ভয়
পার্থ রায়
মুখ হাত পা শক্ত করে বেঁধে রেখেছে শয়তানগুলো। হাতদুটো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এককাতে অসহায় ভাবে কারখানা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে নিশি। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা থাকাতে চিত হতে পারছে না। মাঝে মাঝে মাথা রাখছে মেঝেতে। একবার ঘাড় তুলে দেখেছে তিনজন খুব কাছেই বসে মদ খাচ্ছে, আর হিংস্র হায়নার মতো শিকার ধরার উল্লাসে হাসছে। এক অজানা সর্বনাশের আশঙ্কায় ভীতা হরিণীর অবস্থা নিশার। এরই মাঝে নানা শঙ্কার কালো মেঘ নিশিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মনের মধ্যে কু-ডাক যেমন ডাকছে তেমনি নানা ভাবনা বাইরের বিদ্যুতের মতোই আসা যাওয়া করছে।
বাবা আদর করে বলে, “আমার মা কালী”। দেখো বাবা, আজ তোমার মা কালীর সর্বনাশ নেমে আসছে। বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা এক তরুণীর সব স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার হবে। আমার মুখ দেখানোর কিছু থাকবে না। আমার মুক্তি নেই, আমি আর সমাজে ফিরতে পারব না, বাবা। এই ভাবনাগুলো মস্তিস্কে উঁকি দিতে এক আকুল কান্না নিশির দুই চোখ ছাপিয়ে নামে। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকল, “হে ঠাকুর, হে চামুণ্ডা কালী, হয় রক্ষা করো তানাহলে মৃত্যু দাও”।
মা বাবা দুজনেই আজ ওকে বের হতে বারণ করেছিলেন। গতকাল থেকেই আবহাওয়া খুব খারাপ। কালবৈশাখির ঝড়ে ইলেকট্রিক ল্যাম্পের ওপর গাছ পড়ে এলাকায় অন্ধকার। মায়ের তো খালি এক কথা “দিনকাল ভালো না, রাত বিরেতে না বের হলে চলছে না তোর? এই দিনে না গেলে ছাত্রীর বাবা মা কিচ্ছু মনে করবে না”।
যদিও নিশি জানে, মায়ের ভয় একেবারে অমুলক নয়। পরিত্যেক্ত ল্যাম্প ফ্যাক্টরির আশেপাশে বেআইনি মদ, গাঁজা বিক্রির পাশাপাশি গুন্ডা বদমাশের আড্ডাও বাড়ছে এই আধা মফঃস্বল, আধা গ্রাম জায়গাটায়। পুলিশ, রাজনৈতিক দাদারা সব জানে। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে সব দেখেও দেখে না। মাঝে মাঝে পুলিশ ভেঙ্গে দেয় দোকানগুলো, ধর পাকড়ও করে- তারপরে আবার যে কে সেই।
কিন্তু সেই ভয়ে বাড়ী বসে থাকলে কি আর পেট চলে? বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পরে, নিশি বেশ কিছু টিউশনি নিয়েছে। এই ছাত্রীর বাবা অবস্থাপন্ন এবং শিক্ষিত। ফিজটা আশাতীত ভালো দেয়। গত বছর পুজোর সময় ছাত্রীর মা একটা খুব সুন্দর শাড়ি দিয়েছিল। তাই পারতপক্ষে এখানে কামাই করতে চায় না নিশি।
নিশি হেসে মাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, “কেউ তোমার এই কালী পেত্নির দিকে নজর দেবে না। ভয় পেও না”
মা মুখে একরাশ আষাঢ়ে মেঘ জমা করে বলে, “মেয়েদের যৌবন মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু রে, মা”- বলেই কপালে দুই হাত ঠেকিয়ে ভগবানকে ডাকেন। নিশি জানে, মা ওর মঙ্গলের জন্যই ঠাকুরকে ডাকেন। এটা সত্যি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনিশ্চিত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কালো মেয়ের যৌবনে কোন বাঁধ দিতে পারেনি। পান পাতার মতো মুখে একটা মিষ্টি ভাবের সাথে গোলগাল শরীরের বাঁধন একটা শ্রী ছড়িয়ে রেখেছে। বাবার মতই পাড়ার হারুকাকু আর সিধুদাদুও আদর করে নিশিকে মা কালী বলে ডাকেন। তোমাদের মা কালীর আজ অকাল বিসর্জন হবে। ঠাকুর? ভগবান? সব মিথ্যে! সব মিথ্যে! শয়তানগুলো যদি কোথাও একটু যেত, তাহলেও পালানোর একটা মরিয়া চেষ্টা করা যেত।
(১)
বৃষ্টি একটু থামতেই নিশি ছাত্রীর বাড়ী থেকে বের হয়ে এসেছিল তড়িঘড়ি করে। ছাত্রীর মা বলেছিলেন, “এই দুর্যোগে পড়াতে এলে কেন? এসে যখন পড়েছ একা যেও না। সাথে কেউ যাক, আমি ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি”। শোনেনি নিশি।
বলেছে, “ছাতা আছে, তাছাড়া পরিচিত রাস্তা, ঠিক চলে যাবো, কাকিমা। আপনি চিন্তা করবেন না”।
শর্টকাট হবে বলে, ল্যাম্প ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিশি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে যতটা পারে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছিল। বলতে গেলে খানিকটা দৌড়েই। এই প্রথম চেনা পথে হাঁটতেও ভয় ভয় করছিল নিশির। দিনের বেলা এই পথ দিয়ে লোকজন যাওয়া আসা করে। নিশিও যায়। আজ এই ঘোর দুর্যোগের রাতে রাস্তা শুনশান। আসলে বিপদ যখন আসে তখন আগাম জানান দিয়ে আসে না। স্টেশনের কাছে রাস্তা দিয়ে এলে একটু ঘুর পথ হত বটে কিন্তু কিছু চেনাশোনা লোক থাকত। বাড়ী ফেরা ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের কাউকে পেয়ে যেত।
চেনা পথেই অপেক্ষায় ছিল অচেনা বিষধর সাপেদের দল। চিতা যেমন শিকার ধরে, আচমকা পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে তুলে নিয়ে আসে এই ফাঁকা ল্যাম্প কারখানায়। পরে নিশির মনে হয়েছে ওরা প্ল্যান করেই ওকে ধরেছে, তানাহলে দড়ি কোথা থেকে পেল। প্রাথমিক হতচকিত ভাব কাটিয়ে প্রবল বাধা দিয়েছিল। চিৎকারও করেছিল প্রাণপণে। কিন্তু তুমুল বিদ্যুৎ চমকানো আর মেঘের গর্জনে নিশির ক্ষণিকের আর্ত চিৎকার চাপা পড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া জানোয়ারগুলো সুযোগও দেয়নি। মুখ চেপে ধরেছিল শক্ত করে।
“এই ঢ্যামনা কার্ত্তিক, যা মজা লুটে লে। তবে আগে চান্স দিয়েছি বলে সব শালা চেটে পুটে খাস না। আমাদের জন্যেও রাখিস। আরও দুই পেগ মেরেনি, তারপরে ছম্মক ছল্লুর …”-হাড় হিম করা হায়নার হাসি। লালসার দৃষ্টি হেনে গান ধরল, “ঝুম্মা চুম্মা দে দে ……..”।
কেঁপে ওঠে নিশি। সচকিত হয়ে উঠলো। কারণ একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে আসে। ডুকরে কেঁদে উঠলো। মায়ের মুখ, বাবার করুণ চাউনি মনে পড়তে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কিন্তু নিমেষে নিজেকে সামলে নিল নিশি। একজন ধীর পায়ে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। হাত পা একবার খুলুক, একটা মরীয়া চেষ্টা করবে। হয় এসপার নাহয় ওসপার । এই কলঙ্কিত প্রাণ রেখে আর কী হবে। আর মরতে যখন হবেই, একবার শেষ চেষ্টা করেই মরবে নিশি। হার মানলে হবে না। দাঁতে দাঁত চেপে নিঃসাড়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে এগুচ্ছে লোকটা। ঠিক যেভাবে একটা চিতা বাঘ তার কবলে বন্দী অসহায় শিকারের দিকে এগোয়। এইটুকুই যা মিল, বাকী সবটাই অমিল। বনের জানোয়ার প্রকৃতির নিয়মে শিকার ধরে তার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আর মানুষরুপী দ্বিপদ পশুগুলি ধর্ষণ করে তার বিকৃত কাম, যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে। নিশির মনে হল বনের জানোয়াররা অনেক বেশী সভ্য। ওদেরও একটা এথিক্স থাকে।
কামুক দৃষ্টির উৎসবে এক জোড়া চোখ শায়িত নিশির শরীর চাটছে। লোভীর চোখ ঘোরাফেরা করছে ধ্বস্তাধস্তিতে আঁচল সরে যাওয়া উত্তুংগ বুক আর হাঁটুর নিচ থেকে নগ্ন পায়ের গোছের মধ্যে। দিশি মদের উৎকট গন্ধ নাকে ঢুকতে গা গুলিয়ে উঠল নিশির। শ্বাপদের মুখ নেমে আসে কাছে। অনেক কাছে। এতো কাছে যে সুরা আর কাম মিশ্রিত গরম শ্বাস নিশির মুখে আগুনের হলকার মতো এসে লাগছে। পৃথিবীর সব ঘৃণা জড়ো করে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখছে নিশি। প্রবল ক্রোধের আগুনে জ্বলজ্বল করছে নিশির দুই চোখ। এক অজানা আশঙ্কায় আকাশ চিড়ে আসা বিদ্যুৎও ঘন ঘন উঁকি দিচ্ছে কারখানার পাল্লাবিহীন ভাঙ্গা জানালাগুলো দিয়ে।
বুক আর কোমরের নিচ থেকে শ্বাপদের দৃষ্টি এবার শিকারের মুখে নিবদ্ধ হল। বিদ্যুতের আলোয় দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি মেলে। স্বভাব শান্ত নিশির চোখে গনগনে সূর্যের আগুনের গোলা। যেন পাপে ভরে যাওয়া পৃথ্বীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অগ্নিশুদ্ধ করে তোলার ব্রতে দীপ্তমান। থমকে গেল লোকটা। সুরার নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে যেন কিসের সংশয়। কামুক চাউনি কি ম্লান হচ্ছে? নিশির মনে এক চিলতে বল আসে। চোখ না সরিয়ে স্থির দৃষ্টি মেলে রইল লোকটির গতিবিধির উপর।
“তুই কে রে? কে তুই? মা কালীর মত দেখতে। তুই কি মা কালী নাকি? কাকে ধরে আনলাম?”। শ্বাপদের চাউনিতে ভয় আর দ্বিধা। শিকারির দৃষ্টিতে শিকারের অসহায়তা। আবার কাছে কোথাও বাজ পড়ল। তারই মাঝে নিশি টের পেল হাত পায়ের বাঁধন খুলে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে যেন দৈব বাণীর মতো শুনতে পেল “তোর বাঁধন খুলে দিচ্ছি, আমাকে ধাক্কা মেরে পালা। থামবি না। আমি ওদের আটকাচ্ছি। মায়ের ইজ্জত লিতে পারবনি। পালা! “।