গল্পঃ ডা ল পা লা – অঙ্কন মাইতি

ডা ল পা লা
অঙ্কন

পাকাচালতা রঙের রোদ উঠোনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। শীতের দুপুরে এই আলো বড়ো মায়াময়। মৃদু আলোছায়া মাদুরে আল্পনা তৈরি করে। সনাতন, শীতের তাপ উপভোগ করে। মাটির বাড়িতে একটা অন্যরকম গন্ধ থাকে। বহুদিন পর সনাতন সেই গন্ধটা টের পেল। এক কাপ চা দিয়ে আর এই মাদুর বিছিয়ে রূপা সেই যে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে, তার আর দেখা নেই। গলা শুনতে পাচ্ছে সনাতন কিন্তু ছুঁতে পারছে না। মনমরা সনাতন মরা রোদে বসে প্রকৃতি দেখে। মাঠময় সবুজ ধানের বুকে বাতাসের হিল্লোল যেন সমুদ্রের উন্মত্ত জলরাশি, দূরে তালগাছের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। কিশোরবেলার স্কুলের কথা মনে পড়ে যায় সনাতনের ।
বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা কপালকুণ্ডলায় নবকুমারের সমুদ্র
দর্শন, আপনা হতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে! “আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।”
—”দূৱাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।”
—- শিক্ষকমশাই বলেই চলেছেন সেই সমুদ্র-বর্ণনা। একদিকে তাল-খেজুর ও নারকেল গাছে ভরা সমুদ্রতট, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত উত্তাল তরঙ্গ-সঙ্কুল ঢেউয়ের গভীর গর্জনে অপূর্ব পুলক ও বিস্ময় মনে জেগে ওঠে। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল অনন্ত নীল জলের ওপরে অগুন্তি ঢেউ, ঢেউ আর ঢেউ, একটার পরে আরেকটা, তার উপরে আরেকটা, এইভাবে পরস্পরে আলিঙ্গন করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে তটভূমির দিকে। দূরের দিগন্তরেখা মিশে গেছে নীল আকাশের সাথে। আহা! কি সৌন্দৰ্য্য!
দূর থেকে যখন এক একটা ঢেউ বেলাভূমির দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন মনে হয়, বুঝি এই মুহূর্তেই তটরেখা ঢেউয়ের বিকটগ্ৰাসে ভেঙেচুরে তলিয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির কাৰ্যকলাপ এমনি এক সুতোয় বাঁধা যে ঐ সব ঊর্মিমালা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে তটদেশে আঘাত করে চুৰ্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। উত্তাল ঝড়ঝঞ্ঝা ছাড়া সমুদ্র কখনো বেলাভূমি অতিক্রম করে না।
সনাতন ভাবতে পারে। চোখ খুলে স্বপ্ন দেখতে পারে।
সেইজন্যই সে পালাকার, পালাগান লিখেই সে বিখ্যাত। অনায়াস দক্ষতায় সে পুরাণের সাথে বর্তমানকে, কল্পনার সাথে বাস্তবকে,গল্প গানের সাথে উন্মাদনা মিশিয়ে দিতে পারে। দর্শক উচ্ছসিত, আমোদিত হয়ে তালি বাজাতে থাকে। তাদের মধ্যে চুপ করে বসে থেকে সনাতন সেটা উপভোগ করে।
অনুজ্জ্বল ক্ষয়াটে শরীরের এই নিষ্প্রভ মানুষটা
পালাকার, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। ঘর ছেড়েছে সে বহুদিন। গ্রামগঞ্জ, মফঃস্বল, আধাশহরে সে দৌড়ে বেড়ায় পালাদলের সাথে। বৌ অপর্ণা আর ছোট্ট মেয়ে অর্পিতাকে নিয়ে শহরে তার সংসার। সে শুধু টাকা পাঠায় আর অপর্ণা সংসার সামলে নেয়। মাঝেমধ্যে সে অতিথির মতো বাড়ি ফেরে। অপর্ণা তার পালাগান লেখা নিয়ে কোনদিন বাধা দেয়নি, বরং গর্ব অনুভব করে। ক্রমে, যোগাযোগ থাকে কিন্তু কমে আসে যাতায়াত। সনাতনকে পালাগান লেখার নেশা ক্রমশ জড়িয়ে ধরে আর মদের নেশা তাকে গিলে খায়। সৃষ্টি আর অনাসৃষ্টি হাত ধরাধরি করে পথ হাঁটতে থাকে।
অঢেল পয়সার সাথে নেশাও বাড়ে। তারপর একদিন
বিখ্যাত পালাকার, কুমার সনাতন বেহেড মাতাল হয়ে বাড়ির পথ হারায়।
দোরগোড়ায় ভোররাতে এক ধোপদুরস্ত মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেখে রূপা চমকে ওঠে। কী করবে ভেবে পায় না। ঘরে নিলে আজ কাজ কামাই হবে নিশ্চিত। প্রথম ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল বোধহয়!
টপকেই বা যাবে কীভাবে, এমনভাবে পড়ে আছে। দোটানায় পড়ে রূপা। দেখে তো ভালোমানুষ বলেই
ঠাহর হয়, কিন্তু ,,,! রূপা সামনের চায়ের দোকান থেকে
চিৎকার করে হরিয়াকে ডাকে। দুজনে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসে সনাতনকে, খাটিয়াতে শোয়ায়। বের হওয়ার সময় হরিয়া রূপার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায় একবার। অজানা মানুষের পকেট থেকে রূপা বের করে আনে একটা অর্থহীন মানিব্যাগ, মোবাইল আর কাগজ কলম। মানুষটা কে ? কেন এতো নেশা? মরে যাবে নাতো? বসে ভাবে রূপা। পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার রামচরণকে ফোন মারে। একটু গায়ে পড়া স্বভাব আছে ডাক্তারের কিন্তু উপায় তো নেই। রামচরণ এসেই হম্বিতম্বি! কী দরকার রে বাবা এতো ঝক্কি নেওয়ার। রূপা কড়াচোখে তাকাতেই সুর নরম করে রামচরণ। বেহুঁশ মাতালের চিকিৎসা কেমন করে করবে। পালস দেখে। রোগীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। পড়ে গিয়ে মাথার এক কোণ ফুলে উঠেছে। কাটাছেঁড়া কোথাও নেই। রামচরণ বলে গেল, হুঁশ ফিরলে ডাকতে। মাতালের মোবাইলটাও বন্ধ, সম্ভবত চার্জ খতম। কাকে ফোন করবে রূপা ভেবে পায় না। রাতে না ফেরায় ওর বাড়ির মানুষজন খুব চিন্তায় আছে নিশ্চিত! কী করবে ভাবতে বসে রূপা। কাগজটা উলটে পালটে দেখে যদি কিছু সুলুকসন্ধান পাওয়া যায়। কাগজের এককোনে একটা লেখা দেখে থমকে ওঠে রূপা। —–
এক হতে কজন পেরেছে / ফুটে ওঠা তারাগুলি চুপ
একা হয় থেকেছে কজন / শিশির ভেঙেছে টাপ টুপ
কোথাও আলোরঙখানি / আঁচলে লুকিয়ে অপরূপ—-।
রাই ! কোথা গেলে তোমা পাই !
শীতের আমেজে দুটি চোখ জুড়িয়েছে সনাতনের। আধোঘুমে সে প্রতিদিন পালাগান দেখতে পায়, স্বপ্নে।
কিছু স্মৃতিতে থাকে আর কিছু উড়ে যায় অজানা ডানায়। ঘুমের ঘোরে সে মনেমনে লিখে ফেলে মনগড়া কতোকিছু। দ্বারকা রাজপ্রাসাদের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে সখিদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে রাধারানি। তার কিশোর প্রেমিক এখন দ্বারকাবাসী। শ্রীরাধার রূপের ছটায় রাজপ্রাসাদ আলোকিত। সভাসদ মন্ত্রীশান্ত্রী সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। কে এই রূপবতী মহিলা! কোন কথা নেই মুখে কিন্তু চঞ্চল চোখদুটি কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। অন্দরে খবর গেল।
শ্রীকৃষ্ণ বেরিয়ে এলো রাজসভায়। সাথে দুই পত্নী
রুক্মিণী ও সত্যভামা। সভা থমথমে, নিঃশব্দ। কৃষ্ণ শ্রীরাধিকাকে দেখে চমকে উঠলো। সব ভুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে নাম ধরে ডাকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। রাধিকা মৃদু চলনে কৃষ্ণের সামনে এসে আঁচলের আড়াল থেকে বের করলো আনন্দিনী বাঁশি। এগিয়ে দিলো কৃষ্ণের দিকে। প্রিয় বাঁশি পেয়ে আহ্লাদিত কৃষ্ণ বাঁশিকে জড়িয়ে নিয়ে ফুঁ দিলো। বাঁশি বাজে না । অনেক চেষ্টাতেও সুর আসে না। রাধা ধীর গতিতে এগিয়ে যেতেই কৃষ্ণ এগিয়ে এলো। রাধা একদম কৃষ্ণের গা ঘেঁষে কৃষ্ণের মুখের
দিকে তাকালো। মুখে সেই মনভরানো হাসি। বেজে উঠলো বাঁশি, আশাবরী রাগে। কৃষ্ণ উচ্ছ্বাসিত। সভা জুড়ে শুধু আনন্দরাগিনী। রুক্মিণী আর সত্যভামা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। কৃষ্ণ যেন কৈশোরে ফিরে গেছে। পুরো সভা দন্ডায়মান প্রিয় কৃষ্ণের এই সুর চঞ্চলতায়। শ্রীরাধা গোপন আঁচল থেকে বের করলেন কৃষ্ণের আর এক প্রিয়তম সম্মোহিনী
বাঁশি। কৃষ্ণ আনন্দিনীকে কোমরবন্ধে গুঁজে রেখে হাতে নিলেন রত্নখচিত সম্মোহিনীকে। ঠোঁট লাগাতেই বেজে উঠলো বৃন্দাবনী সারং। পুরো সভাগৃহ মূর্ছনায় আন্দোলিত। রাধা এবার সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন।
কৃষ্ণ চোখ বন্ধ করে বাঁশিতে মগ্ন। সখিদের নিয়ে মূল ফটকের দিকে এগিয়ে চলেছে রাধারাণি। সভা জুড়ে আবছায়া নেমে আসছে। কৃষ্ণ চোখ খুলেই আর্তনাদ করে উঠলো। কোথায় হারিয়ে গেল কৈশোরের চকিত প্রেম, তার রাধারাণি। কৃষ্ণ ছুঁড়ে ফেললেন প্রিয় বাঁশি ।
দৌড়ে গেলেন মূল ফটকের দিকে। পেছনে পেছনে রুক্মিণী, সত্যভামা। না ! কোন চিহ্নই নেই। ফিরে এসে
বসলেন আসনে। রাধা কী তবে ভ্রমমায়া ! কিন্তু প্রিয় বাঁশিদুটি ? স্নেহ ভরে হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু বাঁশি আর বাজে না।
শীতের কোন বিকেল বোধহয় হয়না। সূর্য থাকতে থাকতেই আঁধার আর কুয়াশা নামে। স্বপ্নের ঘুম ভাঙে সনাতনের। একটা ঝুপ অন্ধকার ঘিরে আছে। মনে মনে সাজিয়ে ফেলে ঘটনাক্রম। কিন্তু কাগজটা সে কোথায় রাখলো! রূপার কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুটো
আলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে উঠানের দিকে। কুয়াশা আর আলো আঁধারিতে একটা অন্যরকম চালচিত্র। শহর এই ছবি কখনো দেখেনি। গাড়িটা এসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো। দুজন নেমে এলো গাড়ি থেকে।
রূপা গলা ছেড়ে বললো, —- এই যে ! এই দিকে। বিজলির মৃদু আলোতে বোঝা গেল এক নারী ও এক কিশোরীকন্যা এগিয়ে আসছে। রূপা সনাতনের কাছে এসে জানতে চাইলো, — চিনতে পারছো? দেখো ভালো করে! সনাতন মাথা নেড়ে চলে। হ্যাঁ বা না কিছু বোঝা যায় না। বিড়বিড় করে বলে, — ঠাহর করতে পারি না। দুই নারীমূর্তি থমকে থামে। অপর্ণা এগিয়ে যাওয়া অর্পিতার হাতটা খপ করে ধরে তাকে থামায়।
মগ্নতার কাছে মাথা নিচু করে অপর্ণা। তার পা আজ
মুখোমুখি হতে চাইছে না। পেছন ফিরে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসে দুজনে। রূপা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। সনাতন একবার চোখ মুছে সেই দূরে চলে যাওয়া দেখে।
সনাতন কাগজটা খুঁজে পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চারিদিকে খন্ড খন্ড লেখাগুলো খুঁজতে থাকে। অবশেষে শিশুর মতো খুশিতে সনাতনের মুখ ভরে ওঠে। সুর করে গেয়ে ওঠে —
এক হতে কজন পেরেছে / ফুটে ওঠা তারাগুলি চুপ
একা হয় থেকেছে কজন / শিশির ভেঙেছে টাপ টুপ
কোথাও আলোরঙখানি / আঁচলে লুকিয়ে অপরূপ—-।
রাই ! কোথা গেলে তোমা পাই !
সনাতন নড়েচড়ে বসে। পালাটা আজ লিখে ফেলতেই হবে, রাত জেগে হলেও।

One thought on “গল্পঃ ডা ল পা লা – অঙ্কন মাইতি

  1. প্রথম স্তবক থেকে মুগ্ধতা! পাকাচালতে রোদের মত লেখা। এমন গল্প বারে বারে পাঠকের মন কাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *