নোবেল প্রাপ্তির একশো দশ বছর ও রবীন্দ্রনাথ
নিশীথ ষড়ংগী
অ-শেতাঙ্গ,অ-ইউরোপীয়, উপনিবেশ-অধীন কবি রবীন্দ্রনাথ এশিয়া মহাদেশে প্রথম নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯১৩-র ৯ অক্টোবরে। সমগ্র ভারতবাসী তো অবশ্যই, বাঙালি হিসেবে এ গৌরব এক আশ্চর্য অর্জন। বাঙালির বিস্ময়কর মণীষার এক বিপুল প্রাপ্তি এই অভিধা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের একশত দশ বছর অতিক্রান্ত।আমাদের সৌভাগ্য রবীন্দ্র- স্মরণের এক মহার্ঘ্য সুযোগ তৈরি হয়েছে আমাদের সামনে। অগণিত রবীন্দ্র-অনুরাগীদের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও একথা বলা সম্ভবত অসঙ্গত হবে না যে, রবীন্দ্রনাথকে তো আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণের কার্নিভালের কথা মাথায় রেখেও এবং মঞ্চে মঞ্চে রবীন্দ্র-কবিতা এবং গানের প্রাচুর্য ও প্লাবন কে শিরোধার্য করেও বলতে দ্বিধা নেই যে, রবীন্দ্রনাথকে এখনও আমরা সত্যি সত্যিই হৃদয়ঙ্গম করতে চাইনি। অন্তত এই সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে আমরা মেধা ও মননের আর্কাইভ থেকে ডিলিট করে ফেলেছি। কিন্তু তাতে তো তাঁর নোবেল প্রাপ্তির ইতিহাস মুছে যায়না কখনওই! রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি লিখেছিলেন ১৯০৮-০৯ এ। তাঁর বয়স তখন প্রায় সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর। যথেষ্ট পরিণত তিনি । লেখা হয়ে গেছে আঠারোটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ এবং অন্যান্য আরও অনেক রচনা। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী,সন্ধ্যা- সংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, সোনার তরী, বিদায় অভিশাপ, চিত্রা, চৈতালি, কণিকা, কল্পনা, কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, স্মরণ, শিশু, উৎসর্গ, সাময়িক পত্র, খেয়া ও তারপর লিখেছিলেন গীতাঞ্জলি। বোঝার অসুবিধে নেই যে, তিনি পরিণত বয়সে এসে লেখেন গীতাঞ্জলি। এটি প্রকাশিত হয় ১৯১০-এর ৫ ই সেপ্টেম্বর । এর ঠিক পরেই লিখবেন গীতিমাল্য ও গীতালি এবং প্রায় সমসময়েই বলাকা কাব্যগ্রন্থ।
গীতাঞ্জলির বেশিরভাগ কবিতা, দেখা যাচ্ছে, তিনি লিখছেন শিলাইদহে বসে।যদিও বেশকিছু লেখা হয়েছিল কোলকাতা ও শান্তিনিকেতনে। এসময়ে কবি এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান এবং আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন যা তাঁর এখনকার লেখাগুলিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছিল। গীতাঞ্জলির এ সমস্ত কবিতাগুচ্ছ জীবন,প্রকৃতি ও ঈশ্বর অনুভূতির তীব্রতাকে অকল্পনীয়ভাবে স্পর্শ করে যাচ্ছিল।শুধু তাইনয়,তিনি তাঁর নিজস্ব আধ্যাত্মিকতাকেই প্রশ্ন করছিলেন যেন। প্রথমদিকে তাঁর অবলম্বন ও ঐতিহ্যের প্রতি এক বিরাগ ছায়া ফেলেছিল এ দুঃসময়। কিন্তু এই অন্ধকারময় অসময়ে তিনি ক্রমশঃ উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন।নতুন দার্শনিক ও সাহিত্যিক ভাবনায় ভাবিত হতে পারছেন। ধীরে ধীরে লেখালেখির অভ্যন্তরদেশে মগ্ন হচ্ছেন। এবং এই সজীব নতুনত্ব তাঁর অন্তর্লোককে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিচ্ছে। এসব লেখারই মধ্যবর্তী স্তরে, গীতাঞ্জলিতে অন্তর্ভুক্ত হবে পরে,এমন সৃষ্টিগুলিই সম্ভব হয়ে উঠছিল। মোদ্দাকথা, কবিতারচনায় মনপ্রাণ উজাড় করে দেবার এক মাহেন্দ্রক্ষণ যেন উপস্থিত হচ্ছিল তাঁর কাছে।কবিতাগুলোর মধ্যে প্রায় একইসঙ্গে তাঁর মহার্ঘ্য দুঃখবোধ ও সুগভীর আশাবাদ ঈশ্বরচেতনা ও আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। জীবনের তাৎপর্য, সান্নিধ্য ও উৎকর্ষের সন্ধান যেন কবিতার থিম ও চিত্রকল্পের মধ্যে হয়ে উঠেছিল আভাময়। তিনি নিজেও এরকম বলতে চেয়েছেন যে,গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি তাঁর যন্ত্রণার উপশম ও শুশ্রূষা। তাঁর অবরুদ্ধ আবেগের অবারিত প্রকাশের মুক্তদ্বার। তিনি এও অনুভব করছিলেন যে, এ লেখাগুলো যেন এক নতুন জীবন এনে দিচ্ছে তাঁর কাছে। যেন তাঁর শক্তি ও সৃষ্টিশীলতার পুনর্জন্ম ঘটছে। প্রভূত মানসিক কষ্ট, দুঃখবোধ ও অসহায়তার পাশাপাশি এসমস্ত সৃষ্টি র ভেতরে ভেতরে তাঁর আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা, সৃষ্টির পুনরুত্থান এবং শুশ্রূষা ও রূপান্তরের এক নির্দিষ্ট পথ
যেন তৈরি হয়ে উঠছিল। এতো অতল আধ্যাত্মবোধ ও দীপ্ত দর্শনচিন্তা এর আগে এতোখানি জায়গা করে নিয়েছে বলে মনে হয় না তাঁর জীবনে। গীতাঞ্জলির থিম ও চিত্রকল্পগুলি নিরবধি এবং অসীমের দিকে যাত্রী। লেখাগুলোর ভেতরে এমন সরল ভাষাব্যবহার,গঠনকৌশল ও মৌলিকতা এর আগে এতো স্পর্শময় হয়ে উঠেছে কিনা সন্দেহ। ১৮৮২ তে লেখা হয়েছিল সন্ধ্যাসংগীত, ১৮৮৩ তে প্রভাতসংগীত ও ১৮৯৬ তে
চিত্রা। কিন্তু এ সময়ে প্রেম প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতা যেন আরও ব্যক্তিগত,আরও রোমান্টিক,আরও মুখরবাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে, আরও পল্লবিত বৈচিত্র্যে ও স্টাইলে। একটা অন্যরকম মাত্রা, চেহারা ও রূপ ফুটে উঠছিল কবিতাশরীরে। অনেক পরিশীলিত ও সংহত তিনি। সুগভীর আধ্যাত্মবোধ,বিশ্বজনীনতা ও চিরন্তনতায় আধারিত। আগেকার রচনাগুলি থেকে একেবারে আলাদা এ সৃষ্টি — উদ্ভাবনমূলক, অভিনব, নতুন , সৃষ্টিমুখর।
খেয়া(১৯০৬) কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লেখার সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের মানসিক পরিবর্তনটি টের পাওয়া যাচ্ছিল। পার্থিব জগত থেকে ক্রমশই তাঁর মন এক গভীর অধ্যাত্মজগতে প্রবেশ করছিল। যেন রূপময় পৃথিবী থেকে অরূপের দিকে যাওয়ার সেতুটিই হলো খেয়া। বোঝা যাচ্ছিল, কবি ক্রমে গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি লেখার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন। গীতাঞ্জলিতে এসে এ অনুভূতির পরিপূর্ণতা। শুধু একাব্যই নয়,গীতিমাল্য ও গীতালি (১৯১৪)র সঙ্গীতধর্মী কবিতাগুলিতে ও এ মনোভাব স্পষ্টভাবে পরিবাহিত হয়েছে।১৯০৯এ রবীন্দ্রনাথ যখন প্রায়শ্চিত্ত নাটকটি লিখছিলেন, কিছু গান রচনার দরকার হয়েছিল নাটকের জন্য। সেই গানগুলিতে গীতাঞ্জলির বক্তব্য ও আরাধনার যোগ্য সমর্থন পাওয়া যায়। রবীন্দ্র-জীবনকাল কে যদি আমরা তিনটি পর্বে ভাগ করে নিই তাহলে প্রথমপর্বটি হবে – ১৮৬১-১৯০১,যার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর – ১৮৬১- ১৮৭৮ এবং যৌবন- ১৮৭৮- ১৯০১, মধ্যপর্ব–১৯০১- ১৯৩২ আর অন্তিম পর্ব- ১৯৩২- ১৯৪১, এই কাল খণ্ড। জীবনের সূচনা পর্বের বারো-তেরো বছর কবির প্রধান আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন নতুন বৌঠান।
রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনে অনিশ্চয়তা, দুঃখবোধ,বাধা ও বিপর্যয় ডালপালা বিস্তার করেছে।তা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। এই উত্তরণ ঘটেছে বিভিন্ন আশ্রয়ের মধ্য দিয়ে।ব্যথা ও বেদনার ভেতর দিয়েই তিনি চিনতে পেরেছেন হৃদয়ের সত্য ও সৌন্দর্যকে,শাশ্বত ঐশ্বর্যকে। আর আশ্রয় হয়ে উঠেছে কখনও নতুন বৌঠানের সান্নিধ্য, কখনও আধ্যাত্মিকতা, কখনও মানবিকতা, আবার কখনও জীবন দেবতা। আর সারাজীবনের আশ্রয় তো তাঁর গান।তারপর তাঁর কবিতা ও কবিতা। গীতাঞ্জলির কবিতাগুলির প্রধান আশ্রয় ছিল রবীন্দ্রনাথের গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং ব্যাপ্ত বিশ্ববোধ।তাই অপরিসীম দুঃখবিষাদ পেয়েছে অন্তর্লোকের স্পর্শের জন্য উন্মুখতা, পুঞ্জীভূতবেদনা পেয়েছে আত্মোপলব্ধির পরিসর, প্রেম হয়ে উঠেছে পূজা আর আরাধনা।
রবীন্দ্রনাথের মনোজগতের এই রূপান্তরের পেছনে কি পরমাত্মীয়ের বিয়োগ-বিধুরতা কোনওভাবে ছায়া ফেলেছিল? ১৯০২-র২৩শে সেপ্টেম্বর মারা গেলেন পত্নী মৃণালিনী দেবী। ১৯০৩- র ১৯ শে সেপ্টেম্বর প্রিয় কণ্যা রেণুকা (রাণী)কে হারালেন রবীন্দ্রনাথ।১৯০৫-র ১৯ শে জানুয়ারী প্রয়াত হলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ।১৯০৭-র ২৩ শে নভেম্বর অকালে চলে গেলেন নাবালকপুত্র শমীন্দ্র। তাই ,পরিবারের প্রিয়জনদের মৃত্যুজনিত বিপর্যয় ও শোকের এই আবহে ভারাক্রান্ত ছিল রবীন্দ্রহৃদয়। প্রিয় হারানোর বিচ্ছেদ, তাঁকে সম্ভবত এক বেদনাময় উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল। পরিণামে মানসিক নির্ভরতা,ঈশ্বর চেতনা, গভীর আধ্যাত্মিকতা,বিশ্ববোধ ও দুঃখময়নির্জনতা হয়তো তাঁর শেষআশ্রয় হয়ে উঠেছিল এ সময়ে। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথ,পুত্র রথীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যার পাঠ নেবার জন্য। সেটি ছিল ১৯০৬। ১৯০৭এ নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ছোট জামাই কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন সেখানে। এদিকে, তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে তখন চলছিল শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়। পুত্র এবং জামাইয়ের পড়াশোনার বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথকে।এই মানসিক চাপকেও কোনও ভাবেই আমাদের এড়িয়ে যাওয়া চলে না তাই।এতোগুলো মৃত্যুর অভিঘাত তীব্র অনুভূতিশীল রবীন্দ্রনাথকে একেবারেই স্পর্শ করবে না, তা সম্ভব বলে মনে হয় না।
কিন্তু নোবেল প্রাপ্তির গৌরবময় অনুসঙ্গে এসব আলোচনার যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে নেই বলেই মনে হয়। তবু, যে রত্নগর্ভা গ্রন্থটি (Song Offerings)বিশ্ববিজয় সম্ভব করে তুলেছিল, সে সময়ের ইউরোপের বিশিষ্ট ইন্টেলেকচুয়ালদের বোধ ও হৃদয়কে অভিভূত করেছিল, তার সৃষ্টির নেপথ্যভূমি আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু না হয়ে উঠতে পারে না।
