত কবিতায় কাজ করতে পছন্দ করেন, যদিও এখনও অনেক কবিতা লেখক আছেন যারা আজও সূক্ষ্ম ছন্দে কাজ করছেন। কবিতা বলতে কী বোঝায় এটা পরিস্কার ভাবে বলতে গেলে এখন আরো জোর দিয়ে বলা উচিত যে “কবিতা” শব্দটি দ্বারা আমরা যা বোঝাতে চাই তা কবিতা নয়, কবিতা হল প্রকাশ ও সচেতন ভাবে না-প্রকাশের রসায়ন। সে আমরা যদি হাংরি লেখকদের দেখি, তাঁদের শব্দচয়নের রীতিই ছিল প্রকাশের মধ্যে না-প্রকাশের সদর্প উচ্চারণ তা সে ছন্দে হোক, ছন্দহীনতায় হোক, অনুসঙ্গ প্রাকৃতিক ও অতি-প্রাকৃতিক হোক যাই হোক, মাত্রা মেপে বা না মেপে এবং নিয়মিত লাইন দৈর্ঘ্যের মতো যন্ত্রগুলি কবিতার উপাদান যা কবিতা লেখকদের “কবিতা ” নামক ভাষার প্যাটার্নযুক্ত বিন্যাস তৈরিতে সহায়তা করে। তবু এর পরিপূরক হিসাবে, কল্পনা, আবেগ এবং ভাষার কিছু গুণাবলী যুক্ত করা আবশ্যক, অন্তত “কবিতা ” নামক এই ধরন বা আঙ্গিকে লেখার আগে।
একটি খুব পুরানো প্রবাদ আছে, “Art is long; life is short” কাব্যিক শিল্প দীর্ঘস্থায়ী শিল্পে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যখন এটি ভাষার প্যাটার্ন তৈরির জন্য ব্যবহৃত পদ্যের কৌশলগুলিকে কাজে লাগায়। একজন আমেরিকান কবিতা লেখক একবার বলেছিলেন যে একটি কবিতা হল “A poem is a time mechine” যা শব্দ দিয়ে তৈরি, যার মাধ্যমে অতীতের মানুষ আমাদের সাথে কথা বলতে পারে এবং আমরা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মানুষের সাথে কথা বলতে পারি। মৃত্যুকে পরাজিত করার এবং সময়ের ধ্বংস থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদ হল সমস্ত শিল্প সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আজ হোক কাল হোক, বেশিরভাগ কবিতা লেখকর মনেই আসে যে, আনন্দের সাথে তারা শতাব্দী ধরে বিস্তৃত একটি বিশাল, চলমান এবং বৈচিত্র্যময় কথোপকথনের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। প্রতিটি কবিতা লেখকর অন্তত এই আশা থাকে যে তার কাজ একটি পৃথক জীবনের সময়কাল ধরে বেঁচে থাকবে। কবিতা হল সেই শিল্প মাধ্যম যা গ্রিম রিপারের চোখে একটু বালি ঠেকানোর জন্য আমাদের যে কয়েকটি হাতিয়ার আছে তার মধ্যে একটি। লক্ষ্য করুন যে চিরন্তন খ্যাতির এই বিশেষ প্রচেষ্টায়, শেক্সপিয়ার তার জীবন্ত শব্দগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য একটি ছন্দবদ্ধ প্যাটার্ন (চতুর্দশপদী) আইম্বিক পেন্টামিটার দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলেন। ভাষা স্মরণীয়তা অর্জনের জন্য মাত্রাযুক্ত বিন্যাস বা প্যাটার্নযুক্ত বিন্যাস এবং কাব্যিক শিল্প যে অমরত্বের সন্ধান করে তা শেক্সপিয়ার সনেট প্রধান উদাহরণ আর যেমন এদেশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক বিশেষ প্যাটার্নকে (অমিত্রাক্ষর ছন্দ) পাথেয় করে তার অমোঘ সব সৃষ্টি রচনা করে গেছেন।
অবশ্যই, কবিতা লেখক যা কিছু দিয়েই বা থেকেই তার কবিতা সৃষ্টি করেন না, যেমন এই ধরে নেওয়া যাক পুরো কাপড়ের মণ্ড বানিয়ে একটি পৃথিবী তৈরি তিনি করেন না অবাস্তবিক ভাবে। ফলত আমারা এটা দেখতে পাই একজন কবিতা লেখক তাঁর রচনাগুলিতে, কোনও অর্থ থাকার জন্য, মানুষের জগত এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন বা তাই দিয়েই বুনে তোলেন। শুধুমাত্র কবিতা লেখক আবেগপূর্ণ অনুভব প্রকাশ করেন নিজের তৈরি দৃশ্যমান এক অদৃশ্য জগতের যা অদৃশ্যত প্রাকৃতিক অথচ দৃশ্যত অতি প্রাকৃতিক। আর সেইজন্যই হয়তো কবিতা লেখকের সৃষ্ট কবিতা তার সৃষ্টির উপহার সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, বরং তা অনেক অনেক বেশি ব্যপ্ত এবং স্বাধীনভাবে বিস্তৃত।
ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা লেখক স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ কল্পনার ক্ষমতাকে বোঝাতে আমাদের মনের সীমাবদ্ধতাকে এক অসীম ব্যপ্তির কল্পনাতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছেন এক “Infinite I Am” বলে প্রকাশ করে এবং ঈশ্বরের কল্পনার মধ্যেও যে এক অপরিমেয় সৃজনশীলতার পুনরাবৃত্তি আছে বলে মনে করিয়ে ছিলেন। কবিতা লেখকরা যদি এই ঐশ্বরিক সৃজনশীল গুণের মানবিক উদাহরণ হন, তাহলে দার্শনিক প্লেটোর এই উক্তিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, “A poet is a light and winged thing, and holy”। আর তাই কবিতা লেখক সর্বদা নির্দিষ্ট, স্পর্শকাতর বিবরণে মনোনিবেশ করেন, সংবেদনশীল চিত্রের সাথে তীব্র, যা সবই প্রাণবন্ত, নির্ভুল ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে আশ্চর্যজনকভাবে বাস্তবসম্মত প্রতিকৃতি আঁকেন। প্রাণবন্ত বিবরণ ব্যবহারের পাশাপাশি, কবিতা লেখকের সঙ্গতি, মিল এবং উপমা লক্ষ্য করার এবং তাজা এবং মৌলিক রূপক তৈরিতে এগুলি ব্যবহার করার ক্ষমতা মহান কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিহিত এবং এটি এর কল্পনাপ্রসূত ধারার অংশ। একথা মানতেই হবে যে কবিতা লেখকের লেখনীতে আঁকা বা গড়ে তোলা এই উপমা এবং রূপক প্রায়শই সংবেদনশীল আর সেই কারনেই রূপকের ভাষা মানুষের মনে ব্যাপকভাবে আবেদন তৈরি করে বলে মনে হয়।
আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে আমরা এই মুহূর্তে কেবল কবিতা লেখকের ঊর্ধ্বে উঠে পূর্ণাঙ্গ কবিতা লেখকের উচ্চতর স্তরে স্থানান্তরিত হয়েছি, যেখানে কল্পনা, দৃষ্টি এবং উদ্ভাবনের গুণাবলী স্পষ্টভাবে উজ্জ্বল হতে দেখা যায়। তবু আপনি যে কোন কবিতা লেখককে জিজ্ঞাসা করুন উনি কি এই মুহূর্ত পর্যন্ত, এখনও মহান কবিতার একটি চূড়ান্ত, গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্পর্শ করেছেন? উত্তর না কারণ এক অতৃপ্ত শুন্যতা তার মনকে গ্রাস করে, তাই তিনি প্রকৃত কবিতা লেখক তার সন্ধানে আরো এক কবিতা লেখক তার দিকে / সেই দৃশ্যের দিকে ছুটে যান।
স্মরণীয়তা, সঙ্গীত (music), কল্পনা এবং উদ্ভাবনের গুণাবলী ছাড়াও, আমরা আশা করি কবিতা লেখক আমাদের আবেগগত স্তরকে স্পর্শ করবে। একজন কবিতা লেখক কে তার থেকে আবেগকে সরিয়ে ফেলুন, দেখবেন আমাদের সামনে শুষ্ক, কাঠখোট্টার মতো এবং অকল্পনীয় হাস্যকর ও বর্ণনীয় কিছু একটা পড়ে আছে। “A poem begins with a lump in the throat, a homesickness or love-sickness” মহান কবিতা লেখক রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, “It is a reaching out toward expression; an effort to find fulfilment” আর মহান ইংরেজ কবিতা লেখক উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings; it takes its origin from emotion recollected in tranquillity”। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতে, লেখার তাগিদ একজন ব্যক্তির তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন করে তলে এবং তিনি ধীরে ধীরে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ডুবে যান। এটিই মানুষকে বলা ভালো একজন কবিতা লেখক কে তার নীরবতা ভেঙে উচ্চারণের দিকে যেতে অনুপ্রাণিত করে। আমরা যদি প্রবীর দাশগুপ্তর লেখা “পিন্তানিনা সান্তামারি” গ্রন্থটিকে পড়ি তাহলে দেখবো ওই গ্রন্থের কবিতাগুলো নীরবতা ভেঙে উচ্চারণের দিকে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন জাগে যে এই নীরবতা কিসের নীরবতা? এটা সেই নীরবতা যা একজন কবিতা লেখকের অনুভবের প্রকাশ যা ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে উচ্চারণ অর্থাৎ সেই না-প্রকাশের দিকে। এই প্রসঙ্গে যে কবিতাটিকে চর্বিত চর্বণের মতো আমি উল্লেখ করতে চাই তা হল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা জরাসন্ধ কবিতাটি। প্রতিটি লাইন সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কবিতাটাতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শব্দের প্রকাশের এমন একটা জাল বিস্তার করেছেন যার মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর না-প্রকাশ। কথাটা হচ্ছে দৃশ্যত শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে শক্তি যা বললেন তা কি আদৌ বললেন! নাকি অন্য কিছু বললেন ওই শব্দগুলোর বিন্যাসে যা বাস্তবিক অর্থে প্রকাশ হয়নি অথচ হয়েছে ভীষণ ভাবে এক অন্য মাত্রায়। এই না-প্রকাশ সূক্ষ্ম নান্দনিক অনুভবের আবেগ বিজড়িত যা বৌদ্ধিকভাবে বেশ পরিশীলিত। বিপরীতে, এটি সহজ এবং সরাসরি হতে পারে এবং এগুলি প্রায়শই সবচেয়ে শক্তিশালী ধরণের কবিতা লেখকদের দ্বারা রচিত। উদাহরণস্বরূপ, কবি উৎপল কুমার বসুর ‘আবার পুরী সিরিজ” এর কবিতা। এই কবিতায় লেখক তার প্রত্যেকটা লাইন এক একটা মূর্ত দৃশ্যকে অন্য এক বিমূর্ত দৃশ্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন। আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কবিতায় – “কখনো তোমার করে তোমাকে ভাবিনি” একই সঙ্গে মূর্ততা ও বিমূর্ততাকে আঁকলেন, একই সঙ্গে হৃদয়ের অন্তরস্থল হতে কথাগুলো প্রকাশ করলেন সেই সঙ্গে সৃষ্টি করলেন না-প্রকাশিত অনেক কথা। এই ধরণের লাইনগুলি হৃদয় থেকে আসে এবং যা পাঠক তথা অন্য হৃদয়কে স্পর্শ করে। আমি এখানে খুব সচেতন ভাবে “না প্রকাশ বা না-প্রকাশিত” লিখেছি অপ্রকাশ বা অপ্রকাশিত না লিখে, কারণ কবিতায় আমার কাছে বা আমার মতে “না-প্রকাশ” মানে, যে অনুভূতি অপ্রকাশিত আছে তবু কোথায় যেন প্রকাশিত। “কখনো তোমার করে তোমাকে ভাবিনি” র মধ্যে কোথায় যেন একটা ভাবার প্রকাশ আছে যাকে কবিতা লেখক ‘না’ বা ‘নি’ দিয়ে উহ্য রেখেছেন বা অপ্রকাশিত রেখেছেন বলে আমার মনে হয়েছে বারবার। তাই কবিতা আমার কাছে বরাবরই প্রকাশ আর না-প্রকাশের আলো আঁধারি বলে মনে হয়।
আমাদের আবেগময় সত্তার মূলের উপর একটি খাঁটি দাবি করে এমন কবিতা এবং আমাদের হৃদয়ের তারের উপর অকৃত্রিমভাবে বা অযৌক্তিকভাবে খেলতে চাওয়া কবিতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম রেখা রয়েছে। আবেগপূর্ণ ভাবে আচ্ছন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার সময়, কবিতা লেখক আবেগপ্রবণতায় ডুবে যাওয়া কে, পাঠকের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এবং “অর্জিত আবেগ” নামে পরিচিত জিনিসকে ব্যবহার করার মতো ঝুঁকির মুখোমুখি হন। যদিও এটা বাস্তব, যে আত্ম-করুণা প্রায়শই একটি অপ্রিয় মানবিক আবেগ হিসাবে বিবেচিত হয়। তবুও, যেহেতু এটি মানবিক এবং যেহেতু কোনও মানবিকতা কবিতা লেখকর কলমের বাইরে নয়, তাই শেক্সপিয়ারের মতো একজন মহান কবিতা লেখক এটি পরীক্ষা করতে পারেন, এমনকি স্বীকারও করতে পারেন, সৎভাবে। এই পরিবর্তন সনেটের কাঠামোর বেশ সাধারণ, এবং এটি এর ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি। শুরুতেই লেখক আত্ম-করুণায় ডুবে আছেন, নিজের উপর চাপা পড়েছেন এবং বিষণ্ণ আর সেই সময় তিনি আবিষ্কার করেন যে তার আত্ম-চিন্তন থেকে বেরিয়ে আসার পথ হল অন্যের কথা, তার প্রেমিকের কথা ভাবা, এবং কবিতা লেখক তার পুরো মেজাজ হালকা হয়ে যায়, আর সেটা উদযাপনের সুরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। কবিতা লেখকরা কেবল শক্তিশালী আবেগকে সঠিকভাবে বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ করেন না, তারা সেগুলি প্রকাশ বা উদ্দীপিতও করেন এবং অবশেষে ওই আবেগগুলিকে মূর্ত করে তোলেন, যার বিশ্লেষণকে একটি অতিরিক্ত উচ্চ মাত্রায় তাঁরা নিয়ে চলে যান। এই লেখার ইতি না টানলে এ লেখা চলতেই থাকবে বলে আমার মনে হয়। তাই পরিশেষে কবিতার যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কবিতা লেখকের বা কোন ব্যক্তির কাছে বা পাঠকের কাছে এই ‘প্রকাশ’ আর ‘না-প্রকাশ’ এর যে রসায়ন তা বিনয় মজুমদারের লেখা “ফিরে এসো চাকা” থেকে নেওয়া কয়েকটা লাইনের মাধ্যমে –
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে ।
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায়; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো, অবহিত হও ।
সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে ।
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!