গল্পঃ নতুন পল্লী – ভূমিকা গোস্বামী

সোদপুরের নতুন পল্লীতে তখনও ইলেকট্রিকের পোস্ট বসেনি। একটা বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটি প্লট দূরে আরেকটি বাড়ি ছিল। বহুদিন আগে এখানকার জমিদারের দান করা বেশ কিছু ধানীজমি , জলাজমি ছিল যেগুলো জমিদার বিভিন্ন কর্মচারীকে দান করেছিল। সেখানে যে যার মতো বাড়িঘর করেছে। লেঠেল বিশুকে পুকুর সহ বেশ কয়েক একর জমি দিয়েছিল। জমিদারি প্রথা যখন অবলুপ্ত হল বিশুর তখনও চল্লিশ পেরোয়নি, তবুও অন্য কোন কাজে যুক্ত হয়নি । সারাদিন শুধু তাস-পিটানো, মদ আর মেয়েমানুষের টান। একেকদিন কোলের মেয়েটাকে নিয়ে চৌকিতে শুয়ে বুকের দুধ দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বৌটার হয়তো নিজের চোখটাও লেগে এসেছে ! সন্ধে হতেই অন্য মেয়েরা তো মেঝেতে চটের ওপর কাঁথা পেতে ঘুমিয়ে কাদা। এমন সময়ে রাতদুপুরে মদ, মাংস আর মেয়েমানুষ নিয়ে উপস্থিত হত বিশু। ঘরের কোণে মাংসর ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে ধমকে বলতো – ‘ এই যা, মাংস আর রুটি কর, আমরা খাব।’ চৌকিতে ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখিয়ে ধমকে বলতো–’ সরা এসব আবর্জনা। গুচ্ছের মেয়ে জন্ম দিয়েছে মা..’ কাঁথা অয়েল ক্লথ সহ মেয়েটাকে বুকে করে রান্নাঘরের মেঝেতে শুইয়ে কাঠ জ্বালিয়ে লম্পট স্বামীর জন্য খাবার করে ঘরে এসে দেখতো, বিশু তখন মেয়েমানুষটাকে নিয়ে চরম খেলায় মত্ত। বমি আসতো বৌটার। চৌকির একপাশে খাবার রেখে রান্নাঘরে ফিরে আসতো। চোখ দিয়ে জল নয় আগুন ঝরতো। প্রতিহিংসার জন্য প্রাণ ছটফট করতো।

এদিকে কাঁচা টাকার জন্য একটু একটু করে বিশু বেশ কিছুটা জমি বিক্রি করে ফেলল জলের দামে।

সেইসব জমি দেশভাগের পর ওপার থেকে আসা অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী পরিবারেরা কিনে ফেললো, পরবর্তী প্রজন্মদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু এটা জানতো না যে, কে কতটা ভোগ করবে সেটা তার কর্মফল ঠিক করে। কোন মানুষ নয়। বেশীরভাগই পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া জমি অলসতা আর বিলাসিতায় জন্য নির্বিচারে বিক্রি করেছে, এমনকি নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও হারিয়েছে কেউ কেউ।

যাদের ওপারেও তেমন কিছু ছিল না ভিটেটুকু ছাড়া, তারা এপারে আসার পর ক্যাম্পে থেকে পুনর্বাসনের জন্য আড়াই কাঠা জমি আর কিছু টাকা পেয়েছে। তাই দিয়েই কোনরকমে বেড়ার ঘর আর টালির চাল দিয়ে নতুন পল্লীর পাশে বিবেকানন্দ পল্লীতে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে বাস করেছে। পরে তাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই লেখাপড়া শিখে কাজকর্ম করে, কেউ আবার অটো, টোটো চালিয়েও ভালো বাড়িঘর করে ফেলেছে।

