জননী-যন্ত্রণা
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
সুখেন্দু প্রতিদিনই সকালে উঠে হাঁটতে বেরোয়। ডাক্তারের বিধান তাই। সকালে হাঁটতে পারলে নিরুপমারও ভালো হতো কিন্তু তার যে আবার আর্থারাইটিসের সমস্যা তাই ব্লাড সুগার লেভেল বিপদ সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও স্বামীর প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী হতে পারে না। সুখেন্দু যদিও এই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছে। ত্রিধারেশ। ত্রিধারেশ একটু কথা বলে বেশি কিন্তু এই অকৃতদার মানুষটিকে সুখেন্দুর অপছন্দ হয় না। নিরুপমাও তাকে পছন্দ করে। প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণের শেষে সুখেন্দু-ত্রিধারেশের একটা চায়ের আড্ডা হয়। সুখেন্দুর বাড়িতেই নিরুপমার সৌজন্যে। বাড়ির সেই চায়ের আড্ডায় ত্রিধারেশের রসিকতাপূর্ণ কথাগুলো নিরুপমার শুনতে ভালই লাগে। সে নিজেও ফুটকাটে মাঝেসাঝে।
সুখেন্দু ও ত্রিধারেশের নানা ধরনের অমিলের মধ্যে একটা দারুণ কমন ফ্যাক্টর আছে। এদের দুজনেরই পরম নির্ভরেরা বিদেশে থাকে। সুখেন্দুর মেয়ে এখানে থাকলেও একমাত্র ছেলে দেবজ্যোতি মার্কিন মুলুকে। সেখানে তার মার্কিন স্ত্রী এবং আমেরিকান পুত্র-কন্যা। ত্রিধারেশ যে বাপ-মা-মরা ভাইপোটাকে মানুষ করল, সেই অলকেশ এখন দুবাইতে চাকরি করে। তার এখন বিয়ে করার সময় নেই, তো দেশে আসবে কাকাকে সঙ্গ দিতে! হাঁটতে হাঁটতে স্বাস্থ্য ফেরাতে বা অটুট রাখতে রাখতে দুজনেই তাই একটু দুঃখ-হতাশা, আধটু উদ্বেগের কখনও আপন মনেই শিকার হন, কখনও শেয়ার করেন।
এক সকালে এমনই হেঁটে এসে সবে তখন সুখেন্দু চায়ের কাপে মুখ দিয়েছে বেজে উঠল তাদের স্থানু টেলিফোন। উঠে গিয়ে টেলিফোনে কথা শুরু করেই শিশুর মতো হাউমাউ করে করে উঠল সুখেন্দু। তুই আসছিস দেবু, আসছিস। বউমাকেও নিয়ে আসছিস। নিরুপমা ততক্ষণে উঠে সুখেন্দুর পাশে। স্বামীর কাছ থেকে রিসিভারটা নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে। এনআরআই ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলা ওই স্বামী-স্ত্রীর আনন্দঘন মুখের জেল্লা যেন রিভার্স স্যুইং করল। ভাইপোর মুখ মনে পড়লেও ত্রিধারেশের মুখও স্নাত হল সুখেন্দু-নিরুপমার আনন্দধারায়।
এতদিন বাদে ছেলে আসছে, সুখেন্দুর বাড়িতে সাজ সাজ রব। নানা তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে ছেলের মেমবউ আর মেম নাতি-নাতনির যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় সেদিকেই ওদের নজর। এমনকী, পশ্চিমী ঢঙের টয়লেট-বাথরুম তৈরি হল যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায়। ওদের সাবেকি বাড়ির ভেতরের চেহারাটাও পাল্টে গেল অনেকটা। সুখেন্দু-নিরুপমার কলকাতাবাসী মেয়ে সুকন্যা ও তার স্বামী এই বাড়িতে উজিয়ে এসে প্রায় প্রতিদিনই তদারকি করে যায় সমস্ত কাজকর্মের। দিনে দিনে এগিয়ে আসে দেবজ্যোতির আসার দিন। আর ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুখেন্দু-নিরুপমা। তাদের সঙ্গে ত্রিধারেশও। এর মধ্যে দেবজ্যোতিও ফোনে সুখেন্দুকে তার ব্যস্ত সিডিউল জানিয়ে দিয়েছে। দেবজ্যোতি সপরিবার প্রথম নামবে মুম্বইতে। সেখান থেকে দিল্লি ও হায়দরাবাদ হয়ে আসবে কলকাতায়। প্রতিদিনই যোগাযোগ চলছে। কে কে এয়ারপোর্টে যাবে ওদের রিসিভ করতে, কটা গাড়ি যাবে, রোজই তা নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। সুখেন্দু চায় ত্রিধারেশও যাক এয়ারপোর্টে তাদের সঙ্গে।
নির্দিষ্ট দিনে সুকন্যার স্বামী তার গাড়িটি নিয়ে আসে, ভাড়া করা হয় আরেকটি এসইউভি। সব ঠিকঠাক। যেমন সূচি তেমন ম্যানেজমেন্ট। বিমানবন্দর অভিমুখে রওনা হবার ঠিক আগেই বেজে ওঠে টেলিফোন। সুখেন্দু টেলিফোন ধরে। ও প্রান্ত থেকে দেবজ্যোতি জানায়, তাদের হায়দরাবাদ থেকেই আমেরিকা ফিরে যেতে হচ্ছে। কেননা তার হায়ার ম্যানেজমেন্টের সেরকমই নির্দেশ।। সুখেন্দুর দেবু বারবার ফোনে না আসতে পারার জন্য দুঃখ জানিয়ে নিরুপমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ততক্ষণে নিরুপমা বাপ-ছেলের ফোনালাপের সার কথাটা বুঝে নিয়েছে। নিরুপমা ছেলের সাথে কথা বলতে অস্বীকার করে। বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো দুটো গাড়ি ও ভেতরে ওয়েস্টার্ন টয়লেট ও বাথরুম ব্যঙ্গ করতে থাকে সুখেন্দু-নিরুপমা-ত্রিধারেশদের। গোটা পরিবেশটার বিষাদভাব তীব্র হয়ে ওঠে যখন নিরুপমা নিজের নাড়ী ছিঁড়ে গেয়ে ওঠে, এ পরবাসে রবে কে হায়!