বাংলার মুখ
গোবিন্দ মোদক
তোমার বুকের মধ্যে বহতা নদীটির
পোশাকি কোনও নাম না থাকলেও
তাতে ছায়া পড়ে বাংলার মুখের;
ইঁদুর দৌড়ে সামিল না হলে তুমিও দেখতে পেতে
জীবনানন্দের না লেখা অজস্র অক্ষরমালা,
হিজল বটের ছায়া, ভাটফুল, নিশিন্দা ঝোপ,
অবহেলায় ভেঙে পড়া পীরদরগা,
গ্রামীণ-মেলার চরিত্র বদল,
অবিন্যস্ত চুলের লাবণ্যহীন কিশোর-কিশোরী,
শঙ্খনগরের রূপকথা, কাশেমচাচার ডিঙি বাওয়া
কিংবা গাজনের সঙ।
চোখ কান খোলা রাখলে শুনতে পেতে
বোলান, জারি, মুর্শিদী, বাউল গান,
বালাকি কিংবা সত্যপীরের পাঁচালী।
ভোরের আজান তোমাকে মুগ্ধ করতো,
সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি তোমার অবচেতনে
বুলিয়ে যেত আবেশের প্রলেপ; তুমি টের পেতে –
বাংলার এই ধুলো-মাখা পথে পথে
একদিন নিমাই মানবধর্ম প্রচার করতেন;
এই পথের ধুলোযতেই মিশে আছে
তোমার পিতৃ-পুরুষের অবদান;
তুমি মনে করতে পারতে —
তোমার ঠাকুমা-দিদিমাই
একদিন ছিল কাঁথাশিল্পের পথিকৃৎ;
নকশি-বড়িতেও তাদের কোনও জুড়ি ছিল না।
তুমি টের পেতে — রথের মেলার আবেগ,
উপলব্ধি করতে ছেলেবেলার বৃষ্টি জুড়ে
কাগজের নৌকা ভাসানোর উন্মাদনা;
গ্রামীণ পুতুলনাচ আর যাত্রাপালা
তোমার চেতনাকে পুষ্ট করে তুলতো,
অশ্রুসজল হতো তোমার চোখ।
দুর্গাপুজো, মহরম কিংবা বড়দিনের আড়ম্বর
তোমাকে শোনাতো ধর্ম সমন্বয়ের শাশ্বত বার্তা।
খরা … বন্যা … দুর্ভিক্ষ … মহামারী …
জনজীবনকে ব্যাহত করলেও তুমি টের পেতে
ধ্বংসের বীজের মধ্যেই নিহিত আছে
নবজীবনের আশ্বাস।
তোমার উপলব্ধি জুড়ে অনুরণিত হতো
রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, কোরাণ,
জিন্দ্ আবেস্তা, গ্রন্থসাহেবের চিরন্তন বাণী।
তুমি নিশ্চিত বুঝতে পারতে —
পথের ধারে ঝোপের আড়ালে
যে ছোট্ট পাখিটি গেয়ে চলেছে
সেও তোমাকে কিছু বলতে চায়;
তোমার জনম দুঃখিনী বাংলা মা
তোমার একটু স্পর্শ পেতে চায়।
কিন্তু হায়! হায় সভ্যতা!
শকুনির মত অব্যর্থ পাশা নিক্ষেপ করে
সে জিতে নিয়েছে সমূহ আবেগ,
ভালোবাসা আর অনুরাগ।
তাই বাংলার মুখ আর তোমার চোখে পড়ে না।