বিশু লেঠেলের পাঁচটা মেয়ের পর পাঁচু ঠাকুরের দোর ধরে শেষ ফল হল ওই পাঁচু। ছেলের মুখেভাত দেওয়ার পরপরই বিশু বিছানায় পড়ল। ডাক্তার চিন্তিত হয়ে বলেছিল – ‘খুব খারাপ রোগ বাঁধিয়োছো হে বিশু। অসংযত জীবন যাপনের ফল। এর তো এখনও তেমন ওষুধ বেরোয়নি।’বে-শ কিছুদিন বিছানায় ছটফট করে মারা গেল বিশু। পাঁচু তখন দুবছর। ছোটবেলা থেকে মায়ের আহ্লাদে, আসকারায় পাঁচুর দিন কেটেছে। পাঁচুরমা হেসে হেসে বলত, – ‘লেখা, পড়া, ইস্কুল- এসবে আমার পাঁচুর একটুও মন নেই কো।একখান লাঠি পেলে আর কিচ্ছুটি চাই না । বাপের পানা হয়েছে একেবারে।’ বাপের মতো লম্বা চওড়া বাপের মতোই কষ্টিপাথরে খোঁদাই করা পিটানো চেহারা।

মেয়েগুলোর জন্য পান্তাভাত নয়তো ফেনাভাত। ছেলের জন্য কিন্তু ডিম-দুধ বাঁধা। বিশুর বৌটার গায়ের রং বেশ ফর্সা, দেখতেও সুন্দর । মেয়েগুলোও মায়ের মতো সুন্দর হয়েছে, তেমনি কাজের। ইস্কুলে পাঠায়নি ওদের! সারাদিন টিউবওয়েল থেকে বালতি বালতি জল টেনেছে আর সংসারের সমস্ত কাজ করেছে। ওদের দেখে যেচেই পাত্রপক্ষ শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে গেছে। বিশুর বৌ এর একটা টাকাও খরচ করতে হয়নি। বিশুর ছেলে এদিকে দেখতে দেখতে জোয়ান হয়ে উঠেছে। কাজকর্মে মন নেই ।পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, বাড়িতে মায়ের সাথে জুলুম করে। টাকার জন্য বাকি যেটুকু জমি ছিল ভিটে বাড়ি ছাড়া সব বেচে দিল। বাপের মতোই মদ আর বাইরের মেয়েমানুষের টান।

বিশুরবৌ দাওয়ায় মাথা কোটে আর কাঁদে –’ওরে পাঁচুরে এমনটি করিসনে বাপ। তোর বাপটাও যে এই পাপেই মরলো।’

বন্ধঘরে পাঁচু তখন মিউজিক চালিয়ে অন্য খেলায় মত্ত।

সময়ের সঙ্গে নতুনপল্লীরও উন্নতি হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছ, আলো, টাইম কল এসেছে। ফাঁকা নিচুজমি গুলোতে সুন্দর সুন্দর বাড়ি উঠেছে। লোকসংখ্যাও বেড়েছে। স্টেশনে যাওয়ার জন্য আজকাল অনবরত অটো চলাচল করে। তিরিশ বছর আগে অফিসের লোন নিয়ে বাপি বসাকের কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছিল মধু। তিন রাস্তার মুখে হলেও আলো-জল নেই, বাইরে প্লাস্টার নেই, বাউন্ডারি ওয়াল নেই। তবুও উঠে এসেছিল ওরা। মধুর বৌ সৃষ্টি বলেছিল–’প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা তো গুনতে হবে না, ওই দিয়ে আস্তে আস্তে সব করে নেব।’ দু’বছর লেগেছিল আলো-জল আসতে। সৃষ্টি এত সুন্দর গুছিয়ে সংসার করতো ! ওদের অনেক টাকা ছিল না। সাধারণ ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে অসাধারণ সুন্দর কাজের জিনিস বানিয়ে ব্যবহার করতো। ছেঁড়া কাপড় দিয়ে কাঁটায় বুনে সুন্দর সুন্দর কার্পেট, পাপোশ বানিয়ে ব্যবহার করতো। ওদের বসার ঘরটায় কোন আসবাব ছিল না। লোকজন বাড়িতে এলে আসন পেতে বসতে দিত। বিয়ের সময় বাবা দুটো ট্রাঙ্ক দিয়েছিল। স্টিলের আলমারি কেনার পর একদিন দুপুরে ট্রাঙ্ক দুখানা বসার ঘরের দেয়াল ঘেঁষে পাশাপাশি রেখে ওপরে রণির ছোট তোষক, লেপ পেতে দিল। লীলরংয়ের একটা চাদর বিয়েতে পেয়েছিল কিন্তু ওর খাটের তুলনায় চাদরটা ছোট হওয়ায় তোলাই ছিল এতদিন, সেটা কেটেই ট্রাঙ্কদুটোকে একসঙ্গে ঢাকলো। চাদরের বাকিটা দিয়ে দুটো কোলবালিশ আর তিনটে কুশন ঢাকা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল মধুকে। মধু আদর করে বলেছিল –’তোমার হাতে জাদু আছে।’ এইটুকু কথায় সৃষ্টির সারাদিনের পরিশ্রম সুখে বদলে গেল। নিজেকে এই ছোট্ট সংসারের সম্রাজ্ঞী মনে হল।ওর সাম্রাজ্যে দুখানা ঘর, রান্নাঘর,ছোট খাওয়ার জায়গা , ছাদে ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়িরতলার ঘর আর বেশ বড় বাথরুম। বড় একটা চৌবাচ্চা,তাতে ভাড়ী এসে দুবেলা জল ভরে দিয়ে যেত।

