গল্পঃ যে তাসের ঘরটি এইমাত্র ভেঙে গেল – দেবাশিস মল্লিক

যে তাসের ঘরটি এইমাত্র ভেঙে গেল
দেবাশিস মল্লিক


যে যেভাবে পেরেছে, যতটুকু পেরেছে, কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। যাদের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি, তারাও এসেছিল কুড়োতে! আমি কলতলার ঠিক উল্টো দিকের একটা ইঁটের পাঁজার উপর বসে বসে দেখছিলাম। পাড়ার আধা গোটা প্রায় সমস্ত মহিলা মহল যেন ঝাঁপ দিয়েছিল। সোহমের মা, ফুলটু কাকিমা, তনি, তনির পিসি, সুদীপারা দু-বোন, বাবলু কাকার বউ, আর নির্মলা পিসি তো বটেই! আমাদের পাড়াটা যেন একটা ভ্যারাইটি স্টোর্স এর মতো। বয়স্ক ভ্যাবেন আর নেনু বুড়ি থেকে তনি, সুদীপা প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের ফারাক নিয়ে বিকেলে ঘাটের ধারের আড্ডাটাকে দূর থেকে চিনির সরবতের মতো লাগলেও কাছাকাছি এদের আলোচনা থেকে ছিটকে আসা কথা শুনলেই বোঝা যায় নুন অথবা চুন, লক্ষ্মীর ভাঁড় থেকে অপুর মেয়ের কাট-টু এপিসোড, হেমার ব্রেস্ট টিউমার থেকে চয়নিকার ঘনঘন ব্রেকআপ! এরা ইঞ্চি থেকে ফুট অবধি মানুষের শরীরের সমস্ত অঙ্গের খবর রাখে। বুকের আকৃতিকে বোঝানোর সময় নানান রকমের ফলের নাম খাবলে তুলে নেয়। বাতাবি, কমলা, শুঁটি এমন কত কি! এরা বলতে পারে না এমন কোন কথা নেই, বুঝতে পারেনা এমন কোন ইশারাও নেই। এইতো কদিন আগে ধান কাটতে আসা একজন সাঁওতাল বউ বাচ্ছা কোলে নিয়ে জল তুলল কল থেকে। তারপর প্রতিটি পদক্ষেপ যাওয়ার সময় এক কাঁচল ধরে জল তার কাঁখে থাকা হাড়ি থেকে উপচে পড়ছিল। পিছনে একটি সাঁওতালি পুরুষ বিড়ির ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে সেই পড়ে যাওয়া জলের উপর পা ফেলে ফেলে হাসিমুখে বউটার চলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছিল। এটা থেকে বাপির বউ মিচকি হেসে সম্পদের ঠাকুমাকে বলল, ‘গিয়েই ঘরে ঢুকে আগোড় বন্ধ করবে।’ হাসির রোল উঠেছিল তারপর।
আজ কিন্তু হাসির কোন রোলই ছিল না, বরং স্যান্ডউইচ বলি। সব্বাই যথেষ্ট সিরিয়াস ছিল। আমি তো দর্শক। দর্শকের বোধ করি যা খুশি ভাববার বা মনে মনে চিন্তা করার অধিকার আছে।
অন্যদিন আমি অতো সকালে উঠে ব্রাশ মুখে পুরে কলতলায় আসি। যতটুকু বুঝলাম, আজ আমার আগেই নির্মলা পিসি আর সৌভিকের মা এসে কলতলার চারদিকে ভাঙ্গা তাসের ঘরের টুকরোগুলো দেখেই একটা হল্লামাতন তৈরি করেছিল। কোথা থেকে কে কেন এই তাসের ঘর ভেঙে এখানে তার টুকরো ছড়াতে এসেছিল সেটুকু বোঝার মতো অবস্থা তখন আমার ছিল না। নির্মলা পিসির তীব্র শোকার্ত চিৎকার মেশানো হুতাশে যে যার মত বাসি মুখে ছুটে এসেই দেখছে কি কান্ড! একটা তাসের ঘরের টুকরো চৌদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।
আমার ঘরের পাশ দিয়ে কাক ভোরে মাছ দিলীপ, মুরগী গোপাল, আনাজ শৈল্যরা রোজই যায়। তারাও কি জানতে পারেনি! আমাদের এদিকে কয়েকটা গ্রামে এখনো মিথ আছে, পাড়া এলাকার মরা মানুষেরা গভীর রাতে নানা রকমের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে আসে। তাই কাক ভোরের আগে পাড়ার দিকে কেউই শখ করে বেরোয় না। আমি অবশ্য পরীক্ষা করব বলে কদিন ধরে রাস্তার এ গলি ও গলি ঘুরেছি। কেউ নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমিও নেই। কী বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল আমার! ভরা পূর্ণিমায় দেখেছিলাম সরল আলোর রেখা ঘন হয়ে বাষ্পের মত উপরের দিকে চলে যাচ্ছে আবার ভরা অমবস্যায় কানের কাছে ঠোঁটের মতো অন্ধকার এসে ফিসফিস করে সাবধান করে দিয়েছে ডানদিকে নর্দমা, বাঁদিকের চড়াতে লোক সারাদিন পেচ্ছাব করে। তাই কোন সময়েই পথ চলতে ভুল হয়নি। কেউ নেই বলেই হয়তো হয়নি।