১৯১২-র প্রথম দিক। লণ্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর কথা রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু অসুস্থতা(নার্ভাস ব্রেকডাউন, মতান্তরে অর্শপীড়া)র জন্য চিকিৎসকের,পূর্ণ বিশ্রাম গ্রহণের পরামর্শে, সাময়িক বিরতি ঘটলো এ যাত্রার। শিলাইদহের পদ্মার হাওয়া – বাতাসে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য এখানেই অবস্থান করলেন কবি।যদিও ১৬ ই জুন, ১৯১২ তে যথারীতি লণ্ডন পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি, সুস্থ হওয়ার পর। যাইহোক, এই নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্রামের পরিসরটিকে তিনি ভরিয়ে তুলে ছিলেন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে।”এসব কবিতা বাবার শুধু অনুবাদ নয়, বাবার তৎকালীন মনের ভাব ফুটে উঠেছে কবিতার ছত্রে ছত্রে। এগুলো নিছক অনুবাদ নয়, শিলাইদহের জমিতে নতুন সৃষ্টির ফসল”– এরকমই লিখেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্রনাথ নিজে কী লিখছেন? ভাইঝি ইন্দিরাকে বিদেশ থেকে চিঠির উত্তরে জানাচ্ছেন —
“গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমার কথা লিখেছিস, ওটা যে কেমন করে এত ভালো লেগে গেল, সেকথা আমি আজ পর্যন্ত ভেবেই পেলুম না। তখন চৈত্র মাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকা-ডাকিতে দিনের বেলাকার সকল ক’টা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল।… আমি আমার সমস্ত মন দিয়ে, আমার সমস্ত ছুটি দিয়ে,চৈত্র মাসটিকে যেন জুড়ে বসলুম– তার আলো, তার হাওয়া,তার গন্ধ, তার গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না..গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে এক একটি করে ইংরেজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম।… একটি ছোট খাতা ভরে এল..।”
কিন্তু বাংলা গীতাঞ্জলির অনেক কবিতাই ইংরেজি অনুবাদে সরিয়ে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। গান ও কবিতা অথবা কবিতা/গান মিলিয়ে ১০৩ টি রচনার ইংরেজি অনুবাদ রাখলেন Song Offerings এ।বাংলায় লেখা
গীতাঞ্জলি থেকে পছন্দ করলেন ৫১টি। গীতিমাল্য থেকে ১৭ টি, নৈবেদ্য থেকে ১৬ টি, খেয়া থেকে ১১টি,শিশু থেকে ৩টি, এবং চৈতালি, স্মরণ, কল্পনা, উৎসর্গ ও অচলায়তন নাটক থেকে ১ টি রচনা নিয়ে প্রস্তুত হলো Song Offerings।
এই কাজটি অর্থাৎ শুধু গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি না নিয়ে তিনি কেন অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের কবিতা অনুবাদের দিকে হাত বাড়ালেন ? এর সরাসরি উত্তর হয়তো পাওয়া মুশকিল। আমাদের মনে হয় এ কাজটি তিনি করেছিলেন অনেকগুলি প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে। সম্ভাব্য প্রথম কারণটি হলো এমন সব প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা সং অফারিংস এ থাকবে যা তাঁর কবিতার বিভিন্ন থিম ও স্টাইলকে পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ করবে। তাঁকে চিনতে সুবিধে হবে।
দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত এমন হতে পারে যে, বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সংগ্রহ করে তিনি সমন্বয় ও ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি-ফলন কে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো
এও ভেবেছিলেন যে, গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি বুঝতে গেলে এর প্রসঙ্গ এবং পটভূমিকেও জেনে নেওয়া জরুরি। সেজন্যই তিনি গীতাঞ্জলির পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থ খেয়া, উৎসর্গ, শিশু, স্মরণ, কল্পনা থেকে কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন।১৯১১ তে প্রকাশিত অচলায়তন নাটকের গানগুলিকেও ভাবের উপযুক্ততার জন্য হয়তো তিনি নির্বাচন করে থাকবেন। তিনি হয়তো সেই সমস্ত কবিতাগুচ্ছ নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন যা তাঁর মূলরচনা নির্বিশেষে তাঁরলেখার সাহিত্য ও শিল্প মূল্যটির প্রকৃত উপলব্ধির সহায়ক হয়ে উঠবে।এসবই অনুমান সাপেক্ষ, তাই বিনীতভাবে আমরা শুধু এর সম্ভাবনাটুকুকে উস্কে দিলাম মাত্র।
খেয়া, উৎসর্গ, শিশু, স্মরণ, কল্পনা এবং অচলায়তন থেকে কী কী কবিতা/গান সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর Song Offeringsর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন এবং ভাবের দিক থেকে তা কতো সুসমঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তার আলোচনা সঙ্গত ছিল এখানে। কিন্তু স্থানাভাব ও রচনার বিস্তৃতির জন্য সেসব পরিহার করতে হলো এ প্রসঙ্গে।
১৯১২-র ২৪ মে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদটি সঙ্গে নিয়ে পুত্র রথী ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী সহ লণ্ডন যাত্রা করলেন। পৌঁছালেন ১৬ জুন। রবীন্দ্রনাথের বিদেশযাত্রা এই প্রথম নয়, এর আগেও তিনি
বিদেশ ভ্রমণে এসেছেন। দেখা যাচ্ছে, ১৮১৮ থেকে ১৯৩২অব্দি পাঁচটি মহাদেশের প্রায় ত্রিশটিরও বেশি দেশে তাঁর উপস্থিতিসম্ভব হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৭৮ ও ১৮৯০ তে তিনি ইংল্যান্ডে এসেছেন। এবারে অর্থাৎ তৃতীয়বারের এই ইংল্যান্ড ভ্রমণ,জানা যায়, একান্তই ব্যক্তিগত –নিজের চিকিৎসার জন্য।সঙ্গত– কেননা এই সদ্যই কবি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।যদি তা-ই হয়, তবে গীতাঞ্জলির অনুবাদটি তাঁকে সঙ্গে নিতে হচ্ছে কেন? তবে কি তিনি জানতেন,১৯১৩ তে বসবে সুইডিশ একাডেমি, নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করবে সাহিত্যক্ষেত্রের যোগ্যতম কোনও ব্যক্তিত্বকে? তাই কি তিনি দিনের পর দিন ইংরেজি তর্জমায় নিজেকে এভাবে নিয়োজিত করেছিলেন? আমরা তার বদলে অন্য একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করি। শিল্পী এবং লেখক অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকো শিল্প সংগ্রহশালা দেখার জন্য কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে এসেছিলেন লণ্ডনের প্রখ্যাত চিত্রকর উইলিয়াম রোথেনস্টাইন(Rothenstien)। সেটি ছিল ১৯১১ র জানুয়ারি মাস। সে সময়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ইংরেজি মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের অনূদিত পোষ্টমাস্টার গল্পটি পাঠ করে রোথেনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি মাসকয়েক কোলকাতায় ছিলেনও। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথকে লণ্ডনের খ্যাতনামা পত্রিকা দ্য টাইম, নেশন, ম্যাক মিলান প্রভৃতি প্রকাশনা সংস্থায় তাঁর অনুবাদিত রচনা প্রকাশের অনুরোধ জানান। কোলকাতায় রোথেনস্টাইনের অবস্থানকালে নিশ্চয়ই শিল্প সাহিত্য বিষয়ে নানান চিন্তাভাবনা বিনিময়ের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠেছিলো। রোথেনস্টাইনের পক্ষ থেকে একটি অনুরাগ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক বড়ো হয়ে উঠেছিল হয়তো স্বাভাবিকভাবেই। রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ ও নির্ভরতা এতোটাই প্রবল ছিল যে, পরে তিনি Song Offerings কাব্যগ্রন্থটি রোথেনস্টাইনকে উৎসর্গ করেছিলেন, ডব্লিউ বি ইয়েটস কে নয়। সেই তিনিই যে লণ্ডনের বাসভবনে রোথেনস্টাইনকে স্বকৃত অনূদিত একশো তিনটি গান/কবিতা সম্বলিত Song Offerings এর পাণ্ডুলিপিটি পরে তাঁর হাতে তুলে দেবেন — এতে আশ্চর্যের হয়তো কিছুই নেই। শুধু কি তাই! কবির কাছে এতোখানি প্রিয়, বিশ্বাসভাজন ও বিশেষ অবলম্বন হয়ে ওঠার পেছনে কি আরও কোন ও গভীর বন্ডিং কাজ করেছিল? এটাতো ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথ লণ্ডনে গিয়ে প্রথমেই যাঁর কাছে তাঁর অনুবাদটি তুলে দিয়েছিলেন,তিনি আর কেউ নন, তিনি শিল্পী রোথেনস্টাইনই। The Fortnightly Review পত্রিকায় Rabindranath Tagore in London শিরোনামে কী লিখছেন রোথেনস্টাইন, একবার দেখে নিই আমরা —
“I happened in the Modern Review, upon a translation of a story signed Rabindranath Tagore, which charmed me.I wrote to Jorasanko — were other such stories to be had? Sometime afterwords came an exercise book containing translation of poems by Rabindranath, made by Ajit Chakraborty, a schoolmaster on the staff of Bolpur.The poems of highly mystical character, strack me as being still more remarkable than the story though but rough translation. Meanwhile I met one of the Kooch Behar family, Promotto Lal Sen,a saint man, and a Brahmo course.He brought to our house Dr.Brajendranath Seal,then on a visit to London,
a philosopher with a brilliant mind and a child-like character.They both wrote Tagore,urging him to come to London; he would meet,they said at our house and elsewhere, men after his heart.Then news came that Rabindranath was on the way.I eagerly awaited his visit.At last he arrived, accompanied by two friends,
and by his son.As he entered the room he handed me a note-book in which,since I wish to know more of his poetry, he had made some translations during his passage.”
আমরা ভেবেছিলাম জোড়াসাঁকোয় অবস্থানকালে রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে তৃপ্ত ও আপ্লুত, বিস্মিত ও আনন্দিত রোথেনস্টাইনের স্বতঃপ্রণোদিত আমন্ত্রণে তিনি লণ্ডন যাত্রা করেছিলেন। পরস্পরের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব ও গুনগ্রাহিতা সেরকম অবকাশই তৈরি করেছিল। কিন্তু উইলিয়াম রোথেনস্টাইনের (১৮৭২-১৯৪৫) এ লেখাটি সে সাক্ষ্য দেয়না।আর during his passage বলতে আমরা বুঝবো যে, লণ্ডনগামী জাহাজে বসেও রবীন্দ্রনাথ বেশকয়েকটি কবিতার অনুবাদ গীতাঞ্জলির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।
।। দুই।।
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখাটি (জানু, ১৯১১) কীভাবে রোথেনস্টাইন স্মরণীয় করে রেখেছেন , তাঁর লেখা ‘Men and Memories’ গ্রন্থে, একবার তা পড়ে নিই আমরা —
“জোড়াসাঁকোয় গেলে প্রত্যেকবারই দেখতে পেতাম তাঁদের পিতৃব্যকে। আশ্চর্য সুদর্শন পুরুষ,ধুতি ও চাদরে শোভমান। আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে নীরবে বসে থাকতেন। তিনি যে সেই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য,এসম্বন্ধে কেউ আমাকে কিছুই বলেননি। আমি তাঁর ছবি আঁকতে চাইছিলাম কারণ তাঁর অবাক করা শারীরিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর অন্তর্লোকের একটু একটু আভাস পাচ্ছিলাম, সেটি পেন্সিল দিয়ে কাগজের উপরে ফোটাবার জন্য অধীর হয়ে উঠছিলাম।” এখানে তাঁদের বলতে যে, অবনীন্দ্র ও গগনেন্দ্রনাথকে বোঝানো হচ্ছে, সুধী পাঠকদের তা বলে দিতে হয়না।
যাইহোক, লণ্ডন ফেরার আগেই, অজন্তা মাউন্ট আবু রাজস্থান বারাণসী ঘুরে কোলকাতাকে বিদায় জানানোর প্রাক্কালে ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে চিঠি লিখছেন রোথেনস্টাইন।কী লিখছেন এই চিঠিতে দেখে নিই–
” আপনি জানেন না আপনার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে কী তীব্রভাবে চেয়েছিলাম –কাটাতে না পেরে এক গভীর দুঃখবোধ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আমি! আপনাকে আমি সর্বদা সম্মান করব; আশা করব, মাঝে মাঝে চিঠি লিখলে আপনি বিরক্ত হবেন না, এবং অনুগ্রহ করে আমাকে স্মরণে রাখবেন। আপনার যে কোন কবিতা অথবা গল্পের অনুবাদ, যখনই বের হবে,তা পেতে আমিও উৎসুক হয়ে থাকব। প্রায়ই আপনার কথা ভাবব আমি– মনে রাখব,আপনাদের গৃহে আমিস্বাগত ছিলাম, সেই আমার বিরল সৌভাগ্যের কথা।” রবীন্দ্রনাথের সুমধুর ব্যক্তিত্ব, উষ্ণ আতিথেয়তা,গভীর আত্মীয়তা, সবথেকে বড়োকথা, তাঁর অসাধারণ এক অনুভূতিপ্রবণমন হয়তো চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে ছিল রোথেনস্টাইনকে। প্রথম স্টেটমেন্টের থেকে পরের চিঠিতে কমে এসেছে সম্পর্কের দূরত্ব। সুদূরতা মুছে গিয়ে ক্রমশ এক আশ্চর্য স্পর্শের স্পন্দন টের পাচ্ছেন এই বিদেশি চিত্রকর– মুগ্ধ, বিস্মিত, তৃপ্ত আর অভিনন্দিত। বুঝতে বাকি থাকেনা,কেন রবীন্দ্রনাথ এ মানুষটিকেই বেছে নেবেন না, তাঁর পরম সুহৃদ আর অনুপম অবলম্বন ও সহায় হিসেবে। কেন তুলে দেবেন না তাঁর হাতে,নিজের অক্লান্ত আয়াসের এ শস্যসম্ভারটিকে? আমরা সবাই জানি এ তথ্য যে, রোথেনস্টাইন শুধু একজন সৃষ্টিশীল চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন
বিশ্বখ্যাত ইংরেজ মুদ্রণকার, ড্রাফটম্যান, প্রভাষক আর লেখকও। ১৯০২ থেকে ১৯১২ এ সময়কালে, তিনি থাকতেন লণ্ডনের হ্যাম্পস্টেড-হীথে। প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস, ঔপন্যাসিক জোসেফ কনরাড এবং শিল্প অগাস্টাস জন প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে।উইন্ডহাম লুইস,মার্ক গারটলার,পল ন্যাশের মতো তরুণ শিল্পীরা এখানেই তাঁর সান্নিধ্য পেতেন। প্রাচ্যের, বিশেষ করে
ভারতীয় শিল্পকলার প্রতি তাঁর ছিল সুগভীর অনুরাগ।
The Fortnightly Review তে রোথেনস্টাইন আর কী লিখছেন দেখুন —
“That evening I read the poems.Here was poetry of a new order which seemed to me on a level with that of the great mystics. Andrew Bradley, to whom I showed them, agreed : ‘It looks as though we have at last found a great poet among us again,’he wrote.
I sent word to Yeats, who failed to reply, but whom I wrote again he asked me to send him the poems, and when he had read them his enthusiasm equalled mine.He came to London and went carefully through the poems, making here and there a suggestion, but leaving the original little changed.”
আসলে, ১৬ জুন লণ্ডনে পৌঁছে রথী ও প্রতিমাসহ কবি উঠেছিলেন সেখানকার ব্লুমসবেরি হোটেলে।তারপর রোদেনস্টাইনের বাড়িতে গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে তুলে দেবার ঘটনাটিতো ওপরের লেখা থেকে অবগত হয়েছেন সুধী পাঠক।রোদেনস্টাইন যে অসাধারণ তৎপরতায় অনূদিত গীতাঞ্জলির ব্যাপক পরিচিতির উদ্যোগ নিয়েছেন, এককথায় অভূতপূর্বতা।
এ সময়কার লণ্ডনের সাহিত্যপরিমন্ডলটি কেমন ছিল একবার তা খুব সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নিতে ইচ্ছে হয় আমাদের। লক্ষ্যকরা যায় যে,সমকালীন লণ্ডনের সাহিত্যক্ষেত্রটি ছিল প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময়।
*সে সময়ে Rupert Brooke, Harold Monroe এবং William Butler Yeats- র নেতৃত্বে জর্জিয়ান কবিতাআন্দোলন যথেষ্ট গতি পেয়েছিল। চিরায়ত ফর্ম, প্রকৃতি ও রোমান্টিসিজমের ওপর ভর দিয়ে গড়ে উঠেছিলো এ আন্দোলন।
- প্রধানত T E Hulme এবং Ezra Pound – এর নেতৃত্বে ইমাজিজম্ (কল্পনাবাদ)-এর মতো মডার্নিস্ট মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল এসময়ে। তাঁরা জোর দিয়েছিলেন স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত ভাষা, সুনির্দিষ্ট চিত্রকল্প এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর।
- Walter Pater ও Oscar Wilde – এর অনুপ্রেরণায় Aesthetic Movement ব্যাপ্তি পেয়েছিল এ সময়ে।এ আন্দোলন শিল্প সৌন্দর্য ও ব্যক্তিপ্রাধান্যকে গুরুত্ব দিয়েছিল।
- গ্লোবালাইজেশনের উদ্ভবের ফলে লণ্ডন— ফরাসী সিম্বলিজম্, রুশ সাহিত্য (Tolstoy,Dostoevsky) ও ভারতীয় দর্শন (বেদান্ত, আধ্যাত্মিক জ্ঞান) প্রভৃতির প্রভাবকে, আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক আত্মস্থ করতে চাইছিল।
- The Egoist,The New Age,The PoetryReview এর মতো বিভিন্ন সাহিত্য ম্যাগাজিন সেসময়ে প্রকাশ পেয়েছিল। উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড, সাহিত্যের সম্প্রদায়গত বোধের লালন-পালন এবং বিতর্কসভার আয়োজন প্রভৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল এই ম্যাগাজিনগুলি।
আমরা এটুকু জেনে নিতে চেয়েছি এজন্যই যে, এই গতিশীল এক ল্যান্ডস্কেপ-এ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, এর ভারতীয় মিস্টিসিজম্-এর অনন্য মিশ্রণ, লিরিক কবিতা এবং আন্তর্জাতিক থিমকে সঙ্গী করে, সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে নিতে পেরেছিল কীভাবে — তাকেই উপলব্ধি করার অভিপ্রায়ে। এসব সত্বেও, রোথেনস্টাইনের আন্তরিক পর্যটন যে
ইংল্যান্ডের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদিত সৃষ্টি-টি
কে জল হাওয়া ও তাপ দিয়েছিল, ঐতিহাসিকভাবে
তা, এতোটাই স্বীকৃত যে, তাতে দ্বিমতের কোনও স্থান ই নেই।
আসছি এসব আলোচনায়। তবু বারেবারেই কেন মনে
হচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদ সম্ভবত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুধু কি রোথেনস্টাইন? তিনি নিজে অথবা অন্য কেউ কি তাঁর সৃষ্টির তর্জমার
প্রয়োজনীয়তা অনুভবে আনেন নি? মনে হয়নি কখন
ও যে, বিশ্বজনীন আবেদনে ভরা তাঁর কবিতা, গান
বা অন্য কোনও রচনা অনুবাদিত হয়ে আন্তর্জাতিক হোক? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের পাঠযোগ্যতা
পাক? রবীন্দ্রনাথ তাহলে, নিজের কবিতাকে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদের কথা ভাবলেন কেন? খুঁজতে গিয়ে কি দেখতে পাওয়া যাবে কোনও সূত্রের?
অনূদিত গীতাঞ্জলির সময়কাল থেকে বেশ কিছুটা
পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের।১৮৯০ সাল। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর নিজের একটি কবিতা অনুবাদ করছেন স্বয়ং। কবিতাটির নাম ‘নিষ্ফল কামনা’। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘মানসী’। পুরোটা অনুবাদ নয়– বিচ্ছিন্ন কিছু। সম্ভবত
এই অনুবাদই তাঁর প্রথম নিজের কবিতার অনুবাদ। বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু, যাঁকে তিনি কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর একটি চিঠি–
রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লেখা।২রা নভেম্বর ১৯০০
সাল। লিখছেন লণ্ডন থেকে কবিকে। কী লিখছেন?
” তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিবে, আমি তাহা হইতে
দিব না। তুমি তোমার কবিতাগুলি কেন এমন ভাষায়
লিখ যাহাতে অন্যভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব? কিন্তু তোমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব…আর ভাবিয়া দেখিয়ো তুমি সার্বভৌমিক।”
কথা রেখেছিলেন জগদীশ। কিন্তু তাঁর অনূদিত ছয়টি
রবীন্দ্র-গল্প ইংল্যান্ডের সেসময়ের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হার্পারস ম্যাগাজিন-এ পাঠালে তা প্রত্যাখ্যাত হয় এই কারণ দেখিয়ে যে, এগুলি অরিজিন্যাল নয়।
আরও বলা হলো যে, The West was not sufficiently interested in oriental life।রবীন্দ্রনাথ
উত্তরে জগদীশচন্দ্র কে কী লিখেছিলেন তা জানাটা
খুব জরুরী আমাদের কাছে। তিনি লিখছেন —
” আমার রচনা -লক্ষ্মীকে তুমি জগৎ- সমক্ষে বাহির করিতে উদ্যত হইয়াছ — কিন্তু তাহার বাঙ্গালা ভাষা-
বস্ত্রখানি টানিয়া লইলে দ্রৌপদীর মত সভাকক্ষে তাহার অপমান হইবে না?”
টেরপাই আমরা, রবীন্দ্রনাথ তখনও পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টির
অনুবাদের বিষয়ে যথেষ্ট সঙ্কুচিত এবং যেন অনিচ্ছুক
ও।১৯০৯ এ আবার একটি উদ্যোগের সংবাদ পাওয়া
যাচ্ছে। রবি দত্ত। তখন তিনি বিদেশে পাঠরত এক ছাত্র।কবির এগারোটি গান ও কবিতার অনুবাদ করে-
ছেন।নাম দিচ্ছেন সে সঙ্কলনের Echoes from East
and West(কেমব্রিজ: গ্যালওয়ে এবং পোর্টার,১৯০৯
)।বিরলতম একটি বই, মীরা চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র–
রচনার অনুবাদসূচীতে যা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
আবার,অজিত চক্রবর্তী কবির বেশ কয়েকটি কবিতা
র অনুবাদ পাঠাচ্ছেন এডওয়ার্ড কার্পেন্টারকে। তার
সঙ্গে একটি চিঠিও জুড়ে দিচ্ছেন —
All I can do is to give a rough-translation… which someone must whip up into proper shape.
দুঃখের হলেও সত্যি যে, সে অনুবাদও যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হয়। মোটকথা,১৮৯০ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত রবি দত্ত,লোকেন পালিত,অজিত চক্রবর্তী, আনন্দ কুমার স্বামী ,ভগিনী নিবেদিতা, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অন্য কারও হাত ধরে বিক্ষিপ্তভাবে রবীন্দ্র-সৃষ্টির অনুবাদ হয়েছে। পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ কাজে ব্রতী হয়েছেন। আরও একজন বিশিষ্ট মানুষের কথা এ প্রসঙ্গে না উল্লেখ করলেই নয়।তিনি হলেন সুকুমার
রায়। তিনি তখন লণ্ডনে। বিদেশে পৌঁছেছেন ১৯১১
তে। LCC School of Photo Engraving and Lithography –র বিশেষ ছাত্র। তাঁর নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘The Spirit of Rabindranath’ পাঠ করলেন
East and West Society-র আহ্বানে। সঙ্গে কবির
কিছু কবিতার স্বকৃত অনুবাদও (সুকুমারের নিজের করা)। তারিখটি ছিল ১৯১৩-র ২১ জুলাই। সেগুলি
সেখানকার Quest পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। লণ্ডনে তখন রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করছিলেন। রবিজীবনী কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন —
“ইহাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভারতীয়দের পক্ষে
প্রথম পাবলিক ভাষণ।”
শুধু কি তাই,রবীন্দ্রনাথের ‘সুদূর’,’পরশপাথর’,’সন্ধ্যা’ ইত্যাদি কবিতা (সুকুমারের অনুবাদে) পাঠ করে
শুনিয়েও ছিলেন লণ্ডনে উইলিয়াম পিয়ারসন-র বাড়ি
তে এক ঘরোয়া বৈঠকে। সালটি ছিল ১৯১২-র ১৯ জুন। অন্যতম অতিথি ছিলেন Wisdom of the East- র সম্পাদক ক্র্যানমার বিং।
এতো কথা লিখতে হলো এজন্য যে, অকালপ্রয়াত,
প্রতিভাসম্পন্ন এ মানুষটিকে অন্তত রবীন্দ্র-অনুবাদক (অকিঞ্চিৎকর কেউ কেউ ভাবলেও) হিসেবে, না-কবি,
না–ইতিহাস, কারোর কাছেই হয়তো সেভাবে মান্যতা
পান নি সুকুমার। বলা বাহুল্য, এমনকি রবীন্দ্রনাথও
সুকুমারের এই কবিতা পাঠের সময় স্বয়ং উপস্থিত।
আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ হয়তো ধীরে ধীরে
উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর সৃষ্টি পরিচিত পেতে পারে একমাত্র অনুবাদের ভেতর দিয়েই।আর তা হবে ইংরেজিতে এবং ইংরেজি
তেই। কিন্তু কবিতা বা গান কি সত্যিই অনুবাদযোগ্য,
প্রকৃতভাবে? বিশেষকরে, রবীন্দ্রনাথের নিজের গান
বা কবিতার ভাব-তন্ময়তা ও সৌন্দর্যবোধ কি তুলে আনা সম্ভব অনুবাদে?তর্জমা প্রসঙ্গে একবার নিজেই
বলেছিলেন কবি —
“a poem can not be translated, it can be re-
lived in a different atmosphere”.
রবীন্দ্রনাথের মনোজগতে এ বিষয়ে দ্বিধা তো ছিলই।
আর তাই কি তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির কবিতা/গান
-র নির্যাসটুকুই অনুবাদ করে উঠতে চাইছিলেন? তাই
কি তাঁর পথ গদ্য-অনুবাদের পথ?
রোথেনস্টাইন আর কী জানাচ্ছেন আবারও একবার
জেনে নিই আমরা —
“For a long time Yeats was occupied with Tagore: ‘I have been writing lyric poetry in Normandy.I wish I could have got down to you for I find Tagore and you are a great inspiration in my own art.Thank you for asking me ‘,he said in a letter.”
আরও সাঙ্ঘাতিক কথা লিখছেন রোথেনস্টাইন–
” Tagore’s dignity and handsome presence,
the ease of his manners and his quiet wisdom made a marked impression on all who met him, one of his first persons whom Tagore wanted to know was Stopford Brooke; for Tagore,being a prominent number of the ,Brahmo Samaj , which was closely allied to Unitarianism, he heard so much of him and of Estlin Carpenter.Stopford Brooke
asked me to bring Tagore to Manchester Square; ‘ but tell him,’ he said,’that I am not a
spiritual man’. I think the dear old man with love of beautiful surroundings and of the good things of life,was a little nervous of Tagore’s purity and asceticism as it appeared
to him ; and when he sat down at the Brooke’s generous table though the talk might be of angles ,Stopford must be true to himself.’you and I,’he said to my wife,’are going to drink champagne.”
শুধু গীতাঞ্জলিই সব নয়, dignity and handsome presence, the ease of his manners and his quiet wisdom made a marked impression on all who met him — কী আশ্চর্য,কী বিস্ময় লিখছেন
রোথেনস্টাইন! এরকমই, প্রায় একইরকম বিস্ময়ই দেখবেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো,কবির অনিন্দিত, অ-
পরাহত সৌন্দর্যকে–অনেক, অনেকদিন পর।
।। তিন।।
৩০ জুন,১৯১২। রোথেনস্টাইনের লণ্ডনের বাসভবন। ইয়েটসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইংরেজিতে অনূদিত গীতাঞ্জলিপাঠের সান্ধ্যকালীন ঐতিহাসিক আয়োজন ,যেন সত্যিই নক্ষত্র সমাবেশ। আর্নেস্ট রীজ, এজরা পাউন্ড, চার্লস ট্রেভেলিয়ন, আন্ডারহিল, হেনরি নেভিনসন, চার্লস ফ্রিয়ার, অ্যালিস মেনেল,সি. এফ. এন্ড্রুজ সহ আরও অনেক সাহিত্যিক- সাহিত্যপ্রেমী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই সন্ধ্যার আশ্চর্য অনুভূতি কে অনুপম শব্দবন্ধে স্মরণীয় করে রেখেছেন আমাদের জন্য —
” রোথেনস্টাইনের বাড়িতে ইয়েটস সেদিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সভার আয়োজন করলেন গীতাঞ্জলি
শোনাবার জন্য।সে যে কি সংকোচবোধ করেছিলাম বলতে পারিনে। বারবার বলছি কাজটা ভালো হবে না
ইয়েটস শুনলে না কিছুতে। অদম্য সে, আয়োজন করল।বড় বড় সব লোকেরা এলেন, হল গীতাঞ্জলি পড়া।কারও মুখে একটি কথা নেই — চুপ করে শুনে, চুপচাপ সব বিদায় নিয়ে চলে গেল — না কোন সমালোচনা,না প্রশংসা,না উৎসাহসূচক একটি কথা। লজ্জায়,সংকোচে আমার তো মনে হতে লাগল ধরণী
দ্বিধা হও।কেন ইয়েটসের পাল্লায় পড়ে করতে গেলুম এ কাজ। তার পরদিন থেকে আসতে লাগল চিঠি, উচ্ছ্বসিত চিঠি, চিঠির স্রোত, প্রত্যেকের কাছ থেকে চিঠি এল একেবারে অপ্রত্যাশিত রকমের। তখন বুঝলুম সেদিন ওরা এত মুভড হয়েছিল যে কিছু প্রকাশ করতে পারেনি।ইংরেজরা সাধারণত একটু চাপা, তাদের পক্ষে তখনই কিছু বলা সম্ভব ছিল না। যখন চিঠিগুলি আসতে লাগল কি যে আশ্চর্য হয়েছিলুম ,এত আমি প্রত্যাশাও করিনি, কল্পনাও করিনি। বন্ধু ইয়েটস খুব খুশি হয়েছিল”।
পুত্র রথীন্দ্রনাথও পিতার কথারই প্রায় পুনরাবৃত্তি করেছেন তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’গ্রন্থে। সেদিনের ঐতিহাসিক
সন্ধ্যার অভিঘাত যে কতোটা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল ও
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তার তরঙ্গ যে বিপুল প্লাবনে ভরিয়ে তুলেছিল তার পরিচয় অজ্ঞাত নয়। বেশ কিছু সময় পরে Song Offerings মুদ্রিত হয়ে বেরোবে লণ্ডনের India Society থেকে। যার প্রধান উদ্যোগে থাকবেন রোথেনস্টাইন এবং ভূমিকা লিখে দেবেন ইয়েটস । সবাই জানেন, এই সোসাইটি ঠিক প্রকাশনা সংস্থা নয়, অ্যাসোসিয়েশন জাতীয়। জনাকয়েক ইং- রেজ ও ভারতীয় মিলে লণ্ডনে তৈরি করেছিলেন এই সোসাইটি যার অন্যতম মুখ্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন
উইলিয়াম রোথেনস্টাইন। শেষ পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১২-র ১ নভেম্বর। যাইহোক, এতোকিছুর পরে ব্রিটেনের কবি ও সাহিত্যিক এবং সরকারী স্তরে Song Offerings- র প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, জানতে ইচ্ছে হয় খুব আমাদের।
দুর্ভাগ্যই বলতে হয় একে যে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের এ সম্পর্কে কোনও প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্য নেই। তাঁরা আগাগোড়া ছিলেন নীরব। সেখানকার সাহিত্যজগৎ বরং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সাদর আমন্ত্রণে দ্বিধাহীন ছিলেন। সে সময়ে ইংল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকরা হলেন —
কবি
……
উইলিয়াম ইয়েটস (১৮৬৫- ১৯৩৯)– বিখ্যাত আইরিশ
কবি,নাট্যকার এবং রাজনীতিবিদও।রবীন্দ্রকবিতাকে
পশ্চিমে বিস্তৃত করার কাজে তাঁর নাম সর্বজনস্বীকৃত।
এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২)–আমেরিকায় জন্মানো
ব্রিটিশ কবি,সমালোচক ও একজন বুদ্ধিজীবী।পশ্চিম
-র আভাগাঁ(avant-garde)দের কাছে রবীন্দ্রনাথকে
পরিচিত করানোর উল্লেখযোগ্য কাজটি করেছিলেন যিনি।
Arthur Symons (১৮৬৫-১৯৪৫), Ernest Phys (১৮৫৯-১৯৪৬), Laurence Binyon (১৮৬৯-১৯৪৩)
–এঁরা ইয়েটসের বন্ধুস্থানীয় ও সহমর্মী।রবীন্দ্র-প্রতিভা
-মুগ্ধ।
শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব ও সমালোচক
……………………………………..
William Rothenstein (1872-1946)– একজন আর্টিস্ট, লেখক ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, যিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
E.J.Thompson(1886-1946)– একজন ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী ও কবি, যিনি ভারতীয় সাহিত্য ও রবীন্দ্র-
সৃষ্টির আলোচক।
এছাড়াও সেসময়ে (১৯১২তে যখন রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি -Song Offerings-প্রকাশিত হয়)
ব্রিটেনের সাহিত্যজগতের দিকপাল এবং রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েটসের সমসাময়িক ছিলেন, তাঁরা হলেন —
কবি
……..
Rupert Brooke (1887-1915), Walter de- la Mare (1873-1956), John Masefield (1878-1967), Robert Bridges (1844-1930), Laurence
Binyon (1869-1943).
শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব ও সমালোচক
……………………………………..
Arthur Symons (1865-1945), Ernest Rhys (1859-1946),T.E.Lawerence(1888-1935),E.M.
Forster (1879-1970), Virginia Woolf (1882-19
41).
দার্শনিক ও চিন্তাবিদ
…………………………
Bertrand Russell (1872-1970),G.E.Moorel(18
73-1958),J.M.E Mc Taggart(1866-1925).
অনূদিত গীতাঞ্জলি সম্পর্কে এসব কবি ও চিন্তকদের প্রতিক্রিয়া ছিল কার্যত বহুল পরিমাণে ইতিবাচক ও
আস্থাশীল এবং তৃপ্তিদায়ক। বিশেষ কিছু ব্যক্তিত্বের
আন্তরিক পর্যটন ছিল —
Rupert Brooke — নিজস্ব নির্দিষ্ট মনোভাব জানতে না পারলেও তাঁর বন্ধু ও জীবনীকার Edward Marsh কিন্তু ছিলেন রবীন্দ্রসৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক
জন বিশিষ্ট মানুষ।
Walter de-la Mare- ইনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ
তাঁর কবিতার একজন প্রকৃত গুণমুগ্ধ। তাঁর কবিতার
সৌন্দর্য, সারল্য ও সুগভীর আধ্যাত্মবাদ তাঁকে তীব্র
ভাবে আকর্ষণ করেছিল।
John Masefield– রবীন্দ্ররচনায় গভীরভাবে প্রভা-
বিত ছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু কবিতা
ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
Robert Bridges — সে সময়ের রাজকবি ছিলেন তিনি। গীতাঞ্জলির একটি আকর্ষণীয় রিভিউ লিখে
ছিলেন তিনি।কবির গভীর জ্ঞান ও সৌন্দর্যময় ভাষার
প্রশংসা করেছিলেন তিনি।
Lawrence Binyon – রবীন্দ্রনাথের নিকটতম বন্ধু লরেন্স রবীন্দ্র-কবিতার গুরুত্ব ও সৌন্দর্যের উল্লেখ করেন।
সামান্য ও সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথের এবারের বিদেশযাত্রা এক
বিস্তৃত ও ব্যাপ্ত পরিচিতির অভাবনীয় সাফল্য এনে দিতে পেরেছে তাঁর জীবনে এবং শুধু তাই নয়,প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের একটি বিস্ময়কর সেতুও নির্মিত হয়ে উঠতে
পেরেছে এই অভিযাত্রায়। ব্রিটেনই শুধু নয়, প্রায় সব
দেশেই রবীন্দ্র-চর্চা ও তার মধ্যদিয়ে ভারত-অন্বেষণও
গতি পেয়েছে প্রভূত পরিমাণে। দিকে দিকে রবীন্দ্র-অনুবাদের ধারাটি হয়েছে প্রাণবান। লণ্ডনে বসেই
তাঁকে তাঁর লেখার অনেক অনুবাদের কাজও করে যেতে হয়েছে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও। কিন্তু এ সমস্ত
ছাড়িয়ে শুধু বারবার মনে হতে থাকে, ব্রিটিশ সরকারী
মুখপাত্ররা সেদিন কেন এতোখানি নীরবতা পালন করেছিলেন?
যাইহোক, নোবেল প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত বিদেশে রবীন্দ্র
নাথ সেভাবে অনূদিতই হন নি। ইংল্যান্ডে, বিশেষত
লণ্ডনের বুদ্ধিজীবী ও গুণীজনরাই রবীন্দ্রনাথে দারুণ মশগুল ছিলেন। এবং তা যে রোথেনস্টাইন এবং ইয়েটসের যৌথ উদ্যোগের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম – তা
তো এতোক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে পাঠক সাধারণের কাছে। কিন্তু যদি এ ত্র্যহস্পর্শটি না ঘটতো রবিজীবন
-এ, তাহলে, তাঁর মতো এক ভারতীয়র নোবেল প্রাপ্তি কি সম্ভব হয়ে উঠতো?
এ প্রশ্ন যে কখনও জেগে উঠতে পারে, ভেবেই দেখি না আমরা কোনওদিন। আর ভাবতে যাবোই বা কেন?
অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়, অভিনব এ প্রাপ্তি। আমাদের আশ্চর্য গৌরবের ধন এটি। পরম পাওয়া । তবে কি
এ প্রাপ্তির অগ্রভাগে বিস্মিত বিশেষণগুলি আমরাই
আগেভাগে তৈরি করে নিই নি?
যদি নিয়েও থাকি, তাহলেও, দীর্ঘ পরাধীন, ব্রিটিশের
অধীন এক দেশের, দুর্ভাগ্যপীড়িত, অবদমিত,শোষিত
মানুষ হিসেবে এ প্রাপ্তিকে আমরা এক বড়ো বিজয় বলে কি আনন্দিত, তৃপ্ত হয়ে উঠিনি কি?
তবুও ত্র্যহস্পর্শ শব্দটির অভিঘাত কিন্তু কোনোভাবেই
লঘু হয়ে যায় না। কিছুতেও না।
যাবো আমরা সেসব আলোচনার অন্ধকার গবাক্ষের
কাছে।তার আগে ইংল্যান্ডের সেসময়ের রাজনৈতিক
পরিবেশটি একবার দেখে নিই আমরা —
১৯১২ তে, যখন রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন
তা এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।
ক) রাজনৈতিক পরিবেশ — প্রধানমন্ত্রী H.H.Asquith
এর নেতৃত্বে তখন ইংল্যান্ড, লিবারেল পার্টির দ্বারা শাসিত হচ্ছিল। লিবারেল পার্টি সেসময়, শ্রমিকদের অধিকার, মহিলাদের ভোটাধিকার ও আইরিশ হোম-
রুলের মতো সামাজিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়ে
ছিলেন।
খ) সামাজিক অস্থিরতা — দেশজুড়ে সেসময় চলছিল
সামাজিক অস্থিরতা, বন্ধ ও প্রতিবাদী-বিক্ষোভ এবং
রাজনৈতিক পরিবর্তনের আন্দোলন। মেয়েদের ভোটের অধিকার ব্যাপকতর রূপ নিয়েছিল যার পুরোভাগে ছিলেন Emmeline Pankhurst ও তাঁর মেয়েরা।
গ) সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ — ব্রিটেন তখনও
অব্দি ছিল একটি প্রভাবশালী শক্তিকেন্দ্র। প্রায় সারা
পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো তার বিস্তৃত সাম্রাজ্য। স্বভাবতই ক্রমশ বিতর্ক ও সমালোচনা, প্রবল দানা বাঁধছিল,এর
বিরুদ্ধেই। শুধু ইংল্যান্ডের ভেতরেই নয়, শুরু হয়েছিল
ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মধ্য থেকেও।
ঘ) সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র– সেসময়ে লণ্ডন
ছিল সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের প্রধান এক
ক্ষেত্রভূমি। প্রধানত Bloomsbury Group (ভার্জিনিয়া উলফ, ই.এম.ফ্রসটার ও লিটন স্ট্রাচে
সহ) আধুনিক সাহিত্য ও শিল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
সেসময়ের ইংল্যাণ্ডের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটি আমরা বুঝে নিতে চেয়েছি
এজন্যই যে, রবীন্দ্রনাথের সং-অফারিংস্ এরকম এক
পরিবেশে আলোড়ন তুললো কীভাবে – তাকে কিছুটা
জেনে ওঠার জন্য।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, বিংশশতাব্দীর প্রথমদিকে
ইউরোপের সঙ্গে এশিয়া ও অন্যান্য অংশের, বিশেষ
করে ভারতের সঙ্গে, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের একটি
পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। প্রাচ্যের শিল্পকলা, দর্শন ও
আধ্যাত্মিকতার দিকে পাশ্চাত্যের কৌতুহল ও আগ্রহ
ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। রবীন্দ্রনাথের সং-অফারিংস-
এর গ্রহণযোগ্যতার আরও অনেক কারণের মধ্যে হয়তো এই পারিপার্শ্বিকতারও একটি মূল্য রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটা আবহ তো ছিলই।
একথা সবারই জানা যে, পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে,
ইংল্যাণ্ডে ও আমেরিকায়, ব্যক্তিগতস্তরে এবং সাহিত্য
ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ব্যাপকভাবে পঠিত ও গৃহীত হয়েছিল ১৯১৩-র আগেই। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস স্বয়ং ১৯১২ তে সং-অফারিংস-এর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন এবং ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে তাঁর সৃষ্টিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। এজরা পাউন্ড ১৯১২ তেই রবীন্দ্রনাথের
কবিতা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা তখনকার বিভিন্ন সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিতও হয়েছিল। তাঁর বেশ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত
হয়ে দ্য আটলান্টিক মাসিক কবিতা-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, তখনও অব্দি রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি ঘটেনি। একমাত্র নোবেল পুরস্কারই তাঁকে বৈশ্বিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
।। চার।।
আগেই উল্লেখ করেছি যে,১৯১২-এর শেষের দিকে
লণ্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি রবীন্দ্রনাথের সং-অফারিং
স প্রকাশ করে। এবং প্রকাশের পরে পরেই দারুণ –
ভাবে তা সমর্থন ও আতিথ্য পায়। আরও উল্লিখিত
হয়েছিল যে, লণ্ডনে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর
সৃষ্টির বেশকিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ও
তা প্রকাশিত হয় সেখানে। লণ্ডনের ইন্টেলেকচুয়াল
দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিলিত হওয়ার সময় যেসব
ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি মে সিনক্লেয়ার। সং-অফারিংস- এর উচ্ছসিত
প্রশংসা করে প্রথম মুদ্রিত রচনাটি ৭ নভেম্বর ১৯১২
তে টাইমস্ লিটারেরী সাপ্লিমেন্ট সাহিত্য সাময়িকীতে লিখেছিলেন এই সিনক্লেয়ারই (১৮৬৩-১৯৪৬)। এমন
কী লিখেছিলেন এই ব্রিটিশ লেখিকা অনুবাদিত গীতা
ঞ্জলি সম্পর্কে? লিখেছিলেন —
” রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মানুষের সাধারণ আবেগ- মথিত নিবেদনের মিলন হয়েছে এমন এক সঙ্গীত ও
ছন্দে– যা সুইনবার্নের থেকেও পরিশীলিত।এমন এক
সঙ্গীত ও ছন্দ যা পশ্চিমী শ্রোতার কাছে অচিন্তনীয়,
যাতে আছে শেলীর অপার্থিব চেতনা, অদ্ভুত সুক্ষ্মতা ও তীব্রতা এবং তা এমন সহজিয়া রীতিতে যাতে এই
জাদুকরী- আবেশকেও মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক রূপবন্ধ।”
সিনক্লেয়ার, বিশিষ্ট মহিলা কবি ও কথাসাহিত্যিক, রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন সংঅফারিং
স-এর প্রশংসা করে (দেশ,২০ অগ্রহায়ণ, ১৩৯৩, পত্র
সংখ্যা – ৩২)। তা হলো —
“.…… নিছক কবিতা হিসেবে বিশুদ্ধ এবং সর্বাঙ্গসুন্দর
বলেই নয়, এই কবিতায় এমন এক ঐশী স্পর্শ আছে
যা আমি কদাচিৎ হঠাৎ – আলোর ঝলকের মতো, নিতান্ত ক্ষণিকের জন্য, মনে মনে অনুভব করেছি।জানি না আর একজনের চোখ দিয়ে দেখা যায় কিনা,
তা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়, তবে একথা নিশ্চিত যে,
আর এক জনের প্রত্যয় দিয়ে নিজের প্রত্যয়কে দৃঢ় করে নেওয়া সম্ভব।…তৃপ্তি, পূর্ণ তৃপ্তি — আমি পেয়েছি
কাল রাত্রে আপনার রচনায়। ইংরেজি ভাষায়, বা পাশ্চাত্য দেশের অন্য কোনো ভাষায়, যেসব কথা লিখিত হতে পারে বলে ভরসাও করিনি,স্বচ্ছ ইংরেজি
তে আপনি তা প্রকাশ করেছেন।”
বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ চিঠি লেখা হয়েছে রোথেন-
স্টাইন-ইয়েটসের যুগ্ম উদ্যোগে সং অফারিংস পাঠের
পরের দিনই।
সি.এফ.এন্ড্রুজ -র সেই সন্ধ্যের অভিজ্ঞতা কেমন
ছিল? লিখেছিলেন তিনি এরকম —-
"গ্রীষ্মে সেই সন্ধ্যা কাটলো রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনে। ইয়েটস অভিভূতের মতো একটির পর একটি কবিতাআবৃত্তি করে চলেছেন, আর আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছি, রাত্রে যখন বিদায় নিলাম আমার মন তখন এক অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্র কাব্য-মদিরা মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। চ্যাপ-
ম্যান-কৃত হোমারের অনুবাদ পড়ে কীটসের যে মনো-
ভাব আমারও যেন অনেকটা সেই অবস্থা।”
ইয়েটস,সং অফারিংস-এর মুখবন্ধে রবীন্দ্র-কবিতাকে
কীভাবে দেখছেন, তা একটু দেখে নিতে চাই আমরা।
“…..I have carried the manuscript of these
translations about with me for days, reading
it in railway trains,or on the top of omnibuses
and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger would see how much it moved me.These lyrics… which are in the original,my Indians tell me, full of subtlety of rhythm of untranslatable delicacies of colour, of material invention…..
Rabindranath Tagore, like Chancer’s fore-
runners, writes music for his words, and one
understands at every moment that he is so
spontaneous,so daring his passion,so full of
surprise, because he is doing something which has never seemed strange, unnatural,
or in need of defence…A whole people, a whole civilization, immeasurably strange to us, seems to have been taken up into this imagination; and yet we are not moved because of its strangeness, but because we
have not our own image, as though we had
walked in Rossetti’s willow wood,or heard ,
perhaps for the first time in literature,our voice as in a dream.”
ইয়েটস যেন মূল ধরে নাড়া দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের
কবিতা তাঁকে যে কতোটা ঝাঁকুনি দিয়েছে তার আঁচ
যেন আমরা পাচ্ছি ওপরের কথাগুলো থেকে। তিনি
আরও লিখছেন —-
“Since the Renaissance the writings of European saints…. however familiar their metaphor and the general structure of their
thoughts …has ceased to hold our attention,
we know that we must atleast forsake the
world, and we are accustomed in moments of weariness or exaltation to consider a voluntary forsaking; but how can we, who have read so much poetry,seen so many paintings, listen to so much music, where the cry of the flesh and the cry of the soul seems
one, forsake it hardly and rudely? What have we in common with St. Bernard covering his
eyes that they may not dwell upon the beauty
of the lakes of Switzerland and,or with the
violent rhetoric of the Book of Revelations? We would,if we might, find, as in this book, words full of courtesy…We had not known that we loved God, hardly it may be that we
believed in Him ; yet looking backward upon
our life we discover, in our exploration of the
pathways of woods,in our delight in the lonely places of hills, in that mysterious claim that we have made, unavailingly on the
women that we have loved, the emotion that
created this insidious sweetness.”
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো। আসলে সং অফারিংস- এর ভূমিকা লিখতে বসে ইয়েটস, খুব স্বাভাবিকভাবেই, বিশ্বসাহিত্যের কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্র-কবিতার যে অবস্থানগত তুল্যমূল্যকে বাজিয়ে দেখে নিচ্ছেন, এবং
তা যে তাঁর আন্তরিক পর্যটন থেকে উদ্ভুত, সে বিষয়ে আমরা নিঃসংশয়।
ইয়েটস আরও একটা কথা বললেন যা রবীন্দ্রের
কবিতায়, বিশেষত তাঁর সং অফারিংস- এর ক্ষেত্রে
খাটে অবশ্যই– তা হলো এ কবিতার সারল্য এবং
সহজতা। কী লিখলেন ইয়েটস?—-
” An innocence,a simplicity that one does not find elsewhere in literature makes the birds
and the leaves seem as near to him as they are near to children, and the changes of the
seasons great events as before our thoughts had arisen between them and us.”
আমরা, রবীন্দ্রনাথের সং অফারিংস-র আলোচনা ও বিদগ্ধমহলে তার বিশেষ স্বীকৃতি ও সন্ধিৎসাকে এতো সমীহ করতে চাইছি একারণেই যে,সুইডেনের নোবেল কমিটির গীতাঞ্জলিকে নোবেল সম্মান প্রদান , লণ্ডন এবং আমেরিকার বিদ্বজ্জনের স্বীকৃতি দ্বারা অনেক খানি প্রভাবান্বিত হয়েছিল বলে আমাদের মনে হয়। কেননা, নোবেল প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত বিদেশে রবীন্দ্র-সৃষ্টি সেভাবে আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদে তখনও অব্দি খুব সামান্যই পাওয়া গেছে।
কিন্তু লণ্ডন যাওয়ার আগে গীতাঞ্জলির যে ইংরেজি অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং সেখানে ইন্টেলেকচুয়ালদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রশংসা পেয়ে ছিলেন তার কথাতো আমরা আগেই বলেছি, তবে তার পরেও নোবেল প্রাপ্তির আগে অব্দি সে অর্থে তিনি বিদেশের অন্য কোথাও প্রকাশিত হতে পারেন নি। তবু, Song Offerings এর ঢেউ অনেক দূর পর্যন্ত যে পৌঁছে গিয়েছিল তার নিদর্শন অবশ্যই আছে।
আঁদ্রে জিদ লিখছেন —
” ১৯১২ সালে যখন আমি গীতাঞ্জলি অনুবাদ করছিলাম, এমনকী ইংলন্ডেও তখন রবীন্দ্রনাথের পাঠকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।বইটির অতুলনীয় শুদ্ধতা আমার চোখের সামনে আজ এত স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে যে আমি বুঝতে পারছি যে আমার পক্ষে তাঁর একটি প্রতিবিম্বকে ফ্রান্সে নিয়ে আসাটা ছিল একটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার। যুদ্ধের মধ্যে এবং সমস্ত রাজনৈতিক ও স্বীকারোক্তিমূলক মতানৈক্যকে অতিক্রম করে এই স্থির নক্ষত্রটি সারাক্ষণ জ্বলজ্বল করছে আর পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস আর শান্তির স্নিগ্ধ আলো। আমি আনন্দিত যে আমি আজ ওই বিরাট ব্যক্তিত্বকে, আমার শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছি।
(‘দি গোল্ডেন বুক অফ টেগোর ‘ – ১৯৩১-এর জন্য আঁদ্রে জিদ -এর বার্তা)”।
জিদ এও বলেছিলেন যে—
“এত সুগম্ভীর আর অপরূপ কণ্ঠস্বর আর কোনও সাহিত্যে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।”
বিশিষ্ট চিন্তক ও অধ্যাপক চিন্ময় গুহ জানাচ্ছেন —
” মনে রাখতে হবে যে আঁদ্রে জিদ যখন স্যাঁ – জন পের্সের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ -অনুবাদে হাত দেন তখন একদিকে শুরু হতে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ,অন্য
দিকে ইউরোপে আধুনিকতার নতুন তরঙ্গমালা আছড়ে পড়ছে, জিদ নিজে যার অন্যতম প্রধান উদ্গাতা ও পুরোহিত।কাজেই তিনি যখন তাঁর ফরাসি
অনুবাদের ভূমিকায় ‘গীতাঞ্জলি’ র শীর্ণতার প্রশংসা করেন, তা যে পুরাণকাহিনিতে ঠাসা নয়, প্রস্তুতি ছাড়াও যে তা পড়া যায় সেজন্য গভীর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন, তার পরিপ্রেক্ষিতটা সম্পূর্ণ জানা দরকার।
(সুরের বাঁধনে: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে: চিন্ময় গুহ: পরম্প রা : পৃষ্ঠা -৩২)”।
শ্রী গুহ আরও লেখেন যে —
” ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে ১০৩ টি কবিতার এই সংকলনকে তাই বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তাঁর।….পূজাশ্রয়ী বা আধা- মিস্টিক প্রেমের চেয়েও গীতাঞ্জলিতে তিনি বেশি করে খুঁজে পান মানবিক প্রেম, কখনও বা শারীরিক প্রেম, যেমন ‘গার্ডেনার’-এর ৪৯- সংখ্যক কবিতায়।…কখনও শ্যুমান কখনও বাখ- এর মুর্ছনা বেজে ওঠে তাঁর মনে — ‘দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি,অতি দীর্ঘকাল’ , ‘তোরা শুনিস্ নি কি শুনিসনি তার পায়ের ধ্বনি’ , ‘আমার মিলন লাগি তুমি’, ‘পথ চেয়ে কাটল নিশি’। কখনও এক নারীর কণ্ঠে ফুটিয়ে তোলা প্রতীক্ষা, কখনও অতল মিস্টিসিজ্ম।”(ঐ৩৩)
মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথের সং অফারিংস-এর প্রায় পঁচিশটি কবিতা জিদ ফরাসিতে অনুবাদ করে- ছিলেন প্রথমে ‘লা নুভেল রভ্যু ফ্রাঁসেজ’ পত্রিকায়। আরও একজনের কথা বলতেই হয় এ প্রসঙ্গে। তিনি হলেন ফরাসি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি স্যাঁ – জন
পের্স (১৮৮৭- ১৯৭৫)। চিন্ময় গুহ লিখছেন —
” বিশ শতকের প্রথম পর্বে যখন এক অস্থির, ভঙ্গুর বাস্তবের কঙ্কালের দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইউরোপের কবিতা, বিষয় ও ভাষা নিয়ে চলছে বিতর্ক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, স্বয়ংক্রিয় লিখনের বিপজ্জনক রাস্তা বেছে নিয়েছেন নতুন প্রজন্মের অনেক কবি সেই সময় স্যাঁ-
জন পের্স ছদ্মনামে ওই যুবক সম্পূর্ণ নতুনভাবে লিখছেন বস্তু ও মানুষকে নিয়ে মর্মরিত এক মহাকবিতা।
…. লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্যাঁ-জন পের্স (আসল নাম মারি- রনে- অগ্যুস্ত স্যাঁ–লেজে লেজে, ছদ্মনাম ব্যবহার করবেন আরও পরে)
দেখা করেছিলেন ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর।রবীন্দ্রনাথ তখন জুন থেকে ইংল্যান্ডে, গীতাঞ্জলির ঐতিহাসিক ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হতে চলেছে, তার আগে একবার তিনি আমেরিকা ঘুরে আসবেন ভাবছেন, যেখানে ইতিমধ্যেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে এজরা পাউন্ডের উৎসাহে। লন্ডনের একটি কাগজে ইয়েটসের উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের দুটি কবিতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি নাকি প্রকাশিতব্য ইংরেজি অনুবাদটি প্রূফে পড়েছিলেন,….স্যাঁ-জন পের্সের মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ এক পুরোহিত,দুই পৃথিবীর, দুই যুগের
মাঝখানে দাঁড়িয়ে,পুরাণ-পুরুষের মতো। তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্যর শুরুতেই লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে বড়, কারণ তাঁর আধ্যাত্মিকতা ছিল মানবতায় প্রোথিত। তাঁর কপালে আজও জ্বলজ্বল করছে মহত্ত্বের যৌথ টিকা: কবি হিসেবে তিনি জানতেন কীভাবে মানুষের কাছ থেকে সরে না এসে স্বপ্নকে উঁচুতে তুলে ধরতে হয়।সময় ও স্থানোত্তর তাঁর কবিতা, আবহমান মানুষের পদচিহ্ন ধরে যা শেকড়ের কাছে ফিরে যায়।
সেই নদীতীরের সন্ধানে তাঁর যাত্রা যেখানে সমস্ত রাত্রির অবসান।’ “(ঐ, পৃষ্ঠা -৪১)।
রবীন্দ্রনাথের এক চিঠি এ কথারই প্রতিধ্বনি —–
“কাল সকালে একজন ফরাসী গ্রন্থকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি প্রূফে আমার তর্জমা গুলো পড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আমার কাছে এসে- ছেন। তিনি বল্লেন, তোমার মত কবির জন্য আমরা অপেক্ষা করে আমাদের Lyrics -এ আমরা কেবল accidental -কে নিয়ে বদ্ধ হয়ে আছি –তোমার লেখা দেশকালের অতীত,চল তুমি আমাদের ফ্রান্সে চল, সেখানে তোমাকে আমাদের প্রয়োজন আছে।ইত্যাদি। ইনি আমার এই তর্জমাগুলো ফরাসীতে অনুবাদ করবার অনুমতি নিয়ে গেলেন (১৮ ই অক্টোবর, জগদানন্দ রায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি)।”
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, যতো কমই হোক, অনূদিত গীতাঞ্জলির অভিঘাত কিন্তু ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্স ছাড়িয়ে অন্যান্য দিকেও অনুরণন তুলে দিয়ে ছিল। এবং যতো দিন যাচ্ছিল, যেততোই রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি ও সম্মান বেড়ে চলেছিলো।
তবু একথা পরিষ্কার যে, রোথেনস্টাইনের উদ্যোগ ও ইয়েটসের মুগ্ধতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা অনূদিত গীতাঞ্জলি কে প্রতিষ্ঠা ও পরিব্যাপ্তি দিয়েছিল সর্বতোভাবে।
।। পাঁচ।।
“because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse, by which, with consummate skill, he has made his poetic thought, expressed in his own English words, a part of the literature of the West.”– এই ছিল সং অফারিংস-এর নোবেল প্রাপ্তির অনেক কারণের মধ্যে এক আংশিক উদ্ধার।
কিন্তু আলফ্রেড নোবেল (১৮৩৩-১৮৯৬), সাহিত্যে এ পুরস্কার দেবার জন্য একটি গাইডলাইন দিয়েছিলেন। সেটি মোটামুটি এরকম -“সাহিত্যের ক্ষেত্রে, আদর্শবাদী দিক থেকে সবচেয়ে অসামান্য তৈরি করতে পেরেছেন”এমন একজনকে ই সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।
আদর্শবাদ শব্দটি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, যুগভেদে ও কালপর্বে এটি বিভিন্ন রূপ পেতে থাকে।
হয়েছেও তাই। পরবর্তীকালে, সময়ের স্রোতধারায় তা নানাভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে, সুইডিশ আকাদেমিও তাদের স্ট্যান্ড পয়েন্ট পাল্টেওছেন।
আমরা আগেই স্পর্শ করেছি এ বিষয়ে যে, সং- অফারিংস প্রকাশের প্রাকপর্বে রবীন্দ্র-রচনা সেভাবে প্রচারিত হয় নি।
এখন আমরা দেখে নিতে চাই, সুইডেনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটি সেসময় কেমন ছিল।
১৯১২তে যখন সং অফারিংস প্রকাশিত হয়, তখন সুইডিশ সাহিত্যে চলছিল রোমান্টিসিজম ও ন্যাশনালিজমের হাওয়া। মডার্নিস্ট আন্দোলনও সেসময় তুঙ্গে। প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দিকে চোখ মেলেছে সুইডেন। তখন সুইডিশ সাহিত্য ও রাজনীতি তে অগ্রনী ছিলেন সেখানকার বেশ কিছু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এবং রাজনীতিক।
সাহিত্যক্ষেত্রে সুলেখক, বিখ্যাত নাটককার, উপন্যাসকার ও কবি August Steinberg (১৮৪৯- ১৯১২) যিনি পরীক্ষামূলক ও উত্তেজক স্টাইল ব্যবহার করছেন। তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নৈতিকতা ও সমাজ-সমালোচনা। ছিলেন Selma Lageriof ( ১৮৫৮- ১৯৪০), ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার, যিনি সুইডিশ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রাত্যহিক জীবনকে চিত্রিত করেছিলেন। সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারী অধিকার তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। Verner von Heidenstam (১৮৫৯- ১৯৪০) ছিলেন
বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক, যিনি সুইডিশ আত্মপরিচয়, তার চরিত্র ও লোককাহিনীকে তাঁর লেখাপত্রে
তুলে ধরেছিলেন। প্রখ্যাত কবি Gustaf Froding (১৮৬০- ১৯১১) পরিচিত ছিলেন তাঁর অসাধারণ লিরিকাল এবং আত্মদর্শী কবিতার জন্য। প্রেম প্রকৃতি ও মানুষের সামাজিক অবস্থান ছিল তাঁর চর্চার অবিরত ক্ষেত্র।
কবি Erik Axel Karleldt (১৮৬৪- ১৯৩১) লিখেছেন সুইডিশ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রকৃতিজীবন সম্বন্ধে। সমালোচক ও প্রবন্ধকার Oscar Levertin (১৮৬২- ১৯০৬) উৎসমুখ খুলে দিয়েছিলেন, আধুনিকতা ও নিরীক্ষামূলক সাহিত্য- আলোচনার। বিখ্যাত সাহিত্য- সমালোচক ও ঐতিহাসিক Frederick Böök লেখেন প্রধানত সুইডিশ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভর করে। সামগ্রিকভাবে সুইডিশ কবি লেখক সমালোচকদের লিখন বৈশিষ্ট্যকে আমরা এরকমভাবে দেখে নিতে পারি—-
- ফর্ম ও স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
- সুইডিশ আত্মপরিচয় (identity), সংস্কৃতি ও ইতিহাস।
- প্রকৃতি, লোককাহিনী এবং তার ইতিহাস।
- সামাজিক বিধিনিয়ম ও দেশাচার।
- আধুনিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সং অফারিংস কিন্তু সুইডেনের
সাহিত্য পরিমণ্ডলে এক নতুন উদ্মাদনা নিয়ে আসে।
বলা বাহুল্য,তা অবশ্যই রবীন্দ্র-অনূদিত গীতাঞ্জলিরই
সার্বিক প্রভাবে। কেমন তা?
।।এক।। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গদ্যের অবিমিশ্র আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক থিম, সুইডেনের পাঠকদের
কাছে নতুন চিন্তা, অন্তর্দৃষ্টি ও মিস্টসিজমকে যথার্থ ভাবে তুলে ধরতে পেরেছিল।
।।খ।। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক,ঐতিহ্যবাহী ও আন্তর্জাতিকতার গবাক্ষটি সুইডেনের ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে উন্মুক্ত করেছিল, যা ছিল তাঁদের কাছে সেসময় প্রায় অজ্ঞাত।
। ।গ।। রবীন্দ্রসৃষ্টির মানব-অভিজ্ঞতার ঐক্য, সংস্কৃতিও বিশ্ববীক্ষার অনুভব, সুইডিশ ব্যক্তিত্বদের বিস্মিত
করেছিল। অর্থাৎ বৈশ্বিক-মানবতার এক নতুন চেতনায় যেন তাঁরা অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
।।ঘ।। রবীন্দ্রকৃত ভাষার অভিনবত্ব, ইমেজারি , ফর্ম, উদ্ভাবনমূলক ও নতুন সাহিত্যিক স্টাইল এবং টেক- নিক, সুইডিশ রচয়িতাদের আশ্চর্য করেছিল।
।।ঙ।। প্রক্ষোভ, আবেগ, অন্তর্দৃষ্টি ও অন্তস্থ:জীবনের কথা যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্ররচনায় ,তা প্রচলিত যুক্তিবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিকতা-আধারিত সুইডিশ সাহিত্যের কাছে এক নিশ্চিত বিস্ময় তৈরি করেছিল।
রবীন্দ্রসৃষ্টি এভাবেই সুইডিশ সাহিত্যের অত্যুগ্র ইউরোপ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে কার্যত যেন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে,সে সুইডেনের সাংস্কৃতিক দিগন্তকে বিস্তৃত হওয়ার নতুন
চিন্তা জুগিয়েছিল। রবীন্দ্ররচনা, এক নতুন দার্শনিক ও আধ্যাত্মবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল, যাতে তারা জীবনের অন্যতর এক অর্থ খুঁজে পেয়েছিল,যা নাকি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। এক আন্তর্জাতিক মানব অভিজ্ঞতার সন্ধান রবীন্দ্রসাহিত্যে স্পর্শ করেছিলেন তাঁরা। সাহিত্যের নতুন এক ফর্ম ও স্টাইল হয়তো তাঁদেরকে আতিথ্য দিয়েছিল। সবথেকে বড়ো কথা, সৃষ্টি যে কতো শৈল্পিক ও সুষমামণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে, তা যেন দৃশ্যমান করে তুলেছিল রবীন্দ্রসাহিত্যসমূহ।
আমরা এতো কথার অবতারণা করছি এজন্যই যে, সুইডিশ সাহিত্যপরিমণ্ডলে কীভাবে রবীন্দ্ররচনা একইসঙ্গে আদর্শবাদিতা ও অসামান্যতার দুই সর্বোচ্চ শৃঙ্গকে স্পর্শ করতে পেরেছিল, তাকেই বুঝে নেবার কারণে।
সুইডেনের রাজনৈতিক আবহাওয়াটিরও কিছু খোঁজ নেওয়া জরুরি।
সেসময় একটা পার্লামেন্টারি কতৃত্ববাদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সুইডেন, যেখানে Riksdag প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করছিলেন। লিবারেল পার্টির Karl Staaff-র প্রধানমন্ত্রীত্বে চলছিল সামাজিক পুনর্গঠন, মুক্তবাণিজ্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার মতো
কর্মকাণ্ডগুলি।Hjalmar Branting-র নেতৃত্বে সোস্যালিস্ট পার্টি ক্রমশ তার প্রভাব বাড়াচ্ছিল এসময়।
শ্রমিকের অধিকার, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন ছিল তাদের অন্বিষ্ট। সুইডেন এসময়পর্বে বলকান
যুদ্ধ ও ঘণীভূত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালের আন্তর্জাতিক বিরোধের মতো বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকায় স্থিত ছিল।
Nordic Cooperation Movement -র অংশীদার হিসেবে ডেনমার্ক,নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের মতো প্রতি- বেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুইডেন, সম্পর্কের স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিল। মেয়েদের ভোটাধিকার, শ্রমিকদের নিজস্ব অধিকারের মতো ক্ষেত্রগুলো দ্রুত জনপ্রিয় ও গতিমান হয়ে উঠেছিল, সমসময়ের সুইডিশ রাজনীতিতে।
তাই, এটি সত্যি যে,এ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা সুইডেনের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রটিকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করছিল। এবং নিঃসন্দেহে রবীন্দ্র কবিতাভাবনা সুইডিশ পাঠক ও বুদ্ধিজীবীদের ( ইংরেজি জানা) কাছে হয়ে উঠতে পেরেছিল একটি
উর্বর চারণভূমি।
তাহলে, আমরা যে সময়সন্ধির কথা বলছিলাম,এ আলোচনায়,তাঁর কী হবে? তবে কি কবি রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি একটি নির্দিষ্ট সময়পর্বের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত পরিপার্শ্বের সহ- জাত ও স্বাভাবিক আউটকাম? তা- ই কি শেষঅব্দি হওয়ার ছিল?
খুবই স্পর্শকাতর ও অভিসন্ধিময় মনে হয় এসব প্রশ্ন। তবুও সরাসরি না হলেও এমনসব প্রশ্নেরও কি পরোক্ষ প্রেক্ষিতটিকে অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই? কেমন ছিলো সে সময়ের ( রবীন্দ্রনাথের নোবেল- প্রাপ্তির আগে অন্তত ) পুরো ইউরোপের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি–একবার ফিরে দেখা দরকার আমাদের।জানতে ইচ্ছে হয় তাঁর মূল্যায়নের জন্যও।
সাহিত্য পরিমণ্ডল:– আমরা আগেই জেনেছি যে, এসময়ে মর্ডানিজম ও এক্সপেরিমেন্টেশন চলেছে সমস্ত ইউরোপ জুড়ে। James Joyce, Virginia Woolf, Ezra Pound-র মতো সাহিত্য ব্যক্তিত্ব তাঁদের নতুন স্টাইল ও ফর্মের মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে বিপ্লব
নিয়ে এসেছেন।ডেকাডেন্স ও সিম্বলিজম্ আন্দোলন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, আর যেখানে জোর পড়েছে তা হলো থিমের দ্রুত অপসারণ, হ্রাস বা অবলুপ্তি, নৈতিক অবক্ষয় ও জীবনের অন্বেষণ।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডল:– আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ (প্রথম)পর্বে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ন্যাশনালিজম, ইম্পেরিয়ালিজম ও
মিলিট্যারিজম। রাজনৈতিক আকাশ হয়ে উঠেছে অস্থির, চঞ্চল, টেনশনময়। অন্যদিকে বেড়ে চলেছে সামাজিক নৈরাজ্য ও বিপ্লব।সোশ্যালিজম, অ্যানার্কি- জম ও কমিউনিজম খুব দ্রুত পক্ষবিস্তার করছে। প্রায় গোটা ইউরোপ জুড়ে প্রতিবাদ ও বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। সামাজিক পরিসর ও পরিবেশ প্রভাবিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে এতে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি:– য়ুরোপের শক্তিকেন্দ্রগুলি, কলোনি ও সম্পদের অধিকারলাভের জন্য ক্রমশই হয়ে উঠছিল বিবাদমান, সংগ্রামমুখর। ফল হয়েছিল বিষময়।অসাম্য ও শোষণের ক্ষেত্রটি প্রশস্ত হয়ে উঠে- ছিল। প্রাধান্য পাচ্ছিল নগরায়ণ,দূষণ ও দারিদ্র্য এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল।
এরকমই এক প্রাণান্তকর, তীব্র শ্বাসরোধী পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিগুলি যেন হয়ে উঠেছিল এক ঝলক মুক্ত বাতাস। তাঁর রচনার আধ্যাত্মিকতা, মানবতা ও মূল্যবোধ গোটা ইউরোপের জীবনে নিয়ে এসেছিল বারিধারার স্নিগ্ধতা, উপশম ও শুশ্রূষা। তাঁর কবিতা ও অন্তর্গত দর্শন তখনকার পরিব্যাপ্ত বস্তুবাদ এবং পরিকীর্ণ অস্থিরতা থেকে পথ দেখিয়েছিল সম্ভাবনাময় আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের। অনুরণন তুলে দিয়ে ছিল তাঁদের হৃদয়ে, যাঁদের কাছে প্রার্থিত ছিল আরবেশি সমন্বিত, শক্তিশালী সুন্দর এক পৃথিবী।
যদি অন্যরকম হতো পরিবেশ! যদি বস্তুবাদের প্রতাপ ও পরিণতি এমন না হতো,রণোন্মাদনার তীব্র নিনাদ যদি দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত না হয়ে উঠতো, সাম্রাজ্যবাদী লোভ ও লুন্ঠন যদি অপ্রতিরোধ্য,অপ্রতিহতগতি লাভ না করতো– তবে কি রবীন্দ্র উপাচার মর্যাদাপূর্ণ ও মরমী হয়ে উঠতে পারতো না? পেতো না শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের সম্মান ও পূজা!
থমকে যেতে হয়, এমন প্রশ্নের সামনে এসে; এমন অবিরল আশঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে। তবে কি কোনও সমুদ্যত জিজ্ঞাসাচিহ্ন আমাদের বিমূঢ় করে দেবে? আরাধনাময় একটি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় কি তবে মুছে যাবে সময়ের উচ্চাবচতায়!
শুধু তা- ই বা কেন? যদি না হতো গীতাঞ্জলির ওই ইংরেজি অনুবাদ,যদি না ঘটতো ইংল্যান্ড সফর, যদি রোথেনস্টাইনের উদার আতিথ্য ও বিস্তার না পেতো রবীন্দ্রসৃষ্টি, মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের না যদি লাভ করত অকুণ্ঠ প্রশংসা, প্রকাশিত না হতো সং অফারিংসর অনূদিত রূপ– তবে কি এ সম্মান অর্জিত হতো?
সময়— আবারও এক টালমাটাল, অস্থির প্রশ্ন- চিহ্ন পথরোধ করে সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের।
কিন্তু এওতো সত্যি যে, সময়ও রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির এক বড়ো ফ্যাক্টর। প্রধান না হলেও অন্যতম তো অবশ্যই। কেননা, রবীন্দ্রনাথই সাহিত্যে প্রথম নোবেলজয়ী যিনি একজন অ-ইউরোপীয় এবং এ সম্মান তখনই প্রদান করা হচ্ছে, যখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যথেষ্ট গতি পাচ্ছে। তাঁর এ প্রাপ্তি ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগ বাড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। এবং নিঃসন্দেহে তা ভারতীয় সাহিত্যিকদের কাছে এক মাইলস্টোন।
এও ঠিক যে, সেসময় রবীন্দ্রসৃষ্টি পাশ্চাত্যে ততোখানি সর্বজনবিদিত ও সর্বজনবন্দিত হয়ে ওঠেনি। এবং তাঁর সমসাময়িক Thomas Hardy ও Joseph Conrad ছিলেন সাহিত্যজগতে তাঁর থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল।
তবে অনেকে যে বলেন রাজনীতিও একটি বড়ো নির্ণায়ক রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে? তাঁরা যুক্তিও দেখান এই মর্মে যে, সং অফারিংস প্রকাশের পর ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের বিপুল সমাদর যেহেতু পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ,তাই, এটি প্রভাবিত করেছিল
অনেকাংশেই নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তকে। তাঁরা এও মনে করেন যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ প্রত্যক্ষ করেছিল ইউরোপীয় ক্ষমতাকেন্দ্রগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান tension, বিশেষকরে, ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যেকার অস্বাভাবিক দ্বন্দ্বকে। রবীন্দ্রনাথের মতো ব্রিটিশ উপনিবেশ (ভারত)- জাত একজনকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করার অর্থ হলো ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তিকেই মান্যতা দেওয়া। তাদের তথাকথিত উন্নত,উদার,মেধাবী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা এবং ঋদ্ধ হওয়া রচনাকর্মই এ পুরস্কারের যোগ্যতা দাবি করতে পারে শুধু — ব্রিটিশ ঐতিহ্য বহনকারী এ শিক্ষাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ-র নোবেল প্রাপ্তিটিকে উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল বলে মনে করেন তাঁরা। রবীন্দ্র-কৃত নোবেল-বিজয়কে তাঁরা, এশীয়-সংস্কৃতির প্রতি ইউ.এস.-এর উত্তরোত্তর আকর্ষণ বৃদ্ধির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে মান্যতা দিতে চেয়েছেন।এর উদ্দেশ্য ছিল এ
সব অঞ্চলে ইউ.এস.-এর আন্তর্জাতিক সহযোগ ও বোঝাপড়া কে বিপুলভাবে বাড়িয়ে নেবার এক ছল।
এছাড়াও তাঁদের মতে, Theosophical Society -এর মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে রবীন্দ্রসৃষ্টি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই সংস্থাটি সব সময় আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রটিকে প্রাধান্য দিয়ে চলে। এই বৈশ্বিক সংস্থাটি তার সদস্যদের,এমনকি নোবেলকমিটির সদস্যদেরও রবীন্দ্রনাথকে এ পুরস্কার প্রদানের মতো ঘটনাটিকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছিল। লণ্ডনে ব্রিটিশ ঘরানার ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য ও সান্নিধ্য, বিশেষকরে, ব্রিটিশজাত শিল্পী ও সমালোচক রোথেন স্টাইনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব একদিকে যেমন রবীন্দ্র সৃষ্টির বিস্তৃত প্রচার ও প্রসারের উপযোগী হয়েছিল,
ঠিক তেমনি করেই তা নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও হয়ে উঠেছিল দারুণভাবে ইতিবাচক।
আমরা খুব সঙ্গত কারণেই এ সমস্তকেই অনুমান নির্ভর বলে মনে করলেও, রবীন্দ্র-রচনার বহুল প্রচারের ক্ষেত্রে, রোথেনস্টাইন- ইয়েটসের সদর্থক ভূমিকা কে যথাযথ মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করি না। ইতস্তত করি না, সন্দেহ করি না, অসমর্থন জানাই না এই মতে যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির পরিসরে সারাপৃথিবী ব্যাপী উত্তেজনা ও অস্থিরতাময় সময়বিন্দুতে কবির রচনা একটি শান্তিকামী, শুশ্রূষাময় আহ্বান নিয়ে উপস্থিত হতে পেরেছিল।
।।ক।। সেসময়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল সংক্ষুব্ধ, উত্তেজনাময় ও ভঙ্গুর। রবীন্দ্রসৃষ্টির উপশমকারী, বৈশ্বিক চেতনাধন্য এবং আধ্যাত্মবাদী উদাত্ত উচ্চারণকে চিনে নিতে ভুল করেন নি সুইডেন- র নোবেল কমিটি।
।।খ।। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য সংস্কৃতিতে, বিশ্বব্যাপী জেগে উঠেছিল বস্তুবাদী চেতনা এবং তীব্র বাস্তবতা। গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতা এক প্রাণময়, সজীব স্নিগ্ধতা
নিয়ে এসেছিল। পৃথিবীময় সাহিত্য পরিমণ্ডলের বিপ্রতীপ শান্তিকামী এই ভাবনা নিঃসন্দেহে সুইডিশ একাডেমিকে প্রভাবিত করেছিল।
।।গ।। সে সময়ে,বিশেষকরে বিংশশতাব্দীতেই,বাস্তব- তা- দীর্ণ প্রতীচ্যের মনোভূমি, প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতার
দিকে সাগ্রহ-আকর্ষণ অনুভব করেছিল। প্রাচ্য-দর্শন ও সংস্কৃতির প্রতি তৃষ্ণার্ত হয়েছিল তারা। ভারতীয় দর্শন ও মিস্টিসিজম, যা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে
পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল,তা স্বাভাবিকভাবেই এই সাগ্রহ-
আকর্ষণের সন্ধানবিন্দু হয়ে উঠেছিল।
।।ঘ।। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) প্রাকপর্বটি পৃথিবীব্যাপী মূল্যবোধের ও আধ্যাত্মিকতার কাঙ্ক্ষায়
ছিল কাতর। রবীন্দ্রসাহিত্য তার সহজাত বিশ্বগত মানবিক অভিজ্ঞতায় ছিল পূর্ণ। প্রেম, সৌন্দর্য এবং শিল্পময়তার জন্য ছিল আকুতি। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান
অসন্তোষ, অস্থিরতা, জটিলতা ও বাস্তবতার সামনে রবীন্দ্রসৃষ্টি দাঁড়িয়েছিল মূর্তিময় উপশম হিসেবে। সারল্য, পবিত্রতা ও নিবেদনের যে পথ ধরে রবীন্দ্র- সৃষ্টিজগত আবর্তিত হয়েছিল তার কাছে সারা বিশ্ব পেয়েছিল বেঁচে থাকার মহামন্ত্রধ্বনি।
তাই শুধু রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও সময়বিন্দুর নিরিখে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিকে বিচার করতে বসলে
তাঁর লেখা গীতাঞ্জলির মূল্য অনেকখানি খর্বিত ও খণ্ডিত হয়। কিন্তু তা তো নয়; সং অফারিংস নিজেই হয়ে উঠেছিল পৃথিবীব্যাপী এক বিস্ময়।
।।এক।।গীতাঞ্জলির কালজয়ী অবিনাশী সৌন্দর্যবোধ
আন্তর্জাতিকতা ও আধ্যাত্মিক গভীরতা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সীমানাকে অতিক্রম করেছিল।
।। দুই।। প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির টালমাটাল সময়ে, জাতীয়তাবোধের ক্রম-উত্থানে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্ররচনা, প্রেম শান্তি ও একত্ববোধের জয়গানে ছিল মুখর।
।। তিন।। রবীন্দ্রসৃষ্টি ছিল আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্ব মূল্য-
বোধের প্রতি এক আশ্চর্য সন্ধান।
।। চার।।সেসময়ের, সাহিত্যগত ও বুদ্ধিবাদী আধুনিক
পরিসরে রবীন্দ্ররচনা হয়ে উঠেছিল প্রকাশের এক
অনুপম ও অনন্য মাধ্যম।
তাহলে, অনেকের মনে এ প্রশ্নটি জেগে ওঠা খুব
অস্বাভাবিক নয় যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশো দশ বছর উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও আজ এই ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে আমরা কেন তাঁর মহাবিজয়টিকে স্মরণ করতে যাচ্ছি? গৌরবময় এই শীর্ষটির পাশে পাশে শব্দ ও শ্রদ্ধা জড়ো করতে করতে কেন এগিয়ে যেতে চাইছি আমরা?
এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে রবীন্দ্রসৃষ্টির ঐশ্বর্যময় বিপুল শস্যসম্ভারের অবিনাশিতার কাছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃত অর্থে এক বিস্ময়। তাঁর কবিতা ও গান এ সময়েও আমাদের প্রাণের আরাম, হৃদয়ের শান্তি।
১৯১৩ য় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে সে সময়ের সাহিত্য ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। কিন্তু ২০২৪-এ পৌঁছে তার প্রত্যক্ষ প্রাসঙ্গিকতা হয়ত তেমন নেই। তবুও তাঁর রচনার বৈশ্বিক মানবতাবোধ, পরিবেশবাদ,সাংস্কৃতিক বিনিময় ও ব্যক্তিক স্বাধীনতা-র থিম ও ভাবনার যে উদ্বোধন আমরা পাই,তা আজও, সমান প্রাসঙ্গিক এবং যা এখনও একইভাবে সর্বস্তরের মানুষকে সম্পর্কযুক্ত করে তুলতে পারে।
রবীন্দ্রকবিতা ও রচনাকর্ম মৌলিকভাবে মানব অভিজ্ঞতা ও সান্নিধ্যের কথা বলে যা, ভৌগোলিক ও সময়ের সীমানাকে অতিক্রম করে যায়। তাই তাঁর সৃষ্টি সব যুগের পাঠক, লেখক এবং চিন্তাবিদদের কাছে আজও এক সার্থক উত্তরাধিকার। বিশ্বায়ন, প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাংস্কৃতিকবৈচিত্র্যের মতো সমসাময়িক বিষয়গুলোর নিরিখে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও ভাবনা সবসময়ই মূল্যবান এক অন্তর্দৃষ্টি ও পরিপ্রেক্ষিত রচনা করে যায়। আমাদের অবহিত করে,এসম্পর্কে আজও সদাজাগ্রত রাখে।
আর এ প্রেক্ষিতেই, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি আমাদের কাছে এখনও সমান প্রাসঙ্গিক ও প্রত্যয়ী হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের জীবন যখন অজস্র আবিলতায় ভরে যায়, দুঃসময়ের শোক ও শুষ্কতায় মন যখন মরুময় হয়ে ওঠে, রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার স্রোতধারায় তখন যেন আমরা স্নাত হয়ে উঠি, আজও। দুঃখ ও আনন্দে, হর্ষ ও বিষাদে , মুগ্ধতায় ও মনকেমনে,শোক
ও শুশ্রূষায় , প্রেম ও প্রেমহীনতায় এখনও, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোন্ অবলম্বনইবা আমাদের কাছে আছে আর!
মন বলে উঠতে চায় —
” জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল আকার
গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার
হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ শান্তচরণে এসো।
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন,
দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।
বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।”