এ শহরে
শিখা কর্মকার
এ শহরে একসময় স্নেহময়ী মা ছিল, সিংহের মত তেজী বাবা ছিল, ছিল চিররুগ্ন ভাই, বেয়াদপ বোন ও জোচ্চোর জ্যাঠামশাই । প্রিয়জনদের ঠকিয়ে ধনী হতে চেয়ে যে, নীচে নামতে নামতে এক গোয়াল গরুর ঘাস কেনার পয়সা চুরি করে তীর্থগামী হত, পুণ্য-প্রত্যাশায় । গন্ধরাজ ও মালতীফুলের গন্ধে ম ম করা, গলির শেষে ছিল জেদি ও তেজখাকি প্রিয় বন্ধুর ঘর। তাদের ঘরের ঠিক পাশেই হংসেশ্বরের মন্দির, সেখানে হরবোলা কাকুর ডাকে বিশ-পঞ্চাশটি পাখি চলে আসত মন্দিরের উঠোনে । সেখানে হোলি খেলতে গিয়ে রঙিন করে দিতাম গোটা পাড়ার প্রতিটি বাড়ির বারান্দা ও অলিগলি।
এ শহরে হাত দেখার দাদু ছিল, গাছে গাছে বিশাল বাতাবী ছিল, বুগাবুগীর কুঁড়ে ছিল, রাজপুতদের ম্রিয়মান হয়ে আসা ঘরের ফাটা দেওয়ালে তরোয়াল ঝুলত গুণিতকের চিহ্নের মত। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মোহনবাগানের জায়গায়, গল্পের সীমানা ভেঙ্গে সারি দিয়ে চলে গেছে দেখি এখন বড়ির মত গুমটি, তাদের কপালে টিপ হয়ে জ্বলে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল বাতি। শহর জুড়ে এখনো দোকানে বসে শীতে, বার্ধক্যের চাপে ও আশাহীনতায় ঝুঁকে আসা শীর্ণ ব্যাপারী্রা। বিশাল গাছেদের কেটে ফেলে, এখান সেখানে রূপকথার বদলে দিনরাত বিশাল ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দেয় বাসেরা আর তাদের হর্নের শব্দ চমকে দেয় পিলে । হাইওয়েতে চেপ্টে মরে পড়ে থাকে সোনা ব্যাং আর আধটা রঙ বদলে চিরকালের জন্য স্থির হয়ে যাওয়া বহুরূপী ।
নিটোল স্বর্ণচাঁপায় মধুর খোঁজে ভুল করে এসে পড়া ভ্রমর থাকেনা বেশিক্ষণ এ শহরে। থাকেনা মধুচুষি পাখি বা মৌমাছিরা । ফুলের অভ্যন্তরে নিবিড় পরাগ, সারল্য, ছোটবেলার অ্যাডভেঞ্চার ম্লান হয়ে গেছে কবেই । নেই আর রেখে যাওয়া এক পাড়া অম্লান আনন্দ, এক সাঁতারেই এপার থেকে ওপার যাওয়ার ভরা নদি, তার চরের টুকরো কুয়ো, টুসুর খোলার চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালিয়ে, সেটিকে চন্দ্রমল্লিকায় ও গাঁদায় সাজিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে পৌষের শীতে স্নান করে আসা, লজ্জাবতী লতার অসময়ের কাঁপন।
বাবুইপাখিটি বাসা বাঁধতে বাঁধতে আনমনা হয়ে দ্যাখে শিমুলের উড়ে যাওয়া । দ্যাখে কেটে ফেলা বনস্পতির জায়গায় উঁচু হয়ে উঠতে থাকা ফোনটাওয়ার আর বহুতল বাড়ির বাইরে বিশাল বিজ্ঞাপন ঘোষণা করে শহরকে আবার সবুজে ভাসিয়ে দেবার স্বপ্নকথা। সময়মত এসেও নদিতে-পুকুরে-খালে-বিলে জল না পেয়ে, শুকনো মুখে ফিরে যায় পরিযায়ী পাখিরা, মেঘেরা চোখ বড় করে দ্যাখে তাদের নিরাশ চোখের পলক । কত কি না পাওয়ার ঢেউয়ে, হতাশার স্বাদে ভরে থাকে সন্ধে।
তবু সহজ পাঠ খুলে, অ আ ই ঈ পড়ে কুপির আলোয় এক চিলতে ঘরের খোকাখুকুরা, আর নরম হয়ে আসে গাছের সজনের ডাঁটা আর ক্ষেতের আলু, বুড়বুরিয়ে ফুটতে থাকা ডালের কড়াইয়ে। চিরচেনা ঘুমপাড়ানি গানের সুরে চোখ ভারি হয়ে আসে ঘুমে কোলের শিশুটির। কাঁচের আলমারিতে রাখা গীতবিতান আর কথামৃতের পাশে বাবার হাতে লেখা সাঁওতালদের মোড়লের সাথে চিরকালের বন্ধুত্বের কাহিনী হারিয়ে যায় । চোখ জ্বালা করা কুয়াশায় ঢেকে যায় শহরের নাম।
ঝাপসা হয়ে আসে স্মৃতি । কেউ কোনদিন চিরকাল থাকেনা জেনেও কেন যে মনে পড়ে মায়ের দুচোখ, করুণায় ও ভালোবাসায় উজ্জ্বল, যুদ্ধ জিতে আসা সংগ্রামী বাবার দুহাতে লেগে থাকা দেশের মাটি, সেই মাটি দিয়ে বানানো প্রথম ঘর, হাতে করে লাগানো বাগানের প্রথম চারা, সেই বাগানে বেড়ে উঠতে থাকা কিশলয়ের অবোধ আনন্দ।
এখন এ শহরে আমার চেনা ঘর নেই, মা নেই, বাবা নেই, ভাই-বোন-বন্ধু এমনকি জোচ্চোর জ্যাঠামশাইও নেই। এ শহর ভরে আছে দূর থেকে এসে বাসা করে থাকা অচেনা লোকজনে, জমি চেনেনা বা কেনেনা তারা, আদর করে বাড়ি বানায়না একরাশ স্বপ্ন নিয়ে, সবকিছু দেওয়া হয় তাদের, ছায়ার মত আসে যায় তারা দিনরাত, সময়ের ফেরে বাঁধা হয়ে। ভুল করে এসে প’ড়ে এ শহরের ব্যথিত মাটিতে, আমিও থাকবনা বেশিক্ষণ । বাবার গল্পের খাতার মত এই শহরের মুখটি একবার দেখেই চলে যাবো নিরাশ পরিযায়ীদের মত। ক্লান্ত ডানায় চিরবিশ্রাম নেব এই পৃথিবীর অন্য কোথাও, অন্য কোন অচেনা শহরে।