সকালে কলতলা জুড়ে কিন্তু পাড়ার মেয়ে বউরা গিজগিজ করছিল। সবাই সতর্ক হয়ে ঘাড় নিচু করে কুড়িয়ে রাখছিল ভাঙা তাসের ঘরের টুকরোগুলো। চিনি চিনি করে ও যেন চিনে উঠতে পারছি না, কটা তাস, কী রঙ, শুধু রক্তের মতো কষা একটা রং পুঁই মেতুড়ি হয়ে রাস্তাময় ছিটকে পড়ে আছে। যে যার মত আঁচল চাপা দিয়ে শেষ স্মৃতি মেদুরতাটুকুও তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না, অথবা ভাঙা তাসের ঘরের টুকরোগুলো আমাকে দেখাবে না বলেই তারা চোখে চোখে নরম কৌশল করছে। ভাসা ভাসা দু’একটা কন্ঠ কানে আসছিল তনি একটা টুকরো চাপা দিয়েই বলছিল, এটা সেই মিথ্যা, যা দিয়ে একসাথে শাক আর মাছ ঢাকা যায়। সুদীপা কী একটা দেখিয়ে বলছিল,’ আরে দেখ দেখ এটাই তো সেই হোটেলটা যেখানে ছেলেটার সাথে শর্মিষ্ঠা ঘুরতে গিয়েছিল। এটাও দেখ ওর মা মেয়েকে বলছে, এবার যাকে ধরবি আরো ভালো কামাই চাই। আমি ওদের কথায় না চমকালেও মৌ এর হাতের টুকরোটা এক ঝলক দেখে চমকে ছিলাম। চিনতে পেরেছিলাম ওটা শর্মিষ্ঠার ইগো। গোটাটাই ইগো, এত বড় ভাঙ্গনের পরেও এতোটুকু ভাঙ্গেনি!
পাড়ায় একটা গুপ্তহত্যা হলে কিংবা কেষ্ঠ ঘোষ এর মত কাঠ বামপন্থী লোককে ডানপন্থীদের মিছিলে হাঁটতে দেখলে যতটা সরগরম হত এখন তার চেয়েও বেশি আলোচনা চলছে। একটা সরু নদী যদি কখনো আরো সরু হয়ে যায় তখন যেমন তার জলের স্রোত আরো কমে আসে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে পড়ছিল সব। পাড়ার অনেক ঘরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পূর্ণ হলেও সেই টাকা দানা শস্যের কাজে আসে না। সে টাকার অনেকটাই চলে যায় কেবল ওয়ালাকে দিতে কিংবা গ্রাম্য মেঠো পার্লারে মুখে ময়দা মাখতে। সে কারণেই মেয়ে বউরা জড়ো হলেও পাড়ার ছেলেরা কাজে বেরিয়ে গেছে। শ্লা নারী স্বাধীনতার যুগ। মহিলারা এখনো পুকুরের এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করার অভ্যাসটা সযত্নে পিত্তনালীতে মিশিয়ে নাড়িতেই জমা করে। তাদের কাছে ভাঙ্গা তাসের ঘর আর টুকরো বলতে সার্চ লাইটের আলো মিশ্রিত তীব্র কৌতুহল। তারা কলতলা থেকে ঘর বার করলেও সেই কষাটে লাল জায়গাটার দিকেই ঠায় ঘুরঘুর করছে।
আমার গেটের বাইরের দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। ইঁটের পাঁজার এখান থেকে তাকে চেনা যাচ্ছে না। আমি মনে মনে শর্মিষ্ঠাকে প্রশ্ন করছিলাম তখন, কেন এমন করলি শর্মিষ্ঠা? সে তো হেসেই খুন। তার কল্পিত মুখের নানা রকম এক্সপ্রেশন থেকে বুঝতে পারছিলাম সে বলতে চাইছে, তার এমন কাঁচা ওড়ার বয়সে সে উড়ছে। তার এখন ওড়ার সময়, সে আমার তিন ডিগ্রি জ্বর কিংবা কাশির সঙ্গে ওঠা কাঁচা রক্তের খোঁজ রাখতেই বা যাবে কেন! আমি আবার আমার দরজায় কড়া নাড়তে থাকা মানুষটাকে চিনতে চেষ্টা করছি। না! চেনা যাচ্ছে না। সে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি শুনছি তবুও উত্তর দিতে পারছি না, শুধু মনে হচ্ছে আমি বলে কেউ নেই। ছিল। এখন আর নেই। আমাদের গলিতে যেমন গভীর রাতে কেউ থাকে না, ঠিক তেমনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *