আগমনীর গল্পগাথা
অদিতি ঘোষ দস্তিদার
দিম্মার এই পুজোর ঘরটাতে এলে একটা দারুন অনুভূতি হয় তিতিরের। অবশ্য পুজোর ঘর না বলে আরাধনার ঘর বললেই ভালো হয়- ঘরে দেবদেবীর মূর্তি বা ছবি কিছুই নেই. শুধু একটা ছোট্ট বেদীর ওপর একটা বীণা। নিচে মেঝেতে হারমোনিয়াম, খোল. করতাল, মৃদঙ্গ আর তার সঙ্গে আরো কিছু লোকজ বাজনা যার নাম তিতির জানে না।
দাদু আর দিম্মা দুজনেই গান বাজনা করতেন- পুরাতনী, কীর্তন, শ্যামাসংগীত – মূলত লোকগান।
দুবছর আগে দাদু চলে গেছেন। দিম্মা একা এখন। তিতিরের মা আর মামা দুজনেই গলাতেই সুর আছে, কিন্তু কেউই গান বাজনা সে ভাবে করেন না, চাকরি নিয়ে দুজনেই বেজায় ব্যস্ত।
তিতির অবশ্য ছোটোবেলা থেকেই গান শিখেছে, মূলত শাস্ত্রীয় – কিন্তু দিম্মার কাছে এলে গান আর গানের গল্পে সময় কাটে। দাদু চলে যাবার পর গানকে আশ্রয় করেই দিম্মার জীবন – মা বা মামা কারোর সঙ্গেই থাকতে রাজি নন, তবে মাঝে মাঝেই তিতির এসে থাকে।
তিতির যাচ্ছে ব্যাঙ্গালোরে – মাস্টার্স করতে।
এ বছর পুজোর সময় থাকবে না- তাই বাবা মা যাবেন। যাবার আগে সারাদিন আজ দিম্মার কাছে কাটানোর প্ল্যান। দিম্মাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মা, কিন্তু দিম্মার পুজোর চারদিন বেশ কিছু জায়গায় গান গাওয়া আছে। তাই যাওয়া সম্ভব নয়।
তিতিরের কাছে দিম্মার ফ্ল্যাটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে- ভেতরে ঢুকে দিম্মাকে দেখতে পায়নি- বুঝেছে স্নানে গেছেন।
চুল ঝাড়তে ঝাড়তে প্রণতি বসার ঘরে এসে দেখেন তিতির বসে আছে।
“কখন এলি? একটা ফোন করে তো মানুষ আসে, কী খাবি?”
“কিচ্ছু না, তুমি খেতে বস!”
“দাঁড়া, একটু পুজো করে আসি!”
দিম্মার পুজো মানে যে গান, তিতির জানে। সেই জন্যেই এই সময়টা চুপি চুপি এসেছে, আগে থাকতে বললেই দিম্মা সব সেরে বসে থাকতেন তড়িঘড়ি।
“দিম্মা আজ যে গানগুলো গাইলে সব শ্যামাসঙ্গীত?”
“শুধু কি শ্যামা, উমা সঙ্গীতও তো গাইলাম। আশ্বিন মাস পড়ে গেলেই আমার আগমনী গান গাওয়া শুরু হয়! জয় গোস্বামীর কবিতাটা মনে ভাসে,
কবিতার এই সাদা খাতায় লাঙল দিতে দিতে
হালের মুখে পেয়েছি তোকে, শিশু
কী নাম দেব? কী নাম দেব? ভেবে জীবন চলে গেছে
ভেবে না পাই কিছু।
দুঃখী ঘরে গৃহিণী আছে, দিয়েছি তার কোলে
সে বলেছে, “গৌরী এলো, গৌরী এলো আজ।”
আকাশে ঘন নীল রঙ, মাটিতে কাশ ফুল, পরিয়ে দিল তোকে ডাকের সাজ!”
“গৌরী এল, দেখে যা লো
ভবের ভবানী আমার
ভবন করিল আলো!” তিতির গেয়ে ওঠে!
“দোহারের গান! সুন্দর গাইলি!”
“তাই দিম্মা? গান হচ্ছে না অনেকদিন! সে যাকগে, আচ্ছা, বলো তো উমা সংগীত মানেই কি আগমনী?”
“বলছি দাঁড়া – আগে বল, তুই কবে যেন যাচ্ছিস?”
“পরশু। কাল আর হবে না, তাই আজ তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে এলাম!”
“পুজোর আগেই চললি! আর কটাদিন পরই তো মহালয়া!”
“হ্যাঁ গো, কী আর করা যাবে বলো, তবে মা বাবা পুজোর সময় যাচ্ছে – অন্তত কটাদিন ভালোমন্দ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হব না!”
প্রণতি হাসলেন।
“কালে কালে কী দিন এল, উমার বাড়ি যাচ্ছে কিনা মেনকা আর গিরিরাজ- মেনকার মায়ের নাম অবশ্য আমি জানি না…”
“কী যে বলো, আমি কি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি? যাচ্ছি তো পড়তে!”
“সেইজন্যে তো আমার গর্বে বুক ফুলে উঠছে- কিন্তু এই যে নিজের বাড়ি, মা বাবা ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে যাচ্ছিস, এর বেদনাও তো কম নয়- তাই না? আবার এই শরৎকালে!”
“তুমি কিন্তু একপেশে হচ্ছ। শুধু উমাকে নিয়ে ভাবছ কেন? আমার বন্ধু রোহিত, উত্তরণ, অর্পণ সবাই তো এই সময় পড়তে নানা জায়গায় যাচ্ছে, কেউ কেউ তো আবার বিদেশেও। গোপালদের জন্যে মনখারাপের বুঝি কোনো গান নেই?”
“আরে যুগটা বোঝ। এসব গান লেখা তো সেই যুগে যখন গৌরীদান হত -মানে পাঁচ থেকে আটবছরের মেয়েদের বিয়ে। তারপর তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো মানে চিরকালের মতো পর হয়ে যাওয়া! আর গোপাল মানে কৃষ্ণকে নিয়ে তো পুরো বৈষ্ণব পদাবলীই- তবে সে গানের বেশির ভাগ বিষয় রাধাকৃষ্ণ, মেয়েদের জন্যে এমন আকুল গান কই! যিনি লিখলেন তিনি সত্যিই ব্যতিক্রমী রে!”
“কে তিনি দিম্মা?”
“কবিকঙ্কন রামপ্ৰসাদ সেন. তিনিই এই আগমনী গানের স্রষ্টা! আগমনী হচ্ছে শাক্ত পদাবলীর একটা অঙ্গ!”
“আচ্ছা বললে না তো উমা সংগীত মানে কি শুধুই আগমনী?”
“না রে, আগমনী আর বিজয়া! এক বছর পর উমা আসবে, উমাকে আনতে যাওয়া নিয়ে, উমার আসা নিয়ে যে সব গান তা হল আগমনী আর উমা কৈলাসে চলে যাবার পর মায়ের যে হাহাকার সে বিষয় নিয়ে গান হল বিজয়া!”
“এ কি শুধু বাংলাতেই দিম্মা?”
“হ্যাঁ রে, এই গিরিরাজ বিশেষত মেনকা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কিন্তু ভারতের অন্য কোনো প্রদেশে নেই. বাঙালি তো চিরকালই আবেগপ্রবণ। শিব দুর্গার কাহিনি নিয়েই শাক্ত পদাবলি- কিন্তু উমার মা মেনকা সেখানে বেশ এক জোরালো চরিত্র। আসলে বাঙালি জীবনে বিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে মায়ের যে সম্পর্ক তা তো যুগ যুগ ধরে একই, তাই এই ইন্টারনেটের যুগেও যখন শুনি, ‘আমি দেখেছি স্বপন আমার উমাধন আছে আশা পথ চেয়ে,’ চোখ ভিজে আসে, আর তোর মা বাবা সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে পুজোর দিন ছুটছে তোর কাছে। তফাৎ শুধু এইটুকুই, আবেদনটা চিরন্তন! তার ওপর শিবের চরিত্রটাও দেখ! সেই তাণ্ডবের দেবতা শিবকে বাঙালি নাদুসনুদুস ভুঁড়িওলা জামাই বানিয়েছে, সংসারে তার হুঁশ নেই, আহা রে মেয়েটার কত জ্বালা!”
তিতির মুখ টিপে হাসল।
“তুমি আমার বাবাকেও তাই ভাবো বুঝি?”
প্রণতি দ্বিধায় পড়লেন। সত্যি কথা বলতে জামাইটি তাঁর সত্যিই সদাশিব, কাজ ছাড়া কোনো দিকেই খেয়াল নেই! মিঠু মানে তিতিরের মাকে তাই সবটা সামলাতে হয়!
“জানি তুমি কী ভাবছ, সত্যিই গো মা ছাড়া সংসার অন্ধকার!”
“হা হা, আর মেনকা কী ভাবছে জানিস?
যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা বুঝি আমার কাঁদিছে
উমার যতেক বসন ভূষণ
ভোলা বুঝি সব বেচে খেয়েছে!”
তিতির খিল খিল করে হেসে ওঠে। প্রণতি বলে চলেন, “তাই মেনকা বলেন,
গিরি আর উমা পাঠাব না
বলে বলবে মন্দ লোকে, কারো কথা শুনব না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয়
এবার মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া জামাই বলে মানব না এবার আমার উমা এলে!”’
“কিন্তু তা তো আর হয় না, পাঠাতেই হয়, তাই না?”
“সে তো হবেই। তবে জানিস, এই এক ‘এবার আমার উমা এলে’র কত রকম ফের, সুরে কথায়!”
“তাই একটু শোনাও!”
প্রণতি গুনগুন করে গোটা তিনেক সুরের চলন দেখান। একটা খাঁটি রামপ্রসাদী, একটা মেঠো সুরে একটা আবার পুরোপুরি শাস্ত্রীয়!
তিতিরের চোখেমুখে মুগ্ধতা!
“কী সুন্দর গাও যে তুমি!”
প্রণতি একটু হেসে শুরু করেন। এসব কথা বলতে গেলে মনে বাঁধ ভেঙে যায়।
“মায়ের মন তো স্বপ্ন দেখে চমকে ওঠে! কত কুচিন্তা হয়! সেই নিয়ে আগমনী,
বাছার নাই সে বরণ, নাই আভরণ
হেমাঙ্গি হয়েছে কালির বরণ
হেরে তার আকার চিনে ওঠা ভার
উমা আমার উমা নাই হে আর!”
“আহা রে! কী আবেগ গানে!”
প্রণতি ঘাড় নাড়েন।
“মেনকা তো বলে বলে ক্লান্ত, তবু গিরিরাজ আনতে আর যান না উমাকে। তখন মেনকা বলছেন,
আজি কালি করে দিবস যাবে
প্রাণের উমারে আনিবে কবে
প্রতিদিন কি হে আমায় ভুলাবে
এ কি তব অবিচার?’”
“আর গিরি এসব শোনার পর যখন যাচ্ছেন কৈলাসে তখন মেনকা বলছেন, ‘এবার আমার উমা এলে আর পাঠাব না,’ তাই না?”
“সে তো বলছেনই, আবার মেনকার সাধ কৈলাস গিরিরাজপুরেই বসানো যাক!
ঘরজামাতা করি রাখব কৃত্তিবাস,
গিরিপুরে করব দ্বিতীয় কৈলাস
হরগৌরী চক্ষে হেরব বারোমাস,
বৎসরান্তে আনতে যেতে হবে না!”
“এ সব গান শাক্ত কবিদের তাই তো?”
“একদম! শাক্ত পদকর্তারা ছেলেমেয়ে আর মায়ের যেমন সম্পর্ক, মান অভিমান, খুনসুটি, রাগ সেই সবই জগন্মাতা মানে দেবী দুর্গা বা কালীর সঙ্গে করেছেন। রামপ্রসাদ বলছেন, ‘তাই আমি অভিমান করি শঙ্করী!”’
“আবার আর একটা গান আছে না দিম্মা, “চাই না মাগো রাজা হতে, রাজা হবার সাধ নাই মাগো, দুবেলা যেন পাই মা খেতে!”’
“শাক্তকবিদের জাগতিক চাহিদা কম রে, মসক কাছে পাবার আকুতিই বেশি! রামপ্রসাদ বলছেন,
‘ও মা কালী চিরকালই সং সাজালি এ সংসারে
এ সং সাজায় নাইকো মজা, সাজা পাই মা অন্তরে!’”
“কী সুন্দর চলন গানের!”
“এবার এটা শোন, অভিমানে বলছেন প্রসাদ, ‘মাগো তারা ও শঙ্করী
কোন অবিচারে আমার ‘পরে করলে দুঃখের ডিক্রিজারি!’”
“একদম কথা বলার ভাষা গান হয়ে ফুটে উঠছে, তাই না?”
“তাই জন্যেই জানিস শাক্ত পদাবলীর পদগুলো মানুষের এত কাছের। পদগুলো সাধনসঙ্গীতকিন্তু আসলে মানুষের জীবন সঙ্গীত!”
তিতির হেসে প্রশ্ন করল, “তাহলে শাক্তকবিরাই প্রথম জীবনমুখী গান শুরু করেছিলেন বলো? এসব নতুন কিছু ভাবনা নয়?”
“আরে পাগলী, শিল্প সংগীত সাহিত্য কি জীবন বাদ দিয়ে হয়? সেই জন্যেই শাক্ত পদাবলীর গান আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে, বৈষ্ণব পদাবলী নয়!”
“কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীই তো শাক্ত পদাবলীর অনুপ্রেরণা?”
“না রে, অনেকে তা ভাবলেও আমার মনে হয় সেটা শুধু বাইরের দিকটা, মানে চলনটলন আর কী! শাক্ত পদাবলীর মূল ভাব কিন্তু মঙ্গল সাহিত্যের থেকে নেওয়া। তুই জানিস তো মঙ্গল কাব্য?”
“হ্যাঁ রে বাবা, আচ্ছা অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে শাক্ত পদাবলী কি ছিল না?”
“শাক্ত সঙ্গীত ছিল। নানান জায়গায় ছড়ানো। কিন্তু এই সময়ই অসাধারণ সব শাক্ত কবিদের প্রতিভার সোনারকাঠির ছোঁয়ায় শাক্ত পদাবলী আমাদের বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে উঠেছে রে!”
“রামপ্রসাদই তো শুরু করে দিলেন এই ধারা?”
“স্রষ্টা তিনি, শ্রেষ্ঠও তিনি!”
“কিন্তু এই অষ্টাদশ শতাব্দীতেই বা কেন? কিছু কি বিশেষ কারণ আছে?”
“দেখ কোনো শিল্প বা সাহিত্যসৃষ্টিই তো যুগ বা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে নয়। এই সময় বাংলার যে সামাজিক আর আর্থিক ভাঙন হয়েছিল তাতে মানুষ দিশাহারা, বলতে পারিস হরেক রকমের রাজশক্তির অত্যাচার!”
“মানে নবাব, জমিদার এই সব বলছ তো?”
“পলাশীর যুদ্ধ, ১৭৭৬ সাল, তার মানে কোম্পানির শোষণও শুরু! তাই তখন বাঙালি বরাভয়দাত্রী মূর্তি খুঁজছে, যা একদিকে দুষ্টের বিনাশ করবে আবার একদিকে মা হয়ে সন্তানস্নেহে পালন করবে – কে বল তো তিনি?
“দুর্গা?”
“কালীও, মাতৃশক্তির আরাধনা!”
“তাই তারপরই এল শ্যামাসঙ্গীত? আবার উমা সঙ্গীতও!”
“হ্যাঁ, আবার কেউ কেউ আবার বলেন মালসী। মালশ্রী রাগে ভক্তিমূলক দেবীর গান গাওয়া হত, এটা আসলে লোকসঙ্গীত – কথিত আছে মালশ্রী নাকি ভৈরব রাগের প্রিয়া। আর ভৈরব বা শিবের প্রিয়া কে?”
“উমা মানে মা দুর্গা!”
“একদমই তাই!”
“তাহলে বৈষ্ণব পদাবলী একেবারে শেষ হয়ে গেল দিম্মা?”
“শেষ কি হয় রে সোনা? ‘দিনের সব তারাই থাকে রাতের আলোর গভীরে!’ রামপ্রসাদের এই গানগুলো শোন
‘কালী হলি মা রাসবিহারী
নটবর বেশে বৃন্দাবনে!’
আবার
প্রসাদ হাসিছে, সরসে ভাসিছে
বুঝেছি জননী মনে বিচারি
মহাকাল কানু শ্যামা শ্যামতনু
একই সকল সকল বুঝিতে নারি!’ শ্যামা আর শ্যাম একাকার!”
“আচ্ছা সে না হয় হল, কিন্তু আমায় বলো, সব উমা সঙ্গীত তো মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার পরই মেনকা গাইছে, উমার ছোটোবেলায় তার মা বুঝি গান গায়নি? আমার মা তো ছোটোবেলায় কত গান শোনাত আমায় বলো! তুমিও নিশ্চয়ই মাকে শুনিয়েছ!”
“আছে রে! ‘উমা নাকি আকাশের চাঁদ ধরতে যায়!’”
“তাই? গণেশকে বলে গানুস? উমা বড্ড ছেলেমানুষ, না দিম্মা!”
প্রণতি হাসলেন। টোল পড়ল শুকনো গালে।
“রোজ যা দেখা তাই নিয়েই তো কাব্য করা রে, তাই রামপ্রসাদ লিখছেন,
উমা কেঁদে করে অভিমান, নাহি করে স্তন্য পান
নাহি খায় ক্ষীর ছানা সবে
অতি অবশেষ নিশি, গগনে উদয় শশী
বলে উমা, ধরে দে উহাবে!”
“আহা রে! আর সেই কচি মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো!”
“হ্যাঁ তাই আগমনী গানে তত্ত্বের থেকে আবেগ বেশি। যত সাধারণ কথা, ততই প্রাণের কাছাকাছি। যদিও এ গানের মূল তত্ত্ব শক্তিরূপিণী দেবীকে মর্ত্যে আনা তারপর আবার তাঁর ধামে পাঠানো। সাধনা স্তরে একটা বৃত্তের মতো!”
“ওরে বাবা রে, এত শক্ত কথা আমি বুঝছি না!”
“এই তো! ঠিক তোর মতো সাধারণ মানুষও সাধনতত্ত্ব বোঝে না, সে জানে তার মেয়েটি পরের ঘরে গেলে কী যন্ত্রণা মনে! তাই আগমনী এত প্রাণের গান!
‘গিরি গৌরী আমার এল কৈ?
ঐ যে সবাই দাঁড়িয়েছে এসে,
শুধু সুধামুখী আমার প্রাণের উমা নেই!’ যে গরীব বাবা মায়ের মেয়েটি কোনো কারণে আসতে পারেনি উৎসবের দিনে বাপের ঘরে, তার বেদনাই কবির গানে রে!”
“আহা গো!”
“আবার আর একটা শোন, কী কাব্যিক!
সুনীল আকাশে ঐ শশি দেখি
কৈ গিরি আমার কই শশিমুখী?
শেফালিকা এল উমার বর্ণ মাখি,
বল বল আমার কোথা বর্ণময়ী!”
“মন ভরে গেল দিম্মা। এবার উঠব গো!”
তিতির বেরিয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকলেন প্রণতি। এবার পুজোটা একেবারে ফাঁকা কাটবে। নাতনি তো থাকবেই না, মেয়ে জামাইও যাবে তাদের কন্যার কাছে।
জীবনের নিয়মই এই!
শরৎআকাশে রোদ ছায়ার লুকোচুরি। প্রণতি গুনগুন করলেন,
“তনয়া পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন
হায়, হায় এ কী বিড়ম্বনা বিধাতার!”