বাপি বসাক পাশাপাশি ছ’টা প্লট বিক্রি করে। এমনকি বসত বাড়িটাও মধুকে বিক্রি করে বরানগরে বাড়ি ভাড়া করে মাকে নিয়ে চলে গেল। সরকারি চাকরি করতো বাপি, তবুও এত টাকার প্রয়োজন কেন ছিল, বুঝতে পারে না সৃষ্টি। বাপি বসাকের মা ছেলে অন্ত প্রাণ ছিল। সৃষ্টিরা এখানে আসার পর অনেক পাওনাদার আসতো বাপির খোঁজে। খবরেরকাগজ ওয়ালা , মাছওয়ালা ,মুদি টাকা পেত। আরো কত পাওনাদার ছিল কে জানে! সৃষ্টি একদিন বড় বড় করে একটা কাগজে লিখল – “ বাপি বসাক এই বাড়ি মধু মিত্রকে বিক্রি করে দিয়েছে। দয়া করে বাপি বসাককে খুঁজতে এখানে আসবেন না।” তারপর আঠা দিয়ে দেওয়ালে আটকেছিল। তখন তো ফোন ছিল না। কেউ বাপিকে ধরতে পারেনি।

অনেকদিন পর বাপি বসাকের এক আত্মীয় এক বিকেলে এসেছিল। তখন সৃষ্টি বাগানে পাইপে করে জল দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ওরা বাড়িটা দোতলা করেছে, রং করেছে, বাউন্ডারি দিয়ে সুন্দর বড় গ্রীলের গেট লাগিয়েছে। বাড়ি ঘিরে আম কাঠাল বকুল রঙ্গন জবা সুপুরির গাছ। টবে টবে গোলাপ-পদ্ম-জুঁই, পাতাবাহারে আলো হয়ে আছে বাড়ির ভেতরের পথ। নিজের থেকেই পরিচয় দিয়ে বলল, –’ আপনারা বসাক বাড়ি কিনেছেন, তাই না?’ সৃষ্টি অবাক হয়ে বলল– ‘হ্যাঁ সে তো অনেক দিনের কথা, আপনি ওদের চিনতেন ?’ –‘হ্যাঁ মানে আমাদের দূর সম্পর্কের দেওর হয় বাপি।’ হাসি হাসি মুখে বলল মহিলা – ‘কী সুন্দর করে বাড়িটা সাজিয়েছেন দিদি, যাতায়াতের সময় দেখি। পরের গলিতেই আমার বোন থাকে। মাঝেমাঝেই আসি । কাউকে দেখতে পাই না। আজ দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।’ কথা বলতে বলতে সৃষ্টি বলল–’মাসিমা কেমন আছেন , মানে বাপির মা ?’– ‘উনি তো গত বছর মারা গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। বাপি বিয়ে করেছে বছর দশেক হল। শ্বশুর বাড়ি থেকে ফ্ল্যাট পেয়েছিল। তখনই মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে। গরিব মানুষেরা যেখানে থাকে ওখানে। সামান্য কিছু টাকাপয়সা পাঠাতো বাপি মাসে মাসে, দেখতে যেত না। মারা যাওয়ার খবর শুনে গেছে।ওর মার নামে এত জমি বাড়ি , সব বিক্রি করেছে বাপি। এমন বিশ্বাস করতেন ছেলেকে, সই করে দিয়েছেন ছেলে যেখানে বলেছে। ছেলের নামে কোনদিন অভিযোগ করতেও শুনিনি। সারাক্ষণ “আমার বাপি আমার বাপি” করে গেলেন মাসিমা। সেই মাকে এত কষ্ট দিতে পারলো ! আগে তো দেখতাম মাকে চোখে হারাতো।কথায় কথায় বলতো –”আমার রাজা মা”।’ বলল মহিলা। সৃষ্টির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মহিলা চলে যাবার পর থেকে ভেবে চলেছে। ওরও তো একটা মাত্র ছেলে রণি। ব্যাঙ্গালোরে ফিজিক্স-এ পি-এইচ-ডি করছে। প্রতিদিন সেই ছোটবেলার মতো সারাদিন কী কী হয়েছে, কী খেয়েছে সব বলা চাই। কখনো যদি এমন করে ভুলে যায় সৃষ্টিকে, কীভাবে বাঁচবে । চোখ ভিজে ওঠে। মাসিমা,আপনার কাছ থেকে একটা শিক্ষা পেলাম। কেউ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

নিজের মনকে বলল – ‘যতদিন বেঁচে আছি মাথার ছাদটুকু ছাড়বো না কিছুতেই।’ তিলে তিলে সংসারের টাকা জমিয়ে, সখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে স্বপ্নের বাড়িটা মনের মতো সাজিয়েছে । অংকে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হয়েও চাকরি নেয়নি। ছেলেকে পড়িয়েছে, সংসার করেছ মন দিয়ে।

সৃষ্টি এখানে আসার দুমাস পর দুর্গাষষ্ঠিতে বাড়ি করে এলো মণিবাবু, দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে। কাছেই ক্লাব। সেখানে বড় প্যান্ডেল করে পাড়ার ক্লাবের দুর্গাপুজো হয়। সৃষ্টির বাড়ি থেকে প্রতিমা পরিষ্কার দেখা যায়। সব বয়সের মানুষ সেজেগুজে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে, কী যে ভাল লাগে দেখে। সৃষ্টির বাড়ির মুখোমুখি মণিবাবুর বাড়ি, মাঝে ষোলো ফুট রাস্তা।ওদের গৃহপ্রবেশে সৃষ্টির নিমন্ত্রণ ছিল। সকাল থেকে সেদিন রণির জ্বর ,যাওয়া হয়নি। সন্ধেতে মণিবাবুর বৌ মিনতি নারায়ণ পুজোর প্রসাদ নিয়ে এলো। চল্লিশোর্ধ্ব শ্যামলা স্বাস্থ্যবতী মিনতির কথাবার্তায় আন্তরিকতার ছোঁয়া। বলেছিল– ‘আপনি ভাই, আমার থেকে বয়সে বেশ ছোট, তুমি বলব?’ সৃষ্টি ব্যস্ত হয়ে বলেছিল –’ অবশ্যই ! সৃষ্টি বলেই ডাকবেন।’ সৃষ্টি যখন পাড়ায় এল তখন পঁচিশ বছরের সুন্দরী-যুবতী, রণি দু’বছরের।

মিনতির দুই মেয়ে তিন্নি, মুন্নি। তিন্নি ক্লাস টেনে পড়ে, মুন্নি সিক্সে। তিন্নিকে এককথায় সুন্দরী বলা যায়। বেশ বাড়ন্ত চেহারা। তিন্নির মতো অত সুন্দর না হলেও সুন্দর মুন্নি , একটু পুরুষালি হাবভাব। ক্লাবের মাঠে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সমানভাবে খেলে।

এই ক্লাবের জায়গা, পুজোমণ্ডপের জায়গা, পাশে শিবমন্দিরের জায়গা সবটাই বিশু লেঠেল দান করে গেছে, রোগশয্যায় থাকা কালীন পাড়ার মুরুব্বিদের ডেকে দানপত্রে টিপসহি দিয়ে । ব্যানার্জিবাবু, চ্যাটার্জিবাবু, দত্তবাবুর পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল – ‘ আশীর্বাদ করুন আপনারা, পাপের শরীর থেকে তাড়াতাড়ি যেন মুক্তি পাই।’ মৃত্যুর পর পাড়ার লোকরাই চাঁদা তুলে সৎকার , শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করে। ছেলে ছোট, বৌই মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধ করেছিল। পাড়ার মুরুব্বিরা মিটিং করে চারপাঁচ বাড়িতে পরিচারিকার কাজ দেন বিশুর বৌকে। মুরুব্বিরা সকাল বিকেল হাঁটতে বেরোতেন, খোঁজ খবর নিতেন,পাড়ায় নতুন কেউ এলে সবার সাথে যেচেই আলাপ করে নিতেন। সৃষ্টিরা যখন গৃহপ্রবেশ করে পাড়ার বয়স্ক পাঁচ জন আর অল্পবয়সী পাঁচজন এসেছিল সন্ধ্যায় হরিনাম কীর্তনে। পাঁচু আর পাঁচুরমাও এসেছিল। সৃষ্টি সকলকে কাগজের প্লেটে লুচি,ছোলার-ডাল, মিষ্টি আর শালপাতার বাটিতে নারায়ণপুজোর সিন্নি দিয়েছিল।

মধুর নিজের বলতে কেউ নেই। সৃষ্টির বাবা-মা, অফিসের দুজন কলিগ আর মিশনের অরিন্দমস্যার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেছিল। সৃষ্টির মা-ই রান্না করেছিলেন। মধুর বাবা মা ওর ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। ওপার বাংলায় মামার বাড়িতেই শিশুকাল কেটেছে। মামারা একসময় ওখানকার পাট উঠিয়ে খড়দহে চলে আসে। এখানে জমি কিনে বেশ বড় বাড়ি করে। নিচের তলায় মামার তিন ছেলের তিনটে বড় বড় দোকান । মধু তখন বছর আটেকের। মধুকে ওরা রহোড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠিয়ে দেয়। মামার তখন অনেক বয়েস। মামাতো ভাইরা বিয়ে করেছে, মধুর দায়িত্ব নিতে চাইলো না। মধু মিশনে থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিল তাই মহারাজরা ওকে স্কুলের পাট চুকলেও রেখে দিয়েছিলেন। ছুটিতেও কোনদিন মামার বাড়ি যেত না। প্রতিবার পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার এবং ওর সুন্দর ব্যবহারের জন্য সবার প্রিয়পাত্র ছিল মধু। মিশনের শিক্ষক অরিন্দমস্যারের বন্ধু ছিলেন সৃষ্টির বাবা। স্যার দায়িত্ব নিয়ে সৃষ্টির সাথে মধুর বিয়েটা দিয়েছিলেন।বাড়ি কেনার আগে সৃষ্টির বাপের বাড়ির কাছেই ভাড়া বাড়িতে ছিল ওরা। প্রতিবছর মধু বৌ-ছেলেকে নিয়ে পুজোর অষ্টমীতে মিশনে যায়। অঞ্জলি দেয় , প্রসাদ খায়, সন্ধ্যায় আরতি দেখে মহারাজদের সঙ্গে দেখা করে। ছেলেকেও মিশনে পড়িয়েছে।

নতুনপল্লী ক্লাবে ক্লাস ফোর পর্যন্ত প্রাইভেট স্কুল খোলার প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা নেওয়া, ছাত্রছাত্রী ভর্তি, কাজের মাসি রাখা।

সরকারি স্কুলে বাবা মায়েরা ভরসা করে আর ছেলে মেয়েকে পাঠাতে চায় না।শিক্ষক ভালো, সিলেবাস ভালো তবু পড়াশোনার মান সেখানে দিন দিন কমছে। সকলেরই প্রায় একটা করে সন্তান। সাধ্যের বাইরে গিয়েও প্রত্যেকেই চায় তাদের সন্তান ভালো শিক্ষা পাক। এই সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইভেট স্কুল গজিয়ে উঠছে । প্রচুর খরচ সেখানে। এলাকার বাচ্চারা যাতে কম খরচে ইংরেজি ও বাংলা দুটো মাধ্যমেই ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্লাব। পাড়ার শিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত এবং গৃহবধূ যাঁরা সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করতে ইচ্ছুক তাঁরা এই স্কুলে পড়াবেন। তাঁদের যৎসামান্য টাকা দেওয়া হবে। মিটিং ডাকা হলো। নতুন পল্লীতে এখন বসতি বেড়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল ও শিক্ষিত লোকের অভাব নেই এখন। প্রত্যেক বাড়ির গৃহিণীরা অন্তত গ্র্যাজুয়েট। সৃষ্টি অঙ্কে অনার্স গ্র্যাজুয়েট। রণিকে ওই তো হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়িয়েছে। তাই চর্চাও আছে। রণি ব্যাঙ্গালোরে যাওযার পর থেকে অনেক অবসর। নতুন পল্লী ক্লাবের এই উদ্যোগে তাই সঙ্গে আছে।

সময় গড়িয়ে গেছে নিজের নিয়মে। মণিবাবুর মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করেছে। তিন্নির বর প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, মুন্নির বরের ব্যবসা।

প্রীতির সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছে পাঁচু। ওর একটা ছেলে। প্রীতি বেশ শক্ত ধাঁচের মেয়ে। নিজে আয়ার কাজ করে। পাঁচুকেও কাজ করতে বাধ্য করেছে, ও এখন একটি ল্যাবরেটরিতে রক্ত নেওয়ার কাজ করে। ছেলেটার পড়ার যাবতীয় দায়িত্ব প্রীতির। পাঁচুর মা নাতিকে বেশী প্রশ্রয় দিলে প্রীতি ধমকে বলে –” কী চাও ? পাঁচুর ছেলে আরেকটা পাঁচু হোক ?” সকালে দুধ বিস্কুট খাইয়ে ছেলেকে প্রাইভেট পড়তে দিয়ে নিজে কাজে যায়। দশটায় পাঁচু ছেলেকে বাড়িতে এনে নাইয়ে খাইয়ে স্কুলে দিয়ে নিজে কাজে যায়। প্রীতি যে বৃদ্ধার দেখাশোনা করে তার কাছ থেকে স্বল্প সময়ের ছুটি নিয়ে ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে শিবমন্দিরের সিঁড়িতে বসে স্কুলের জামা ছাড়িয়ে খেলার পোশাক পরিয়ে দেয়। কাজের বাড়িতে দেওয়া সকালে জলখাবারের রুটি তরকারি ছেলেকে খাইয়ে একটু বিশ্রাম করিয়ে খেলার মাঠে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। পাঁচু কাজ থেকে ফেরার পথে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি আসে, হাত-পা ধুইয়ে পড়তে বসায়। প্রীতি যদি এসে দেখে রোহিতের হোম ওয়ার্ক হয়নি দারুণ অশান্তি করে। ওদের সংসার এখন বেশ ছন্দে চলছে। ছেলেটা মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। পাশাপাশি খেলাতেও ভাল করছে। প্রীতির ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায়। রোহিত বাপের মতো উচ্চতা চেহারা পেলেও স্বভাব চরিত্রে ঠিক বিপরীত। আস্তে আস্তে কথা বলে। ভদ্র স্বভাবের জন্য পাড়ার সবাই ওকে বেশ পছন্দ করে। ওদের বাড়ির চেহারাটাও বদলে গেছে। সামনের দিকে সরকারি টাকায় উঁচু করে ন্যানো বাড়ি করেছে। পিছনের দিকের টালির বাড়ির মেঝে উঁচু করেছে। রাস্তা উঁচু হয়েছে তাই বেশী বৃষ্টি হলে ওই ঘরগুলোতে জল ঢুকে যেত। এখন ন্যানো বাড়িতে ওরা থাকে, টালির ঘরগুলো ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। পাঁচুর মা এখনও বেশ শক্ত আছে। বিকেল বেলা পরিষ্কার সরুপাড়ের সাদাশাড়ি সাদা ব্লাউজ পরে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়।

রবিবার পাঁচুদের বাড়ি নারায়ণ পুজোর নিমন্ত্রণ। দুপুরে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেছে। সবার বাড়িতে বাড়িতে হাতজোর করে নিমন্ত্রণ করেছে পাঁচু।

পুকুরের পাড় ঘেঁষে বিশাল প্যাণ্ডেল হয়েছে। ডেকোরেটর্সের বড় বড় হাড়ি কড়াই চেয়ার টেবিল এসেছে। রবিবার বেলা বারোটা বাজতেই পাড়ার লোকজন এসে গেছে। পাঁচুর দিদিরাও এসেছে। বলতে গেলে এই প্রথম পাঁচুদের বাড়ি খাওয়ার নিমন্ত্রণ। সৃষ্টি আর মধুও গিয়েছে। ওদের ন্যানো বাড়ির পাশে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য চারফুট রাস্তা একেবারে পুকুর পাড় পর্যন্ত। পুকুরের ধারে লাউ কুমড়ো সিম বেগুন টমেটো লংকা সজনের গাছ। আম কাঁঠাল লেবু গাছও আছে। চারটে খুঁটি, মাথায় টালি, চারদিকে বেঁড়া দেওয়া একটা বড় রান্নার জায়গা। দুটো কাঠের জালের মাটির নিকোনো উনুন। মেঝেটাও মাটির। এখানেই পাঁচুর মা দুপুরে রান্না করে। সবাইকে পাঁচু আর প্রীতি আদর করে বসিয়েছে প্যাণ্ডেলে। রোহিত ওর ঠাকুমার হাত ধরে সকলের সামনে এসে দাঁড়াল। রোহিতের হাতে মাইক।ও বলছে, – “প্রথমেই আপনাদের প্রণাম জানিয়ে একটি সুখবর দিতে চাই। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে দুপুরে আমি বাড়িতেই থাকতাম, পড়াশোনা করতাম। ঠাকুমাকে বাড়ির শাক সবজি তুলে গাছের ডালপালা পাতা দিয়ে উনুন ধরিয়ে রাঁধতে দেখতাম। পরীক্ষার পর হঠাৎ মনে হল, এগুলো দিয়ে ভিডিও করলে কেমন হয়। আজকাল তো কেউ এভাবে রান্না করে না। গ্যাসের ওভেনেই রান্না করে। ঠাকুমার সাথে গল্প করতে করতে স্কুল থেকে পাওয়া ট‍্যাব দিয়ে ভিডিও করে ইউটিউবে দিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজার হাজার তারপর লাখ লাখ ভিউয়ার। লাইক কমেন্টও হতে লাগল প্রচুর। বাড়ির কেউ জানত না। ঠাকুমাকেও বলিনি। টাকা পাওয়ার পর জানিয়েছি। আপনারাও হয়তো ইউটিউবে দেখে থাকবেন “সুরবালার রান্নাঘর”।” মিনতিদি বলল –”আরে আমিও তো দেখি। পাঁচুরমা যে সুরোবালা তা কী করে বুঝবো।” রোহিত বলল –”ঠাকুমার ঠাকুমা নাম রেখেছিলেন সুরোবালা।” উপস্থিত সবাই খুশি।

–” আমিও যে কিছু করতি পারি ভাবিনি কো।” বলেই নাতির বুকে মুখ রেখে হাউহাউ করে কাঁদছে সুরোবালা দাসী। সৃষ্টি ভাবল –আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ,বিশুর বৌ না, পাঁচুর মা না, রোহিতের ঠাকুমা না, “সুরবালার রান্নাঘরের” সুরবালা দাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *