প্রবন্ধ: বাঁকুড়ায় রবীন্দ্রনাথ; চন্ডীদাস প্রসঙ্গ – মধুসূদন দরিপা

 ছাতনার চণ্ডীদাস না নানুরের চণ্ডীদাস ? শতবর্ষ প্রাচীন এই বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ১৯৪০ সালের ১লা মার্চ তিনি এসেছিলেন বাঁকুড়া জেলায়। ছিলেন তিনদিন। উদ্দেশ্য ছিল মূলত একটি কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্য প্রদর্শনী উদ্বোধন ও ‘ বাঁকুড়া নারী ও শিশুমঙ্গল সমিতি’-র প্রসূতি ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। কবিগুরুর এই আগমনের পিছনে মূল উদ্যোগ ছিল তৎকালীন বাঁকুড়ার জেলা শাসক শ্রীসুধীন্দ্রকুমার হালদারের সহধর্মিনী শ্রীমতী ঊষা হালদারের। তাঁর পিতা সেকালের প্রখ্যাত চিকিৎসক তথা স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী ও বিশিষ্ট বন্ধু। উপরন্তু কবিগুরুকে বাঁকুড়ায় আনার ব্যাপারে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দৌত্যকার্য চালিয়েছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র শ্রীরামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর এই উৎসাহের প্রাবল্যের অন্যতম মুখ্য একটি কারণ ছিল, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কৌশলে চণ্ডীদাস যে আদতে ছাতনার, সেকথা বলিয়ে নেওয়া। ঘটনাচক্রে কী হয়েছিল, তা বলার আগে চণ্ডীদাস বিতর্ক নিয়ে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করে নেওয়া আবশ্যক। 

 ১৩১৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সন্নিকটে কাঁকিল্যা গ্রামের বাসিন্দা শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘরের মাচা থেকে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদবল্লভ একটি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পান এবং ১৩১৮ বঙ্গাব্দের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় পুঁথির দুটি পৃষ্ঠার আলোকচিত্র সহ ‘ চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজের আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। অবিলম্বে সমকালীন বৈষ্ণব সমাজ ও পণ্ডিতবর্গ এর বিরুদ্ধে জেহাদ তুলে পদাবলীর চণ্ডীদাস ও নব-আবিষ্কৃত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চণ্ডীদাস যে এক ব্যক্তি নন, সেকথা প্রমাণ করতে মরীয়া হয়ে ওঠেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বসন্তরঞ্জনের সম্পাদনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। মুখবন্ধ লেখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও পুঁথির লিপিকাল নিয়ে আলোচনা করেন ঐতিহাসিক রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

 ১৩২৬ বঙ্গাব্দের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বাঁকুড়া জেলারই প্রথিতযশা মনীষী আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বসন্তরঞ্জনকে তীব্র আক্রমণ করে তাঁর ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সংশয় ‘ প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন –” শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যদি চণ্ডীদাসের, চণ্ডীদাসের ভনিতাযুক্ত পদগুলি কাহার? বসন্তবাবু দুই অভিন্ন মনে করিয়া অর্ধকুক্কুটি ন্যায় অনুমোদন করিয়াছেন।…. আমার বিশ্বাস যাহা ইতিহাস নামে খ্যাত তাহার সমস্ত সত্য নহে, এবং যাহা জনশ্রুতি নামে প্রচলিত, তাহারও সমস্ত অসত্য নহে, পদাবলীর চণ্ডীদাস ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চণ্ডীদাসকে এক ব্যক্তি বলিতে পারা যাইতেছে না।”

(“অর্ধকুক্কুটি-ন্যায়” একটি প্রবাদ, যার অর্থ হল, কোনও বিষয়ে একের প্রতি বিশ্বাস করলেও অন্যের প্রতি অসম্মান করা ঠিক নয়। কোনও বিষয়ে একের প্রতি বিশ্বাস করলেও অন্যের প্রতি অসম্মান করলে তা অর্ধকুক্কুটি-ন্যায়ের মতো হবে। )

 চণ্ডীদাসের বাসস্থান কোথায় ছিল? বাঁকুড়ার ছাতনা না বীরভূমের নানুর? নানুরে চণ্ডীদাসের নিবাস এমন কিংবদন্তী যেমন সুদীর্ঘকাল প্রচলিত, তেমনই ছাতনার কথাও অশ্রুত ছিল না। এই দুই স্থানেই চণ্ডীদাসের আবির্ভাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত তথাকথিত নানুর- বাদ ও ছাতনা- বাদের উৎপত্তি হয়েছিল। এই বাদানুবাদ নিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় মসীযুদ্ধ শুরু হয়। নানুরের পক্ষে কলম ধরেছিলেন বৈষ্ণব শাস্ত্রের বিদগ্ধ পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ । বিপ্রতীপে ছাতনা নিয়ে মুখর হয়েছিলেন বসন্তরঞ্জন রায়, সত্যকিঙ্কর সাহানা প্রভৃতি। সত্যকিঙ্কর ‘চণ্ডীদাস প্রসঙ্গ’ শিরোনামে একটি গ্রন্থও প্রণয়ন করেন। ইতিমধ্যে ছাতনার সন্নিকটে কৃষ্ণপ্রসাদ সেনের নামাঙ্কিত ‘ চণ্ডীদাস চরিত ‘ প্রকাশ করে যোগেশচন্দ্র রায় পর্যন্ত বসন্তরঞ্জন বিরোধিতা থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে চণ্ডীদাসকে ছাতনার কবি প্রমাণে তৎপর হয়ে ওঠেন। যোগেশচন্দ্রের সপক্ষে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৩৪২-এর শ্রাবণ সংখ্যা প্রবাসীর বিবিধ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেন তার একাংশে লেখেন “সুখের বিষয় এই যে রবীন্দ্রনাথ ইহা পড়িয়া আনন্দিত হইয়াছেন।…. অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র আমাদের লিখিয়াছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা ও অভিমত দ্বারা ‘ চণ্ডীদাসচরিত’ ধন্য হইল।”  বলা বাহুল্য যে, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ছাতনাবাদের সমর্থক। বিতর্কের অবসান ঘটাতে চণ্ডীদাস সমস্যার সমাধানের উদ্দেশে বসন্তরঞ্জন রায়, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছিল। যাতে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

 সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল চণ্ডীদাস নানুরেরই অধিবাসী ছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে একটি চিঠিতে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখেছিলেন— “এখান হইতে জয়দেবের বাসভূমি ছয় ক্রোশ— চণ্ডীদাসের জন্মভূমিও অধিক দূর নয়।“ এমতাবস্থায় ছাতনাবাদীদের অভিপ্রায় হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, কবিগুরু ছাতনার সপক্ষেই মত দিন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হবার পর তার একটি কপি বসন্তরঞ্জন উপহার হিসেবে কবিকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কবি এই গ্রন্থ সম্পর্কে কোনো মতামত দেননি। পরবর্তীকালে প্রেরিত যোগেশচন্দ্রের ‘ চণ্ডীদাসচরিত ‘ গ্রন্থটি নিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় লেখা রামানন্দের মন্তব্য সম্পর্কেও কবি নীরব ছিলেন।

 ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রবীন্দ্রনাথ বীরভূমের সিউড়িতে একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি বাঁকুড়ায় আগমনের আমন্ত্রণ পান। শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস কিছুকাল বাঁকড়ার ওয়েসলিয়ান কলেজে ( অধুনা বাঁকুড়া খৃশ্চান কলেজ) ছাত্র ছিলেন। সেই সুবাদে কলেজ হস্টেলে থাকতেন। বাঁকুড়ায় তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও ছিল ভালো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁকুড়ায় আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাটি নিয়ে তিনি তাঁর ‘ আত্মস্মৃতি ‘ গ্রন্থে লিখেছেন —” আমি স্পষ্ট বুঝিলাম এই সভার উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের সাহায্যে বাঁকুড়ায় চণ্ডীদাসকে প্রতিষ্ঠিত করা। ইহারা বিদায় লইলে আমি কবিকে যথাসাধ্য সচেতন করিয়া দিলাম। বিশেষ করিয়া ছাতনা গমন সম্পর্কে।” 

 রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই বিতর্ক সম্পর্কে প্রথম থেকেই সতর্ক ও সচেতন ছিলেন। বাঁকুড়া আসার দুদিন আগে তাই সজনীকান্তের এই সাবধান থাকার আবেদনকে মান্যতা দিয়ে ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪০ একটি চিঠিতে লেখেন —” আপাতত চললুম বাঁকুড়ায়– চাণ্ডীদাসিক চক্রবাত্যার কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে থাকব। ফিরে আসব চৌঠা নাগাদ…..। ”

 অতঃপর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাঁকুড়ায় কবির উপর চণ্ডীদাস নিয়ে ছাতনাবাদীদের প্রবল চাপ ছিল। কারণ অনুষ্ঠান পরিচালনার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি, সত্যকিঙ্কর সাহানা প্রমুখ। কবি বাঁকুড়ায় পদার্পণ করেন ১ লা মার্চ ১৯৪০। অবস্থান করেন হিল হাউসে। বর্তমানে সেটি জেলা শাসকের বাসভবন। দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ২রা মার্চ কবি পরবর্তী কালে চণ্ডীদাস চিত্রমন্দির নামে যে সিনেমা হলটি চালু হয়েছিল, সেই নির্মীয়মান অভিনয় প্রেক্ষাগৃহ প্রাঙ্গণে আয়োজিত জনাকীর্ণ সভায় কবি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি ‘ কবির উত্তর, বাঁকুড়ার জনসভায় অভিনন্দনের উত্তরে লিখিত, ১৩৪৬ ফাল্গুন ১৮ ’ শীর্ষনামে প্রবাসীর ১৩৪৭ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল। চণ্ডীদাস প্রসঙ্গে সেদিন কবি যা বলেছিলেন —

 “ জীবনের পরপারবর্তী একজন কবির প্রতি এই প্রদেশের কত বড়ো সম্মান ভালোবাসার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছে এখানকার আকাশে। সেই চণ্ডীদাস মৃত্যুর আগে সমাজে কত নিন্দা পেয়েছেন, কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। কবি- জনোচিত আত্মশক্তি ছিল তাঁর। যে সাধনাকে গ্রহণ করেছিলেন তাতে লোকনিন্দা পরিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে তাঁর উপর থেকে। সে নিন্দা তাঁর জীবনকে মহত্ত্ব দিয়েছে, পরে সেই জীবন আপন সম্মান নিয়ে সুবিস্তীর্ণ হয়েছে সমস্ত বাংলার মধ্যে। মহাকালের হাতে সত্যকার সম্মান লাভ করেছেন তিনি মৃত্যুর পরে, এখন তো কেউ বাধা দিতে পারবে না তাঁকে। যদি অদৃষ্টে থাকে চণ্ডীদাসের সম্মান আমার ঘটবে – তখন জানব না আমি থাকব না আমি। 

সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া
মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ —

 সুস্পষ্ট বাংলা ভাষায় এই যেন প্রথম বাণী চিরকালের মর্মের মধ্যে প্রবেশ করে রইল। চণ্ডীদাসের গান বাংলার গায়কদের সহযোগিতা আকর্ষণ করেছে, গঙ্গার প্রবাহ যেমন পূর্ণ হয়েছে পথে পথে উপনদীদের ধারায়। তখনকার কালের কাব্য সমস্ত দেশের কাব্যরসকে মিলিয়ে চলত আপনার মধ্যে। আমাদের দেশের কালোয়াতি গানে রচয়িতার স্বত্বসীমা গায়কের তানের উচ্ছ্বাসকে বাধা দেয় না। পদাবলীরও সেই দশা। চণ্ডীদাসের গান উৎসমুখে ছিল যে ভাষায় কালের প্রবাহে সে-ভাষা বাংলার পরিবর্তনমান বাণীকে গ্রহণ করে এসেছে। বস্তুত কাল-শিল্পীর হাতের রং লাগানো চণ্ডীদাসের গানকেই আমরা আপন বলে উপভোগ করে এসেছি। এতদিন তাকে তার ঐতিহাসিক সীমায় পাইনি। এখন ইতিহাসের প্রহরী তার তর্জনী তুলেছে। তার ফলে তিন চণ্ডীদাসের নয়, দুঈ চণ্ডীদাসের উদ্ভব হয়েছে – ঐতিহাসিক তর্কক্ষেত্রের বিশেষ চণ্ডীদাস একজন, আর একজন সর্বজনের চণ্ডীদাস, সর্বকালের বাংলাভাষায় যাঁর গান ধ্বনিত হচ্ছে। এই চণ্ডীদাসের সঙ্গেই আমার প্রথম পরিচয় এবং সম্পূর্ণ পরিচয়। 

 এখন ছাপাখানা হয়েছে, আমাদের গানের সীমানা পাকা হয়ে গেছে ছাপার হরফে। তাই চণ্ডীদাস দেশের যেক্ষেত্রে আন নিয়েছেন আমাদের মতো হালের কবি সেখানে পৌঁছতে পারবে না। আমরা ইতিহাসে বাঁধা, এতো বাঁধা যে কবির নিজের হাতের বদল নিয়েও সত্বের মামলা উঠে পড়ে। চণ্ডীদাস আজ সমস্ত দেশের কাছে যে অভিনন্দন পাচ্ছেন ইতিহাস তাকে বেড়া দিয়ে ঘেরেনি, আজকের দিনের এই অভিনন্দনের মধ্যে বসে এ তর্ক সহজেই মনে আসে ইতিহাসের অতীত মহাকাল এর কতখানি গ্রহণ করবেন কতখানি ফেলে দেবেন বিস্মৃতির আবর্জনায়। পৃথিবীতে পাকা ইমারত দিয়েই ইতিহাসের বড়ো বড়ো ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে। যা চলনশীল, কালের চলার সঙ্গে যার চলার তাল মেলে তা বিশেষ সত্বের দাবি করে না বলেই সকলের স্বত্বে টিকে যায়। তোমাদের অভিনন্দনকে আমি আজ গ্রহণ করি, আপাতত এ জমা থাক গচ্ছিত্  সম্পত্তির মতো, কালের বড়ো অভিনন্দন সভায় ওর যাচাই হবে, তখন তোমাদের এই বাঁকুড়াতেই চণ্ডীদাসের পাশে কি আসন পাব – এই প্রশ্ন মনে নিয়ে বিদায় গ্রহণ করি। “

 উপরোক্ত ভাষণ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ সুকৌশলে দার্শনিক ভঙ্গিতে চণ্ডীদাস প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তথাকথিত দুই বাদীদের কোনো পক্ষকেই প্রত্যক্ষ সমর্থন না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও উদ্যোক্তাদের পক্ষে কবিকে নিজেদের মতের পক্ষে টানার জন্য তৎপরতার কোনো খামতি ছিল না। বাঁকুড়ার স়ংবর্ধনা সভায় কবিকে যে ব্যাজ পরানো হয়েছিল তার অলঙ্করণ নিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় লেখা হয় :

 “ ….. এবং পরিষদের নিদর্শনী (Badge) রেশমী কাপড়ে মুদ্রিত বংশীর ছবির নীচে চণ্ডীদাসের বাণী — সবার উপরে মানুষ সত্যসত্য তাহার উপরে নাই — কবিকে পরাইয়া দেন। “

 রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বাঁকুড়ায় চণ্ডীদাস স্মৃতিমন্দির স্থাপন প্রসঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের অনুমোদনের কথা উল্লেখ করেন —” এমন কথা যদি বলা হয় যে, চণ্ডীদাস এক ছোট কবি, যে তাঁহার স্মৃতিমন্দির নির্মাণ না করাই ভালো, তাহা হইলে আমরা নিজে কিছু না বলিয়া রবীন্দ্রনাথ গত ফাল্গুন মাসে বাঁকুড়ায় তাঁহার একটি বক্তৃতায় যাহা বলিয়াছেন ও যাহার সংক্ষিপ্ত অনুলিপি প্রবাসীর বর্তমান সংখ্যার ৫১ পৃষ্ঠার শেষ প্যারাগ্রাফ হইতে ৫২ পৃষ্ঠার শেষ পর্যন্ত আছে ( এবং যাহা তাঁহার অনুমোদিত) তাহাতে সংশয়াপন্ন ব্যক্তিদিকের দৃষ্টিপাত যাচ্ঞা করিতেছি। ”

 চণ্ডীদাসকে নিয়ে এ বিষয়ে মাতোয়ারা ছাতনাবাদীর দল যতই নিজের ঢাক নিজে পেটান না কেন, রবীন্দ্রনাথের বাঁকুড়া সফর যে আদৌ স্বস্তিকর বা সুখকর হয়নি, সেকথা কবি স্বয়ং বাঁকুড়া থেকে শান্তিনিকেতন ফিরেই ৮ মার্চ ১৯৪০ সজনীকান্ত দাসকে লেখা চিঠির শুরুতেই জানিয়েছিলেন,

 “ বাঁকুড়ায় যেরকম খাটতে হয়েছিল এমন কোথাও হয়নি। মাঝে মাঝে আমার শরীরের অবস্থা সম্বন্ধে ভয়ের কারণ ঘটেছিল কাউকে বলিনি, কর্তব্য করে গিয়েছি। আরম্ভে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলুম, অন্তে পারিশ্রমিক পাইনি বললেই হয় – আমাদের সঙ্গীত ভবনের নিরসন দশায় উদ্বিগ্ন হয়েছি। ”

 সজনীকান্তও প্রত্যুত্তরে কবিগুরুকে ১২ মার্চ ১৯৪০ লেখা চিঠিতে এই প্রসঙ্গে লেখেন, 

“….বাঁকুড়ায় দুটি সভাপতিত্ব খাঁড়ার মত মাথার উপর ঝুলিতেছে। বাঁকুড়ার যেরূপ পরিচয় পাইলাম তাহাতে নিরুৎসাহ বোধ করিতেছি, কিন্তু এখন আর উপায় নাই।….. ”

 প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকে যে, বাঁকুড়া সফরের সময় বিশ্বভারতীর বেশ ভালোরকম আর্থিক অনটন চলছিল। রবীন্দ্রনাথ যেদিন বাঁকুড়ায় এসেছিলেন (১ লা মার্চ ১৯৪০), সেই দিন কলকাতা কর্পোরেশন মাত্র ২৫০০ টাকা অনুদান মঞ্জুর করেন। কিন্তু বাংলা সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তার দশগুণ অর্থাৎ ২৫০০০ টাকা। অতএব বাঁকুড়া জেলা থেকেও যে কবির ভালোরকম অনুদান পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শ্রীমতী ঊষা হালদার অনুষ্ঠানের পর মাত্র ৬০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রাপ্তি স্বীকার করে তাঁকে চিঠিও লিখেছিলেন —” বিশ্বভারতীর তুলনায় এই টাকা সামান্য। কাজেই মনে হয় – এহ বাহ্য। ”

 ছাতনার চণ্ডীদাস না নানুরের চণ্ডীদাস —শতবর্ষকাল প্রাচীন এই বিতর্কের বিষয় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে বাঁকুড়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুষঙ্গ বিচার আজও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রবাসীতে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় চণ্ডীদাস প্রসঙ্গ এবং কিছু পত্র ব্যতীত আর কোথাও এ সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না। যদিও জনশ্রুতি আছে যে, বাঁকুড়া শহরে ‘চণ্ডীদাস চিত্রমন্দির ‘ – এই নামে একটি সিনেমা হলের নামকরণ কবি কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছিল। কিন্তু আদতে তেমন কোনো প্রামাণ্য নথি আজ অবধি উদ্ধার হয়নি। যদিও কবি তাঁর বাঁকুড়া সফরকালে উপর্যুপরি দু’ দিন (২ মার্চ ও ৩ মার্চ ১৯৪০) ঐ নির্মীয়মান প্রেক্ষাগৃহ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সভায় যোগদান করেছিলেন। তাই তাঁর এই জেলায় আগমনের সাড়ে আট দশক পরেও প্রাপ্ত নথিপত্রের বিচারশেষে একথা হলফ করে বলা যাবে না যে, রবীন্দ্রনাথ ছাতনার চণ্ডীদাসের অনুকূলেই মত প্রকাশ করেছিলেন। 

সহায়ক গ্রন্থ : 

১. বাঁকুড়ায় রবীন্দ্রনাথ : রবি দত্ত

২. বাঁকুড়ায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য : গৌতম দে 

৩. রবীন্দ্র জন্মসার্ধশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, বাঁকুড়া ও বাঁকুড়া জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ “ আমি তোমাদেরই লোক”।

৪. রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ প্রবন্ধ সংকলন হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, বাঁকুড়া জেলা কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ “ মনোভূমি বাঁকুড়া “ 

৫. বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র 

৬. প্রবাসী পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যা

৭. আত্মস্মৃতি : সজনীকান্ত দাস 

৮. আন্তর্জাল 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *