গল্পঃ জারজ – মৌলীনাথ গোস্বামী

জারজ
মৌলীনাথ গোস্বামী

নর্দমার মতো সরু গলির দুইপাশে কাঠি ফুরিয়ে যাওয়া অনেক পুরোনো ময়লা
দেশলাই বাক্সের মতো সারি সারি ঘর। একদা অভিবাসীদের বংশপরম্পরাক্রমিক
চিরকালীন আস্তানা। তাহলে বোধহয় ঘর না বলে বাড়িই বলা চলে। বাইরে
পলেস্তারা খসে পড়া দেওয়ালে ফাটা গোড়ালির মতো ফাটলের অজস্র কাটাকুটি।
দেওয়ালের এক একটা অংশ এক এক রঙের। কোনটা হলদে, কোনটা গেরুয়া, বা
নীল। সব দেওয়ালের গায়ে কেমন একটা ক্লান্তির ছাপ। গলিতে দাঁড়িয়ে তাকালে
দেওয়ালের থেকে বেশি দরজা দেখা যায়। দরজাগুলো থেকে থেকেই কিছুক্ষণের
জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কোনটায় বহুবছরের আকাচা পর্দা ঝোলে। কোন দরজা
বেআব্রু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাঁতহীন অশীতিপর বৃদ্ধার মতো। ঘরগুলোর ভেতরে
আলকাতরার মতো ঘন রহস্যময় অন্ধকার।
        প্রত্যেকটা ঘর, সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পথচারী পুরুষদের রোজ ডাকে। ঘর
ডাকে, না ঘরের মানুষগুলো ডাকে? কখনও শাড়ী বা লং স্কার্ট হাঁটুর ওপরে উঠিয়ে
মোড়ায় বসে, কখনও বা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে, কখনও বা বুকের থেকে শাড়ি সরিয়ে
পেট বের করে থামে হেলান দিয়ে, অথবা ঘরেরই চৌকাঠে হাঁটু ভেঙে পা-ফাঁক করে
বসা থেকে ডেকে ওঠে – “যাবে নাকি?” যারা ডাকে তারাও ওই ঘরগুলোর মতোই
অভিন্ন। জীবনের পলেস্তারা খসে পড়া মানুষজন – উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী,
ভরন্ত যুবতী, বিগতযৌবনা মাঝবয়সী ভুঁড়িওলা থলথলে মহিলা। ভাঙা অস্তিত্ব
ঢেকে রাখতে তাদের গায়ে নয়নভোলানো মোহিনী পোশাক – কারও স্বচ্ছ, কারও
সংক্ষিপ্ত। অন্তর্বাস দেখা যায়। মুখে চড়া সাদাটে পাউডারের প্রলেপ, চোখে
লাইনার, ঠোঁটে পুরু লিপস্টিক। জীবনের অভ্যন্তরীণ রংহীনতাকে বাহ্যিক রঙের
প্রলেপ দিয়ে ঢেকে আকৃষ্ট করে রাখার মরিয়া প্রয়াস। চলমান বিসদৃশ রংগুলো
হাত নেড়ে নিশির ডাকের মতো প্রত্যেকদিন দুপুরের পর থেকে ডাকাডাকি করে।
       তেমনই এক নিস্তেজ দেশলাইয়ের খোলের মধ্যে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে
বসে মাঝবয়সী আয়েশা। যৌবন গোধূলির দিকে ঢলে পড়ব পড়ব করেও সূর্যাস্তের
শেষ আলোর মতো লেগে আছে মেদবহুল শরীরে। বেশ কিছুদিন হলো ভালোই ভুগলো
সে। এইসব ঘরের বাসিন্দাদের অবশ্য রোগজ্বালা আকচার লেগেই থাকে।
বেশিরভাগই মেয়েলি গুপ্ত রোগ। হবে নাই বা কেন, মেথর থেকে খালাসি, সবরকম
মানুষকে নিয়েই বিছানায় শুতে হয়। কত রোগ নিঃশব্দে এসে শরীরে বাসা বাঁধে।
তারই হ্যাপা পোহাতে হয়। বাছবিচার করলে তো পেটও চলবে না আর বাড়িওলি

ধুমসি মাসির ভাড়াও দেওয়া হবে না। মাসের তিন তারিখ পেরতে না পেরতেই খিস্তি
খেউর শুরু করে দেবে। এত বছর এই ঘরটায় আছে আয়েশা, অথচ মাসির স্বভাব
বদলালো না। সেই কোন সতেরো বছর বয়সে স্বামী নামক নিকা করা লোকটা
একদিন এখানে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে এই চার হাতের ঘরখানাই ওর
বাড়ি, ওর সংসার। আয়েশার যৌবন গনগনে মধ্যাহ্নের সূর্য থেকে অস্তগামী সূর্যে
বদলে গেল, অথচ মাসি একই রয়ে গেল।

অনেকদিন পরে সকাল থেকে শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছিল আয়েশার। সেই
সঙ্গে মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিল, গোটা একটা সপ্তাহ কাজ করা হয়নি।
খদ্দের ঢোকানো হয়নি একটাও। গত দু’দিন হলো কোনরকমে একটু রান্নাবাড়া
করতে পেরেছে। ছেলেটা কেবল ঘ্যানঘ্যান করছিল। মায়ের হাতের রান্না ছাড়া খেতে
চায় না। পাশের ঘরের বিলাসী আর ময়নারা মিলে এই ক’দিন দুপুরে ওকে রেঁধে
খাইয়েছে বটে কিন্তু মন্টু কিছুতেই মুখে তোলেনি সেসব। দুপুরে যদিও বা বাবা-বাছা
বলে খাওয়ানো গেছে, রাতে আর ওর দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায় কারও।
বিলাসীদের সবার নজর তখন খদ্দেরের দিকে। আর মন্টু কেবল এসে এসে
শয্যাশায়ী মায়ের কাছে খাবারের জন্য বায়না করেছে। বছর ছয়-সাত হবে। এই
মন্টুর জন্যই ধস্ত শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে গত দুদিন ভাতেভাত ফুটিয়েছে
আয়েশা। মায়ের হাতের ফেনভাত পেয়ে ছেলের ফুর্তি দেখে কে! একেবারে ছাড়া গরু।
        মন্টুর বাপ কে আয়েশা জানে না। সঙ্গমের হিন্দু-মুসলমান হয় না আয়েশা
জানে। তাই কোনদিন কোন খদ্দেরের নাম জিজ্ঞেস করেনি। লোকগুলো করে কখনো
সখনো। আয়েশার জামাকাপড় খুলতে খুলতে অহেতুক কিছু প্রশ্ন করে, ক’রে
উত্তরের অপেক্ষা না করেই যে কাজের জন্য আসা সেই কাজে হামলে পড়ে।
আয়েশার সয়ে গেছে এইসব। সে যন্ত্রের মতো বুভুক্ষু লোকগুলোর সাথে সংগত
করে যতক্ষণ ওরা ছিঁড়ে খায় ওকে। কেউ নিরোধ পরে, কেউ হাজার বললেও ঢাকনা
নেয় না। বেশি চাপাচাপি করলে মাসিকে নালিশ ঠোকে। বুড়ি বাপ-মা তুলে গাল পাড়ে।
ওদিকে আবার খদ্দের খসে যাওয়ার ভয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়
আয়েশাকে। এমন মাঝেমধ্যে হয়, আয়েশারও আবেশ চলে আসে। সেও তো মানুষ
একটা। নিজেকে যন্ত্র বানিয়ে রাখা তারও সবসময় সম্ভব হয় না। এমনই কোন
বেসামাল সন্ধে বা অজ্ঞাতপরিচয় রাতের ফসল মন্টু।
      বুড়ি মাসি এন্তার গাল পাড়ত যতদিন পোয়াতি ছিল আয়েশা। তাও প্রথম
ক’মাস, যতদিন না পেট ফুলে জানান দিতে শুরু করেছে, খদ্দের নিয়েছিল সে। একটু
সাবধানেই নিত। বুড়িকে বলেনি। এই পট্টির অনেকেই বাচ্চা বিইয়েছে। শুরুতে বুড়ির
কাছে চেপে গেছে। কিন্তু পোয়াতির পেট ক’দিন আর চাপা থাকে! বুড়ি যখন জানতে

পারে, তখন আর বাচ্চা খসানোর উপায় থাকে না। তাই এই পট্টির কেউ না কেউ
কখনো না কখনো বাচ্চা বিয়োয়। সেগুলো আর চারটে বেওয়ারিশ এন্ডিগেন্ডির
সাথেই ন্যাংটোপোঁদে মায়েদের রঙ্গতামাশা দেখতে দেখতে এলাকার কুকুর বেড়ালের
সাথে বড় হয়। ছেলেগুলো সেই ছোট্টবেলা থেকেই দালাল, গাঁজাড়ি, বেশ্যাদের মাঝে
বড় হতে হতে চোস্ত খিস্তিখেউর শেখে, মুখে গালিগালাজের খই ফোটে; বেজন্মা
মেয়েগুলোও শেখে তবে প্রকাশ্যে আওড়ায় না, বরং মায়েদের রংঢং একটু একটু
করে রপ্ত করে। কেবল নিজেরা যখন ঝগড়া করে তখন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি আর
অশ্রাব্য ভাষার বাঁধ খুলে যায়।
      মন্টুকে নিয়ে প্রথম প্রথম সন্ধের পর থেকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হত
আয়েশাকে। দুপুরে সাধারণত ঘরে লোক ঢোকায় না আয়েশা। দুপুর অবধি গড়িমসি
করে কাটায়। কিন্তু মন্টুকে পেটে ধরার জন্য এবং ডেলিভারির পরের কয়েক মাস
কাজ করতে পারেনি আয়েশা। অনেক টাকা লোকসান হয়েছিল। তাই একটু একটু করে
পুষিয়ে নিতে মাঝেমধ্যে দুপুরে কেউ করতে চাইলে ফেরাত না। মন্টুও ঘুমিয়ে থাকত।
ব্যাঘাত ঘটত না। সমস্যা হত সন্ধের পর থেকে। মন্টুকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে
রেখে তড়িঘড়ি কোনরকমে মুখে চুনকাম করে, কোনদিন মাথায় জুঁইফুলের মালা
ঝুলিয়ে খদ্দের ডাকবে বলে রাস্তায় দাঁড়াত সে। হাতছানি, অঙ্গভঙ্গি, চোখের
কটাক্ষ ইশারা, শাড়ি তুলে থাই দেখানো, সবই করত। হাঘরের অভাব নেই। সন্ধে
হলেই পট্টির ঘরগুলোর সামনে মাছির মতো ভনভন করে। খদ্দেরের ভিড় লেগে
যেত। একটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে প্রথমেই মন্টুকে মেঝেতে শুইয়ে দিত। তারপর কাজে
লেগে পড়ত। বাধ সাধত মন্টু। আয়েশাকে নিয়ে খদ্দেরের ধামসাধামসির মাঝেই
অবধারিতভাবে তারস্বরে চ‍্যাঁ করে কেঁদে উঠত। মৌতাতে বিঘ্ন ঘটায় বিরক্ত হত
রসের নাগর। নেশা ছুটে গেলে গাল দিত। তখন এমন দিনও গেছে নগরের সাথে ওই
অবস্থায় মাটিতে নেমে আসতে হয়েছে আয়েশাকে। এক হাতে মন্টুকে থাবা দিয়েছে,
অন্য হাতে খদ্দেরকে। আবার এমনও হয়েছে মন্টুর মুখে একটা মাই গুঁজে আর
একটা গুঁজে দিতে হয়েছে পুলকিত খদ্দেরের মুখে। খুশি হয়ে বেশি বকশিশও পেয়েছে
আয়েশা। তবে মন্টু যতদিন ছোট ছিল ওর সামনে একইঘরে গ্রাহকের সাথে করতে
অস্বস্তি হত না আয়েশার। কিন্তু মন্টু যখন থেকে কথা বলা শুরু করল, একটু
বুঝতে শিখল তখন আর ওর সামনে একই ঘরে লোক নিত না আয়েশা। মন্টুকে
ঘরের বাইরে বের করে দিত। বিলাসী, রেশমীরা যে যখন পারত আয়েশার না হওয়া
অবধি মন্টুকে সামাল দিত। এভাবেই পট্টির সব মন্টুদের সামাল দিত মন্টুদের
খেটে-খাওয়া মায়েরা। দিয়ে আসছে। দেবেও।
       একটু বেলা অবধিই শুয়েছিল আয়েশা। শুয়ে ভাবছিল, আজ খদ্দের না নিলেই
নয়। এরপর মাসির বাখান শুনতে হবে। ঠিক তখনই পর্দা ঠেলে বৃদ্ধ মোষের মতন

থপথপ করে মাসি এসে ঢুকল। মুখে পানের টোপলা। “বলি বেগমের আজ কি গতর
খাটানো হবে? মাগী তোর জাঙের ফাঁকে তো মাকড়সার জাল গজিয়ে গেছে!” কাঁসার
বাসনের মতো ঝনঝন করে উঠল মহিলার গলা। এই গলার জোরেই এই এতবড়
সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছে এতদিন ধরে।
     “সকাল সকাল মুখ খারাপ করো না তো মাসি। সাধ করে কি শুয়ে আছি?
হারামিগুলোকে নিরোধ পরিয়ে পাঠাতে পার না? শালা কে কোন ভাগাড় থেকে মারিয়ে
আসে!” আয়েশা পাল্টা জবাব দেয়।
    “তোর বড় চোপা বেড়েছে। খালি খরখর করিস। চল ওঠ। আজ কাজে বসবি
তো, নাকি?”
     “না বসলে চলবে? এসেছ তো ভাড়ার টাকা কবে পাবে সেই দেখতে। আচ্ছা
মাসি, এখানে আমার এত বছর হয়ে গেল, এতদিন ধরে দেখছ আমাকে, কোন মাসে
তোমার পাওনা বাকি রেখে ফুর্তি করেছি আমি, যে আজও আমার পেছনে ছোঁকছোঁক
করছ টাকার জন্য?” আয়েশা শুধায়।
     “তোদের মাগীদের কাউকে বিশ্বাস নেই। কবে কোন লভর জুটিয়ে উড়ে যাবি।
যায় নি আট নম্বর ঘরের সাবিত্রী? এতগুলো বচ্চর এখানে রেখে পাললাম। ছাদ-
খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। নেমকহারাম ডাঁসা ছোকরা দেখল কী পটিয়ে পালিয়ে
গেল! তোদের কাউকে বিশ্বাস নেই। কাল ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিস।” মোষের মতো
জাবর কাটতে কাটতে চলে যায় মাসি। আয়েশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ে
খাট থেকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আলুথালু শাড়িটা
কোনরকমে শরীরে আলগোছে পেঁচিয়ে গ্যাস ধরিয়ে ভাতের জল বসায়। বসিয়ে
তোষকের তলা থেকে কয়েকটা নোট বের করে ঘরের বাইরে পা রাখে। অনেকদিন
পরে ঘুপচি ঘরখানা থেকে বেরিয়ে জোরে স্বাস নেয় আয়েশা। বাইরের বাতাসের
গন্ধটা ভালো লাগে। ঘরে তো সবসময় ভ্যাপসা গন্ধ… মানুষের ঘামের গন্ধ, তাদের
মুখের আর গায়ের ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ, সস্তা সেন্ট পাউডারের তীব্র বাস, আর
ফ্যাদামাখা ন্যাকড়ার পুতিগন্ধ মিলিয়ে সবসময় বিশ্রী একটা ইঁদুরপচা দুর্গন্ধ
ভেসে থাকে চার দেওয়ালের ভেতর। ঘরে একখানা জানলাও নেই। দরজা দিয়ে
গন্ধগুলো কেবলই আয়েশার কোমর জড়িয়ে ঢোকে, আর বেরয় না।
       বেরিয়েই রাস্তার উল্টোদিকে একটু এগিয়েই শম্ভুর দোকান। নুন থেকে
নিরোধ, সব রাখে শম্ভু। ওরা ডাকে শম্ভুদা বলে। ওদের প্রত্যেক দিনের সব
ঘটনার নীরব সাক্ষী শম্ভু। শরীরে মায়াদয়া আছে। বিপদে আপদে ওদের পাশে এসে
দাঁড়ায়। সবাই শম্ভুর সাথে সদ্ভাব রাখে কারণ খদ্দেররা ওর দোকানে দাঁড়িয়েই
সিগারেট খেতে খেতে মেয়েদের জরিপ করে, কোন ঘরে ভালো মেয়ে আছে তার
খোঁজখবর নেয়। শম্ভু পালা করে সবাইকে এক একজনের ঘরে পাঠায়।
“শম্ভুদা, চারটে ডিম দাও।” আয়েশাকে দেখে হাসে শম্ভু।

“শরীর সেরে গেছে দেখছি। আজ অনেকদিন বাদে বেরিয়েছ…,” খবরাখবর নেয়
সে।
“না বেরলে চলবে? না খেয়ে মরতে হবে যে। আমায় তো কেউ বসে খাওয়াবে
না। সে ভাগ্যি করে আমি জন্মাইনি গো।” ডিমের দাম চোকাতে চোকাতে উত্তর দেয়
আয়েশা। দোকানেই দেখা হয়ে যায় ল্যাংড়া রতনের সাথে। রতন বেশ্যাদের দালালী
করে। জহুরীর চোখ। সন্ধে হলেই ভিড় করে আসা লোকজনের মধ্যে থেকে ঠিক
লোকটিকে গেঁথে কারও ফাঁকা ঘরে নিয়ে এসে ওঠায় সে। বুড়ির খাস পেয়াদা। আবার
বুড়ির পোষা মেয়েগুলোকে কড়া পাহারায়ও রাখে যাতে পাখি খাঁচা থেকে উড়ে না যায়।
ল্যাংড়া হলে কী হবে, গায়ে অমানুষিক শক্তি। বুকের ভেতরটাও পাথরের মতো।
“কী রে রেন্ডী মাগী? আজ বিছানা গরম করবি তো? মাসি বলছিল।” কোমরে
হাত দিয়ে আয়েশার পথ আগলে দাঁড়ায় রতন।
“না করলে আর রেহাই আছে আমার? পারলে তো মড়ার সাথে চিতাতেও লোক
শোয়াবে তুমি। পাঠিও কাকে পাঠাবে।” আয়েশা আর দাঁড়ায় না। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে
আসে। চাল ছাড়ে। ডিম সেদ্ধ বসায়। তারপর একটা মোড়া টেনে দরজার বাইরে এসে
বসে।
দিনের এই সময়টা পট্টির সব মেয়েরাই আলুথালু আলসেমিতে কাটায়।
রোদে বসে গায়ের ব্যাথা মারে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা
মস্করা করে। পরনিন্দা পরচর্চাও চলে,  কখনও উত্তেজিত হয়ে বাপ-মা তুলে মুখ
খারাপও করে। ওদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাওয়া কৌতূহলী পথচারীকে নিয়ে
টিকাটিপ্পনি হাসাহাসিও হয়। শরীরের ক্লান্তির জন্য গজল্লায় খুব একটা জড়ায়
না আয়েশা। চুপ করে বসে রোদ পোহায়। মন্টুকে দেখতে পায়। একটু দূরে রাস্তার
পাশে একটা ঘরের সিঁড়িতে বসে ওর বয়সী আরও দু-তিনটে ছেলের সাথে কী যেন
খেলছে মন্টু। লুডো মনে হয়। থেকে থেকেই বাগবিতণ্ডা হচ্ছে ওদের মধ্যে।
হাতাহাতিও হচ্ছে। গালিগালাজ ছিটকে আসছে ওদের সকলের মুখ থেকে। এতটুকুটুকু
বাচ্চা সব, বোধবুদ্ধি পাকেনি, গুছিয়ে কথা বলতে শেখেনি অথচ কেমন খিস্তি রপ্ত
করে ফেলেছে, খানকির ছেলে ছাড়া কথা শেষ হয় না! দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে আয়েশা।
করবে না-ই বা কেন। এই পট্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে খিস্তিখেউর, বাচ্চা, বুড়ো,
মেয়েমদ্দর মুখে দিনরাত ফ্যাদার মতো ছিটকাচ্ছে। সারাদিন তো এই পট্টির
অলিতেগলিতেই কেটে যায় ছেলেটার। সন্ধেবিকেল থেকে ঘরের সামনে অথবা
রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিলাসী, রেশমীদের গা-ঢলানি দ্যাখে। প্রতিদিন
বিকেল নামার আগে নিজের মা-কেও পাতলা শায়া আর খাটো ব্রেসিয়ার পরে মুখে-
ঠোঁটে রং মাখতে দ্যাখে, রাস্তায় শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুক-পেট বের করে দাঁড়িয়ে
থাকতে দ্যাখে; অচেনা মানুষের সাথে দরদাম করতে শোনে। রতন যে আয়েশার ঘরে
লোক ধরে নিয়ে আসে, তখন তিনজনের মধ্যে যা কথাবার্তা হয় এক একদিন সবই

শোনে। সবটা না বুঝলেও টুকরো টুকরো কথা নিশ্চই বোঝে, বা বোঝার চেষ্টা করে।
মন্টুকে ওই সময় তাড়িয়ে দিলেও আয়েশা জানে, মন্টু ঠিক কোন না কোন মেয়ের
কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনে, হাবভাব লক্ষ করে। না করে উপায়ও নেই। সন্ধের
সাথে সাথে এক ঝাঁক আয়েশা – কুমারী, কিশোরী, মাঝবয়সী পথের ওপর পঙ্গপালের
মতন নেমে আসে শুধুমাত্র খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে বলে। এই দেহের বাজারে তাদের
সকলের শরীরের ছলাকলা কেউ দেখতে না চাইলেও দেখতে যে তাকে হবেই। এছাড়াও
টইটই করতে করতে কোন মেয়ের চানঘরের টিনের ঘেরাটোপে স্নানের সময়
খেয়ালে বা বেখেয়ালে উঁকি মারাও আছে। সেই নিয়ে আয়েশাকে কথাও শুনতে হয়েছে।
মন্টুকে নিয়ে আর ভাবে না আয়েশা। পাঁকের পোকা পাঁকেই থাকে। এভাবেই আর
পাঁচটা নাজায়েস বাচ্চার সাথে রাস্তার ময়লার মতো বেড়ে উঠছে মন্টু। কিন্তু
আয়েশার চোখে সে তো এখনও ছোট। বাস্তবিক সে তো ছোটই। কিন্তু হয়ত এই
নরকে শৈশব বলে তার আর কিছু নেই। তবু এখনও মায়ের জন্য মায়া আছে ছেলেটার
ভেতরে। এই যে এই সাতদিন বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছিল আয়েশা, মন্টু মাঝেমধ্যেই
এসে মুখ শুকনো করে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। আয়েশা বরং ওকে জোর করে
ঠেলে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিত। “কেউ আসবে না আজ?” – সরল মনে প্রথম
ক”দিন বিকেলে জিজ্ঞেসও করেছে আয়েশাকে। রাতে সাত তাড়াতাড়ি মায়ের পাশে
ফাঁকা জায়গাটায় এসে শুয়ে পড়েছে প্রতিদিন। পড়েই ঘুমিয়ে গেছে। এই ক”দিন তো
আয়েশার পাশে পালা করে করে অচেনা লোকেরা শুতে আসেনি, যেমন অন্যান্য
রাতগুলোয় আসে; মন্টু তো মায়ের পাশে শোয়ার সুযোগই পায় না রাতেরবেলা।
     “আজ বাবু নিবি তো?” চার নম্বর খাঁচার শান্তি জিজ্ঞেস করে।
  “নেব। মাসি খুব তাড়া দিচ্ছে। তবে আজ রাস্তায় দাঁড়াতে পারব না। শরীলে
অত তাগত নাই। ঘরেই থাকব। কেউ এলে নেব।” উত্তর দেয় আয়েশা।
          টুকটাক কথার ফাঁকে বেলা বাড়ে। এক এক করে সবাই স্যাঁতস্যাঁতে
দেশলাইয়ের খোলের ভেতরে ঢুকে যায় একটু একটু করে নিজেদের বারুদ গরম করবে
বলে। মন্টুকে খাইয়ে নিজেও দু”গাল খেয়ে আস্তেধীরে আসন্ন সন্ধ্যার জন্য
তোড়জোড় শুরু করে আয়েশা। মেঝেতে আনমনে শুয়ে অনেকদিন পর মায়ের
প্রস্তুতিপর্ব তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে মন্টু। আর অনেকদিন বাদে আয়নায় আবার
নিজেকে দ্যাখে আয়েশা। মুখটা শুকনো লাগছে যেন। চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে
এই সাতদিনে। ব্রেসিয়ারটা ঢিলে হচ্ছে মনে হয়। ছেলের দিকে পিঠ করে উদম হয়ে
ব্রেসিয়ার বদলায় আয়েশা। আরও ছোট মাপের লাল একখানা গায়ে চড়ায়। নিঃশ্বাস
চেপে টেনেটুনে হুক লাগায়। বুকদুটো ঠেলে ওপরদিকে বেরিয়ে আসতে চায়। আয়নায়
নিজের বুক দেখে খুশি হয় আয়েশা। সাদা স্বচ্ছ খাটো ব্লাউজ পরে। শায়াটা
কোমরের অনেক নিচে টেনে নামিয়ে দেয়। তারপর মুখে সাদা রং মাখতে বসে।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পোচের পর পোচ ঘষে গালে, চোখের তলায়। তামাটে পেটেও

বুলিয়ে নেয় একটু। গালে লাল রুজ লাগায় হালকা করে। একটা পাতলা শিফন শাড়ি
পরে। আঁচলটা সরু করে বুকের মাঝখান দিয়ে টেনে কাঁধে ফ্যালে। মন্টু নিবিষ্ট হয়ে
হাঁ করে মায়ের সাজগোজ দ্যাখে। দরজার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে এক ঝলক
তাকিয়ে দেখে নেয় আয়েশা। সন্ধে নেমে গেছে। কাজের টাইম হয়ে গেছে।
“মন্টু… উঠে পড়। বাইরে যা। আমি কাজ করব।” কড়া গলায় বলে ওঠে
আয়েশা। কড়া করে না বললে ছেলে শুনতে চায় না।
    এই শব্দগুলো মন্টুর জানা। সে উঠে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যায়। আয়েশা
ব্লাউজের দুই বগলে একটু সেন্ট লাগায়। উগ্র গন্ধে ঝাঁঝাঁ করে ওঠে চারপাশ।
পর্দা সরিয়ে একবার চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। বাইরে মেয়েদের ভিড়। সারি দিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে বিলাসী, রেশমী আর বাকি সবাই। শরীরের মেলা বসেছে। আয়েশা
কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ঘরের আলো জ্বেলে পর্দাটা অর্ধেক
গুটিয়ে খাটে এসে গা এলিয়ে দেয়। আঁচল ফেলে দেয় শরীরের ওপর থেকে। পায়ের
কাছ থেকে শাড়িটা উঠিয়ে দেয় হাঁটু অবধি। অর্ধেক উদম হয়ে শুয়ে থাকে যাতে
রাস্তা থেকে পরিষ্কার দেখা যায় ওকে। খোলা নিমন্ত্রণ। শুয়েই থাকে। শুয়েই
থাকে… কেউ আসে না। না কোন খদ্দের, না খদ্দের নিয়ে রতন। একটা কারও
পাত্তা নেই। কোথায় গেল সব কুত্তাগুলো! অপেক্ষা করতে করতে, শুয়ে থাকতে
থাকতে ক্লান্তিতে হতাশায় চোখ বুজে আসে আয়েশার। কখন যেন মন্টুর গলা
পেয়ে ঘোর ভাঙে।
“আম্মি!”
“কী রে মন্টু?” দরজার দিকে চোখ চলে যায় ওর।
“আম্মি, নিয়ে এসেছি।”
“কী?”
“বাবু!”

One thought on “গল্পঃ জারজ – মৌলীনাথ গোস্বামী

  1. অন্ধকার জগতের গল্প। শেষটা মন খারাপ হয়ে গেল।

Leave a Reply to ভূমিকা গোস্বামী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *