মুক্তগদ্যঃ নার্সাসিজিম ও অনন্ত বৈধব্য – সৌমী আচার্য

যে রঙের ভিতর জড়িয়ে থাকব বলে আমি আদি অনন্তকাল বৈধব্যের ভিতর শুয়ে আছি তেমন রঙিন মানুষ আজও এলো না। একটার পর একটা ডাকটিকিট বেবাক। যে ডাকটিকিটে আমার প্রথম কৈশোরের গন্ধ মাখা ঠোঁট ছিল সে এক লম্পটের ঠিকানায় পৌঁছে গেল। বিশ্বাস নির্ভরতায় সিক্ত প্রথম বৃষ্টি ভেজা আমিকে গোপনে নিল ভীতু, ঘরকুনো কোনোদিন উঠতে না পারা ঢোড়া সাপ। এখন আর মনে রাখিনা কোনটায় কী এঁকেছিলাম? তবে ধুম জ্বরের ভিতর তেতো জিভ ভুলে প্রথমবার শান্তি পেয়েছিলাম যে ক্ষণে সেই ডাকটিকিটে মন কেমন ফিরোজা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই আমার আকাঙ্খিত সেই রঙ। কিন্তু উদাসী চোখের ভিতর বেভুল মানুষ সে, গিয়ে দাঁড়াল নড়বড়ে সাঁকোর উপর। কী অপূর্ব বেদনায় দুহাতে জমিন আসমান এক করতে করতে পৌঁছে গেল বহুদূর। আমি রাতের ভিতর ডাকি, ‘আয় তো আমার আলো, আয়, আয়’ আমি দিনের জৌলুসে ক্ষীণ স্বরে বলি, ‘আয় তো আমার ঘুম, আয় আয়’ আসে না। অন্ধকারের ভিতর জেগে থাকি। আলো আর ঘুম মিতালী পাতায়, লুকোচুরি খেলে আমার সাথে। আমার আয়ুর ভিতর মিশে যায় জন্মান্তরের শোক।
আসলে যে মানুষ নিজের হয়েও পরের হয়, যার কাছে প্রতিটি মানুষের ভিতর ঈশ্বর, সেই ফরিস্তা ভঙ্গুর সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে আজীবন। প্রেমের তৃষা বুকে নিয়েই জ্বলতে থাকে প্রদীপ হয়ে ওঠে। আমার চোখ ঝাপসা হতে হতে একদিন সাঁকোটাই মিলিয়ে যায়। জলের ভিতর নিজেকে দেখি। আচ্ছা নার্সাসিজিম নেই এমন মানুষ বেশি নাকি আমার মতো মানুষ? অবাক হয়ে নিজেকে দেখি। পোষাক খুলে নেমে যাই আরও গভীরে আরও আরও। আমার বুকের কাছে পাঁপড়ি মেলে দুটি পদ্ম যদিও বুড়ি নানি বলে ‘ও হল শঙ্খ, বাজানোর তেমন বাজনদার মেলে কি মেলে না, দেখ জীবনভোর।’ শঙ্খ! বাজনদার! নিজের দিকে চেয়ে থাকি। ডাকটিকিট জমতে থাকে, স্তূপের ভিতর ডুবে যাই আর কতটা খুঁজলে দেখা মেলে! সংকীর্তন চলেছে নগর জুড়ে, চোঙা ফুঁকে স্বপ্ন দেখায় যে তার হাতে শঙ্খ তুলে দিই। নাড়েচাড়ে অথচ বোঝে না, যত বলি বাজাও, সে বুঝে পায়না কোনপথে শঙ্খ নিনাদ করে।

আত্মরতি! নার্সাসিজিম! ছুঁড়ে ফেলি নিজেকে। মর্ মর্ তুই! কোনো রঙ এমন নেই যার ভিতর জড়িয়ে থাকা যায়, কোনো বাজনদার এমন নেই যে তোকে ধ্বনিত করে। মর্ তুই। বেশ তবে মরি। কিন্তু আসমানের একা চাঁদ তো মরেনা। কিসের পিয়াসে রয়ে যায় ক্ষয়ে যায় আবার পূর্ণ হয় সে? উত্তর দেবার গরজ কার? আশেপাশের সংসারপোকা ঠোঁট বেঁকিয়ে আমায় গথধরা জীবনের ছাঁচে ফেলতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। আমার মনের ভিতর আরও একলা ঘর গড়ে ওঠে। অথচ তারা নিয়ম করে আমায় পাঁচালি শোনায়, সংসারের কূটকাচালি। পাঁকের ভিতর নাক অবধি ডুবিয়ে টিকে থাকাতেই মোক্ষপ্রাপ্তি, এই সার সত্য আবৃত হতে থাকে। ঝাপসা দেখি সব সম্পর্ক। হাত পা বেঁধে চশমা এঁটে দেয় প্রাজ্ঞজন। ঝাড়ফুঁক তুকতাক চলে দফায় দফায়।

অথচ আমার ভিতর হাহা দুপুরের তীব্র গরম হাওয়া। সাতপাকে ঘুরতে ঘুরতে ভালো করে চেয়েছি এই বুঝি রঙের ঝলক চোখে পড়ে। কত রঙ প্যালেট জুড়ে। আমি চিৎকার করে উঠি, দুহাত কানে চেপে ধরি, ছুটে পালাতে চাই। বাজনদার কত রকম আওয়াজে মুখরিত করে চারিধার। দফায় দফায় সালিশি সভা বসে। ছুটে পালাই, হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে পাঁচিল ডিঙোতে চাই। আরও উঁচু হয় প্রাচীর, আরও উঠি, উঁচু উঁচু ক্ষত যন্ত্রণা। সব বিলাসে পরিণত হয়। পদ্মের নাল ভেঙে যায় এলিয়ে যায় পদ্ম। শঙ্খের পথ রুদ্ধ হয়। আঁচলে লাল মাটি লাগে, হেঁটে যাই আগামীর দিকে একা। বৈধব্য কলঙ্কের মতো জুড়ে থাকে আমার সত্ত্বায়। দোসর বিহীন জীবন খেজুর গাছের মতো। প্রয়োজনে কত কে আসে রসের স্রোতে তৃপ্ত হয়, রয়ে যায় কেবল কাঁটা। ছায়া হীন হাহা জীবনের শেষে সাঁকোটা দুলে ওঠে।
কেও কোথাও নেই। দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর। ধানকাটা শেষে রিক্ত সে জমিতে মৃত্যু গজিয়ে ওঠে। আমি শেষবারের মতো হাঁকি, ‘এই জ্যোৎস্নার উপর কে কে তুমি রয়েছ জেগে? কে তুমি ধোঁয়াটে সাঁকোর ওপাশে আমায় হাঁক দিয়ে যাও?’ রামধনু ফুটে ওঠে। জলের ভিতর আর নিজেকে খুঁজে পাইনা। সাদাটে ধোঁয়া অতৃপ্তি নিয়ে চেয়ে থাকে মায়াময় পৃথিবীর উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *