গল্প নাকি সত্যি
রঞ্জন ব্যানার্জী
দিঘার সমুদ্র সৈকতে চুপ করে বসে আছি।পশ্চিমাকাশে সূর্য আবির গোলা রং ছড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।যেন আশ্চয্য এক স্বর্গীয় দৃশ্য।নীল আকাশে ঘন মাজেন্টা রঙের চারিপাশে আভা ছড়িয়ে লাল টকটকে অস্তগামী সূর্য সমুদ্রের বুকে আশ্রয় নিচ্ছে।নীড়ে ফেরা পাখিগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে উড়তে উড়তে দলবদ্ধ ভাবে বাসায় ফিরছে।দূরে নৌকা গুলো থেকে একটা দুটো করে আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে।কখন যে একফালি চাঁদ লাজুক লাজুক মুখে ঠিক সমুদ্রের ওপরে আল গোছে ঝুলে রয়েছে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেবে।
আমি একা এক বসে এই অপরূপ স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে লাগলাম।সাধারণত এমন দৃশ্য আমি দেখতে পাই না।আমি উত্তরবঙ্গে থাকি।আমার সাথে বেশি আত্মিক ভাব পাহাড়ের।পাহাড় আমার প্রাণ।পাহাড় আমাকে সবসময় ডাকে।তাই তো সময় পেলেই আমি পাহাড়ে চলে যাই। এখানে আসার মুল কারণ অন্য।একটু অল্প বিস্তর লেখালেখি করার সুবাদে অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বের হয়।সেই সুবাদে কখনো সখনো পত্রিকাও পাই সাথে কখনো পুরস্কার ও জুটে যায় কপালে। শিয়ালদার কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হলে প্রায় অনুষ্ঠান হয়।আর আমি নিমন্ত্রিত থাকি কিন্তু কোনোবার ই আমার আসা হয়না।এক দূরত্ব আর দ্বিতীয় কাজ থেকে ছুটি পাওয়া যাই না বলে।তবে আমার এক লেখক বন্ধু আছেন তিনি প্রায়ই আমার বই মেমেন্টো আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।তার সাথে আলাপ শুধু ফোনেই।তিনি প্রায় বলেন উনার বাড়ি আসতে ।কিন্তু আসা হয়না।এবার ঠিক করেছিলাম কয়েকদিনের ছুটি যখন পাচ্ছি তখন বই পুরস্কার নিয়ে সোজা বন্ধুর বাড়ি যাবো মেদিনীপুরে।সাথে দীঘা দেখার আবদার ও ছিলো।বন্ধু বললো তার বাড়ি থেকে দীঘা কাছেই তাই অসুবিধা কিছু নেই।আমি তো আনন্দে আটখানা।কলকাতায় আসা অবধি একের পর এক ঘটনায় আমি শিহরিত ।সেই গল্পেই আসছি।
বছর তিন আগে মা আমার হঠাৎ ই মারা গেলেন।অনেক দিন থেকে আমাকে বলছিলেন একবার শ্রীক্ষেত্রে প্রভু জগন্নাথের দর্শন করতে যাবেন।সেইমতো আমরা সপরিবারে গেলাম শ্রীক্ষেত্রে। প্রভু কে দর্শন করে আমি সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে একটা লাল পাথর কুড়িয়ে পাই।পাথরটা এনে মায়ের হাতে দিই।মাঝে শুধু একবার একটা সোনার দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখাই।দোকানের মালিক আবার জ্যোতিষ চর্চাও করেন।তিনি দেখে বলেন এতো সূর্যকান্ত মনি।যাকে আমরা চুনি বলে জানি।তিনি বললেন এই পাথরটা খুব দামি।যত্ন করে রেখে দিও।অনেক দাম।তাছাড়া বাড়িতে থাকলে অনেক শুভ ফল দেয়।তারপর থেকে ওটা মায়ের কাছেই রেখে দিয়েছিলাম ।কিন্তু মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর ফলে চুনি টা যে কোথায় মা রেখে গেলো তা আমি খুঁজেই পেলাম না।সারা বাড়ি অনেক খোঁজাখুঁজি করা সত্ত্বেও কোথাও খুঁজে পাইনি।মায়ের যত লুকোনো জায়গা ছিলো সব দেখেছি কিন্তু কোথাও পাইনি।একটা পুরোনো আলমারি আছে কিন্তু সেটা বহুকাল কেউ খুলতে পারিনি চাবি র অভাবে।একটা চাবি মায়ের কাছে ছিলো কিন্তু মা কোথায় সেটা হারিয়ে ফেলে নিজেও মনে করতে পারেননা।আমি অবশ্য চাবিওয়ালা এনেছিলাম ডুপ্লিকেট চাবির জন্য কিন্তু সেও পারেনি চাবি বানিয়ে দিতে।শেষ কালে আলমারিটা ভেঙে ফেলার ও আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু কেন জানি না কেউ ই ভাঙতে পারিনি।দিনে দিনে চুনিটার আশা ত্যাগ করেছিলাম।
রাতের গাড়িতে আসছি শিয়ালদাতে ।সকালে অনুষ্ঠানে থেকে বই নিয়ে সেই লেখক বন্ধুর সাথে তার বাড়ি মেদিনীপুরে চলে যাবো ।রামপুরহাটে ট্রেনটা থামতে এক সাধু উঠলো ট্রেনে।পুরো গাড়ি ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও সে এসে আমার সামনে বসলো।অনেক্ষন ধরে আমাকে লক্ষ্য করতে লাগলো।নাস্তিক মন অন্য কিছুই সন্দেহ করেছিলো ।কেউ অমন করে তাকিয়ে থাকলে খুব অস্বস্তি হয়।থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম “সাধুবাবা কি দেখছেন অমন করে ?” সাধুবাবা যা বললেন শুনলে তো গা শিউরে উঠলো ।তিনি বললেন আমি নাকি সাত রাজার ধন এক মানিকের সন্ধান পাবো। আমার সাথে একটা অত্যাচর্য ঘটনা ঘটবে যা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এছাড়া লেখার দুনিয়ায় আমার নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে।।আর খুব সাবধান
সামনে একটা ছোটো বিপদ আসছে।সাবধানে ঘোরাফেরা করতে।
হঠাৎ আমার অফিসের বসের একটা দরকারি ফোন এলো।আমি ফোনে কথা বলতে বলতে বাথরুমের সামনে দরজার কাছে এলাম । যাতে টাওয়ারটা ভালো পাওয়া যায় ।ফোন শেষ করে এসে দেখি সেই সাধু বাবা আর নেই।এ কি করে হয়।আমি সারাক্ষন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম আর কোনো স্টেশনেই ট্রেনটা দাঁড়ায়ওনি।তাহলে তিনি কোথায় গেলেন।আমি পুরো কম্পার্টমেন্ট টা ঘুরে দেখে এলাম যদি কোথাও সেই সাধুবাবাকে দেখতে পাই।কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না।ব্যর্থ মনোরথে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়লাম।আর ভাবতে লাগলাম তিনি যা যা বললেন যদি সবকটা কথা মিলে যায় তাহলে তো আমার একটা বিপদ আছে।কি হবে তাহলে আমার।এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না একটা হৈচৈ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো।দেখি কেউ একটা কিছু নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে।সবাই চোর চোর বলে চিৎকার করছে।একটু আগে একটা ভিখিরি ছেলে খাবারের পয়সা চাইছিলো।সবাই দিছিলো ও।তারপর সুযোগ বুঝে ব্যাগ মোবাইল নিয়ে চম্পট।ভালো করে দেখি আমার ব্যাগ টাও নিয়ে গেছে।যদিও তেমন কিছু ছিলো না কয়েকটা জামাকাপড়।মানিব্যাগ মোবাইল ও ক্যামেরা আমার গলায় ঝোলানো ছোটো ব্যাগে।কোচ এটেন্ডেন্ট কে রিপোর্ট লিখিয়ে একপ্রকার লাগেজ হীন অবস্থায় শিয়ালদাহ পৌছালাম।
এই সময় বন্ধুটির ফোন পেলাম সে বললো আজ যে কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হলে বই প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিলো সেটা হচ্ছে না।তুমি আমার বাড়ি চলে এসো।আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।বললাম আগে বলতে তো পারতে।তাহলে আসতাম না।বন্ধুটি বললো প্রকাশকের এক নিকট আত্মীয় মারা যাওয়ায় আজ অনিবার্য কারণ বশত অনুষ্ঠান টি স্তগিত রাখা হয়েছে।অন্য কোনো দিনে হবে।সেটা পরে জানানো হবে।বন্ধু বললো মেদিনীপুর লোকাল ধরে চলে এসো আমার বাড়ি।একটা অনুষ্টান আছে ।আসলে দেখতে পাবে।যাইহোক শিয়ালদা স্টেশন থেকে বাসে হাওড়া স্টেশন এলাম।ওখান থেকে রওনা দিলাম বন্ধুর বাড়ি মেদিনীপুরে।গিয়ে দেখি বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে।বন্ধুটি বললো তার ছোটো ভাইয়ের মেয়ের মুখেভাত আজকে।
বেশ বেলা হয়েছিলো পৌঁছাতে পৌঁছাতে।বন্ধুটি বললো -” খেয়ে দেয়ে বসে বিশ্রাম করো।বিকেলে গল্প করবো ।অতিথি আপ্যায়ন সেরে আসছি”।এই বলে বন্ধুটি চলে গেলো।আমি এঘর অঘর ঘুরতে ঘুরতে এমন একটা ঘরে এলাম যেখানে দেখলাম বিছানার অপর বেশ কয়েকটি বাচ্ছা।যার অন্নপ্রাশন তাকে চারিদিকে বালিশ দিয়ে আধ শোয়া করে রেখেছে আর বেশ কয়েকটা বিভিন্ন বয়সের বাচ্ছা তাকে ঘিরে খেলা করছে বিভিন্ন খেলনা নিয়ে।আমাকে ওই ঘরে দেখে বন্ধুটির স্ত্রী ও ভাইয়ের বৌ আলাপ করলেন।একথা ওকথা বলতে বলতে তারা বললেন দাদা আপনি একটু এই বাচ্ছাগুলোর কাছে বসুন আমরা আপনার খাবার ব্যবস্থা করে আসছি।অগত্যা আমি বাচ্ছাগুলোর কাছে বসলাম।আমি মাথা নিচু করে তাদের একটা খেলনা নিয়ে নাড়াচারা করছিলাম। হঠাৎ শুনলাম একটি বাচ্ছা বলছে ” বিজু কেমন আছিস ?? সন্তু কেমন আছে ?? তোদের জন্য খুব মন কেমন করে।”। হঠাৎ মায়ের চেনা গলা শুনে চমকে উঠলাম।এতো যেন আমার মা কথা বলছে। গলাটা অবিকল আমার মায়ের মতো।আমি বললাম মা তুমি?? কি করে সম্ভব?আমি দেখলাম একটি বাচ্ছা যে এখনো ভালো করে কথা বলতে পারেনা সে আমাকে এই কথা গুলো বলছে।আমি বাচ্ছাটার পা দুটো জড়িয়ে ধরলাম।সেই বাচ্ছারুপী মা বললেন আমার জন্ম হয়ে গেছে কিন্তু আগের জন্মের অনেক কথা এখনো আমার মনে আছে।আমি বললাম তুমি মারা যাবার পর একটা মহামারী অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটে।পরপর কয়েকবছর।সন্তু মানে বড়দা রোগে ভুগে মারা গেছে গতবছর।মা বললো সন্তু মারা গেলো।আমি বললাম শেষের দিকে বেডশোর হয়ে গেসলো।মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।হঠাৎ আমার মাথায় সেই চাবির কথা এলো।আমি বললাম মা তোমাকে একটা চুনি দিয়ে ছিলাম সেটার আর কোন খোঁজ পাচ্ছিনা।মা বললেন ওটা তো ঐ সিন্দুকে আছে ।আর চাবিটা আমাদের পুরোনো বাড়ির চাবির গোছার মধ্যে রাখা আছে চট করে দেখলে বুঝতে পারবি না।আমি বললাম হা ঐ চাবির রিং টা বেশি ব্যবহার হয়না।ওটা তো আমার আলমারির মধ্যেই আছে।মা বললেন ঐ সিন্দুকটা খুললে ওখানে আরো একটা দামি জিনিস আছে।তোর বাবার হীরের আংটি।আর একটা পুটলির মধ্যে পুরোনো দিনের কিছু স্বর্ণ মুদ্রা।মা বলে চলেছেন আর আমি মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।মা বললো কাঁদিস না খোকা মা কি কারোর চিরদিন থাকে।আমি বাচ্ছা টার পা দুটো জড়িয়ে ধরে আছি।আর আমার মা রুপী বাচ্ছাটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।কতক্ষন এমন চললো জানি না আমি তখনো মায়ের আদর খেয়ে চলেছি।আমাকে খেতে ডাকতে এসেছে।মা বললেন খেয়ে আয়।আমি আছি।আমি মাকে ছেড়ে যেতে চাইছি না দেখে মা আবার বললো যা বেলা অনেক হয়েছে খেয়ে আয়।আমি আছি তো।অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি খেতে গেলাম।যতটা তাড়াতাড়ি খাওয়া যায় খেয়ে এসে দেখি ঘর ফাঁকা।কোনো বাচ্ছাই নেই সেই ঘরে।আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ির কর্তাকে বাচ্ছাগুলো কোথায় গেলো?? তিনি বললেন যাদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে তারা তাদের বাচ্ছা নিয়ে চলে গেছে।আমি বললাম একটা টকটকে ফর্সা বাচ্ছা ছিলো ।টানা টানা কাজল পড়ে ছিলো।খুব মিষ্টি দেখতে তাকে খুব দরকার।আমার বন্ধুটি বললো বুঝতে পারছি না কোন বাচ্ছাটার কথা বলছেন।সবাই যে চেনা পরিচিত তা নয়।কিছু ভাইয়ের অফিসের লোকজন ও আছে।কিন্তু আপনি যে বাচ্ছাটার কথা বলছেন তাকে ঠিক চিনতে বা বুঝতে পারছি না।কথাটা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।মাকে কাছে পেয়েও হাতছাড়া করলাম।আমার দুর্ভাগ্য।সাত রাজার ধন মানিক পেয়েও হাতছাড়া করলাম।
আমি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম মায়ের জন্য।