ইতিহাসের খোঁজে
বিজন সাহা
পদার্থবিদ্যা ও গণিতের বাইরে যে বিষয়টি আমার খুব প্রিয় সেটা ইতিহাস। সেটা শুধু রাজা বাদশাহদের
ইতিহাস নয়, মানুষের ইতিহাস, বিভিন্ন জায়গায় মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস। আর যদি কোন জায়গা
বিশেষ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয় তবে তো কোন কথাই নেই। তাই ২০১৪ সালে যখন ইন্ডিয়ার
বিভিন্ন শহরে গেলাম গবেষণার কাজে ইচ্ছে করেই প্রোগ্রাম এমন সেট করলাম যেন কাজের ফাঁকে
ফাঁকে ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে পারি, যেন অল্প সময়ের জন্য হলেও ডুবে যেতে
পারি ইতিহাসের পাতায়। যদিও এসেছিলাম মস্কো থেকে নিজের কাজে, তবে এই সুযোগে বাংলাদেশে
নিজের গ্রামে কিছুদিন কাটাই আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমার যাত্রা। অন্য দিকে কোলকাতা ও
আশেপাশে অনেক আত্মীয় স্বজন থাকার কারণে ভারত ভ্রমণের প্রথম ও শেষ পর্যায় ছিল এই
কোলকাতাই। চলুন শুরু করা যাক! আরেকতা কথা, মহাবিশ্বে সব কিছুই আপেক্ষিক, এখানে অতুলনীয়
বলে কিছু নেই। এমনকি যা অতুলনীয় সেটাও অন্য কোন কিছুর তুলনায়ই। মানুষ যখন কোথাও বেড়াতে
যায় সে যায় পূর্ব অভিজ্ঞতার ঝোলা কাঁধে ঝুলিয়ে। যদি সেই জায়গায় আগে গিয়ে থাকে তবে সে সেই
জায়গার অতীতের সাথে বর্তমানের তুলনা করে, যদি এটাই তার প্রথম যাত্রা হয়, তবে সে অন্য কোন
জায়গার সাথে এর তুলনা করে। এক কোথায় তুলনা নিজেই তুলনাহীন।
স্মৃতির শহর কোলকাতায়
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আমি নেতাজী এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করি। আগের দিনটা কেটেছিল খুবই
টেনশনে, কেননা সেদিন বাংলাদেশে হরতাল ছিল। তা আগেরদিনই এয়ারপোর্টের পাশেই এক বন্ধুর
বাসায় এসে উঠি। এই নিয়ে কোলকাতায় আমি ছয় বার। প্রথমবার এসেছিলাম মায়ের সাথে ১৯৬৯ সালে,
পাঁচ বছর বয়সে। এই সময়ের অনেক কথাই মনে আছে। সবচেয়ে যে ঘটনা বেশি মনে পড়ে সেটা ট্রেন
দুর্ঘটনা। ওই ট্রেনে আমাদের পুরী যাওয়ার কথা ছিল। হিন্দমোটর থেকে রওনা হব। মা, রতন, দাদু,
দিদিমা, টুকু আর আমি। পাশের বাড়ির কালী মামার কথা ছিল আমাকে কোলে করে স্টেশনে নিয়ে যাবেন।
কি কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি। আমার সে কী কান্না! ঠিক হল পরের ট্রেনে যাব। কালী মামা
নিজে আমাকে ট্রেনে তুলে দেবেন। মিস করা সেই ট্রেনের কয়েকটা বগি পড়ে গিয়েছিল। অনেক হতাহত
হয়েছিল। আমরা যখন ওই ট্রেনের পাশ দিয়ে পুরীর পথে এগিয়ে যাই সমস্ত লাইট অফ করা হয়েছিল।
দাদু বলেছিলেন “তোর জেদের কারণে আমরা বড় বাঁচাই বেঁচে গেলাম।” এরপর ১৯৭২ সালে যুদ্ধের পরে
আবার যাই মায়ের সাথেই। তখন আমার দাদা নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ ছিল। মা কোন
খবর পেলেই পাগলের মত সেখানে ছুটে যেতেন। সাথে আমিও। সে সময় কত জায়গায় যে ঘুরেছি আমরা।
এক জায়গায় গিয়ে টুকুর সাথে আম চুরি করে খাওয়ার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। ১৯৮০ সালে এসএসসি
পরীক্ষার পরে আবার যাই দুই সপ্তাহের জন্য। একদিন মনীষের সাথে হাঁটছি শেয়ালদা স্টেশনের দিকে
হঠাৎ লোকজনের মাঝে এক চাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেল। খবর নিয়ে জানা গেল সঞ্জয় গান্ধী বিমান
দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ভীষণ টেনশন হয়েছিল আমাদের। মনে পড়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের
কথা। এরপর কলকাতা আসি ১৯৮৯ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করে মস্কো থেকে বাড়ি বেড়াতে এসে।
মাঝে বাবার সাথে গেলাম ইন্ডিয়া। সেটাই বাবার সাথে আমার বলতে গেলে একমাত্র ও শেষ ভ্রমণ।
শেষ বার আসি ১৯৯৭ সালে। সেবার প্লেনে। অনেক ঝামেলার মধ্যে। আসলে ব্যাপার অনেকটা
কাকতালীয়। ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে দেখি আগের প্লেনে সীট খালি, অনেকটা মানিকগঞ্জ ট্যু ঢাকা
মিনিবাসের মত। বলতে গেলে জোর করেই নিয়ে গেল। কলকাতা নেমে ইমিগ্রেশন পড়লাম ঝামেলায়।
যেহেতু ও সেবার পুনা যাচ্ছিলাম একটা কনফারেন্সে, তাই সেটাই উল্লেখ করেছিলাম ডেসটিনেশন
হিসেবে। একের পর এক সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়েই আছি তো আছিই। আমার কোন তাড়া ছিল
না, কেননা দাদারা আসবে এক ঘণ্টা পরে নির্ধারিত ফ্লাইটের সময় অনুযায়ী। একসময় জানাল আমার
ভিসা জাল। কী ব্যাপার? পাশের কাউন্টারে যে ছেলে দাঁড়িয়ে তার সিরিয়াল নম্বর আমার আগে, অথচ
ভিসা পেয়েছে পরে। আমি জানতাম না দেশে ভিসা পেতে এত ঝামেলা, তাই মস্কো থেকে ভিসা না নিয়ে
ঢাকায় নেব বলে ঠিক করেছিলাম। এসে দেখি বিশাল হাঙ্গামা, তাই বন্ধু রকিবকে বলে দালাল দিয়ে ভিসা
করিয়ে নেই। যাহোক, বললাম, দুটো ভিসা দেখে কোনটা আসল আর কোনটা কোনটা নকল সেটা বের
করা সম্ভব নয়। মিনিমাম তিনটে ভিসা দরকার। আর মনে মনে ভাবলাম মানব জাতির ইতিহাসই তো
দুজনের ইতিহাস। যিনি আমাদের বোকার স্বর্গে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি লর্ড আর যিনি জ্ঞান
বৃক্ষের ফল দিলেন তিনি লুইসিফার। তবে যারা এসব বিশ্বাস করে তাদের কাছে এ যুক্তি হালে পানি
পায় না। ইতিমধ্যে সবাই বেরিয়ে গেছে তাই তৃতীয় জনকে আর পাওয়া গেল না। আমি ইমিগ্রেশন
অফিসারদের ইনভাইটেশন, এমন কী ফ্যামিলি অ্যালবাম পর্যন্ত দেখালাম। বললাম আমি ভাইদের
ওখানে থাকব। হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল «আমি যাই» এর রুশ কী। চটপট উত্তর দিলাম। বললাম
আগের প্লেনে এসেছি। পরে বাসায় ফোন করে জানা গেল ওর দুই দাদা বেরিয়ে গেছে, সময় আছে ভেবে
লেক টাউনে বউদির ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। যে লোক আমাকে রুশ বলতে বলেছিল সে রুশ জানে কি না
জানতে চাইলে বলল, “না, তবে আপনার বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝেছি ভাষাটা আপনি জানেন। এটা ছিল
সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। কি করব বলেন? এখন ইন্ডিয়া হয়ে বাংলাদেশের অনেকেই রাশিয়া যাচ্ছে
পরবর্তীতে ইউরোপ যাবে বলে। ফলে আমাদের উপর ওদিক থেকে চাপ আছে।” ১৯৯৭ এর মত এবারও
গেলাম প্লেনে আর ভাবলাম আবার কোন ঝামেলায় না পড়লেই হয়। যা ভাবা, তাই হল। কল্যাণদা আগের
দিন বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়া চলে গেছে আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে বলে। যাবার আগে ওর আর
স্বপনদার ঠিকানা লিখে দিয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে নেমে দেখি সেসবের কোন কিছুই নেই। আমি আবারও
এক গাদি ইনভাইটেশন দেখালাম, কিন্তু কোন কাজ হল না। শেষ পর্যন্ত বলল যেকোনো একটা ঠিকানা
লেখেন। স্বপনদার ইন্দ্রলোক হাউজিং এস্টেট মনে করতে পারলাম না, লিখলাম ইন্দ্রপুরী।
অফিসাররা হাহা করে হেসে উঠল, তবে ওরা মনে হয় এরই মধ্যে বুঝে গেছে আমাকে দাড় করিয়ে রেখে
কোন লাভ হবে না, অযথা ওদের মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। পরে অবশ্য বাসায় এসে ঠিকানা খুঁজে
পেয়েছিলাম। লাগেজের ভেতরে ছিল। আমি বাসায় দিনে দশ বার কলম, পেন্সিল, টেলিফোন ইত্যাদি
হারাই। কল্যাণদাও ইতিমধ্যে বুঝে গেছে আমি আসলে একটা গন কেস।
কোলকাতায় আমার ফরমালি দু-তিনটে কাজ ছিল, ইন্ডিয়ান আসসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ
সায়েন্স, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট আর কোলকাতা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স
ডিপার্টমেন্টে সেমিনার দেয়া আর অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করা। এবার আমি উঠেছিলাম
কল্যাণদার ওখানে নাগের বাজারে, লর্ড ক্লাইভের ভাঙ্গা বাড়ির পাশে। ১৯৯৭ সালে আমার আসার
তেমন কোন প্ল্যান ছিল না। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলাম যে আমার জ্যাঠতুতো দাদা ভাগুদা মানে
ভাগবৎদা মারা গেছেন। তখনই মনে হল আমাদের জেনারেশনের বিদায়ের পালা শুরু হল। তাই দেশে গিয়ে
সবার সাথে দেখা করা দরকার। এরপর থেকে দেশে বা ইন্ডিয়া এলে সমস্ত ভাইবোনদের সাথে দেখা
করি। কোলকাতায় দেখা করার মধ্যে ছিল স্বপনদা, দীপকদা, জ্যোৎস্না বউদি, অশোক মামা, মনীষ,
মিঠু আর শিবাজী। কোলকাতার বাইরে সন্ধ্যাদি, আরতিদি আর চন্দনা। অন্য মামাদের সাথে সময়
পেলে ফেরার পথে দেখা করব। এর বাইরে দুয়েকটা জায়গা দেখার ইচ্ছে ছিল। এ সবের মধ্যে ছিল
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি, বেলুর মঠ, দক্ষিণেশ্বর। ঠাকুর বাড়ি সেবারই আমি প্রথম যাব। বেলুর মঠ
আর দক্ষিণেশ্বরে আগেও গিয়েছি। মনে আছে, কোতরং দাদুর বাড়ি থেকে অনেক সময় হাঁটতে হাঁটতে
আসতাম উত্তরপাড়া সন্ধ্যাদির ওখানে আর সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বরে। ভাটার সময় গঙ্গা প্রায়
শুকিয়ে যেত, ওই সময়টাতে আমরা আসতাম। বেলুর মঠের রং বেরঙের গোলাপ আমাকে সব সময়ই মুগ্ধ
করত। আগে গড়ের মাঠ, প্ল্যানেটরিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, আলিপুর চিড়িয়াখানা, হাওড়া
ব্রীজ, ইডেন গার্ডেন রাখতাম আমার উইশ লিস্টে, এখন ওগুলো আর মাস্ট আইটেম নয়। তবে চেষ্টা
করি কলেজ স্ট্রিট আর কফি হাউজে ঢুঁ মারতে।
ফর্মাল কাজের মাঝেই ও একে একে আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করলাম, সব জায়গায়ই অল্প
সময়ের জন্য। কোথাও লাঞ্চ তো কোথাও ডিনার। কোলকাতার সময় এভাবেই শেষ হয়ে আসছিল।
কাল্টিভিশনে আর স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে কৌশিক আর সুবীর আগেই সব ঠিক করে রেখেছিল।
তাই ওখানে সেমিনারগুলো হল সিডিউল অনুযায়ী। তবে সাইন্স কলেজে আগে কথা বলিনি। তাই একদিন
চলে গেলাম অমিয় দার সাথে দেখা করতে, তিনি তখন সেখানকার হেড। উনি কোলকাতার বাইরে ছিলেন,
ঠিক যেমন ছিলেন সাহা ইনস্টিটিউটের অঞ্জন দা। তাই ঠিক হল আমি অন্যান্য শহর ঘুরে দেশের
ফেরার আগে যখন কোলকাতা ফিরব তখন সেমিনার হবে। সেখান থেকে আচার্য জগদীশ বসুর বাড়ির
ওখানটা ঘুরে আমরা গেলাম কফি হাউজে। মজার ব্যাপার হল তিন বছর আগে দেশে এসে আমি আচার্য
জগদীশ বসুর বিক্রমপুরের বাড়ি ঘুরে এসেছি। কলেজ স্ট্রীটে আমার কিছু বই দেখতে হবে, সেই সাথে
কফি হাউজে আড্ডা দেওয়া যাবে। কদিন আগেই তো মান্না দে মারা গেছেন। ওখানে তখন মান্না দের
একটি বিশাল ছবি ঝুলছিল। কোলকাতায় কল্যাণদা আমার গাইড, সব জায়গায় নিয়ে যায়। মনে পড়ল
১৯৮৯ সালের কথা। সেবার ক্লাসমেট রানার সাথে দেখা করেছিলাম এই কফি হাউজেই। কল্যাণদা
আমাকে রানার কাছে রেখে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল আর সময় মত এসে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সেল
ফোনের সুযোগ ছিল না, তাই আগে থেকেই কথা বলে নিতে হত। এখন অবশ্য অন্য কথা। সেখান থেকে
আমাদের প্ল্যান শিয়ালদহ মনীশের ওখানে যাওয়া।
চল হেঁটেই যাই। খুব বেশি দূরে নয়।
আমার ট্রামে চড়তে ইচ্ছে করছে। এদিকে ট্রাম চলে?
হঠাৎ ট্রামে?
ছোটবেলায় যখনই আসতাম, আমি থাকতাম বেহালার চৌরাস্তায়। একদিকে ছিল অশোকা সিনেমা হল,
অন্য দিকে আমাদের বাসা। অশোকা সিনেমা হলের পাশেই ছিল মামার বাসা। আমরা প্রায়ই দাদাদের
ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে মামার বাসায় যেতাম। ১৯৬৯ সালে গেলাম এখানে গোপী গাইন বাঘা বাইন
দেখতে। ভূত দেখে আমার সে কী কান্না। ভাগ্যিস মামার বাসা পাশে ছিল। মামা আমাকে বাসায় নিয়ে
গেলেন। তখন মাঝে মধ্যে ট্রাম দেখে চড়তে ইচ্ছে করত, কিন্তু কখনোই সেটা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলার
সেই ইচ্ছেটা এখন পূরণ করতে চাইছি। আর হ্যাঁ, হাঁটবো অনেক। হাঁটতে অসুবিধা নেই। দেশের মানুষ তো
হয় গাড়ি নয় রিক্সায় করে ঘুরতে অভ্যস্ত। একদিন ভুলেই যাবে তার পা কেন দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক আছে। চল তাহলে ট্রাম কোথায় যাওয়া যায়।
এটা মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র শহর বা রাজ্য যেখানে হাত তুললেই বাস, ট্রাম থামায়। অন্তত সেটাই
দেখছি আগে। চল এক কাজ করি মনীশের সাথে দেখা করে বেলুর মঠে যাই। ওখান থেকে ফেরীতে
দক্ষিণেশ্বর আসব। ওই জায়গাগুলোও আমার ছোটবেলার স্মৃতি জড়িত। সারা দিন তো সামনেই।
হঠাৎ তীর্থস্থান দেখার এত শখ?
না না, হঠাৎ হবে কেন? এখন তো পৃথিবী ধার্মিকে ভরে গেছে। জাস্ট দেখার ইচ্ছে এখানকার
ধার্মিকেরা কেমন?
মানে?
দেখ, এখন তো সারা বিশ্বই ধর্মীয় উগ্রবাদে ভরা। সেদিক থেকে রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ অনেকটা
ধর্ম নিরপেক্ষ এ অর্থে যে সেখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রবেশ অধিকার আছে বলেই শুনেছি।
অসহিষ্ণুতার এই যুগে তারা একটু হলেও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাই ওই দুটো জায়গায় যাচ্ছি।
তাছাড়া আরও একটা পর্যবেক্ষণ দরকার।
কিসের পর্যবেক্ষণ?
বিভিন্ন রকমের পর্যবেক্ষণ। আমি এবার যখন দেশে আসি, তার কয়েকদিন আগেই দুর্গা পূজা ছিল।
মস্কোয় কেউ কেউ বলেছিল আমি যেন পূজার আগেই দেশে যাই, পূজাটা তাহলে দেখা হবে। কিন্তু আমি
ইচ্ছে করেই আসিনি। আমি আসলে ফর্মালিটি তেমন পছন্দ করি না। মস্কোয় পূজা দেখতে যাই মূলত
বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আবার ইচ্ছে না হলে যাই না। দেশে তো সেটা হবে না। আত্মীয় স্বজনদের
অনুরোধের ঢেঁকি গিলে ইচ্ছে অনিচ্ছায় যেতে হবে। ছোট বেলায় সত্যিই ইচ্ছে ছিল, এখন আর নেই। তাই
ভাবলাম দেশে গেলে আনন্দের চেয়ে মন খারাপের পরিমাণটা বেশি হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া আমার
ছোটবেলায় মানুষ মূলত পূজা করত, পূজার আনন্দই মূল ছিল, নতুন জামাকাপড়ের আনন্দ যে ছিল না
তা নয়, তবে সেটা মুখ্য ছিল না। এখন পূজার থেকেও পূজার সাজগোজ, প্রতিমার বা মণ্ডপের ডেকরেশন
এসবই মূল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ পূজার গুরত্বের ভরকেন্দ্র আগের জায়গায় থাকছে না। তবে পূজার
পরে কোলকাতায় এসেই যে পূজার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি তা নয়। রাস্তায় রাস্তায় দেখছি জগদ্ধাত্রী
পূজা। বাংলাদেশে এর তেমন প্রচলন নেই। তাই একটু অবাকই হলাম। বিশাল বিশাল পূজা মন্ডপ,
একেকটা ছোটোখাটো লাস ভেগাস। কিছু কিছু মণ্ডপ রাস্তা দখল করে বসে আছে। শহরটা যেন
দেবতাদের কাছে জিম্মি। কিছু কিছু পূজা আছে যেকোনো সময় করা যায়, কিন্তু এই প্রথম একটা পূজা
দেখে মনে হল এখানে অসময়েও সময়, মানে এক জায়গায় এর বিসর্জন হচ্ছে তো অন্য জায়গায় শুরু।
বর্তমানের পুঁজিবাদী বিশ্বে অনেককে সরিয়ে জগদ্ধাত্রী, বিশ্বকর্মা, গণেশের মত কমার্শিয়াল আর
টেকনিক্যাল দেব দেবীরা সামনে চলে আসছেন। মানে সব জায়গাতেই প্রগতির হাওয়া, ভোগবাদের
জয়জয়কার। একই কথা কিন্তু ঈদে। অন্তত সামাজিক মিডিয়া দেখলে মনে হয় ঈদের চেয়েও ঈদের
মারকেটিং, জামাকাপড়ের ফ্যাশান, কোরবানির পশুর দাম এসবই প্রথম সারিতে চলে আসছে।
ক্রিসমাসেও দেখবি একই ঘটনা। আসলে সবই বদলাচ্ছে। আগে মানুষ পড়াশুনা করত মূলত জ্ঞানের
জন্য, জানার জন্য, এখন করে ডিগ্রীর জন্য। এই মেন্টালিটি সমাজের সর্বত্র ক্যান্সারের মত
ছড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু এসব তো পত্রপত্রিকা পড়েই জানা যায়। অথবা গাড়িতে করে ঘুরে। হাঁটার কি কোন বিশেষ
উদ্দেশ্য আছে?
ঐ দেখ একটা ছেলে রাস্তার উপর স্নান করছে। দাড়া একটা ছবি তুলে নিই। আচ্ছা গাড়িতে গেলে এ
দৃশ্য দেখতে পেতাম? মানুষকে দেখতে চাইলে তাদের মধ্যে যেতে হবে। গাড়ি তো আমাদের সংস্কৃতি নয়।
জানিস তো আমি ছবি তুলতে খুব পছন্দ করি। এক সময় শুধুই প্রকৃতির ছবি তুলতাম, কোথাও গেলে
অপেক্ষা করতাম কখন সব মানুষজন সরে যায়। এক সময় বুঝলাম গ্রাম, শহর মানুষ ছাড়া মৃত।
মানুষের হাতে তৈরি যা কিছু তাতে মানুষ অনুপস্থিত থাকলে সেটা সম্পূর্ণ হয় না। কলকাতা এলাম, তার
রাস্তায় ঘুরব না, রাস্তায় মানুষ কীভাবে স্নান করছে, চুল কাটাচ্ছে বা দাঁড়িয়ে চা আর ফুচকা খাচ্ছে,
ঐ যে রিক্সাওয়ালা যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা ক্যামেরায় না ধরলে আমি রাশিয়ায় বন্ধুদের
কোলকাতা দেখাব কীভাবে?
কিন্তু কোলকাতা তো শুধু এসব মানুষেরই বাসভূমি নয়। এখানে তো পস এরিয়াও আছে।
আছে, সেটা তো সবাই তোলে, সবাই দেখায়। কনট্রাস্টটাও তো দেখানো দরকার। ঢাকার তুলনায়
কোলকাতার ফুটপাত অনেক পরিষ্কার। ঢাকায় তো চাইলেও হাঁটতে পারবি না। তাছাড়া এখন যেভাবে
প্রাসাদসম মন্দির মসজিদ তৈরি হচ্ছে সর্বত্র তাতে কোনটা যে পস এরিয়া, আর কোনটা নয় সেটাই
বোঝা কষ্ট। ঈশ্বরের কত রিয়াল এস্টেট। যে দিকেই তাকাও শুধু মন্দির, মসজিদ, গির্জা। তাছাড়া
প্রতিদিন কত মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঈশ্বরকে ট্যাক্স দিচ্ছে প্রণামী হিসেবে সে হিসাব
কে রাখে? এর একটা অংশও যদি পরম করুণাময় দুঃস্থ মানুষের মধ্যে দান করার ব্যবস্থা করতেন
সেটাই দেশে দেশে দারিদ্র্য দমনে একটা ব্রেকথ্রো হতে পারত। এখনও পর্যন্ত যা দেখছি শুধু ধনী
দরিদ্রের মধ্যেই দূরত্ব বাড়ছে না, দূরত্ব বাড়ছে মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে। ঈশ্বর যেমন বিশাল
বিশাল অট্টালিকায় স্থান পাচ্ছেন তেমনিভাবে কোটি কোটি মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে এসব উপাসনালয়ের
দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষে করে দিন কাটাচ্ছে। যত বেশি করে সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হচ্ছে
আর্থিক ভাবে তিনি তাদের চেয়ে তত বেশি দূরে সরে যাচ্ছেন।
আবার রাজনীতি।
না না, রাজনীতির কি আছে? এটাই বাস্তবতা। দেখ না চারিদিকে তাকিয়ে। যাদের সুযোগ আছে তারা
ঈশ্বরের উপর ভারসা না করে নেতাদের শরণ নেয়। নেতা বল, বস বল – তারা যাদের মনে করে নিজেদের
ভাগ্যবিধাতা, দেবতার মত সেসব মানুষের পূজা করে। আর যাদের নেতা নেই, বস নেই, এ জন্মে কিছুই
পাওয়ার আশা পর্যন্ত নেই তারা ঈশ্বরের শরণ নেয় যদি পরলোকে কিছু পাওয়া যায় সেই দুরাশায়।
ধর্ম মানুষের অস্থি মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে সে তার জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এই ফর্মুলা
মেনে চলছে। আমার তো মনে হয় ধর্ম এখন মানুষের ডিএনএ লেবেলে ঢুকে পড়েছে। অবাক হব না যদি
বিজ্ঞানীরা কোন দিন ডিএনএ তে ধর্ম কোষ নামে কোন কিছু খুঁজে পান।
আমরা কিন্তু দক্ষিণেশ্বর এসে গেছি। এখানে আগে যাব, না আগে বেলুর মঠ।
আগে বেলুর মঠ। আমার ছোটবেলায় এই ব্রীজ ছিল না। ভাঁটার সময় আমরা প্রায় হেঁটে গঙ্গা পার
হতাম। তখন সাইরেন বাজিয়ে জোয়ার ভাঁটার খবর জানানো হত। অন্তত দাদু তাই বলতেন। এখন কত
রাস্তাঘাট হয়ে গেছে। আমাদের দেশও বদলে গেছে। নতুন রাস্তাঘাট হয়েছে। এতে একদিকে যেমন
দেশের উন্নতি হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলা, হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশব,
শৈশবের স্মৃতি।
দেখতে দেখতে আমরা বেলুর মঠ চলে এলাম। তখন ছিল লাঞ্চ ব্রেক। প্রচুর লোকজন বাইরে দাঁড়িয়ে
আছে। সাধারণ মন্দিরে যেখানে বয়স্ক মানুষের ভিড়, তার বিপরীতে এখানে তরুণ তরুণীদের সংখ্যাই
বেশি। কেউ দাঁড়িয়ে ডাবের জল খাচ্ছে, কেউ বা বাদাম। দেখতে দেখতে এক সময় দরোজা খুলে গেল। ছবি
তুলতে মানা তাই আমি খুব বেশি ইন্টারেস্ট অনুভব করলাম না এখানে বেশি সময় কাটানোর। অনেকেই
আসে প্রার্থনা করতে, অনেকে ঘুরে বেড়াতে। গঙ্গার ধারে সুন্দর জায়গা, বসে থাকলেও মনটা ভালো
হয়ে যায়। ভারতের আকাশে বিবেকানন্দের আবির্ভাব অনেকটা ধূমকেতুর মত, ধর্ম প্রচার করলেও
মূলত তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে গেলাম গঙ্গার ধারে। ওখানে থেকে
লঞ্চে যাব দক্ষিণেশ্বর। ওটাই আজকের শেষ স্টেশন। এর আগে আমি কোনদিন গঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ
করিনি। একদিকে কোলকাতা, অন্যদিকে হাওড়া। মাঝে মধ্যেই নদীর ধারে কলকারখানা অথবা
উপাসনালয়। তেত্রিশ কোটি দেবতার জন্য স্বর্গ মনে হয় খুব ঘন বসতিপূর্ণ। তাই আজকাল তাঁরা
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভক্তদের দেওয়া দেবালয়েই বেশি সময় কাটান। ফোর্বস যদি তার ধনীদের
তালিকায় দেবতাদের যোগ করত, সেখানে দেবতারাই প্রথম কয়েক শ’ স্থান দখল করত বলে আমার
বিশ্বাস। দক্ষিণেশ্বরে এসে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলাম। আগের মতই নেই কিছুই। আমার
ছোটবেলায় পাণ্ডাদের অত্যাচার ছিল অন্য রকম, অথবা হতে পারে আমাদের দেখে বোঝা যায় বেড়াতে
এসেছি, পূজা দিতে নয়। মন্দিরে না ঢুকে আমরা হেঁটে বেড়ালাম বিশাল চত্বরে, গঙ্গার ধারে। এখানে
বিভিন্ন ফুড কর্নার ছিল, সেখানেই খেয়ে নিলাম। কাল সকালে ফ্লাই করব ভুবনেশ্বর। আমি যাব
কল্যাণদার বাসায়। পথে স্বপনদার ওখানে নামব। নভেম্বরের ০৮ থেকে ১৫ এ সাত দিন আমি কাটাব
ভুবনেশ্বরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সে।
ভুবনেশ্বরের দিনগুলো
পরের দিন সকালে কল্যাণদা আমাকে প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে এল। ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে নেমে
একজনকে দেখলাম উড়িষ্যার ট্র্যাডিশনাল পোষাকে লাগেজ খুঁজছেন। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর একটা ছবি
নেওয়ার, কিন্তু সাহসে কুলাল না। ভাবলাম শহরে এমন লোক অনেক, তাই পরে চুপি চুপি তুলে নেব।
কিন্তু সাতদিনের ট্রিপে এমন কারও দেখা আর পেলাম না। ইনস্টিটিউট থেকে গাড়ি এসেছিল, কোন
ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছে গেলাম গেস্ট হাউজে। মনে পড়ল ১৯৯৭ সালের ভিজিটের কথা। সেবার কোলকাতা
থেকে ট্রেনে এসেছিলাম। প্রফেসর অবিনাশ খারে আমাকে বলেছিলেন রেল স্টেশন থেকে ইনস্টিটিউট
খুব একটা দূরে নয়, রিক্সা বা অটোরিক্সায় চলে আসতে পারব। স্টেশন থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই
একগাদি রিক্সা এগিয়ে এলো। আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে ইংরেজি জানলে ইন্ডিয়ায় ঘোরাফেরা
সহজ। সেটা হয়তো ঠিক, তবে প্রথম যাদের সাথে দেখা হয় এরা রিক্সাওয়ালা, অটোওয়ালা বা ট্যাক্সি
ড্রাইভার। এরা ইংরেজি জানে না। তাই সমস্যায় পড়তেই হয়। ভেবেছিলাম ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স
বললে সবাই চিনবে। দেখা গেল, কেউ চেনে না। ঠিকানা জানতে চাইল। আমার মনে ছিল মার্গ। বললাম
আনন্দ মার্গ। কেন বললাম সেটা বলতে পারব না। পরে মনে হল, আনন্দ মার্গ যেহেতু নয়, নিশ্চয়ই
আনন্দ মঠ। এটা বঙ্কিম চন্দ্রের কৃপায়। আবার মিস ফায়ার। রিক্সাওয়ালা নাছোড়বান্দা। বলল,
«বাংলা জানেন?» ব্যাস। কোথায়, কি জন্য যাচ্ছি বলায় ও দিব্যি বুঝল গন্তব্য। রিক্সায় যাওয়ার
কারণ এই বিকেলে শহরটা একটু দেখা। শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হলাম সচিবালয় মার্গে। সে গেল
১৯৯৭ এর কথা। এবার জায়গাটা কমবেশি জানা, তাছাড়া ওদের গাড়ি, তাই ভাবনা ছিল না। গেস্ট হাউসে
এসেই খোঁজ করলাম এক লোকের। গতবার যিনি আমার দেখাশোনা করতেন। নাম মনে ছিল না, তাই
পাওয়া গেল না। তার দেখা পেয়েছিলাম শেষ দিন, চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে। একটু ফ্রেশ হয়ে
ফোন করলাম প্রতীককে। প্রতীক এই ক্যাম্পাসেই থাকে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সাইন্স
এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ –এ পিএইচডি করছে। এটা আগে ছিল না, ইদানীং হয়েছে। প্রতীক দুবনা
এসেছিল একটা কনফারেন্সে। সেসব সময় ইন্ডিয়া থেকে কেউ গেলে আমার সাথে সাধারণত যোগাযোগ
দেখা করত। বাইরে আমরা আর বাংলাদেশী, ভারতীয় বা পাকিস্তানি থাকি না, সবাই ইন্ডিয়ান
সাবকন্টিনেন্টের হয়ে যাই। আবার এমনও হয়, ভাষাগত সমস্যা হলে হোটেল বা অফিস (অফিসে সবাই
কমবেশি ইংরেজি বলে তাই সমস্যা হয় না) আমাকে ডাকে। প্রতীকের সাথে ওভাবেই আলাপ। সেটা ছিল
শনিবার। আমি থাকবে শুক্রবার পর্যন্ত। তাই প্ল্যান ছিল যা দেখার শনি আর রবিবারই দেখে নেবে।
কথা মত প্রতীক চলে এলো। একটা অটো ডেকে রওনা হলাম শহর দর্শনে। যাচ্ছে ১৯৯৭ সালে যেসব
জায়গায় গেছিলাম, নতুন করে সেসব দেখতে। প্রথমেই গেলাম লিঙ্গরাজ মন্দিরে। এটা ভুবনেশ্বরের
সবচেয়ে পুরনো শিব মন্দির। একাদশ শতকের শেষ দশকে তৈরি এ মন্দির কলিঙ্গ স্থাপত্যের
নিদর্শন। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে অপেক্ষা করছে ভিখিরি আর পুণ্যার্থীর দল। দেখে মনে হয়
সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের প্রতিনিধি। তবে সঠিক বলতে পারব না। ছোটবেলায় মায়ের সাথে
যখন এসেছি তাঁকেও দেখেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্দিরের দ্বারে বসে থাকতে। সে যাই হোক, এদের
বেশভূষা, শারীরিক অবস্থা মনে আশা জাগায় না। আমার এমনিতেই ঠাকুর দেবতার প্রতি ভক্তি নেই,
যাওয়া মূলত প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে আর ছবি তুলতে, কিন্তু যখন দেখলাম খালি পায়ে ঢুকতে হবে
মন্দিরে, আমার সমস্ত ইচ্ছে কর্পূরের মত উবে গেল। ঘুরে ঘুরে একটা জায়গা খুঁজে বের করলাম
যেখানে দাঁড়িয়ে প্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে ভেতরের ছবি তোলা যায়। ও সেটাই করলাম। আমার ধারণা
ভেতরে গিয়ে এত ভালো ছবি পাওয়া যেত না। মানুষের পাশেই বিশাল এক ষাঁড় ঘোরাফেরা করছিল। দেখতে
বদমেজাজী মনে হলেও ছিল শান্ত। শিবের মতই আপনভোলা। ওখান থেকে গেলাম ধবলগিরি মন্দিরে।
এই সেই বিখ্যাত কলিঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্র। কথিত আছে এখানে মহাপ্রতাপশালী সম্রাট অশোক তাঁর শেষ
যুদ্ধ করেন। কলিঙ্গ বিজয় সম্পন্ন করতে তিনি রাস্তা তৈরি করেন যাতে হস্তী বাহিনী অনায়াসে
এখানে আসতে পারে। এ যেন ধ্বংসের আগে সৃষ্টি। পাশ নিয়ে বহমান দয়া নদী নাকি রক্তের বন্যায়
ভেসে যায়। এত রক্ত যে সম্রাট অশোকের হৃদয় পর্যন্ত কেঁদে ওঠে। তিনি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে
বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষে শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মের জয়যাত্রা। একসময় বৈদিক ধর্মের
বিভিন্ন রীতিনীতির প্রতিবাদে গৌতম বুদ্ধ নতুন শিক্ষা প্রচার শুরু করেন বর্ণাশ্রম থেকে মানুষকে
মুক্ত করতে। এখানে যে মোক্ষের কথা বলা হয় সেটা স্বর্গ লাভ নয়, পরম জ্ঞান লাভ। বুদ্ধ নিজে
চিরায়ত ভগবানকে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে তাঁর ভক্তরা তাঁকে ভগবান বুদ্ধে পরিণত করে।
আর বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রাস করার জন্য বৈদিক ধর্ম মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম,
রাম ও কৃষ্ণের পাশাপাশি বুদ্ধকেও অবতারের মর্যাদা দেয়। সিমেটিক ধর্মের পয়গম্বর বা নবীর সাথে
অবতারের পার্থক্য এই যে পয়গম্বর প্রেরিত পুরুষ, খৃস্টান ধর্মে ঈশ্বর পুত্র, কিন্তু হিন্দু ধর্মের
অবতার ভগবান বিষ্ণুর জাগতিক রূপ। গীতার ভাষ্য অনুযায়ী “যখন পৃথিবীতে ধর্ম রসাতলে যায়, তখন
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন আর ধর্ম রক্ষার্থে ভগবান যুগে যুগে জন্মগ্রহন করেন।” প্রচলিত
বিশ্বাস মতে কলিকালের শেষ কল্কি অবতারের আবির্ভাব ঘটবে। ধার্মিকের হাতে ধর্মের সে দশা
হয়েছে আমার বিশ্বাস কল্কি অবতারের আগমন হওয়া দরকার ধার্মিকদের হাত থেকে ধর্মকে উদ্ধার
করার জন্য। এই ধবলগিরি শীর্ষে সাদা পাথরের বৌদ্ধ মন্দির সম্রাট অশোকের সেই শান্তির প্রতি
আনুগত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মন্দির নাকি জাপানের সহায়তায় তৈরি। জন্মভূমি থেকে
বিদায় নিলেও বৌদ্ধ ধর্ম চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম,
লাওস, কাম্পুচিয়া, বার্মা, এমন কি রাশিয়ার কিছু কিছু প্রদেশে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। ধবলগিরির
চূড়া থেকে দয়া নদীকে মনে হয় একটা রজ্জু বা সাপের মত, যা সবুজ জমির বুক বেয়ে চলে গেছে বহুদূরে।
গতবার যখন এসেছিলাম তখন দয়া নদীর একটা ছবি তুলেছিলাম। এবার আসার সময় এর আরও কিছু
ছবি নেব বলে মনে মনে ঠিক করেছিলাম। ধবলগিরির পাশেই উদয়গিরি। এই পাহাড়ের মূল আকর্ষণ
পাদুকা আশ্রম। ধারণা করা হয় এখানেই ভরত রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে চৌদ্দ বছর রাজ্য শাসন
করে। এ ছাড়াও সেখানে রয়েছে দুর্গের মত সব দালানকোঠা আর অসংখ্য বানর। বানরদের কিছু
পারিবারিক ছবি তুলে গেলাম পাশের খণ্ডগিরিতে। সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে জৈন মন্দির। এসবই
ভুবনেশ্বর থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সুন্দর শান্ত পরিবেশ। লোকজন আছে, তবে ভিড় নেই। কাজু
বাদামের গাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে। খণ্ডগিরির উপরেই নেমে আসে
সন্ধ্যার কালো যবনিকা। রওনা হই শহরের উদ্দেশ্যে। ইচ্ছে পথে ইস্কনের মন্দির দর্শনে যাব।
গেলাম বটে তবে মন্দির অনেক আগেই রাতের আঁধারে হারিয়ে গেছে। অতঃপর গেস্ট হাউজে ফেরা। কাল
গন্তব্য কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখে চন্দ্রভাগা হয়ে পূরী যাওয়া আর ফেরার পথে পিপলি হয়ে আসা
কিছু ব্যাগ আর স্যুভেনির কেনার জন্য।
পর দিন সকালে রওনা হলাম পুরীর পথে। ইচ্ছে ছিল ট্যাক্সি ভাড়া করা, প্রতীক বলল অটোতে যেতে।
যে রাস্তা তাতে সেটাই বেটার অপশন, বিশেষ করে যেখানে সেখানে নেমে ছবি তোলা যাবে। বাংলাদেশে
পথের ধারে অনেক গ্রাম, এখানে তেমনটি নয়, যদিও রাশিয়ার মত জনশূন্যও নয়। রাস্তায় মাঝে মধ্যে
নেমে ছবি তুললাম। গল্পে গল্পে কেটে গেল সময়। কথা হচ্ছিল রাশিয়া নিয়ে, দুবনা নিয়ে। প্রতীক
বিভিন্ন কথা জানতে চাইছিল।
স্যার, লেনিনের সেই স্ট্যাচুটা এখনও আছে মস্কো ক্যানেলের শুরুতে?
কেন, থাকবে না কেন?
না, সোভিয়েত আমলে তো ওঁর বিপরীতে দাঁড়ানো স্ট্যালিনের স্ট্যাচুটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল, তাই মনে
হল।
দেখ, লেনিন সম্পর্কে রাশিয়ার মানুষের ধারণা আজকাল বদলে গেছে, তবুও সেটা এ পর্যায়ে নয় যে
স্ট্যাচু ভাংতে হবে। আশির দশকে লেনিন ছিলেন সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে
তাঁর সমালোচনা করলে প্রায় যেকোনো লোকের মধ্যেই বর্তমানের তালিবান বা ইসলামিক স্টেটের
চেহেরা দেখতে পেতে। আজকাল এ নিয়ে প্রচুর খোলামেলা কথা হয়, টক শো হয়। সোভিয়েত আমলে
যেদিকেই তাকাও শুধু লেনিন আর লেনিন। প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে। জানি না
সোভিয়েত ইউনিয়নে যত লেনিনের স্ট্যাচু ছিল ভারতে তত শিবলিঙ্গ ছিল কি না। আমার রুমমেট
ইয়েভগেনি একদিন তো বললই, “যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, লেনিনই হতেন আমার ঈশ্বর।” সেই
বুদ্ধ দেবের মত যে লেনিন সারা জীবন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন, অনুসারীরা তাঁকেই
ভগবানের আসনে বসিয়েছে। বর্তমানে অনেক গোপন ঐতিহাসিক দলিলপত্র ওপেন করা হয়েছে। সেসব
দেখিয়ে মানুষ পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথাই বলে। এমনকি যারা লেনিনের বা সমাজতন্ত্রের সমর্থক
তাদের অনেকেই লেনিনের ভুলগুলো স্বীকার করে। সেটা তাঁর কিছু জাতীয় পলিসিই হোক আর সবংশে
জারকে নিধন করাই হোক। ইংল্যান্ডে রুশ চার্চের ফাদার জন বলেছিলেন “১৯১৭ সালের বিপ্লবে ঈশ্বর
গৃহহারা হয়েছিলেন।” সেই সূত্র ধরে বলা যায় ১৯৯১ সালের পরিবর্তনে লেনিন দেবালয় থেকে বহিষ্কৃত
হয়েছেন। কিন্তু এদেশের বেশির ভাগ মানুষই তাঁকে নিজেদের ঘরে স্থান দেয়নি। কেন? সে অনেক
প্রশ্ন। যদিও বিপ্লব পূর্ব রাশিয়ার ইতিহাস অজানা ছিল না, তবে সেটা সোভিয়েত পরিবেশনায় মূলত
ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেকটা দেশে যেমন বলা হয় “অনেক দিন আগের কথা। আরবের লোকেরা তখন
বর্বর ছিল।” কিন্তু যদি একটু ভাবি দেখব এই সভ্যতা মিশরীয়, ব্যবিলনীয়, সিরিয় সভ্যতার
উত্তরাধিকারী। আর জানোই তো এসব এলাকায় সভ্যতার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। এমন কি যদি
অন্যভাবেও দেখ, ইসলাম সেই যুগে যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী নিয়ে আসে সেটা সম্ভব কেবল উন্নত
ও সভ্য সমাজে। বর্বর, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে সেটা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, রুশ আমলে
শিক্ষিতের হার খুব কমছিল। সোভিয়েত আমলে শিক্ষার হার বাড়ে আর ইতিহাস তারা শেখে সোভিয়েত
প্রোপ্যাগান্ডা থেকে। নতুন রাশিয়ায় মানুষ জানল স্তালিপিনের কথা। জানল সেই সময় রুশ দেশের
অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা। ফলে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগলো দেশের অগ্রগতির জন্য বিপ্লব কী
অবশ্যম্ভাবী ছিল?
আপনি জাতীয় পলিসি বলে একটা কথা বলেছেন। এর মানে মানে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানের মধ্যেই যেকোনো অঙ্গ রাজ্যের বের হওয়ার অধিকার ছিল।
অনেকেই মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের টাইম বোমা সেখানেই ছিল। যখন ইউক্রাইন রাজ্য
গঠন করা হয়, তখন খারকভ, ওদেসাসহ পুরো পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রাইন যা ছিল রাশিয়ায় অংশ,
রাশিয়ার তৈরি – সেটা ইউক্রাইনের সাথে যুক্ত করা হয় সেই প্রজাতন্ত্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত
করার জন্য। একই ঘটনা ঘটে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের ক্ষেত্রে। এসব পরবর্তী কালে অনেক
অমীমাংসিত সমস্যার জন্ম দিয়েছে। আজও মানুষ সেই পলিসির নেগেটিভ ফল ভোগ করছে। নাগরনি
কারাবাখ, দনবাস এসব সমস্যার মূল কিন্তু বলতে গেলে লেনিনের হাতেই রোপিত। সব মিলিয়ে বলতে
পার লেনিন দেবালয় থেকে মানুষের ঘরে ফিরে এসেছেন, দোষগুন সব নিয়েই। আসলে এখন আর সাধারণ
মানুষ তাঁকে নিয়ে কিছুই ভাবে না। তুমি তো পদার্থবিদ্যার ছাত্র। যদি কোন এক্সপেরিমেন্ট কর, সেটা
যতক্ষণ না ফেল করে ততক্ষণই ভালো, কিন্তু একবার ফেল করলে সেটাকে তো ভালো বলবে না। তুমি
কী করবে, ওখানে কী কী ভুল ছিল সেটা বের করার চেষ্টা করবে আর সেই সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে
নতুন করে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করবে। আমাদের সমস্যা আমরা অনেকেই সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক
ভুলটা স্বীকার করলেও এর যে তত্ত্বগত ভুল থাকতে পারে সেটা মানতে রাজী নই। এমনকি যখন
প্রায়োগিক ভুল স্বীকার করি তার দোষও কিছু মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে পুরনো পথেই চলার চেষ্টা
করি। কেউই স্বীকার করতে চাই না যে তাত্ত্বিক ভুলের কারণেই বা বলতে পার ফ্লেক্সিবিলিটির
অভাবেই প্রায়োগিক ভুল হয়েছে। আমরা সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে বিশ্বাস করি
কিন্তু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মূলনীতি প্রশ্ন করা, সমালোচনা করা – সেটা করি না, কোন রকম
সমালোচনা গ্রহণ করি না। এ কারণেই পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা সামনে
চলতে পারছি না। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধুর স্মৃতির মধ্যে আটকে আছি ঠিক মাছি যেমন গুড়ের বয়মে
আটকে মরে। আচ্ছা ঐ যে ছোট্ট একটা মন্দির মত দেখা যাচ্ছে ওখানে একটু থামতে বল।
ওখানে তো কিছুই নেই। ছোট্ট কোন এক দেবতা!
দেখ, সারা জীবন গরীবদের কথা বললাম, গরীবদের রাজনীতি করলাম। এখন যদি এই অবহেলিত,
গরীবের দেবতার কথা না ভাবি, দেখা না করি স্বর্গে বিপ্লবের সাথী পাব কোথায়?
সেটাও তো ভাবার বিষয়। চলুন।
ছোট্ট শিব মন্দির। সামনে শিব-দুর্গার ছবি। পাশে ডোবা। তাতে ফুটে আছে বেগুনি রঙের শাপলা।
কয়েকটা ছবি তুলে আবার রওনা হলাম কোনার্কের পথে।
সূর্য শহর কোনার্ক
কথা শেষ হতে না হতেই আমরা চলে এলাম কোনার্ক। প্রাচীন শহর, বিখ্যাত তার সূর্য মন্দিরের
জন্য। কোনার্ক শব্দটাই কোনা মানে কর্নার আর অর্ক মানে সূর্য – দুটো শব্দ থেকে এসেছে। এই
মন্দিরটি ১২৫০ সালে পূর্ব গঙ্গা বংশের রাজা নরসিংহের আমলে তৈরি। বৈদিক ধর্ম বিশ্বাসে
সূর্যদেব প্রতিদিন সাতটি ঘোড়ায় টানা রথে করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করে। এই
সূর্য মন্দির আসলে সেই রথের আদলে তৈরি। এখানে এটা আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ। লোকের ভিড়
থাকলেও যাকে বলে মেলার মত ধাক্কাধাক্কি নেই। খোলা মেলা। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে স্থাপত্য
শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। বিশেষ করে দেওয়াল চিত্র। যদিও সময়ের বা বলা ভালো বয়সের চাপে প্রায়
নুয়ে পড়ার অবস্থা, দেওয়াল চিত্রগুলো এখনও বিস্ময় জাগায়। চারিদিকে বিশাল বিশাল বট গাছ। কেউ
কেউ তাদের ছায়ায় দিব্যি ঘুমুচ্ছে। ১৯৯৭ সালে লোকজন আসত ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে, এখন
অবশ্য সেসব নেই, সবাই সেলফি তুলতে ব্যস্ত। আমিও সময় নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেশ কিছু ছবি
তুললাম। সেখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে ওরা রওনা হলাম চন্দ্রভাগার পথে।
১৯৯৭ সালের থেকে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন?
না, কী তখন, কী এখন – স্থাপত্য শিল্পের এই অপূর্ব নিদর্শন সংরক্ষণে সরকার খুব একটা আগ্রহী
বলে মনে হয় না। যদি সময় মত রিকনস্ট্রাকশন করা না হয়, এসব আর দু এক দশকের মধ্যেই
ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। এটা তো এখন আর মন্দির নেই, পূজা অর্চনা হয় না, নামে সূর্য মন্দির
হলেও এটা এখন স্রেফ পর্যটক কেন্দ্র। তাই সে দিকে দৃষ্টি রেখেই এটার শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়,
পুনর্নির্মাণের কথা ভাবা দরকার। একটা জাতির সভ্যতার ইতিহাসের জন্যেও এটা দরকার।
কিন্তু দেশের এত সমস্যা, সেখানে এটা কী এমনই জরুরি?
দেখ ছোট বা বড় সমস্যা বলে কিছু নেই। কিছু সমস্যার জরুরি সমাধান দরকার, কিছু সমস্যার সমাধান
ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া যায়। আমাদের যখন শরীর খারাপ করে আমরা তো কোন অসুখ তেমন
ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করতে পারি না। কেননা ছোট ছোট সমস্যাই একসময় বড় হয়ে দেখা দেয়।
আমরা দেখি কোনটার জরুরি চিকিৎসা দরকার, কোনটার চিকিৎসা দুদিন পরে করলেও হবে। কিন্তু
চিকিৎসাটা করতে হবে। এখানেও তাই। দেশও একটা বিরাট শরীর, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আগে হোক
বা পরে হোক – সব সমস্যারই সামাধান দরকার। সেটা না হলে একদিন দেশটাই থাকবে না।
দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম চন্দ্রভাগায়। এটা সমুদ্র সৈকত। বালু আর বালু। আর সেই বালুতে
ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের যত ক্রোধ। প্রতীক সমুদ্রস্নান করল। আমি উপরে
ঘোরাফেরা করলাম এদিক সেদিক। রাশিয়ায় এই আবহাওয়ায় এ ধরণের জায়গায় তিল ধারণের জায়গা
থাকত না। এখানে কেউ রোদ পোহায় না, সাঁতার কাটে না। বাচ্চাদের কোলাহল নেই। নেই বিভিন্ন
খেলাধুলার ব্যবস্থা। লোকজন আসছে মূলত ছবি তুলতে। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র আকুল হয়ে ডাকছে
মানুষকে তার বুকে। এখানে অল্প সময় কাটিয়ে আবার পথে নামলাম। এবার গন্তব্য পুরী। প্রতীক
আগের কথা ধরে প্রশ্ন করল
আপনি কিন্তু বললেন না লেনিনের প্রতি বা মার্ক্সবাদের প্রতি আপনার মনোভাবের কথা।
দেখো সেটা এক কথায় বলা সম্ভব নয়। ভালমন্দ দুটো মিলেই সেই অনুভূতি। মৌলানা আবুল কালাম
আজাদের “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিইডম” বইয়ে একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। দেশ বিভাগের আগে কংগ্রেস
আর মুসলিম লীগের এক যৌথ মন্ত্রী সভা গঠন করা হয় কেন্দ্রে মানে দিল্লিতে। নেহরু হন
প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম লীগ দাবী করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বেঁকে বসেন সর্দার বল্লভ ভাই
প্যাটেল। তিনি হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। মৌলানা তাঁকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে
লিয়াকত আলী খানকে অর্থ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দিয়ে সমঝোতায় আসা হয়। তবে আসল ঘটনা
এখানে নয়। মৌলানার কথায় “খান সাহেবের অনুমোদন ছাড়া সর্দারজী এমন কি নিজের মন্ত্রনালয়ে
এক জন চাপরাশি নিয়োগ করতে পারতেন না।” বুঝতেই পারছ দিনের শেষ সব কিছু নির্ভর করে
অর্থনীতির উপরে। আমরা আজও কৌটিল্যের অর্থনীতির কথা বলি। মানুষের সামাজিক ইতিহাস যদি
লক্ষ্য কর, দেখবে তার শ্রেণী বিন্যাস অস্ত্রশস্ত্রের ভিত্তিতে হয়নি, হয়েছে উৎপাদন ব্যবস্থা ও
সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তার বন্টনের ভিত্তিতে। মার্ক্স তাঁর তত্ত্ব দিয়েছেন পুঁজিবাদী
ব্যবস্থার অর্থনীতির ভিত্তিতে। তিনি সেখানে মূলত বন্টনের নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন, কিন্তু
উৎপাদনের কথা বলেছেন বলে জানা নেই আমার। তবে বাস্তবতা বলে এখনও পর্যন্ত পুঁজিবাদী
উৎপাদন ব্যবস্থা সবচেয়ে এফেক্টিভ আর সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা মানবিক। বর্তমান
রাশিয়ায় যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগেন তাদের একটা বিরাট অংশ যাকে বলে
অল্পে সন্তুষ্ট টাইপের মানুষ। এরা উদ্যোগী নয়, অন্তত নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের
ক্ষেত্রে। আরও একদল আছেন যারা সেই সময়ের নিরাপত্তার কথা মনে করে নস্টালজিয়ায় ভুগেন।
কিন্তু বর্তমানে যারা উদ্যোগী, যারা সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে নতুন জীবনে, নতুন
বাস্তবতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন তারা সেই নস্টালজিয়ায় ভুগেন না। বর্তমান বিশ্বের
দিকে তাকালে মনে হয় দরকার একটা মাঝামাঝি পথ, মানে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি
সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা। ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলো সে পথেই যাচ্ছে বলে মনে হয়। অনেকেই
বলতে পারেন লেনিন তো নিউ ইকনমিক পলিসি বা নেপ প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল সমাজ
একদিনে গড়ে ওঠে না। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক সম্পর্ক একদিনে ভেঙ্গে ফেলা যায়
না। আমার বিশ্বাস আমরা যারা বাইরে থাকি, এমন কি সেই থাকাটা যদি জীবনের সিংহ ভাগ সময়ও হয়,
জন্ম সূত্রে পাওয়া কিছু অভ্যেস আমাদের থেকেই যায়। অর্থনীতি এর বাইরে নয়। ডিক্রি জারি করে
বাহ্যিক দিকটা ভাঙ্গা যায়, কিন্তু যেটা মানুষের অন্তরে যুগ যুগ ধরে একটু একটু করে বড় হয়েছে
সেটা ভাঙ্গা কি এতই সহজ? আরও কঠিন নতুন কিছু প্রতিষ্ঠা করা। স্যোশাল সাইকোলজি সহজে
বিলুপ্ত হয় না। এই দেখ, ভারত বা বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে,
দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে। দেশ, দেশের মানুষ আজও কি সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে
আসতে পেরেছে? আবার একই ভাবে দেখলে, এরা কী দ্বিজাতি তত্ত্ব গিলে খেয়েছে? কোনটাই নয়। এরা
স্বাভাবিক সময়ে মিলেমিশে থাকে, একে অন্যের ডাকে এগিয়ে যায় আবার পরিস্থিতির শিকার হয়ে
কখনও সাম্প্রদায়িক হয়, কখনও ধর্মনিরপেক্ষ। না না, এটা ভারত বিভাগের জটিলতার সময়
এনকোডেড কোন চিপ নয়, এটা তাদের হাজার বছরে পাশাপাশি বাস করে লব্ধ জেনেটিক্যাল কোড। আর
যারা অতিমাত্রায় ধর্মান্ধ, মৌলবাদী – সেটা তাদের মধ্যে ঢুকানো হয়েছিল, ঢুকানো হচ্ছে দ্বিজাতি
তত্ত্বের ভ্যাকসিনের মাধ্যমে। যাকগে ফিরে আসি তোমার প্রশ্নে। লেনিন বলেছিলেন জমি হবে
কৃষকদের, কলকারখানা শ্রমিকদের। সেটা কী হয়েছিল? জাতীয়করণ করার ফলে মালিকানার
পরিবর্তন হয়, কিন্তু কৃষক বা শ্রমিক মালিক হয়নি, মালিক হয়েছে ডি জুর্যো রাষ্ট্র আর ডি
ফাক্টো পার্টি। বুঝলে হে, ক্ষমতা ব্যাপারটা বড়ই গোলমেলে, সেটা দেবতাকে পর্যন্ত দানবে পরিণত
করতে পারে। হয়তো সে কারণেই এক সময় দেশের সম্পদ ছিল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের, সেটাকে পার্টি
করতে চেয়েছিল সবার, আর পরিনামে সেটা হয়েছিল বেওয়ারিশ। মানুষ ছিল অনেকটা মেকানিক্যাল।
তখনকার একটা আনেকদোত ছিল এ রকম
এক লোক গর্ত খুঁড়ে জল ঢালছে, কিছুক্ষণ পরে আরেকজন এসে সেটা মাটি দিয়ে ভরে দিচ্ছে। কেন এটা
করছে জিজ্ঞেস করলে উত্তর ছিল, «যার গাছ লাগানোর কথা সে অসুস্থ, তাই বলে আমরা তো বসে
থাকতে পারি না।» এমন ঘটনা আমার মস্কো জীবনে অনেক দেখেছি। তাই শুধু লেনিন নয় আমরা যখন
কোন মানুষের সম্পর্কে কথা বলি, বিশেষ করে তিনি যদি রাজনীতিবিদ হন, তখন আমাদের শুধু তাঁরা কী
চেয়েছিলেন সেটা দেখলেই চলবে না, সেই চাওয়া দেশকে, দেশের মানুষকে কী দিল সেটাও দেখতে হবে।
আমি বা আমরা, যারা সে দেশে পড়াশুনা করেছি তারা প্রচুর পেয়েছি সে দেশ থেকে। এমন কি তুমি নিজেও
পেয়েছ। কীভাবে? লেনিন না জন্মালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন না হলে আমাদের দেশগুলো স্বাধীন হত কি
না, সেটা বিরাট প্রশ্ন। শুধু তাই নয়। পুঁজিবাদী বিশ্বে শ্রমিকেরা আজকের মত থাকত কিনা সেটাও
প্রশ্ন সাপেক্ষ। আসলে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুটো ব্যবস্থার মধ্যে যে প্রতিযোগিতা ছিল সেটা
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এমন কি মানসিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন
এনেছে। আজ আমরা যে টেকনোলজিক্যাল জগতে বাস করছি সেটাও দু ব্যবস্থার অস্ত্র
প্রতিযোগিতার, প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার অদম্য ইচ্ছার ফল। তাই বিভিন্ন
ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাশিয়ার সমাজে লেনিনের প্রভাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও মানব জাতির
সার্বিক উন্নয়নে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তবে লেনিনকে নিয়ে রুশ সমাজে যে নেগেটিভ মনোভাব
আছে সেটা মূলত অর্থনৈতিক ও টেকনোলজির ক্ষেত্রে এ দেশ পশ্চিমা বিশ্বের থেকে পিছিয়ে থাকার
কারণে। সাথে সাথে মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতা – এসব ভুললেও চলবে না। সোভিয়েত সমাজ হয়তো
গড়পড়তা মানুষের জন্য ভালো ছিল, কিন্তু উদ্যোগী মানুষের জন্য, যারা নিজেদের কর্মক্ষমতা দ্বারা,
উদ্যোগ দ্বারা অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিল আর বার বার তাদের টেনে নামানো হয়েছিল, সে
ব্যবস্থা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। উদ্যোগী মানুষের দরকার চিন্তার স্বাধীনতা, চিন্তাকে বাস্তবে রূপ
দেওয়ার স্বাধীনতা, চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা। এসবের খুবই অভাব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। এর
ফলে শুধু যে এসব মানুষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাই নয়, অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই বিভিন্ন ভাবে দেশ
আর সমাজও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই আমার মনে হয় অনেক পজিটিভ থাকার পরেও অক্টোবর
বিপ্লব সঠিক পথ নয়, সেই পথকে বা তার ফলে যে সমাজ ব্যবস্থা আমরা পেয়েছিলাম সেটাকে মডেল
হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়, সেই সমাজের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আর পজিটিভ দিকগুলো পুঁজি করে
আমাদের নতুন কোন মডেল খুঁজতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক ভালো দিক ছিল, প্রায় প্রতিটি
শিশুর নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশের সুযোগ ছিল। একটা পিছিয়ে পড়া সমাজ থেকে মাত্র কয়েক দশকে
এরা কী বিজ্ঞান, কী শিক্ষা, কী টেকনোলজি, কী সংস্কৃতি – প্রায় সব ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নতি
করেছে সেটা অবিশ্বাস্য। তবে সমস্যা হয়েছিল পরে। যান্ত্রিক ভাবে সবাইকে সমান করতে গিয়ে
উদ্যোগী মানুষের মূল্যায়ন করা হয়নি। আর গুনী যদি গুনের মূল্য না পায় সেটাও তো এক ধরণের
বৈষম্য। মানে সমতা শুধু মাথাপিছু হলে হবে না, হতে হবে কার মাথার ভেতর কি আছে সেটা বিবেচনায়
এনে।
পূরী
পুরীতে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এই সেই পুরী যেখানে এসেছিলাম ১৯৬৯ সালে আর আমার
কান্নাকাটিতে ট্রেন ফেল করে নিশ্চিত দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। ১৯৯৭ সালেও অবশ্য
পুরী আসি এক দিনের ট্রিপে একটা গ্রুপের সাথে। মন্দিরে যে যাব না সেটা আগে থেকেই ঠিক করে
রেখেছি আগে থেকেই। বাইরে ঘুরব আর ছবি তুলব। তবে জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সামনে সব সময়ই
মেলা। বলা হয়ে থাকে যে প্রথম জগন্নাথ মন্দির মহাভারত ও পুরাণে বর্ণিত মালব রাজ
ইন্দ্রদ্যুম্নের তৈরি। তিনি ছিলেন ভারত ও সুনন্দার সন্তান। মন্দিরের সামনে যে রাস্তা সেখানেই হয়
রথযাত্রা। তিন ভাই বোন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে রথে বসিয়ে এ রাস্তায়ই ঘুরানো হয়।
বর্তমানের মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয় দশম শতাব্দীতে। গঙ্গা বংশের রাজা অনন্তবর্মণ
ছোটগঙ্গা দ্বাদশ শতাব্দীতে এই কাজ সম্পন্ন করেন। যদিও এই মন্দির বিখ্যাত রথযাত্রার জন্য,
সারা বছরই এখানে ভক্তদের ভিড় দেখা যায়। আর মন্দিরের সামনের বিশাল রাস্তা সব সময়ই লোকে
লোকারণ্য। মানুষ, গরু, গাড়ি, ঘোড়া সবাই আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে এক এলাহি কাণ্ড। এর মধ্যেই
বিভিন্ন দোকান বসেছে। স্যুভেনিরের পাশেই খাবার। তার পরেই ভিখিরি বসে আছে। গরীবের সাম্যবাদ
আর কি! এখানে অনেকটা পথ খালি পায়ে যেতে হয়। সেটা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। স্বাস্থ্যের জন্যও
ক্ষতিকর বলেই মনে হয়। তবুও ভিড়ের অন্য একটা শক্তি থাকে, সে মানুষকে টানে, অনেক অপ্রিয়
কাজও সে অন্যের দেখাদেখি করে ফেলে। আমিও ব্যতিক্রম নই। এদিক সেদিক ঘুরে বেশ কিছু ছবি তুলে
গেলাম সমুদ্র ধারে।
পুরীর সমুদ্র। আমার মনে পড়ে প্রথম সমুদ্র স্নানের কথা। ১৯৬৯ সালে এখানেই প্রথম সমুদ্র স্নান।
পান্ডার হাত ধরে। তখনই শুনেছিলাম, পুরীর সমুদ্রে কোন কিছু ছুঁড়লে সে তা দুইবার ফিরিয়ে দেয় আর
তৃতীয় বার চিরকালের মত নিয়ে যায়। এবার আর সমুদ্র স্নানের ব্যাপার ছিল না। এখানে আসতে
আসতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো সমুদ্রের বুকে আটকে আছে। আর একটু।
তারপরেই সারাদিন রোদে পুড়ে উত্তপ্ত সূর্য সমুদ্রের শীতল জলে ডুব দেবে। স্নান শেষ করে ঘুমিয়ে
পড়বে। সামনে নতুন দিন, নতুন কাজ। সূর্য তো আর আলসেমি করে একটু বেশি সময় লেপ মুড়ি দিয়ে
শুয়ে থাকতে পারবে না! এবার ঘরে ফেরার পালা!
সারাদিনের ঘোরাফেরায় প্রতীক মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সোভিয়েত ফেরত লোকজন এক
হলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে গল্প শুরু করি। এখন প্রতীকের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের
অজান্তেই গল্প সেদিকে মোড় নিয়েছে। আচ্ছা প্রতীক এই যে আমি তোমার সাথে রাশিয়া নিয়ে,
সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে কথা বলছি, তোমার কি মনে হয় – এটা কি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে
যাচ্ছে?
ও কিছু বলার আগেই আমি বলতে শুরু করলাম
কে জানে? আসলে আমাদের পরিচয় ওখানেই। তাছাড়া তুমি নিজেই এ প্রশ্ন করলে। আর অভ্যাস? তাই
হয়তো। আসলে যাদের সাথে আমার যেখানে প্রথম আলাপ তাদের সাথে সেখানকার গল্প দিয়েই শুরু
করি বা কথার ফাঁকে ফাঁকে সেখানে ফিরে যাই। যাদের সাথে প্রথম আলাপ ইতালীর ট্রিয়েস্টে ওদের
সাথে কিন্তু সেখানকার গল্পই করি। দেশের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে গ্রামের বা মানিকগঞ্জের
গল্প করি। যাক, ট্রিয়েস্টের কথা যখন উঠল, একটা গল্প করি। ১৯৯৬ সালে প্রথম সেখানে যাই।
পৌঁছলাম গিয়ে শনিবার ভোরে। কিছুই জানি না, টাকাপয়াসা তেমন নেই। ইনস্টিটিউট থেকে সব ব্যয়ভার
বহন করবে, তাই টাকা আনার দরকার হয়নি, তাছাড়া তখন টাকাপয়সাও তেমন ছিল না। এখনও যে আছে
সেটাও বলা ঠিক হবে না। গেস্ট হাউজে থাকতে দিয়েছে আর দিয়েছে খাবার কুপন, সোমবার অফিস
খুললে টাকাপয়সা দেবে। সাথে কিছু রুটি কালবাসা ছিল মস্কো থেকে আনা। সেটাই খেলাম দুপুরে। মাঝে
এক আধটু বাংলা শব্দ কানে এলো, কিন্তু ঠিক সাহস বা ইচ্ছে হল না তাদের সাথে গিয়ে আলাপ করতে।
সন্ধ্যায় টিভি দেখছি, দেখি দুজনে গল্প করছে। যেহেতু দেখতে রাশানদের মত নয়, তাই প্রথমে বুঝতে
পারিনি। একটু খেয়াল করে বুঝলাম রুশ ভাষায় কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম। জানলাম ওরা
আর্মেনিয়া থেকে। একজন আমি যে ল্যাবরেটরীতে কাজ করি সেখানেই আছে। গত দুই বছরে কখনও
দেখা হয়েছে বলে মনে করতে পারছিলাম না। যাই হোক, আমরা সবাই যেন হাতে চাঁদ পেলাম, বন্ধুত্ব
হয়ে গেল। এরপরে ওখানে অনেক বাঙ্গালীদের সাথে দেখা হলেও সেরগেই আর ডেভিড ছিল নিত্য দিনের
সঙ্গী। ওখানেই আলাপ হয় শৌর্য আর কৌশিকের সাথে। সে সময় কৌশিক ভুবনেশ্বরেই পিএইচডি
করছিল। সে বন্ধুত্ব এখনও অটুট। কে জানে, হয়তো মানুষ হিসেবে আমাদের ফরমেশন হয়
ইউনিভার্সিটি লাইফে। তাই ওই সময়টা যে দেশে কাটে, সেই দেশের প্রতি একটা বিশেষ টান থাকে।
আবার দুবনায় আমাদের মত কাউকে দেখলে আমি এগিয়ে গিয়ে কথা বলি। আসলে মানুষ নিজের মত,
মানে যারা দেখতে তোমার মত, তোমার ভাষায় কথা বলে, অথবা একই জায়গার মানে যাদের সাথে কমন
স্মৃতি আছে তাদের বিশ্বাস করে। ওই ট্রেস্টেই নাইজেরিয়ার এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। কথায়
কথায় জানলাম তিনিও মস্কোয় পড়াশুনা করেছেন। কত গল্প আমাদের! আবার দেখ দেশের বাইরে যখন
যাও, প্রথমে খোঁজ দেশের মানুষ, এরপর আসে আঞ্চলিকতা। তাই আমি যারা কখনও না কখনও
রাশিয়া ছিল, তাদের প্রতি এক ধরণের দুর্বলতা অনুভব করি। এতে ভালো বা মন্দের কিছু নেই যদি না
সেটা অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই বলে হয়তো তার প্রতি আমাদের আবেগটা
একটু বেশি। অবশ্য দ্ব্যর্থহীনভাবে সেটা বলতে পারব না।
কেন?
দেখ আমি যতবারই কোলকাতায় এসেছি আর রাস্তাঘাটে বা কোন দোকানে যখন কেউ জেনেছে আমি
বাংলাদেশ থেকে তারা আমাকে আত্মীয়ের মত জড়িয়ে ধরেছে। এরা সবাই পূর্ব বাংলার লোক। এদের
অনেকেই ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় দেশছাড়া হয়েছে, অনেকে একাত্তরে, অনেকে আবার বর্তমান
বাংলাদেশে। নিউ জেনারেশনের মধ্যে আবেগ নেই, বরং আক্রোশ আছে, যেহেতু এত ত্যাগ তিতিক্ষার
বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে সেই দেশের বিভিন্ন সরকারের উপেক্ষা আর মৌন
সম্মতির মধ্য দিয়েই চলছে আজকের ইমিগ্রেশন। কিন্তু সাতচল্লিশ বা একাত্তরে মানুষ এর চেয়ে
ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশত্যাগ করলেও মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার প্রদীপ
তাদের হৃদয়ে এখনও জ্বলছে। তাই তারা যখন শুনে আমি বাংলাদেশ থেকে তারা জানতে চায় তাদের
হারানো দেশের কথা। শুধু তাই কেন, আমার দাদারা, যারা আমার জন্মের আগে বা ঐ সময়ে দেশ ছেড়ে
চলে এসেছে, দেখা হলে ওরাও ওদের বন্ধুদের কথা জানতে চায়, জানতে চায় সেই সময়ের রাস্তাঘাট
বাড়ি ঘরের কথা। একই ভাবে মস্কোর বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারা জানতে চায় মস্কোর রাস্তাঘাটের
কথা। তাই এই আবেগ যে একান্তই আমাদের সেটা বলা ঠিক হবে না। আমরা অন্যদের আবেগের কথা
জানি না। আমার বিশ্বাস অন্যান্য দেশে পড়াশুনা করেছে এমন লোকজন যখন একে অন্যের দেখা পায়,
তাদের মনও এভাবেই আবেগে ভরে ওঠে। এইতো আমরা পিপলি চলে এসেছি। চল নামা যাক।
পিপলি ছোট্ট এক শহর, শহর কী, গ্রামই বলা চলে। হস্ত শিল্পের জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে আপ্লিক
আর্টের জন্য। ১৯৯৭ সালেও এসেছিলাম। এখানে খুব সুন্দর সুন্দর ব্যাগ ও অন্যান্য স্যুভেনীর
পাওয়া যায়। বাড়ির জন্য আর কোলকাতায় আত্মীয় স্বজনদের জন্য দরকার ছিল, তাই রাত হওয়ার
পরেও এ পথে আসা। তাড়াতাড়ি কেনাকাটা সেরে রওনা হলাম ভুবনেশ্বরের পথে।
প্রতীক আমাকে অবাক করে দিয়ে জানতে চাইল
লেনিন সম্পর্কে আপনি আগে মনে হয় এরকম ক্রিটিক্যাল ছিলেন না। মনে হয় আশির দশকে আপনি
তাঁকে প্রায় দেবতার মত ভাবতেন। আপনি নিজেই বলেছেন অনেকবার দেশ থেকে আসা ডেলিগেটদের
নিয়ে লেনিনের দরগায় মানে মুসলিয়ামে গেছেন। গোর্কি লেনিনস্কি গেছেন। কিন্তু আজকে আপনার কথা
শুনে মনে হল সেসব দিন আর নেই।
তা ঠিক। তার পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে তুমি যেমনটা ভাবছ, তা নয়। অনেক কথা আছে এর
ভেতরে। রুশে একটা কথা আছে “বোকার শত্রু নেই।” যতদিন লেনিন সম্পর্কে জানতাম শুধু সোভিয়েত
কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশিত বই পত্রে থেকে, সে জানা ছিল এক রকম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে
অন্য অনেক সোর্চ থেকে জানার সুযোগ হয়েছে। জানার সাথে সাথে প্রশ্ন এসেছে। আসলে বলব, ঠিক
ক্রিটিক্যাল নয়, এটা অন্ধবিশ্বাস মুক্ত দৃষ্টি। শোন রাত অনেক, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। আরও
কয়েকদিন তো আছি, সময় সুযোগে নিশ্চ্যই বলব। এখন রাতের উড়িষ্যা দেখতে দেখতে যাই। এমন
তারাভরা রাত তো খুব একটা দেখি না।
রামানুজমের চেন্নাই
ভুবনেশ্বরে আমি আরও পাঁচ দিন ছিলাম। এ কটা দিন কেটেছে কাজের মধ্যে। একটা সেমিনার ছিল
আইওপি-তে, আরেকটি প্রতীকের উদ্যোগে এনআইএসএআর-এ পপুলার টক কসমোলজির উপরে।
প্রতীক নিজেও খুব ব্যস্ত ছিল। তবে এসব ব্যস্ততার মধ্যেও বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে। এক
সপ্তাহ ভুবনেশ্বরে কাটিয়ে শুক্রবার রওনা হলাম চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে। সেখানে ইনস্টিটিউট অফ
ম্যাথেমাটিক্যাল সাইন্স-এ থাকব এক সপ্তাহ। এর আয়োজন করেছেন ১৯৯৬ সালে ট্রিয়েস্টে পরিচিত
পুরুষোত্তমদা, প্রোফেসর পুরুষোত্তম রায়। এই এলাকায় আমার এটাই প্রথম আসা। পুরুষোত্তমদা
বলে দিয়েছিলেন এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি করে চলে আসতে। গেস্ট হাউজের ঠিকানা দেওয়া ছিল।
দক্ষিণ ভারতের প্রকৃতি অবলোকন করতে করতে চলে এলাম গেস্ট হাউজে। একেবারে ভিন্ন
ল্যান্ডশাফট, বেশ রুক্ষ বলে মনে হল। গেস্ট হাউজে এসেই পুরুষোত্তমদাকে ফোন করলাম। একটু
ফ্রেশ হওয়ার পরপরই উনি চল এলেন। আশেপাশের দোকানপাট দেখিয়ে দিলেন। বললেন, সোমবার
আমার সেমিনার। উনি আগামীকাল সকালে যাবেন গ্রামের বাড়ি, পণ্ডিচেরীর উপকণ্ঠে। আমাকে
আমন্ত্রণ জানালেন তাদের সঙ্গী হতে। আমার অন্য কোন কাজ ছিল না, তাছাড়া শনিবার, রবিবার সব
বন্ধ। অজানা অচেনা শহরে ও কীই বা করব! তাই রাজী হয়ে গেলাম। কথা হল আমাকে নিয়ে তাঁরা পাশের
জেলেদের গ্রাম, পণ্ডিচেরী ও ঋষি অরবিন্দের আশ্রম আউরোভিল যাবেন। পণ্ডিচেরীর ব্যাপারে
আমার বরাবরই আগ্রহ ছিল, ব্রিটিশ ভারতে এটা ছিল ফ্রান্সের কলোনি। পুরুষোত্তমদা চলে গেলেন,
কথা রইল, আগামীকাল মানে শনিবার ভোরে আসবেন আমাকে নিতে।
পণ্ডিচেরী – ফ্রান্স থেকে আউরোভিলা
পরের দিন সাত সকালে আমরা রওনা হলাম। পুরুষোত্তমদা, বউদি আর আমি। রাস্তায় এক ক্যাফেতে
ব্রেকফাস্ট করলাম আমরা। এর আগে অবশ্য এক জায়গায় নেমে পাখিদের ছবি তুলতে ভুলিনি। ওখানে
ছিল পেলিকান পাখী। ওদের দেখে মনে পড়ে গেল ভিলকোভার কথা। ইউক্রেন আর রোমানিয়ার বর্ডারে
যেখানে দানিউব নদ কৃষ্ণ সাগরে পড়ছে সেখানে আমরা গেছিলাম ২০১৩ সালে এই পাখীদের ছবি তুলতে।
যে রেস্তোরায় ব্রেকফাস্ট করলাম সেখানে ছিল ছোট্ট এক নদী। আমার তো পোয়াবারো। আরও কিছু
ছবি পাওয়া গেল। এক লোক গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিল আর এক মহিলা যাচ্ছিলেন এক পাল ছাগল নিয়ে
মেইন রোদ ধরে। যেতে যেতে এক জায়গায় দেখি এক লোক গরু দিয়ে হালচাষ করছে। আমার অনেক
দিনের ইচ্ছে এরকম একটা ছবি তোলা। ছোটবেলায় নিজেদের অনেক জমিজমা ছিল, ছিল গোয়াল ভরা
গরু, রাখাল চাকর দিয়ে বাড়ি ছিল লোকে লোকারণ্য। ধান পাট কি না হত আর ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ,
ধান ভানা, পাট আর পাটখড়ি শুকোনো এ সবই হত বাড়িতে। এসব ছিল আমার শৈশব আর কৈশোরের
সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। দেশে ফিরে আশেপাশের জমিতে কত বার গেছি এসবের ছবি তুলতে।
পারিনি। দেশে এখন আর এসব দেখা যায় না, আমাদের গ্রামে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হয়। পুরুষোত্তমদাকে
অনুরোধ করতেই গাড়ি থামালেন। বোনাস হিসেবে পেলাম তাল গাছ আর এক ঝাঁক বক। দেখতে দেখতে
ওরা চলে এলাম গ্রামের বাড়ি। গ্রামের বাড়ি বললে ভুল হবে, ওটা ছিল উচ্চ বিত্তের কোয়ার্টার, মূলত
আইএমএস এর বিজ্ঞানীদের উইকএণ্ড কাটানোর কলোনি। দুপুরে ওখানে খাওয়া দাওয়া করে রওনা
হলাম পণ্ডিচেরীর উদ্দেশ্যে। পথে একটা গ্রামে নেমে সী বীচে হাঁটাহাঁটি করলাম। দেখলাম কীভাবে
সূর্য সাগরের জলে লুটোপুটি খেতে খেতে এক সময় এক সময় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পণ্ডিচেরী
যখন পৌঁছুলাম রাত নেমে এসেছে শহরের উপর। আকাশের তারাগুলোকে ম্লান করে দিয়ে জ্বলে উঠেছে
বিজলী বাতি। পণ্ডিচেরী ছোট্ট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর। ভারতের অন্যান্য শহরের মত নয়।
লোকজন মূলত ট্যুরিস্ট। দুই একটা মন্দিরেও গেলাম, গনেশের মন্দির মনে হয় আর ঋষি অরবিন্দের
আশ্রম মত। মনে হল এটাই পণ্ডিচেরীর প্রাইম টাইম। আলো আঁধারের সাথে লুকোচুরি খেলেতে খেলতে
এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশ বিদেশের ট্যুরিস্টরা। আর চারিদিক থেকে তাদের ডাকছে অন্তহীন
স্যুভেনিরের দোকান। ওখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত। ঠিক হল পরের দিন সকালে যাব এক
জেলে পাড়ায়। সেখানে মাছের বাজার বসে। সেখান থেকে আউরোভিলে। দুপুরের পর রওনা হব চেন্নাইয়ের
পথে। আমাদের তাড়া নেই, তবে আমার যেহেতু সেমিনার, তাই রাত না করাই ভালো।
পরের দিন সকালে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আউরোভিলের পথে। রাস্তায় ছোট্ট একটা বিরতি। জেলেদের
গ্রাম। লোকজন কাজে ব্যস্ত, কেউ সাগরে যাচ্ছে মাছ ধরতে, কেউবা ফিরছে সেখান থেকে। এদিকে
কেউ কেউ জাল সেলাই করছে। আমার মনে পড়ল নিজের গ্রামের কথা। বাড়ির পাশেই জেলেপাড়া। সেখানে
সারা বছর ধরেই চলত জাল বোনা আর জাল সেলাইয়ের কাজ। কয়েকটি বাচ্চা ছেলে এসে আমাকে ঘিরে
ধরল। আমাকে অবাক করে ইংরেজিতে কথা বলল ওরা। পুরুষোত্তমদা বললেন, ওরা মিশনারি। ওদের
থেকে দূরে থাকাই ভালো। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম স্থানীয় বাজারে। মহিলারা বসে মাছ ভাগ বাটয়ারা করছে,
বিক্রিও করছে। অনেকটা তরার মাছের আড়তের মত। এরপর আবার পথে নামলাম আমরা। দেখতে
দেখতে পৌঁছে গেলাম আউরোভিলে। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন রামায়ণ বা মহাভারতে
বর্ণিত কোন তপোবন। এদিক সেদিক গরু ভেড়া ঘোরাফেরা করছে। পুরুষোত্তমদা সংক্ষেপে এ জায়গা
সম্পর্কে আমাকে জানালেন। ঋষি অরবিন্দ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি
ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রবক্তা। পরবর্তী জীবনে আধ্যাত্মিক গুরু। তিনি ছিলেন দার্শনিক, কবি,
জাতীয়তাবাদী নেতা, যোগী এবং গুরু। শেষ জীবন কাটে পণ্ডিচেরীতে। বিপ্লবী থেকে ঋষি – কী বৈপ্লবিক
পরিবর্তন এই এক জীবনেই! ওখানেই ব্রেকফাস্ট, তারপর ঘোরাফেরা। সময়াভাবে আশ্রমের ভেতরে
যাওয়া হয়নি, তবে ঐ রাজ্যটা দেখা হয়েছে ভালো ভাবেই। আশ্রম এলাকায় ঢোকার মুখে একজোড়া
স্যাণ্ডেলের অর্ডার দেই। ফেরার পথে ঠিক তৈরি হয়ে যায়। আশ্রম চলে কমিউন পদ্ধতিতে। যারা
থাকতে চান সবাই সব কাজ করেন। কোন শ্রেণী বিন্যাস নেই, বড়ছোট নেই। আর যার যা দরকার সেটা
আশ্রম থেকেই পান। তবে আশ্রমে যারা থাকেন তাদের চাহিদা কম, তাই কোন সমস্যা হয় না। এখানে
নিজস্ব নিয়ম, ভারত সরকারের নিয়ম বলতে গেলে সেখানে অচল, তাই বলে এটা ভারতের বাইরেও নয়।
যে কেউই এখানে থাকতে পারে (অবশ্যই টেস্টে টিকলে) আবার চলেও যেতে পারে স্বেচ্ছায়। যাকে বলে
পূর্ণ স্বাধীনতা। অন্তত আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়।
দুপুরে বাসায় লাঞ্চ করে ফিরলাম চেন্নাই। ফিরতে ফিরতে অবশ্য রাত। পরের দিন সেমিনার। ব্যস্ততা।
তার আগে আমাকে কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। দেওয়া হল বাকী সপ্তাহ কাটানোর জন্য
একটা অফিস। এরই মধ্যে ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিলাম আমরা, কথা হল কখন লাঞ্চ আর ডিনার
করব এসব। সেমিনার শেষে পুরুষোত্তমদা বললেন “আবার কবে আসবে কে জানে। চেন্নাই আর
আশেপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখে যাও। চেন্নাই আইআইটি পাশেই, সেখানে ঘুরতে যেতে পার একদিন,
আরেক দিন মহাবালীপুরম। তুমি ছবি তুলতে পছন্দ কর। এসব ছবি তোলার জন্য খুব ভালো জায়গা। তবে
আমি তো ব্যস্ত থাকব কাজে। তোমাকেই যেতে হবে। কোন অসুবিধা হলে ফোন করো, আমি গাইড করব।
আজ আজ বিকেলে যাব এখানকার সবচেয়ে বড় মন্দিরে। এরপর রামকৃষ্ণ মিশনে।”
বিকেলে আমরা গেলাম ম্যালাপুর নামে একটা জায়গায়। নামটা তামিল উচ্চারণে ময়লার মত শোনায় তাই
পুরুষোত্তমদা এভাবেই উচ্চারণ করলেন আর আমার কানে সেটাই গেঁথে রইল। ম্যালাপুর শিব মন্দির
চেন্নাইয়ের অন্যতম বৃহৎ মন্দিরের একটা। দক্ষিণ ভারতের মন্দির মানেই রাম আর হনূমানের
ছড়াছড়ি। মন্দিরের বাইরের দিকটা বিভিন্ন রকম কারুকার্যে ভরা। কত রকম যে মূর্তি সেখানে! আর
ভেতরটা? এই প্রথম কোন মন্দিরের ভেতরে খালি পায়ে ঢুকতে আমার এতটুকু দ্বিধা হল না। এমন
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মন্দির তো নয় যেন মিউজিয়াম। প্রবেশ পথে জুতা রাখার জায়গা, মস্কোয়
থিয়েটারে যেমন ওভার কোট রাখার ব্যবস্থা অনেকটা তেমন। এই সন্ধ্যায় অনেক লোকের সমারোহ,
কিন্তু উত্তর ভারত বা বাংলার মন্দিরের মত ঠ্যালা ধাক্কা নেই। মন্দিরের সামনে নেই ভিখারির ভিড়।
উল্টো, অনেক দোকানপাট, মেলা মেলা ভাব। ওখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশনে।
বিশাল আশ্রম। ঝকঝক তকতক করছে চারিদিক। ভক্তরা বসে আছে। কেউ কিছু পড়ছে, কেউবা
ধ্যানমগ্ন।
প্রাচীন শহর মহাবালীপুরমের পথে
পরদিন ভোরে আমি চলে গেলাম একটা মন্দিরের কাছে। ওখান থেকেই একটা বাসে যাব মহাবালীপুরম।
পথে নামলাম ক্রকোডাইল পার্কে। এটাও পুরুষোত্তম দা বলে দিয়েছিলেন। আসলে ট্রিপের পুরো ছকটা
পুরুষোত্তমদা করে দিয়েছিলেন, তাই আমি সেভাবেই গেছি। বাসের নম্বর জানা ছিল। ভাষা গত কারণে
কোন রকম দুর্ঘটনা এড়াতে বাসে যাওয়াই ঠিক করলাম, অন্তত গন্তব্যের ব্যাপারে কোন দুশ্চিন্তায়
পড়তে হবে না। বাসে তেমন লোকজন নেই, প্রায় আমার বয়সী একজন লোক এসে আলাপ শুরু করলেন।
যেহেতু একি বাসে যাচ্ছি তাই আমিও আগ্রহ নিয়ে গল্প করলাম। যখন জানলেন আমি তিরিশ বছরের
বেশি মস্কো আছি, রুশ দেশ, লেনিন – এদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কখনও জানালা দিয়ে তাকিয়ে
প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে, কখনও বা গল্প করে আমরা এগিয়ে চললাম।
এখন তো লেনিন আর আগের অবস্থায় নেই। শুনেছি তার সম্পর্কে অনেক অজানা ও অপ্রিয় তথ্য
প্রকাশিত হয়েছে। কি বলেন আপনি এ ব্যাপারে?
ও হ্যাঁ। বর্তমানে সেই সময়ের অনেক দলিলপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। সব দলিলই এক সময়ে প্রকাশ
করা হয়, তাই সেখান থেকে অনেক তথ্য জানা যায়। কিছু দলিল থেকে দেখা যায় লেনিন ছিলেন
জার্মানির চর। আসলে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল পুরাদমে। রাশিয়া ছিল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড,
অ্যামেরিকার সাথে। জার্মানি চাইছিল এই জোট ভাঙতে। লেনিন তখন ইউরোপে পলাতক। জার্মানি তাঁকে
রাশিয়ায় ক্ষমতা দখলে সাহায্যের প্রস্তাব দেয় পরিকল্পনা সফল হলে রাশিয়া জোট থেকে বেরিয়ে
যাবে এই শর্তে। লেনিন সেটা গ্রহণ করেন। লেনিনের দিক থেকে সেটা ছিল রুশ বিপ্লব সম্পন্ন করার
অনুকূলে সাহায্য, জার্মানির জন্য উল্টোটা। উদ্দেশ্য যাই থাকুক, এটাই ফ্যাক্ট। এ নিয়ে সমাজে
এখন নানা প্রশ্ন আছে। অনেকেই অপেক্ষা করছে এ সংক্রান্ত জার্মান ও ব্রিটিশ দলিল প্রকাশের।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে এটা নিয়ে তেমন চিন্তিত নই। আমার স্কুল শুরু হয় বলতে গেলে মুর্শিদাবাদের
বহরমপুরে। মাসির বাড়ির সাথেই স্কুল। তাই ১৯৬৯ স্কুলে হাতেখড়ি এই স্কুলেই। ১৯৭২ সালে বেড়াতে
এসেও কয়েক মাস সেই স্কুলে গেছি। শিশুদের বইয়ে তখন অতি সংক্ষেপে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু
আর দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাস সম্পর্কে লেখা ছিল। মা ছিলেন নেতাজির ভক্ত। তাই তার সম্পর্কে
অনেক শুনেছি, তাঁকে আদর্শ মেনেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার পর জার্মানির অত্যাচার আর
ধ্বংসলীলার কথা যখন পড়লাম, নেতাজি সম্পর্কে এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছিল।
তবে পরে বুঝলাম, উনি ইংরেজদের বদলে জার্মানির কলোনি হতে চাননি, শুধু জার্মানির সাহায্যে
ইংরেজ হটাতে চেয়েছেন। উনি ইংরেজ বিরোধী ছিলেন কিন্তু ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন না। একই
ভাবে দেখব আমাদের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরু ইংরেজদের হাত ধরে। তখন গতিপ্রাপ্ত
সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দমাতে ইংরেজ শাসকেরা বন্দীদের মধ্যে মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিতরণ করত।
আমরা তো কখনও উপমহাদেশের কমিউনিস্টদের ইংরেজের দালাল বলি না। আসল কথা হল দু’পক্ষ
যখন কোন চুক্তি করে সবাই নিজ নিজ স্বার্থ থেকেই সেটা করে, অনেক সময় দু দলের লক্ষ্য
একেবারে ভিন্ন হতে পারে, তবে সেই সময়ের জন্য সেটা উভয়ের জন্যই লাভজনক। দিনের শেষে
রাজনীতি, এটা লাভ ক্ষতির খেলা, কোথাও ছাড় দেওয়া, কোথাও দর কষাকষি করা, এসবই রাজনীতি
আর কূটনীতির অংশ। এটা খেলার অঘোষিত নিয়ম। ইতিহাসে এসব খুঁটিনাটি বিষয় স্থান পায় না, স্থান
পায় শেষ ফলাফল। তারপর একটু বড় আঙ্গিকে দেখলে এই সব ইজমই তো এক একটা আইডিয়া বই তো
কিছু নয়। মানে এগুলো যাকে বলে প্রাকৃতিক নয়, মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত। তবে এসবই আবার
মানুষের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই রচিত। আদিম সমাজে কমিউন ব্যবস্থা ছিল, কারণ ব্যক্তিগত
সম্পদ বলতে কিছু ছিল না। ছিল প্রতিকূল প্রকৃতি আর তার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য
যৌথ সংগ্রামের অপরিহার্যতা। এখনও দেখবেন যেকোনো গণ আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর
মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে সকলের বৃহত্তর স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ইনস্টিঙ্কট মনে হয় সেই আদিম
যুগ থেকে উত্তারাধিকার সুত্রে পাওয়া। ভালো মন্দ সবই তো আপেক্ষিক। কোন বিশেষ সমাজে বিশেষ
অবস্থায় আজ যেটা ভালো, কালও যে সেটা ভালো থাকবে তার কি কোন কথা আছে? একটা পুরনো
ধর্মকে সরিয়ে নতুন ধর্ম যখন এসেছে, সেটা কিন্তু সমাজের চাহিদা থেকেই এসেছে। একটা রাজনৈতিক
দলকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেকটা দল যখন ক্ষমতা দখল করে সেটাও কিন্তু সমাজের চাহিদা থেকেই
করে। বলতে পারেন সামরিক অভ্যুত্থানের কথা। কিন্তু এভাবে ক্ষমতা বদল তো চিরস্থায়ী নয়।
আসলে এক অর্থে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিজম – এসবও ধর্ম। ধর্মের মধ্যেও কী আমরা
ফ্যাসিস্ট উপাদান দেখতে পাই না? মৌলবাদীদের দিকে তাকালে দেখব ওদের মধ্যেও ফ্যাসিস্ট
চিন্তাভাবনা, ফ্যাসিস্ট আদর্শ বিদ্যমান। আবার ধর্মের মতই এইসব ইজমও মানুষকে স্বপ্ন দেখায়,
আশ্বাস দেয়। ধর্ম তার অনুসারীদের পুরস্কৃত করে পরলোকে, এরা ইহলোকে। ধর্মে পুরস্কৃত করে
অদৃশ্য ঈশ্বর, এসব ব্যবস্থায় দৃশ্যমান মানুষ। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিজম – এসব ঈশ্বরকে
নয় মানুষকেই নিজের ভাগ্য বিধাতা ভাবতে শেখায়। তবে আজকাল এইসব তন্ত্রও ধর্মের উপাদান
ব্যবহার করে। তাই আম জনতা নয় নেতারূপী মানুষ তার ভাগ্য বিধাতা। আর এই নেতারা অনেকটা
স্বর্গবাসী, সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু অন্যদের সাথে সমাজতন্ত্রের পার্থক্য হল
অন্যেরা ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করার স্বপ্ন দেখায়, সমাজতন্ত্র পুরস্কৃত করতে চায় সমষ্টিকে। সেই
সোভিয়েত আমলেও আমার প্রায়ই এমনটা মনে হত যে ধর্মের বিপক্ষে বললেও, ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র
নয়, সামাজিক জীবন থেকে বের করে দিলেও সোভিয়েত ব্যবস্থা মূলত ধর্মীয় পথেই গড়ে উঠেছে।
ধর্মীয় ইতিহাস ঘাটলে আমরা কি দেখব, ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। এক ধর্মের আবির্ভাব
ঘটেছে কিন্তু অন্য ধর্ম মধ্য থেকে, প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসে কিছু পরিবর্তন এনে, কিছু সংশোধন,
কিছু সংযোজন, কিছু বর্জন করে। কিন্তু সব কিছুর মূলেই আছে এক অলৌকিক শক্তির প্রতি ভয় আর
ভক্তি, আছে নির্মম শাস্তি আর অভূতপূর্ব পুরস্কারের লোভ। আসলে মানুষের স্বভাবগত চরিত্রের
সাথে মিল রেখেই তৈরি হয়েছে নরক আর স্বর্গের অবকাঠামো। এই যে আমরা পড়াশুনা করি, সেটাও
তো এই একই ছকে ফেলে করি। কয় জন মানুষ জ্ঞান অর্জন করার জন্য পড়াশুনা করে? ধর্মের মূল
কথাও তো ঈশ্বরকে জানা। ঈশ্বর কে? যিনি সৃষ্টিকর্তা। তাঁকে জানা মানে সৃষ্টির রহস্য জানা। কিন্তু
মানুষ কি তাঁকে জানার চেষ্টা করে? করে না। মানুষ তাঁর পূজা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য। তাঁকে
জেনে নয়, তাঁকে তুষ্ট করে মানুষ চায় তাঁর করুণা, মানুষ ইহলোকে চায় ধনদৌলত আর পরলোকে চায়
স্বর্গের টিকেট। স্বর্গ কী? অগণিত অপ্সরা আর অফুরান খাদ্য। আশ্চর্য কি জানেন? কেউ যদি
ইহলোকে ব্যভিচার করে পরলোকে পায় নরক যন্ত্রণা, তবে ইহলোকে সংযম পরলোকে তাকে দেয়
ব্যভিচারের টিকেট। এখানেও যেন সুখ আর দুঃখের নিত্যতার সূত্র কাজ করে। ও হ্যাঁ, জ্ঞানার্জনের
কথা বলছিলাম। বলতে পারেন কয়জন মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়াশুনা করে? অধিকাংশ করে ভয়
থেকে যাতে শিক্ষক বা অভিভাবক বকাঝকা না করেন। আর যারা নিজেদের থেকেই পড়াশুনা করে,
তাদের বেশির ভাগ সেটা করে ভাল মার্কস পাওয়ার জন্য। পার্থক্য হল মার্কস আমরা চোখে দেখি,
স্বর্গ – সেটা দেখি না, শুধুই আশা করি। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ – এরা কাজ
করে কুইক ডেলিভারি সিস্টেমে, অন্তত করতে চায়। এরা শেষ বিচারের জন্য বসে না থেকে এখানেই
নিজেদের আইন আদালত তৈরি করে, ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেয়, যারা সহমত তাদের
পুরস্কৃত করে। সত্যি বলতে কি, সেই সোভিয়েত আমলেই যখন দেখতাম একদল লোক বিভিন্ন
প্রশংসাপত্র পাওয়ার জন্য বাড়তি কাজ করছে বা এক বছরের প্ল্যান ছয় বা নয় মাসে পূর্ণ করছে,
আমার কেন যেন সে কথাই মনে হত। কেন, সেটা বলতে পারব না, তবে কি রকম একটা মিল খুঁজে
পেতাম। আমার নাস্তিক রুশ রুমমেট বলত যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করত তবে তার ঈশ্বর হত লেনিন।
অনেককেই দেখতাম পার্টিকে মনে করত ইন্দ্রের সভা। ভালো কাজ করলে কমসোমল বা পার্টির
প্রশংসা জুটত, খারাপ কাজ করলে তিরস্কার। অধিকাংশ সোভিয়েত ছাত্রদের দেখতাম কমসোমলের
প্রশংসাপত্র স্বর্গের ভিসা বলে মনে করত। আসলেও তাই, এটা ছিল পরবর্তী জীবনে উন্নতির
ছাড়পত্র। যাহোক, লেনিন চেয়েছিলেন শ্রেণীহীন সমাজ গড়তে, কিন্তু মানুষ নিজের চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্যের কারণে সেটাকে অন্যভাবে সাজিয়ে নতুন শ্রেণীর বা বিভাজনের জন্ম দিয়েছে। তাই আমরা
যেভাবেই দেখি না কেন লেনিন, সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত ব্যবস্থা এসব নিয়ে প্রশ্ন আছে, থাকবে।
থাকাটাই ভালো। নইলে আবার নতুন ডগমা জন্ম নেবে। আসলে সব ব্যবস্থাই মানুষের নামে, মানুষের
স্বার্থে হলেও শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তার সুফল ভোগ করে। তাই মনে হয় সমস্যা যত না তত্ত্বে,
তার চেয়ে বেশি প্রয়োগে। প্রয়োগের মধ্যেই এমন কিছু থাকে যাকে ব্যবহার করে একদল মানুষ আরেক
দলকে ঠকায়, ঠকাতে পারে আর সেটা হয় নিয়মের মধ্যে থেকেই। তাই প্রশ্ন তুলতে হবে প্রয়োগের
ফাঁকফোকর নিয়ে। মানে কীভাবে এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা যায়, যাতে সুযোগ সন্ধানীরা কোন
ভালো আইডিয়াকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।
কথা বলতে বলতে এক সময় আমরা চলে এলাম ক্রকোডাইল পার্কে। কুমির আর বিভিন্ন রকম সাপে
ভরা এই পার্ক। কুমিরগুলো যেন পশ্চিমের কোন সী বীচে শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কেউ হাই তুলছে,
কেউ বা দাঁত কিলিয়ে হাসছে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে চললাম মহাবালীপুরম। মহাবালীপুরম
মামাল্লাপুরাম নামেও খ্যাত। এখানকার মূল আকর্ষণ সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু মন্দির।
সপ্তম শতকে এটা ছিল পল্লভ রাজ্যের অন্যতম প্রধান বানিজ্য বন্দর। পল্লভ রাজ নরসিংহবর্মণ
বা মহাবলীর নামানুসারে এই বন্দরের নামকরণ করা হয়। এ শহরের প্রায় সব মন্দিরই পাথরের তৈরি।
আসলে উড়িষ্যা থেকেই শুরু হয় পাথরের রাজত্ব। কী মন্দির, কী স্যুভেনির – প্রায় সবই পাথরের।
রাস্তার দু পাশে দোকান পাট পাথরের জিনিসপত্রে বোঝাই। কোথাও কারিগররা বসে পাথর খোদাই
করছে। বঙ্গোপসাগরের তীরে ছোট্ট সুন্দর এ শহর সত্যিই মন ভোলানো। একটা জায়গায় বিশাল এক
পাথর – পাশে লেখা কৃষ্ণের ননী। পাশেপাশে বসেই লোকজন দুপুরের খাবার খাচ্ছে। এক ভদ্রলোক
সবেমাত্র খাবার বের করেছে, কোত্থেকে যেন এক বানর এসে ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে গেল। সেখানেই
দেখলাম কালো পোশাক পরিহিত এক গ্রুপ। কথা বলে জানলাম ওরা কেরালা থেকে। এক মাসের এক
ধর্মীয় ট্যুরে বেরিয়েছে।
প্রথম দিন চেন্নাই নেমে মনে হয়েছিল রাজ্যটা কেমন রুক্ষ, এখন মনে হল বাংলার মত সবুজ না হলেও
এর এক অন্য রকম সৌন্দর্য আছে। কী গ্রাম, কী শহর সবই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা মুগ্ধ
হয়ে ঘুরে বেড়ালাম এই ছোট্ট সুন্দর ঐতিহাসিক শহরে। সেখানে এক কাণ্ড ঘটে গেল। আমাদের
সামনেই একদল বিদেশী যাচ্ছিল, মানে ইউরোপিয়ান। মনে হয় কলেজে পড়ুয়া। ওদের সাথে এক মেয়ে ছিল
যাকে দেখতে স্থানীয় মনে হলেও বোঝা যাচ্ছিল যে ও বাইরের। ওকে এক লোক বিরক্ত করছিল কিছু
পাথরের জিনিস কেনার জন্য। কে জানে, ঐ মেয়েটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ঐ লোক ঠিক দাম
চাইছে কি না। আমি বললাম শহরের দোকানে আরও কম দামে পাওয়া যাবে। তবে যেহেতু ঐ লোক পিছু
ছাড়ছিল না, তাই বললাম আমাদের স্থানীয় রুপি নেই। ও নাছোড়বান্দা। “আপনারা নিয়ে যান, ফেরার
পথে টাকা দেবেন”। যাহোক আমার কারণেই ও সেটা গছিয়ে দিতে পারল না। জানলাম ঐ মেয়েটা স্থানীয়।
তবে ছোটবেলায় ফ্রান্সের এক যুগল ওকে দত্তক নেয়। সেই থেকে ও সেখানে থাকে। বন্ধুদের সাথে
এসেছে ইন্ডিয়া বেড়াতে। তারপর এক সময় আমি ঐ দলটাকে হারিয়ে ফেললাম। যখন মহাবালীপুরমের
মূল মন্দির দেখে ফিরছি, দেখি সেই লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে কি সব বলল। সেটা যে
গালিগালাজ – বুঝতে অসুবিধা হল না। পরে বাসে বসে কষ্ট লেগেছে, কারণ আমার কারণে একটা মেয়ে
হয়তো ঠকার হাত থেকে বেঁচে গেল, কিন্তু হতে পারে এ জন্যে একটা পরিবার কিছুটা হলেও খাবার
বঞ্চিত হল।
সারাদিন ঘোরাফেরা করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। পথের সেই সাথীও একই বাসে। অনেক কথাই
আমাদের বলার ছিল, তবে রাজনীতি বা অন্য কোন ব্যাপারে কথা বলে মহাবালীপুরমের ইম্প্রেশন
আমরা নষ্ট করতে চাইছিলাম না। বাস চলছিল দ্রুত বেগে, একের পর এক গাছপালা, গ্রামগঞ্জ ছুটে
যাচ্ছিল পেছনের দিকে। আমার মনে পড়ছিল ছোটবেলার কথা। মায়ের সাথে বাসে করে যখন কোন মেলায়
যেতাম, আমি বাসের গেটে দাঁড়িয়ে দেখতাম কিভাবে দূর্বা ঘাস দ্রুত ছুটে যাচ্ছে পেছনের দিকে। তখনও
আমি জানতাম না যে সব গতিই আপেক্ষিক, জানতাম না বাস যে গতিতে গাছপালা থেকে এগিয়ে যায়,
গাছপালাও ঠিক একই গতিতে বাস থেকে পিছিয়ে যায়। আর জীবনে যারা সামনে না গিয়ে এক জায়গায়
দাঁড়িয়ে থাকে তারাও আসলে জীবন থেকে অনবরত পিছিয়ে পড়ে। অন্ধকারে জনবিহীন রাস্তায় পথ
খুঁজতে খুঁজে বাস এক সময় আলোর সন্ধান পায়, দূরে দেখা দেয় চেন্নাইয়ের আলো। আমি বাইরেই
রাতের খাবার সেরে নিজের গেস্ট হাউজে চলে আসি। এসেই পুরুষোত্তম ডাকে ফোন করি। উনিই বলেন
পরের দিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে মাদ্রাজ আইআইটি ক্যাম্পাস ঘুরে আসতে। আমার সাথে যোগ দেবে
জাপানের সোনাদা যাকে আমরা আদর করে ডাকতাম সোনা দা বলে। ও রাস্তা চেনে, মাকে রাস্তা দেখিয়ে
নিয়ে যাবে।
আই আই টি চেন্নাই
পরদিন সকালে ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিনে ব্রেকফাস্ট করে সোনাদা আর আমি হাঁটতে শুরু করলাম
আইআইটির উদ্দেশ্যে। হাঁটছি তো হাঁটছিই, পথ আর ফুরায় না। আমার মনে পড়ল ১৯৬৯ সালের কথা।
কিছুদিনের জন্য আমরা গিয়েছিলাম সুবোধদার ওখানে। তিনি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বোকারো
স্টিল সিটিতে চাকরি করেন। ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে অশোক মামার বাসা। দাদা বিবাহিত, ওদের
বাচ্চা হবে। আমিই তখন বউদিকে সাধ খাইয়েছিল আর ওদের ছেলে বাপি ছিল বংশের বড় সন্তান।
অনেক বছর পরে ২০১১ সালে আমি আবার সাধ খাওয়াই রতনের বউকে, ঋতম হবে ওদের জেনারেশনের
সর্বকনিষ্ঠ। যাহোক, আমরা প্রায় বিকেলেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম মামার বাড়ি। রাস্তায় দেখতাম
এক পাহাড়। একদিন পথে আমার ইচ্ছে হল সেই পাহাড়ে যাব। আমি ছিলাম মায়ের সাথে একা। আর যায়
কোথায়? হাঁটতে শুরু করলাম আমি, পেছনে মা। কিন্তু যতই আমরা এগোই পাহাড় ততই দূরে চলে যায়।
এক সময় যখন শক্তি শেষ, মা অনেক বুঝিয়ে আমাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। আজও সবাই বলছিল, এই তো,
আর কয়েক মিনিটের রাস্তা, কিন্তু রাস্তা যেন শেষ হচ্ছিল না। অচেনা, অজানা জায়গায় সে এক
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে আমরা এক সময় এসে পৌছুলাম আইআইটির গেটে।
কোন ঝামেলা ছাড়াই ঢুকে পড়লাম ক্যাম্পাসে। বিশাল ক্যাম্পাস, বিভিন্ন গাছগাছালি দিয়ে ভরা। দুবনায়
আমাদের ইনস্টিটিউটেও অনেক গাছ, বার্চ, পাইন, ফার ইত্যাদি গাছ, তবে সেটা দেখতে পার্ক বা
বনের মত। আমার সেটাকে কখনও জঙ্গল বলে মনে হয় না। কিন্তু এখানে? এ যে গহন অরণ্য? আমার
বরাবরই পছন্দ গাছের ছবি তোলা, কিন্তু এই প্রথম একটু ইতস্তত করলাম। কে জানে সাপ-টাপ কিছু
আছে কি না!
দেখুন দেখুন, হরিণ!
চিৎকার করে উঠলো সোনাদা। হ্যাঁ, কতগুলো হরিণ শাবক এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে আমি
দুবনার ক্যাম্পাসে কাঠবিড়ালি বা কালেভদ্রে সজারু বা পেঁচা দেখলে সব ভুলে দাঁড়িয়ে থাকি, হরিণ দেখে
আমাকে আর পায় কে। এদিক থেকে ছবি নেই তো ওদিক থেকে। ওদিকে বিশাল বিশাল বটগাছে বানরেরা
ঝুলে বিভিন্নভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হয়তো আমারা যেদিক দিয়ে হাঁটছিলাম সেটা মেইন
রাস্তা নয়। লোকজন ছিলই না বলতে গেলে। এক সময় সামনে পড়ল এক সাইনবোর্ড। সেটা দেখে ওরা
গেলাম পুকুরের ধারে। শত হলেও শীত কাল, জল নেই বললেই চলে। অনেক হাঁটাহাঁটির পর একটা
ক্যাফের দেখা মিলল। সেখানে গেলাম আইসক্রিম আর চা বা কফি খেতে। সোনাদা আগেই বলল
আমি তোমাকে খাওয়াবো।
আসলে বিভিন্ন ভিজিট বা কনফারেন্সে গিয়ে আমার একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটা কী দেশে কী
মস্কোর বাঙ্গালী, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের মধ্যে দেখা যায় না। কনফারেন্সে আমরা প্রায়ই দল
বেঁধে ডিনার করতে যাই কোন রেস্টুরেন্টে। কখনও যার যারটা সেই পে করে, আবার কখনও যে যাই
অর্ডার দিক না কেন, টোটাল বিলটা সবাই সমান ভাবে ভাগাভাগি করে দেয়। ওখানে খাওয়া নয়,
কোম্পানি দেওয়া বা এক সাথে সবাই মিলে খাওয়াটাই আসল কথা। খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা হাঁটতে
হাঁটতে চলে এলাম মেইন গেটে। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে এক দিনে, আর নয়। বাসে করে শহর দেখতে
দেখতে ঘরে ফিরলাম আমরা। আমি চাইছিলাম ট্যাক্সি ডাকতে, তবে সোনাদা রাজী হল না। অগত্যা
বাসে। শুনেছি দেশ থেকে প্রচুর লোক এখানে আসে মেডিক্যাল চেক-আপ করাতে। তবে কোথাও কোন
বাংলাদেশি দেখলাম না। হয়তো ছিল, আমি স্থানীয়দের থেকে ওদের আলাদা করতে পারিনি। এটা তো
আর রাশিয়া নয় যে গায়ের রঙ দেখেই বুঝব!
পুনায় দশদিন
চেন্নাই থেকে আমি গেলাম পুনায়। এটা পুনায় আমার দ্বিতীয় সফর। এর আগে এসেছিলাম ১৯৯৭ সালে
জিআর ১৫ এ যোগ দিতে। সেবার এসেছিলাম ভুবনেশ্বর থেকে ট্রেনে। সেটাই ছিল আমার কোন বড়
কনফারেন্সে যোগ দেওয়া। অনেকের সাথে আগে পরিচয় ছিল তাদের পেপারের মাধ্যমে, সেবার পরিচয়
হল মুখোমুখি। মনে পড়ে ট্রেন এসেছিল বিশখাপত্তম হয়ে। নামটা পরিচিত। আমার বড়দা ওখানে ছিলেন
অনেকদিন চাকরি সুত্রে। খুব ভোরে ট্রেন এসে পৌছুলো বিশখাপত্তমে আর বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর
যখন চলতে শুরু করল, ঝাকুনি খেয়ে টের পেলাম আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি। এক ধরণের আশংকা মনে
জাগলেও উপায় ছিল না। চুপচাপ বসে রইলাম। পথে পড়ল বিজয়নগর, হায়দরবাদ, সিকান্দ্রাবাদসহ
বিভিন্ন ঐতিহাসিক শহর। ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়। সময় পেলেই ইতিহাসের উপর বিভিন্ন বই পড়ি।
ভারতের শহরগুলো তো প্রায় সবই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তাই যখন কোন বড় শহর পার
হয়ে যাই, আমি যেন হারানো দিনের ইতিহাস ছুঁয়ে ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াই। রাশিয়ায় ট্রেন জার্নি
মানেই অনেক ঘণ্টা বা অনেক দিনের ব্যাপার। ভারতে ট্রেন জার্নি করলে দেশটির ব্যাপকতা বোঝা
যায়। উপমহাদেশ তো এমনি এমনি ছিল না, আয়তনে প্রায় ইউরোপের সমান (সোভিয়েত ইউনিয়ন বাদে)।
ওই ট্রেনেই অন্য এক কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছিল আইওপির এক ছেলে। ট্রেন এসে পুনা পৌঁছুলে ও এসে
রেলওয়ে স্টেশন থেকে আমাকে নিয়ে গেল ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড
অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বা আইউকায়। সেখানেই হবে কনফারেন্স। দুবনা থেকে আরও কয়েকজন অংশ
গ্রহণ করেছিল সেই কনফারেন্সে। পরিচয় হল ভারতের অনেক সিনিয়র ও জুনিয়র কলিগদের সাথে।
সেবার মহাত্মা গান্ধীর বাসভবন সহ আরও কিছু কিছু এলাকা আমার দেখা হয়েছিল। একদিন
গিয়েছিলাম সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভাইপোর সাথে দেখা করতে। ও দুদিন আগে কোলকাতায়
চলে গেছে। তাই আর এখনও পর্যন্ত দেখা হয়নি ওর সাথে। তবে অনেক বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের
সাথে দেখা হয়েছিল। সেবার আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল পুনা ইউনিভার্সিটি আর আইউকা যে বিশাল
চত্বরে অবস্থিত তার বাইরে, ঠিক গেটের সাথে লাগানো কোন এক ইনস্টিটিউটের গেস্ট হাউজে।
প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে যেতাম কনফারেন্স হলে। পার্কের ভেতর দিয়ে যেতে মন্দ লাগত না। এবার অবশ্য
আমার থাকার ব্যবস্থা আইউকার গেস্ট হাউজে যার নাম আকাশগঙ্গা। আইউকার সব কিছুর নামই
অবশ্য হয় আকাশের বাসিন্দাদের নামে, নয়তো পৃথিবীর যে সব বাসিন্দারা আকাশের বাসিন্দাদের নিয়ে
গবেষণা করেছেন তাদের নামে। ১৯৯৭ সালে যখন এসেছিলাম, বন্ধু অঞ্জন বলছিল, গেস্ট হাউজের যে
রুমে ও থাকে সেখানে নাকি সাপ ঢুকেছিল। তাই একটু টেনশনে ছিলাম, তবে সব দেখে বুঝলাম, এত
ঘাবড়ানোর কিছু নেই। গত ১৭ বছরে সাপের সাথে একটা অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে নিশ্চয়ই।
একটু ফ্রেশ হয়েই চলে গেলাম আইউকা চত্বরে যেখানে ছোট্ট এক মাঠে আর্যভট্ট, গ্যালিলিও,
নিউটন আর আইনস্টাইন গভীর আলচনায় মগ্ন। পাশেই ক্যান্টিন। সেখানে বেশ কিছু ছেলেমেয়ের সাথে
আলাপ হল, ওরা পশ্চিমবঙ্গের, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে থিসিসের কাজ করতে। ওদের গুরু
সুবিনয়দা আমার পূর্ব পরিচিত। ফলে ক্যাম্পাসে সময় ভালই কাটবে বলে অনুমান করলাম। ভারতে
প্রতিটি বিজ্ঞান কেন্দ্রেই প্রচুর বাঙ্গালী। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, বাঙ্গালীরা মূলত ফিজিক্স
পড়ে আর তামিলরা গণিত। কে জানে বাংলার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ
সাহা আর তামিলনাড়ুর শ্রীনিবাস রামানুজন এর নেপথ্যে কলকাঠি ঘুরাচ্ছেন কি না? আগে বিভিন্ন
জায়গায় গেলে আমি প্রথমেই যে কাজটা করতাম, সেটা হল স্থনীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে কি কি সুযোগ
সুবিধা আছে তার খোঁজ নেওয়া। এখন প্রয়োজনীয় প্রায় সবই অনলাইনে পাওয়া যায়, ফলে লাইব্রেরি
ওয়ার্কের সেই তাগিদটা নেই, বিশেষ করে আমি যখন সবই ঘরে শুয়ে বসে করতেই ভালবাসি। বাসায়
একা থাকার ফলে কোন সমস্যা হয় না। দুবনায় আমি অফিসে যাই মূলত কলিগদের সাথে কোন ব্যাপারে
আলোচনা করতে আর যেসব জার্নাল বাসা থেকে ফ্রি পাওয়া যায় না সেগুলো ডাউনলোড করতে। তারপর
গেলাম ক্যান্টিনের ব্যবস্থা দেখতে। ইন্ডিয়ার প্রায় সব জায়গায়ই ভেজ আর নন-ভেজের ব্যবস্থা
আছে। আমার বাবা আর জ্যাঠাও ছিলেন নিরামিষাশী মানে ভেজ। আলাদা আলাদা পাত্রে সেসব রান্না
হত আর আলাদা আলাদা আলমারিতে সেসব থাকত। সে সময় বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না, তাহলে হয়তো দুটো
আলাদা ফ্রিজ রাখতে হত। রান্না ঘরে মাংসের প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সেটা হত বাইরে, সাধারণত
কাছারি ঘরে। তাই ভেজ নন-ভেজের কনসেপ্ট আমার অপরিচিত ছিল না। ভুবনেশ্বরে আইওপিতে আগে
থেকে বলে রাখলেই হয়। চেন্নাইয়ে আইএমএসে সে ঝামেলা ছিল না, ইউরোপের মত সবই ছিল, যার যেটা
দরকার নিয়ে নিত। উত্তর ভারতে ভেজ যেমন পপুলার, দক্ষিণ ভারতে তেমনি নন-ভেজ। অন্তত আমার
তাই মনে হয়েছে। কিন্তু আইউকায় ব্যবস্থা একেবারেই ভিন্ন রকম। সপ্তাহে দুদিন নন-ভেজ আইটেম
থাকে আর পাঁচ দিন শুধুই ভেজ। তাও আবার আগে থেকে অর্ডার দিতে হয় মাংসের জন্য। আমার ধারণা
ছিল এতে অসুবিধা হবে না। মাত্র তো দশ দিনের মামলা। তাছাড়া ও নিজে রেগুলার সব্জি খাই, পছন্দ
করি। কিন্তু প্রথম দিনেই বুঝলাম খাবার ঠিক তেমন নয় যা খেয়ে আমি অভ্যস্ত। মাংস না হলে
বিপত্তি। তবে সমস্যা মনে হয় মাংসে নয়, চাইলেই পাব না সেই অপশনের অভাবই ছিল স্নায়বিক চাপের
জন্য যথেষ্ট। চাইলেই অবশ্য ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতে পারতাম, তবে সে এক বিরাট
হ্যাঙ্গামা। তবে একদিন আগে থেকে মাংস অর্ডার দিয়েও পাওয়া গেল না। বলল আমি একা মাংস বুকিং
দিয়েছি, তাই ওরা একজনের জন্য রান্না করেনি। এই প্রথম বুঝলাম আমি মাংসের উপর কতটা
নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে এই ঝামেলা এড়াতে আমি নতুন পরিচিত যাদবপুরের ছাত্রদের বললাম মাংস
বুকিং করতে। সেসব আমি নিজেই নেব, একাই খাব। ক্যান্টিনে খোঁজ খবর নিয়ে হাঁটতে গেলাম সামনের
রাস্তা দিয়ে। এখানে মোটর বাইক দুবনায় সাইকেলের মত, মানে প্রচুর লোকজন মোটর বাইকে
যাতায়াত করছে, বিশেষ করে ক্যাম্পাস এলাকায়। ছেলেমেয়ে সবাই, তবে রাশিয়ায় বাইকাররা যেমন সু-
৫৭ ফাইটারের মত গর্জন করে চারিদিকের মানুষজনকে জানান দিয়ে হারলি-ডেভিডসন নিয়ে সাঁ সাঁ করে
চলে যায়, এখানে তেমন নয়, সবাই চলে ভদ্রভাবে। তবে একটা জিনিস আমাকে প্রচণ্ড অবাক করল।
ছেলেরা হেলমেট পড়ে বাইক চালালালেও, মেয়েরা সাধারণত সেটা করছে না, তাদের মাথা, মুখ সব ঢাকা
শুধু চোখ ছাড়া। দেখতে অনেকটা হিজাবের মত। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে আমি প্রোফেসর সাহনীকে
জিজ্ঞেস করে বসলাম। বরুণ সাহনী মস্কোয় পড়াশুনা করেছেন, উনিও কসমোলজির উপরে কাজ করেন,
আমাকে তিনিই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আইউকায়। উনি ব্যাপারটা খোলসা করে বললেন। পুনায় আসলে
প্রচুর ধুলাবালি। তার হাত থেকে চুল আর মুখ রক্ষা করার জন্যই হিজাবরূপী এই আবরণ কাম
আভরণ।
পরের দিন ছিল রবিবার। তাই দেরী না করে নতুন পরিচিত একজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে।
ঘুরলাম মূলত পাশের পার্কে, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। কেননা কোন ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরতে গেলে
গল্প আর করা হয় না।
পরিচয়ের সময় বিভিন্ন গল্পের সূত্র ধরে সে জিজ্ঞেস করল “আপনার কথা শুনে ঠিক বুঝলাম না
আপনি লেনিনের পক্ষে না বিপক্ষে। মানে সোভিয়েত আমলে আপনি প্রায় অন্ধভাবে তাঁকে বিশ্বাস
করতেন, এখন মাঝেমধ্যে সমালোচনা করলেও তার কাজের পক্ষেও যুক্তি খোঁজেন। একটু খলসা করে
বলবেন?”
এই এক সমস্যা। রাশিয়ায় লেনিনকে নিয়ে উৎসাহে ভাঁটা পড়লেও আমাদের দেশে বিশেষ করে ছাত্রদের
মধ্যে সেটা আগের মতই তীব্র। তাই বললাম
তোমার অবজারভেশন ঠিক তবে সেটা লেনিনকে নিয়ে নয়। আমি সব কিছুর মধ্যে পজিটিভ ও নেগেটিভ
দুটোই খুঁজি। আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ প্রায় নিখুঁত কাজেও খুঁত খুঁজে পাবে আবার খারাপের মধ্যেও
কিছু ভালো পাবে। এটা নির্ভর করে মানুষের মাইন্ড সেটের উপর। তাই নিরপেক্ষ ভাবে কোন কিছু
বিশ্লেষণ করতে হলে নিজেকেই সেটা করতে হবে। যেহেতু লেনিন সোভিয়েত ব্যবস্থার জন্মদাতা
আমরা ধরে নেব পরবর্তীতে যা কিছু হয়েছে সেখানে লেনিনের কিছু দায় দায়িত্ব আছে। না ধরলেও চলে।
এটা করা যাতে উদাহরণ দিতে সুবিধা হয়। অন্তত এতে আমরা যেসব উপসংহার টানব, তার খুব একটা
হেরফের হবে না। জানই তো আমি দুবনায় থাকি। ধরা হয় এর জন্ম ১৯৫৬ সালে। আসলে এটাও
কণ্ডিশনাল। এখানে আগে গ্রাম ছিল। ভোলগা আর দুবনা নদীর সঙ্গম স্থলে অনেক পুরান একটা চার্চ
এখনও বিদ্যমান। সেখানে একটা পাথরে লেখা আছে ১১৩৪ সালে মানে ১১৪৭ সালে মস্কো প্রতিষ্ঠার
১৩ বছর আগে দুবনা প্রতিষ্ঠিত হয়। তার অর্থ এখানে লোকবসতি অনেক আগে থেকেই ছিল। এমন কি
দুবনা শহর তৈরির আগে তিরিশের দশকেই এখানে শুরু হয় বিরাট নির্মাণ কাজ। আগে বিশ্বের সব
দেশেই বড় বড় জনবসতি গড়ে উঠত নদীর ধারে। নদী ছিল বলতে গেলে যোগাযোগের একমাত্র উপায়।
যেকোনো বড় জনবসতির জন্য দরকার প্রচুর রসদ, সেটা আসত আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে, এমন
কি দূর দেশ থেকে। তখন গাড়ি ছিল না, রেলগাড়ি ছিল না। তাই রসদ সবরাহের মূল উপায় ছিল নদী পথ।
লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে রসদের চাহিদা বাড়ে, বাড়ে আভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য জলের
চাহিদা। সোভিয়েত ইউনিয়নে মস্কো যখন রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়, এর লোকসংখ্যা দ্রুত বাড়তে
শুরু করে। মস্কো নদীর জল সবার চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। প্রয়োজন হয় মস্কো নদীকে কোন বড়
নদী, যেমন ভোলগা বা ওবের সাথে সংযুক্ত করার। বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায় ভোলগার সাথে মস্কো
নদী সংযুক্ত করাই সব দিক থেকে ভালো অপশন, এক দিকে তাতে মস্কো নদীতে জলের সাপ্লাই
থাকবে আর যেহেতু ভোলগা রাশিয়ার প্রধান নদী, তাতে করে নদীবন্দর হিসেবে মস্কোর গুরুত্বও
অনেক বাড়বে। এর ফলে প্রায় একাত্তর কিলোমিটার জুড়ে ভোলগার তীরে যে শ খানেক গ্রাম ছিল
তাদের ডুবিয়ে তৈরি করা হয় ইভানকভস্কি রিজারভয়ার বা মস্কো সী। যদিও সেসব গ্রামের
অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়, যারা যেতে অস্বীকার করে, তাদের বন্দী করা হয়। অনেকে
নিজেদের ঘরবাড়ি আঁকড়ে থেকে ডুবে মারা যায়। শুনেছি যখন মস্কো সীতে জলের পরিমাণ কমে যায়,
কোন কোন গ্রামের ডুবে যাওয়া গির্জার চূড়া এখনও ভেসে ওঠে। এখানে থেকেই তৈরি করা হয় মস্কো
কানাল যা প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। বলা হয় এটা করতে মূলত যুদ্ধবন্দী আর ভিন্ন
মতাবলম্বীদের কাজে লাগানো হয়। মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। যারা কমিউনিস্ট আদর্শ বা
সোভিয়েত ব্যবস্থার বিরোধী তারা এটাকে অমানবিক কাজ হিসেবে দেখে। এখন চিন্তা করি ভিন্ন
ভাবে। যদি মস্কো শহরের জন্য এই জলের ব্যবস্থা না থাকত কত লোক ক্ষতিগ্রস্থ হত?
নিঃসন্দেহে বলতে পারি অনেক অনেক বেশি। তাই রিজারভয়ার তৈরি করতে গিয়ে শ খানেক গ্রাম ধ্বংস
করা হলেও সেটার প্রয়োজন ছিল অপরিসীম। যুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী অনেক চেষ্টা করেছে বোমা
ফেলে এখানকার বাধ ভেঙ্গে ফেলতে। করতে দেওয়া হয়নি। কারণ এতে শুধু ভাঁটির জনপদই
ক্ষতিগ্রস্থ হত না, মস্কোয় জলের অভাব প্রকট হত। প্রশ্ন আসতে পারে এত লোককে মৃত্যু মুখে
কেন ঠেলে দেওয়া হল কানাল তৈরি করতে? তখন আজকের মত এত সব টেকনলজি ছিল না, বিশেষ করে
বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায়। কী মিশরের পিরামিড, কী আগ্রার তাজমহল, কী শিল্পে বানিজ্যে এগিয়ে
থাকা ইউরোপ আমেরিকা – এসবই কী এরকম লাখ লাখ মানুষের রক্ত, ঘাম আর কান্নার উপর গড়ে
ওঠেনি? নাৎসি জার্মানির কলের চাকা কী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের হতভাগ্য মানুষের জীবন
শক্তিতে ঘোরেনি? ব্যাকিংহাম প্যালেস কী লাখ লাখ ক্ষুধার্ত ভারতবাসীর হাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নেই?
কত আমেরিকান ইন্ডিয়ান, কত আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাস নিজেদের রক্ত দিয়ে আমেরিকার
বিজয় রথ ভাসিয়ে রেখেছে সে খবর ক’ জন রাখে, রাখতে চায় বা তা নিয়ে বলতে চায়? ছোটলোকের
রক্তের উপর গড়ে তোলা প্রাসাদে বসে নিজেকে ভদ্রলোক ভাবা যায়, হওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক
ইউরোপ আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য গণতন্ত্র চায় না, তাদের উন্নতি চায় না, চায়
গণতন্ত্রের আপিম খাইয়ে তাদের দাস করে রাখতে ঠিক যেমন ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মের আপীম খাইয়ে
মানুষকে শোষণ করে। আসল কথা হল সমস্ত সভ্যতাই গড়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের কঙ্কালের উপর।
হয়তো বা সেটা না হলে আজ মানবসভ্যতা যেখানে এসে পৌঁছেছে সেটা হত না। এ প্রসঙ্গে একটা কথা
বলি। আগে দুবনা থেকে মস্কো যাওয়ার গাড়ির রাস্তা ছিল দিমিত্রভের উপর দিয়ে। ১৯৯০ এ দশকের
শেষ দিকে শহরকে বাইপাস করে নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়। এক জায়গায় এসে রাস্তা এক বাড়ির
সামনে আটকে পড়ে। ব্যাপারটা এরকম নয় যে ওখানে মাত্র একটা বাড়ি ছিল, চাইলেই রাস্তা
অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়া যেত। ওখানে অনেক বাড়িঘর ছিল। তাদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ভিন্ন
জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তবে একজন সরকারের দেওয়া সব প্রস্তাব নাকচ করে নিজের
ঘরে বসে থাকে। সে তার প্রতিবেশীরা যে শর্তে জায়গা ছেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি
করে। আমি মাঝে মধ্যে বাসে করে মস্কো যেতাম। ওখানে এসে কত ঝামেলা যে পোহাতে হত সবাইকে!
এ নিয়ে মামলা চলে অনেক দিন। সোভিয়েত আমলে ঐ লোককে জিজ্ঞেস করত না, এখন করে। কিন্তু ঐ
মামলায় রাস্তার কাজ কয়েক বছর স্থগিত থাকে, সেই ক্ষতি কি সেই লোক পূরণ করবে? কথা
এখানেই, অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে অমানবিক হতে হয়। ভাব তো যদি কেউ প্রশ্ন করে বাংলাদেশ
তো ঘুরে ফিরে আবার সেই পাকিস্তানেই পরিণত হচ্ছে। কী লাভ হল ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন আর দুই
লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে? অনেক কিছুই আছে যেটা ওভাবে মাপা যায়
না। মন্দ দেখার আগে যেমন ভালো কী হয়েছে সেটা দেখা দরকার একই ভাবে ভালোটা কী কী ক্ষতি বয়ে
আনল সেটাও ভাবা দরকার। এটা করা দরকার ভবিষ্যতে অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেটা
নিশ্চিত করতে।
দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম পুনা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। কি একটা রিকনস্ট্রাকশন চলছে
সেখানে। তাই খুব বেশি ঘুরাঘুরির স্কোপ নেই। মনে পড়ল ১৯৯৭ সালের কথা। তখন এদিক দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে যখন আইউকা যেতাম, ছাত্রছাত্রীদের কলরবে মুখর থাকত চত্বরটা। ওখানে কিছু ছবি তুলে
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম উল্টো দিকে। আইউকার চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়াম পেরিয়ে চললাম
স্টেডিয়ামের দিকে। কত লোকজন যে ক্রিকেট খেলছে তার ইয়ত্তা নেই। পুনা জনসংখ্যার দিক থেকে
ভারতের অষ্টম বৃহত্তম শহর আর দ্বিতীয় বৃহত্তম আইটি হাব। পুনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়
রাষ্ট্রকুটা বংশের ৯৩৭ সালের এক লিপিতে। ৮৫৮ ও ৮৬৮ সালের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় সে সময়
এখানে জনবসতি ছিল। পরবর্তীতে পুনা যথাক্রমে ভোশালে জায়গীর আর মারাঠা সাম্রাজ্যের অংশ হয়।
পুনাকে কেন্দ্র করে মারাঠা ও মুঘলদের মধ্যে যুদ্ধও হয়। ১৭২০ সালে বালাজি রাও মারাঠা
সাম্রাজ্যের পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী রূপে নিয়োগ পান। তিনি ১৭২৮ সালে সাস্বাদ থেকে রাজধানী
পুনায় স্থানান্তরিত করেন। তখন থেকেই শুরু হয় পুনার অগ্রযাত্রা। পথে যে অডিটোরিয়াম দেখতে পাই
সেটা প্রখ্যাত ভারতীয়-আমেরিকান জ্যোতির্বিদ সুব্রামনিয়াম চন্দ্রশেখরের নামানুসারে। উনি ছিলেন
ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ সি ভি রমনের ভাইপো। ইউনিভার্সিটি শেষ করে ইংল্যান্ড
যান স্যার এডিংটনের অধীনে পিএইচডি করতে। দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় তিনি ব্ল্যাক হোলের ভর বিষয়ে
কিছু মৌলিক ফলাফল লাভ করেন। তবে স্যার এডিংটন সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। পিএইচডি
শেষ তিনি দেশে এসে অনেক চেষ্টা করেও কোথাও চাকরি না পেয়ে আমেরিকা চলে যান এবং নিজেকে
অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৮৩ সালে
পদার্থবিদ্যায় তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
পুনায় আমার জন্য কোন সেমিনারের ব্যবস্থা ছিল না। ওখানে গেস্টদের জন্য সপ্তাহে একটা করে
সেমিনারের ব্যবস্থা। সেই সপ্তাহে সেমিনার ছিল সদ্য ইংল্যান্ড ফেরত এক ছেলের আর পরের
সপ্তাহে আমি থাকব না। তবে পুনায় কিছু স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে আমার কাজকর্ম নিয়ে
আলোচনা হয়। ওখানে কমবেশি সবাই কসমোলজি বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের উপর কাজ করছেন। ওদের
এক্সপেরিমেন্টাল গ্রুপ খুবই শক্তিশালী। পাশেই টাটা ন্যাশনাল সেন্টার ফর রেডিও
অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। তার সাথেও অনেকে কোলাবরেশন করেন। তাই এদের সাথে আলোচনা আমার
কাজের ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ ছিল।
এই সমস্ত আলোচনার ফাঁকেই আমি একদিন বেরিয়ে পড়লাম পুনা দর্শনে। আগা খান প্যালেসে আগেই
গিয়েছিলাম। আগা খান প্যালেস তৃতীয় সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এটা ছিল
নিজারি ইসমাইলি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক গুরুর এক দাতব্য কর্ম যিনি পুনার আশেপাশের এলাকার
দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ভারত ছাড় আন্দোলনের
সময় এই প্যালেসে মহত্মা গান্ধী, তাঁর স্ত্রী কাস্তুরব গান্ধী, সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই ও
সরোজিনী নাইডু অন্তরীন ছিলেন। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাদেও আগা খান প্যালেস তার অপূর্ব
স্থাপত্যের জন্য ফটোগ্রাফারদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। এরপর গেলাম শনিভার ভাদা নামে এক
জায়গায়। ১৭৩২ সালে তৈরি এই দুর্গ ১৮১৮ সাল পর্যন্ত ছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশোয়া বা
প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান। বর্তমানে সেটা ঠিক ধ্বংসস্তূপ না হলেও খুব ভালভাবে যে সংরক্ষিত সেটা
বলা যাবে না। তবে প্রতিদিন সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। আমি সেখানে গেছিলাম বিকেলের
দিকে। দেখে মনে হয়েছিল এটা পুনাবাসীর সান্ধ্যকালীন ভ্রমণের এক জনপ্রিয় জায়গা।
পরে আরেকদিন গেলাম পার্বতী। পুনার এই পাহাড় সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০ মিটার উঁচু। এই
পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত পার্বতী মন্দির। পেশোয়াদের রাজত্বকালে তৈরি এই মন্দির পুনার
প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার অন্যতম। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা এই মন্দির থেকে
সমস্ত পুনা যেন হাতের মুঠোয় দেখা যায়।
আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল মুম্বাই। সেখানে টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ বা
টিয়াইএফআর-এ একটা সেমিনার আছে। আমার ওখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বড়দা মানে সুবোধদার
সাথে দেখা করা। তাই অনেক চেষ্টা করে এভাবে প্রোগ্রাম সেট করেছি। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে
কোলকাতায় ফিরব। ওর ইন্ডিয়া ট্যুরের ব্যয়ভার বহন করছিল আমার ইনস্টিটিউট আর আভ্যন্তরীণ
ব্যয়ভার বহন করছিল স্থানীয় ইনস্টিটিউটগুলো। যে কোলাবরেটর আমাকে দিল্লি ইনভাইট করেছিল
শেষ মুহূর্তে তার ফাণ্ড নিয়ে একটু সমস্যা হয়। কী করা? লিখলাম অশোকদাকে এলাহাবাদে একটা
ট্রিপের জন্য। অশোকদা মানে প্রোফেসর অশোক সেন। ওনার সাথে আমার আলাপ ২০০৬ সালে
ইতালীর ট্রিয়েস্টে। চিঠি পাওয়া মাত্রই উনি আমন্ত্রণ পত্র পাঠালেন। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলে বাঁচলাম। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাশিয়ায় আমি কলিগ বা শিক্ষকদের নাম ধরে
ডাকতেই অভ্যস্ত। দেশে অবশ্য সবাই স্যার বলতে বা শুনতে পছন্দ করেন। ভারতে বাঙ্গালী কলিগরা
দাদা ডাকলে মাইন্ড তো করেনই না বরং তাতে খুশিই হন। ফলে সম্পর্ক অনেক ইমফর্মাল হয়।
এরমধ্যে তিনটে শহর ঘুরে স্যুভেনির দিয়ে ব্যাগ ভারী হয়ে গেছিল। শত হলেও বিমানে ওজনের
রেস্ট্রিকশন। তাই যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সুপ্রিয়র হাতে ও কিছু জিনিস পাঠিয়ে দিলাম। ও ট্রেনে
যাবে, তাই ওজনের সমস্যা হবে না। কল্যাণ বা আমি নিজে কোলকাতায় ফিরে সেগুলো কালেক্ট করে
নেব।
মুম্বাই
আইউকা আমার প্লেন ফেয়ার বেয়ার করেনি, তাই মুম্বাই যেতে হবে নিজের খরচে। দাদার কাছে জানতে
চাইলাম কীভাবে গেলে ওদের সুবিধা হবে। ট্রেন বা প্লেন – দুটো অপশনই ছিল। ওরা যেহেতু কাজে
ব্যস্ত থাকে তাই ওদের সুবিধা অনুযায়ী প্রোগ্রাম সাজাব। ওরা পুনায় আমার ঠিকানা জানতে চাইলো।
সব জেনে লিখল বাপি, মানে আমার ভাইপো গাড়ি ঠিক করেছে। ঐ গাড়ি রবিবার সকাল ১০ টায় আমাকে
তুলে নিয়ে যাবে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি তো খুব খুশি, কেননা সেক্ষেত্রে রাস্তায় নেমে কিছু ছবি
তোলা যাবে। কল্যাণদা পুনে আর মুম্বাইয়ের মাঝে একটা জায়গার কথা বলেছিল। সেখানে নেমে কিছু
কেনাকাটি করলাম। পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম মুম্বাইয়ের পথে। যদিও ইচ্ছে হচ্ছিল
কোথাও নেমে ছবি তোলার, তবে গাড়ি থামানো যায় সেরকম জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া হিন্দি না
জানায় ড্রাইভারকেও ঠিক বোঝাতে পারছিলাম না বা ড্রাইভার ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করছিল,
কেননা থামা মানেই ওর সময় নষ্ট।
সুবোধদা আমার সবচেয়ে বড় দাদা। জীবনে দুবার মাত্র দেখা হয়েছে। একবার ১৯৬৯ সালে যখন মায়ের
সাথে কোলকাতা যাই। তখন ওরা কোলকাতা এসেছিল। পরে আমরাও ওদের বাসায় যায় বোকারো স্টিল
সিটিতে। দাদা তখন সেখানে চাকরি করতেন। এরপর দেখা ১৯৭২ সালে কোলকাতায়। দাদা তখন অসুস্থ,
কী একটা অপারেশন হয়েছিল। তাই দেখা তেমন একটা হয়নি। ১৯৭২ থেকে ২০১৪। মাঝখানে কেটে গেছে
দীর্ঘ ৪২ বছর। ১৯৮৯ সালে আমি কোলকাতা এলে দাদা ছিলেন দিল্লীতে চাকরি সূত্রে। প্লেনের
টিকেট পাঠাতে চেয়েছিলেন, যাইনি। বাবাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করেনি। বাবাও প্লেন জার্নির ঝক্কি
নিতে চাননি শারীরিক কারণে। ১৯৯৭ সালে আমি যখন পুনা ও মুম্বাই আসি দাদা অফিসের কাজে বাইরে
ছিলেন। তাই সেবারও দেখা হয়নি। এবার আসার আগে ঠিক করে রেখেছিলাম, যে করেই হোক দেখা
করব। তাই মুম্বাইতে সেমিনারের আয়োজন। যদিও দাদা নিজে শিওর ছিলেন না অফিসের কাজে বাইরে
যেতে হবে কি না, তবে বলেছিলেন যে বউদি, বাপি আর সোমা থাকবে। আমি যেন অবশ্যই আসি। আর ওঁ
নিজে চেষ্টা করবে অফিসের কাজে বাইরে না যেতে।
এটা আমার দ্বিতীয় বার মুম্বাই আসা। ১৯৮৩ সালে আমি যদিও মুম্বাই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড
করেছিলাম মস্কো যাওয়ার পথে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এরপর এসেছিলাম ১৯৯৭ সালে। পুনা থেকে
কোলকাতা ফেরার টিকেট না পেয়ে মুম্বাই কোলকাতা টিকেট কিনেছিলাম। দ্বিতীয় শ্রেনীর টিকেট না
পাওয়ায় প্রথম শ্রেনীর টিকেট কাটি, সেটাও ওয়েটিং লিস্টে। তবে ফিরতেই হবে, কেননা পরের দিন
সকালে ঢাকার ফ্লাইট। তখন শৌর্যের সাথে কনফারেন্স থেকে একদিন আগেই মুম্বাই চলে আসি।
ছিলাম শৌর্যের বন্ধু অলোকের ওখানে। সেবার আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া।
ওখান থেকে টিআইএফআর গিয়েছিলাম, তবে ঢুকতে পারিনি, গেটের ওখান থেকে ফিরে এসেছিলাম।
পরের দিন ওরা আমাকে ট্রেনে তুলে দেয়, কোন সীট ছিল না। অনেক অনুরোধ করে প্রথম শ্রেণীর
টিকেট নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামড়ায় ওঠি। সেবারও ওখানে খুব সম্ভব যাদবপুর ইউনিভার্সিটির
ছাত্ররা যাচ্ছিল। তবে কেউ কোন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ছিল অতি সাধারণ এক পরিবার,
স্বামী-স্ত্রী। ওরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। দীর্ঘ জার্নি। তাই ওরা পালা করে দুই সীটে তিন জন
ঘুমুতো। তবে যাদবপুরের ছাত্ররা খুব মনোযোগ সহকারে রাশিয়ার গল্প শুনছিল, বিভিন্ন প্রশ্ন
করছিল। হাওড়া স্টেশনে নামার পর একজন তো গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। তবে কল্যাণদা
চলে আসায় আমার আর সে সাহায্য নিতে হয়নি।
পুনা থেকে মুম্বাই যেতে যেতে কত কথা যে ভাবছিলাম! দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পর দাদা আমাকে চিনবেন
তো? আমি নিজেই কি চিনব দাদাকে? হাজারো প্রশ্ন মনের ভেতর। ড্রাইভার মুম্বাই এসে ঠিক বুঝতে
পারছিল না বাসাটা কোথায়। আমি তো সেখানকার কিছুই চিনি না। এ সময় দাদার ফোন এল। এত সময়
পার হরে গেছে, তবুও আমরা নেই দেখে তারা টেনশনে। ড্রাইভারকে ফোনটা দিলে দাদা ওকে সব বুঝিয়ে
দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছুলাম গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি ঠিক যেন বাবার
মত কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। আমার এতটুকু অসুবিধা হল না চিনতে। আমি যখন মস্কো যাই বাবার বয়স
তখন ৭৫, আর এখন, ২০১৪ সালে দাদার বয়স ৭৩। আসলে এর আগে দুবার যখন দেখা হয়েছে, দাদা
তিরিশের এদিক সেদিকে, হালকা পাতলা। এখন শরীরে ভারিক্কি ভাব এসেছে। “তোমাকে দেখতে
একেবারে বাবার মত লাগছে।” দাদা হাসলেন, বললেন “বয়স তো কম হল না।” আমরা উপর চলে গেলাম।
ওখানে একটা ভাড়া বাসায় ওরা সবাই মিলে থাকে। দাদা, বউদি, সোমা আর বাপি ওর বৌ আর দুই মেয়ে
নিয়ে। ওঁদের নিজেদের বাসা মুম্বাইয়ের বাইরে। বড় বাসা। সুইমিং পুল সহ অন্যান্য ব্যবস্থা আছে।
সোমার নিজের বাসাও শহরেই। সোমা আর বাপি দু’ জনেই ইঞ্জিনিয়ার, ওদের বাবার মত। সোমা অবশ্য
বিয়ে থা করেনি। তবে অফিস কাছে, এই এলাকায় অনেক দিন আছে, বাচ্চাদের স্কুল পাশে এসব
বিবেচনায় ওরা বাসা ভাড়া করে থাকে সবাই মিলে। দাদা আর বাপি প্রায়ই অফিসের কাজে বাইরে থাকে,
সেদিক থেকে এটা প্র্যাক্টিক্যাল ডিসিশন। আমি একা থাকতে অভ্যস্ত। তাছাড়া এখন ছেলেমেয়রা
আলাদা থাকতেই পছন্দ করে। সেদিক থেকে ওরা উল্টো পথ যাত্রী। দাদা বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন।
আমারও অনেক প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে বাবাকে নিয়ে, বাবার কোলকাতা জীবন নিয়ে। তবে খুব বেশি
দাদাও জানেন না। আমি এই প্রথম জানলাম যে দাদা শেষ বারের মত দেশে যান ১৯৬২ সালে, আমার
জন্মেরও আগে। বাড়িতে কে কেমন আছে সেটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি দিদিকে ফোন করলাম। দিদি
আর রতন কথা বলল দাদার সাথে। “একবার এসে ঘুরে যাও দেশে।” “আমাদের আর হবে না রে। তোরা
সবাই মিলে চলে আয় কোলকাতায়। আগে থেকে জানাস। তাহলে আমরা সবাই কোলকাতা চলে আসব।”
বউদি অনেকক্ষণ কথা বললেন। দিদির কাছে জিজ্ঞেস করলেন কি পাঠাতে হবে। এরপর আমাকে
বললেন “তুই বন্যার জন্যে এটা নিবি, সেটা নিবি। বাপি আসছে। এখনই কিনে নিবি।” “বউদি, আমি যাচ্ছি
প্লেনে। সেখানে ওজনের ব্যাপার আছে। তুমি এসব করে আমাকে ঝামেলায় ফেলো না।” অনেক বুঝিয়ে
ওরা দুই ভাই বউদিকে নিরস্ত্র করল। এর মধ্যে বাপি অফিস থেকে ফিরে এসে দাদা বউদি বাদে
সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ড্রাইভে। গেলাম সী বীচে। সেখানে এটা সেটা খেলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সী
বীচ লোকে লোকারণ্য। প্রচুর লোক এসেছে ফ্যামিলি নিয়ে। বৌ আর কয়েকজন করে ছেলেমেয়ে।
মেয়েরা অধিকাংশই বোরকা বা হিজাব পড়া। একটু অবাকই হলাম। মুম্বাই সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল
একেবারেই অন্য রকম। আধুনিক, নাচেগানে ভরপুর। এরপর গেলাম সমুদ্রের ভেতর দিয়ে নতুন তৈরি
রাস্তায় ড্রাইভে। আমার তো সব সময়ই ছবি তুলতে হাত নিশপিশ করে। তবে আলোর অভাবে সেটা হয়ে
ওঠেনি। বাসায় ফিরে ঠিক হল আমি পরের দিন দুপুরে চলে যাব টিআইএফআরএর গেস্ট হাউজে, যাতে
সেমিনারের জন্য রেডি হতে পারি। সেমিনার পরশু। তার পরের দিন সকালে বাপি গাড়ি ঠিক করে দেবে
এয়ারপোর্টের জন্য। গেস্ট হাউজ থেকে এয়ারপোর্ট কাছে হবে। রাতে সোমাকে বৌদির ঘরে পাঠিয়ে
আমার শোবার ব্যাবস্থা করা হল ওর ঘরে। একটু পরে দাদা চলে এলেন। দুই ভাই গল্প করতে করতে
এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন ভোরে দাদা চলে গেলেন অফিসে। বললেন «ড্রাইভার তোকে গেস্ট
হাউজে পৌঁছে দেবে। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করে চলে যাস। আমি পরে ফোন করব»। যাওয়ার আগে হাতে
একটা ইনভেলাপ ধরিয়ে দিলেন। «এটা কী?» «বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনে নিস।» আমি বাড়ির ছোট
ছেলে। সারা জীবন অন্যদের আদর পেতেই অভ্যস্ত। পঞ্চাশ পেরিয়েও দাদা দিদিদের কাছে ছোট
থাকতে বেশ ভালই লাগে। বউদি অনেক যত্ন করে আমাকে খাওয়ালেন। বাপির বৌ ওকে গাড়িতে তুলে
দিয়ে এল। মুম্বাই শহর দেখতে দেখতে আমি চললাম টিআইএফআরএর দিকে। গাড়ি ঘোড়া লোকজন। শুধু
ভিড় আর ভিড়। এক জায়গায় আমার মনে হল কোন জনসভা হচ্ছে। রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে
বিশাল জনতা। কিসব স্লোগান ভেসে আসছে সেখান থেকে। «এটা অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি। ঐশ্বরীয়া রায়
বাসায় এসেছেন। তাই এত লোক ভিড় করেছে তাঁকে দেখতে।» ড্রাইভার জানাল আমাকে। কী বলব বুঝতে
পারলাম না। এমনটাও যে হতে পারে সেটা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। একটু পরে ড্রাইভার আমাকে
আম্বানীর বাড়ি দেখাল। মুম্বাইয়ে মনে হয় ওরা দেবদেবীর মত। শেষ পর্যন্ত আমরা গেস্ট হাউজে
এসে পৌঁছুলাম। সেখানে লাগেজ রেখে ফোন করলাম প্রোফেসর নরসিংহকে। কিভাবে তাঁর অফিসে যেতে
হবে সেটা জেনে সোজা চলে গেলাম সেখানে। সেখানেই আলাপ হল স্থানীয় এক তরুণ গবেষকের সাথে।
কথায় বুঝলাম এক সময়ের মার্ক্সবাদী। উনি আগামীকালের সেমিনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে
বললেন “আপনার সেমিনার কাল সাড়ে তিনটায়। পরশু ভোরেই তো চলে যাচ্ছেন। সকালে এলিফান্টা থেকে
ঘুরে আসেন। গেস্ট হাউজে বললে ওরা গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া যাওয়ার গাড়ি ডেকে দেবে। সেখান থেকে
চলে যাবেন। যাতায়াতে ঘণ্টা দেড়েক আর ওখানে এক থেকে দেড় ঘন্টা। কোন অসুবিধা হবে না। একটু
দেরী হলে আমরা অপেক্ষা করব।” এরপর উনি ক্যান্টিন দেখিয়ে দিলেন। ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে
ক্যান্টিনে গেলাম খেতে। তারপর গেলাম আরব সাগরের ধারে। সূর্যাস্তের আগে আকাশে মেঘের ঢেউ
খেলে যাচ্ছে। সেই ঢেউয়ে সাঁতার কেটে বাসায় ফিরছে পাখির ঝাঁক। সব জায়গায়ই সূর্য অস্ত যায় কিন্তু
একেক জায়গায় তার একেক রকম রূপ। আরবের মরুভূমির তপ্ত বালিতে ভাজা সূর্য কমলা বর্ণ ধারণ
করে একসময় সাগর জলে ডুবে গেল।
নির্জন দ্বীপ এলিফান্টা
পরদিন সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলাম। যাব এলিফান্টায়। এর মধ্যেই গতকালের সেই
মার্ক্সবাদী গবেষককে পটিয়ে ফেলেছি সাথী হবার জন্য। ও নিজেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন
সম্পর্কে জানতে উৎসাহী ছিল। না না, আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। তবে সেই সময়টা তো বটেই,
এখনও যেহেতু মস্কোতেই থাকি তাই অনেকেই জানতে চায় আমার মতামত। একটা ট্যাক্সি করে আমরা
চলে গেলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায়। প্রথমটায় মনে হয়েছিল এই ভিড়ে টিকেট পাবে না। কিন্তু একটু
পরেই ভিড় উধাও। আপডাউন টিকেট কেটে লঞ্চে উঠে বসলাম। সাগর থেকে মুম্বাই নতুন রূপে দেখা
দিল। এদিক সেদিক রণতরী। অনেকটা নৌকা টাইপ এই লঞ্চে সমুদ্র যাত্রা আমার মনে উৎসাহ আর
ভয় দুটোরই জন্ম দিল। সাগরে তেমন কিছু নেই শুধু জল ছাড়া। গল্প করার উত্তম সময়।
মনে আছে লেনিনের সেই বিখ্যাত উক্তি «গতকাল খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত, কিন্তু আগামীকাল খুব দেরী
হয়ে যাবে।» আমার কেন যেন মনে হয় গতকাল আর আগামীকালের মধ্যে «আজ» সময়টি বাছতে তিনি
ভুল করেছিলেন। কী সাফল্য, কী ব্যর্থতা – সব কিছুর পেছনেই অনেক কারণ থাকে। তাই
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের পেছনেও যেমন অনেক কারণ আছে, এর ব্যর্থতার পেছনেও
তেমনি অনেক কারণ আছে। এর একটি মনে হয় ওয়ান পার্টি সিস্টেম। অন্তত আমার তাই মনে হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নে কী একাধিক পার্টি থাকা সম্ভব ছিল? পূর্ব জার্মানি বা অন্য যেসব
সমাজতান্ত্রিক দেশে একাধিক পার্টি ছিল, তারাও মুলত কোয়ালিশন করে এক পার্টি গঠন করেছিল,
অনেকটা আমাদের বাকশালের মত। আমি ঠিক সেরকম কিছু বলছি না। যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের
সংবিধান বা সোভিয়েত ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে এমন একাধিক দল থাকত আর তাতে যেমন সরকারি
তেমনি বিরোধী দলও থাকত ঘটনা ভিন্ন হতে পারত। গণতান্ত্রিক দেশে অনেক দল থাকে আর সেসব
দল দেশের সংবিধান মেনে চলে। তাহলে কেন সমাজতন্ত্রে সেটা সম্ভব নয়? সোভিয়েত ইউনিয়নের
পতনের মূল কারণ দেশ চালনায় কমিউনিস্ট পার্টির অপারগতা। সেই সময়ে যে গণভোট হয়েছিল তাতে
সিংহভাগ মানুষ সোভিয়েত ব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছে। তার মানে এই মানুষ কমিউনিস্ট পার্টির
উপর আস্থা হারালেও সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারায়নি। বলতেই পারি যে তখন তো ভোট হত
অল্টারনেটিভ অপশন ছাড়া। কিন্তু এর মধ্যে সমাজে পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত জনপ্রিয় হয়েছে।
যদিও সেই নির্বাচন হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে, ১৯৯২ সালে তাতে সবচেয়ে বেশি ভোট
পায় ঝিরিনভস্কির এলডিপিআর। এ সেই ঝিরিনভস্কি, যিনি গরবাচভের বিরুদ্ধে গেকাচেপে বা ক্যু
সমর্থন করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটায় যে বেলভেঝস্কি চুক্তি বা ষড়যন্ত্র তার
বিরোধিতা করেছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি তাঁকে বা তাঁর দলকে সমর্থন করি না। কিন্তু তাঁর এসব
রাজনৈতিক পদক্ষেপ ভুললে চলবে না। সে সেময় যদি সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি অনুগত কোন
শক্তিশালী দল থাকত তারা কমিউনিস্ট পার্টির পরিবর্তে সরকার গঠন করতে পারত। এতে প্রথমত
কমিউনিস্ট পার্টি আমলাতান্ত্রিক পার্টিতে পরিণত হত না আর দেশও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত না।
আমাদের দেশের দিকে খেয়াল করলে কি দেখব? অনেকেই বলবে আওয়ামী লীগের কোন বিকল্প নেই।
কেন? তারা একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিশালী কোন বিরোধী দল দেখতে পায় না। গণ জাগরণ
মঞ্চ ঘিরে যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তখন সেরকম একটা পার্টি বা জোট গঠন করা
সম্ভব ছিল। আওয়ামী লীগ সেটা হতে দেয়নি। ফল কি? আওয়ামী লীগ নিজেই একাত্তরের চেতনা ধারণ
করে কিনা সে প্রশ্ন আজ মানুষের মুখে মুখে। যেকোন ধরণের মনোপলিই সমাজের জন্যও তো বটেই
এমন কি মনোপলিস্টদের জন্যও ক্ষতিকর। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে অনেক পুরনো এক
আনেকডোট।
কী সেই আনেকডোট?
ব্যবসায়ীদের নিয়ে। এক ভদ্রলোক ওষুধের দোকানে এসেছেন মাথা ব্যথার ওষুধ কিনতে। দোকানের
কম্পাউন্ডার অন্য এক কাস্টমারকে সার্ভ করছিল। তাই ভদ্রলোক তার আনকোরা সহকারীর কাছ
থেকে ওষুধ নিয়ে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে কম্পাউন্ডার ফ্রি হয়ে সহকারীকে জিজ্ঞেস করল কি অসুখ
আর কি ওষুধ সে দিয়েছে। উত্তর শুনে বেচারির তো হার্ট ফেল করার অবস্থা। “করেছ কী? এটা খেলে
তো সে লোকের লুজ মোশন শুরু হয়ে যাবে?” “তা ঠিক, তবে তার তখন মাথা ব্যথা নিয়ে মাথা ঘামানোর
সময় থাকবে না। এর মধ্যে হয়তো তার মাথা ব্যথাও সেরে যাবে।”
কিন্তু এর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক কি?
আমাদের সব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোট ভাগাভাগির ভয়ে নিজেদের কাছাকাছি আদর্শের
দলগুলোকে দাবিয়ে রাখে। ফলে কোন কারণে জনগণ দল বদলাতে চাইলে শুধু দল নয়, বস্তুত সিস্টেম
পাল্টাতে বাধ্য হয়। ভারত স্বাধীনতার পর অনেক দিন পর্যন্ত কংগ্রেস ছিল ক্ষমতার একচ্ছত্র
অধিকারী। জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে শক্তিশালী বিরোধী জোট গড়ে ওঠে।
বিরোধী হলেও এ জোট ছিল ভারতের সংবিধানের মূল নীতিগুলোর প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু এক
সময় সে জোট ভেঙ্গে যায়। সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে এ রকম দলের অনুপস্থিতিতে জনগণ বিজেপিকে
সমর্থন করে। জনগণ কংগ্রেসের পরিবর্তে ঐ জাতীয় অন্য কোন দল মানে আনালজিনের পরিবর্তে
প্যারাসিটামল না পেয়ে ডায়রিয়ার ওষুধ গ্রহণ করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় যেকোন
একটা পরিবর্তন আনা, তারা সেটাই করেছে। এ জন্যেই শাসক দলের সব সময় ভাবা দরকার ক্ষমতার
ম্যান্ডেট অনন্তকালের জন্য নয়। তাই সময় থাকতে এমন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা যাতে প্রায়
একই আদর্শের বিরোধী দল গড়ে ওঠে। তাহলেই আর ক্ষমতা হারানো এতটা ভয়ানক হবে না। যদিও
এক সময় বিভিন্ন দেশে ট্যু পার্টি সিস্টেম খুব সফল ভাবে কাজ করেছে বর্তমানে মনে হয় সেটাও গুড
অপশন নয়। আমাদের ছোটবেলায় ইংল্যান্ডে লেবার আর কনজারভেটিভ পার্টি পালাক্রমে ক্ষমতায়
এসেছে, এখন নতুন নতুন পার্টি তৈরি হচ্ছে। এর পেছনে অবজেক্টিভ কারণ আছে। আসলে ট্যু পার্টি
সিস্টেমে এক সময় দেখা যায় এরা একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ। আলটিমেটলি সবাই বৃহৎ পুঁজির
স্বার্থ রক্ষা করে। সেটা আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটিক আর রিপাবলিকান পার্টিই হোক আর আমাদের
দেশে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিই হোক। অবাক হলে? কিন্তু আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে
একাত্তরে বঙ্গবন্ধু আর জিয়ার ভূমিকা নিয়ে মত পার্থক্য ছাড়া আর কি তেমন সমস্যা আছে? তাদের
অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম কী কমবেশি এক নয়? দেশের মানুষ তৃতীয় শক্তির খোঁজ পাচ্ছে না। ইউরোপে
বিভিন্ন দেশে গ্রীন পার্টি, এমন কি আলট্রা রাইট দলগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে ট্র্যাডিশনাল দলগুলোর
প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে বলে। আমেরিকায় বিগ মানির গেম, তাই হয়তো দুই দলের বাইরে কেউ
তেমন মাথা তুলতে পারছে না। তবে আমার বিশ্বাস সেখানেও আজ প্রচুর মানুষ এই দুই পার্টির
অল্টারনেটিভ কোন দল খুঁজছে। আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব যত বেশি করে বিশ্বের উপর তাদের
ক্ষমতার মনোপলি আরোপ করতে চাইছে তাদের দেশে ততো বেশি করে প্লুরালিজমের চাহিদা বাড়ছে।
গল্পে গল্পে আমরা চলে এলাম এলিফান্টায়। এলিফান্টা গুহা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। মুম্বাই
থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে এলিফ্যান্ট দ্বীপে অবস্থিত এই গুহাগুলো মূলত হিন্দু দেবতা শিবের
মন্দির। তবে সেখানে কিছু বুদ্ধ স্তূপও আছে। স্তূপগুলো খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরি।
এলিফান্টা গুহায় রক কাটা পাথরের স্থাপত্য হিন্দু ও বৌদ্ধ ধারণার সমন্বয়বাদ ও আইকনোগ্রাফির
বহিঃপ্রকাশ। এখানে খোদাই করা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল
ত্রিমূর্তি সদাশিব, নটরাজ ও যোগীশ্বর। এই মূর্তিগুলো পঞ্চম থেকে নবম শতকে বিভিন্ন হিন্দু
ডাইনাস্টি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। এসব গুহা দেখতে দেখতে দ্রুত সময় কেটে গেল। আমার তাড়া ছিল
ঘরে ফেরার। ঘরে ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে চললাম সেনিমারে। সেমিনার শেষ ঘরে ফিরে রেস্ট নিচ্ছি, ভাবছি
হাঁটতে যাব সমুদ্রের ধারে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই একজন বলল “আপনাকে
কেউ একজন ফোন করছে, নীচে চলে আসেন।” আমি তো অবাক। নীচে গিয়ে দেখি দাদার ফোন এসেছে।
“আমি সেই কখন থেকে ফোন করছি, কোন সাড়া নেই। সব ঠিক আছে তো?” আমার মনে পড়ল
সেমিনারের সময় ফোনটা মিউট করে রেখেছিলাম। “হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক মত হয়েছে। এখন ভাবছি একটু
ঘুরতে যাব।” “কোন দরকার নেই। ড্রাইভার ওখানে তোর অপেক্ষা করছে। লাগেজ নিয়ে চলে আয়। আজ
আমাদের সাথে কাটা। কাল সকালে এখান থেকে এয়ারপোর্ট যাবি।”
সে রাতে ছিল এক জম্পেশ ডিনার। বউদি খুব ভালো রান্না করেন। আমাদের বউদিদের মধ্যে কয়েকজন
আছেন মা ঘরানার মানে মায়েরা যেমন ছেলেমেয়েদের এরা তেমনি দেবর-ননদদের আদর যত্ন করেন।
স্বপ্না বউদি তাদের একজন। অবশ্য তাঁর কাজই দুটো, রান্না করা আর ঠাকুর দেবতার পূজা অর্চনা
করা। অনেক রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা। খুব ভোরে চলে গেলাম এয়ারপোর্টে। যাওয়ার আগে সবার কাছ
থেকে বিদায় নেবার পালা। কে জানে আবার কবে দেখা হবে, হবে কিনা আদৌ। সোমাকে আমি এবারই
প্রথম দেখি, যদিও অনেক আগে এক সময় চিঠি লিখতাম নিয়মিত। তবে এখন দেখা না হলেও
যোগাযোগের মাধ্যম বেড়েছে, ফলে চাইলে অন্তত যোগাযোগটা রাখা যাবে। আমার আরও একটা দায়িত্ব
বেড়ে গেল। এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়ে অন্য দাদাদের সাথে এখানেও একটা ফোন করে জানানো
ভালো ভাবে পৌঁছেছি। দাদা বেরুনোর সময় বললেন কোলকাতার বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। ওখানে কেউ
থাকে না, যায় না। ওরা মুম্বাইতেই অভ্যস্ত, ছেলেমেয়েরা তো এখানেই বড় হয়েছে। তাই কি লাভ ওখানে
একটা বাড়ি রেখে। আমার মনে হল, ইস দাদার সাথে বাংলার যোগাযোগটা একেবারেই ছিন্ন হয়ে যাবে।
আমি নিজে যদিও অনেক আগেই এ এলাকার সাথে সম্পর্ক ঘুচিয়ে বিদেশ বিভূঁইকে আপন করে নিয়েছি
সেটা মনেই হল না। মানুষ মনে হয় এমনটাই।
বানারস
সকালে এসে নামলাম বারাণসী এয়ারপোর্টে। এর আরেক নাম কাশী। এখানেই অবস্থিত বিখ্যাত
বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। সেখানকার অনেকের সাথেই কাজের সূত্রে ভার্চুয়াল পরিচয় আছে। এখান
থেকেই দুএকজন পোস্টডক কাজ করেছে আমার সাথে। তবে বারাণসীর কথা মনে হলে মনে পড়ে
বিশ্বনাথ মন্দির, বিসমিল্লাহ্ খানের সানাই-এর কথা। মনে পড়ে ছোটবেলার কথা যখন মা, মাসীমা
আর মামা-মামীর সাথে এখানে এসেছিলাম তীর্থ ভ্রমণে। সেবার গন্তব্য ছিল গয়া, বুদ্ধগয়া আর কাশী।
এখানেই কোথাও, মনে হয় বুদ্ধগয়ায় অনেকটা তেলের ড্রামের মত ড্রাম দিয়ে তৈরি বাঁধ পেরিয়ে
আমরা যাই তুলসীদাসের মন্দিরে যেখানে প্রমাণ সাইজের পুতুল নেচে নেচে রামায়ণ গান করছিল। এই
সেতু পেরোনোর সময় মনে হয়েছিল বানর সেনা সহ রামের সমুদ্র পার হওয়ার করা। মনে আছে গয়ায়
এক মাঠের কথা যেখানে ঘাস ছিল কার্পেটের মত মোলায়েম আর অস্বাভাবিক রকম লম্বা। আর মনে
পড়ছে অশোক স্তম্ভের কথা। সেবার আমরা কাশীর রাজবাড়ি গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম সূর্যঘড়ি আর
হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন স্যুভেনির। পরে রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি পড়তে গেলেই মনে পড়ত
সেই কাশীর রাজবাড়ির কথা।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখি গাড়ি অপেক্ষা করছে। সেখান থেকে গাড়িতে যাব এলাহাবাদ। ইচ্ছে
ছিল বিশ্বনাথের মন্দিরের দু একটা ছবি তোলার। ড্রাইভারকে বললাম, তবে ও ইংরেজি না বোঝার ভান
করে কথাটা এড়িয়ে গেল। এলাহাবাদের পথে পড়ল বিভিন্ন গ্রাম ও শহর, ইতিহাস বই বা রামায়ণ,
মহাভারত থেকে পরিচিত অনেক নাম। হঠাৎ যেন প্রাচীন কালের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠল চোখের
সামনে। প্রায় ঘণ্টা দুই জার্নির পরে এসে পৌঁছুলাম হরিষ চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা
এইচআরআই-এ। এই ইনস্টিটিউটের আগে নাম ছিল ফিজিক্স রিসার্চ ল্যাবরাটরি বা পিআরএল। পরে
আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় বৈজ্ঞানিক হরিশ চন্দ্রের নামানুসারে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়
এইচআরআই। এটা অবশ্য নদীর এ পাড়ে। মূল শহর নদীর অন্য পাড়ে অবস্থিত।
প্রয়াগ থেকে এলাহাবাদ
এলাহাবাদের প্রাচীন নাম প্রয়াগ। এই শহরের উৎপত্তি বৈদিক যুগে। প্রয়াগের সর্বপ্রথম উল্লেখ
পাওয়া যায় ঋগবেদে। এছাড়া পালি ভাষায় লেখা বৌদ্ধ পান্ডুলিপিতেও প্রয়াগের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বেদে উল্লেখ আছে এই জায়গায় ব্রহ্মা তাঁর যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। আর্যরা যখন আর্যাবর্তে এসে
পৌঁছে তখন প্রয়াগ বা কৌসুম্বি ছিল এলাকার গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এক সময় এর রাজা ছিল কুরু।
মহাভারতে উল্লেখ আছে যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এখানে লোকজন আসত স্নান করতে।
মাহাভারতে উল্লেখ আছে যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে অনেকেই এখানে পুণ্যস্নানে এসেছিলেন। বেদ
ও মহাভারত বাদেও বিভিন্ন পুরাণে প্রয়াগের উল্লেখ আছে। বিভিন্ন সময়ে এই জনপদ ছিল মৌর্য,
গুপ্ত ও কুশান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এখানে অবস্থিত অশোক স্তম্ভ এক সময় এই জনপদের
গুরুত্ব যে বারাণসী ও হরিদ্বারের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না সেই সাক্ষ্য বহন করে। ১১৯৩ সালে
প্রয়াগ দিল্লীর সুলতানের অধীনে আসে। সম্রাট আকবর এখানে বিশাল দুর্গ তৈরি করেন আর ১৫৭৫
বা ১৫৮৩ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন আল্লাহবাদ যা কিনা ব্রিটিশ উচ্চারণে এলাহাবাদ বলে
খ্যাত হয়। বর্তমানে এই শহরকে তার পুরানো নাম ফিরিয়ে দিয়ে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে।
গেস্ট হাউজে জিনিসপত্র রেখে চলে গেলাম অফিসে। সেখানে করডিনেটর শ্বেতা সব বুঝিয়ে দিল।
আগামীকালের সেমিনারের সময় ও স্থান সম্পর্কে বলে দিল। এরপর আমি গেলাম অশোকদার খোঁজে।
উনি অফিসে ছিলেন না। তাই আমার জন্যে বরাদ্দ করা অফিসে বসে পরের দিনের লেকচার রেডি করতে
বসে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে দরজায় টোকা। অশোকদা নিজেই এসে হাজির।
কি খবর? কেমন আছ?
খুব ভালো অশোকদা। অনেক ধন্যবাদ ট্রিপটা আরেঞ্জ করার জন্য।
ঠিক আছে। তুমি কি আরও কয়েকটা দিন থাকবে?
না অশোকদা। আমি পরশু সকালেই দিল্লি চলে যাব। ওখানে একটু ঘুরতে চাই।
ঠিক আছে। তাহলে যেটুকু সময় পাও এদিকটাও ঘুরে দেখ। আর তিনটের সময় আমার একটা লেকচার
আছে, চলে এসো। আগামী কাল যারা তোমার সেমিনারে থাকবে ওদের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।
ঠিক আছে।
অশোকদা চলে গেলেন। অশোকদা মানে অশোক সেন। ভীষণ অমায়িক মানুষ। পদার্থবিদ্যার বিশেষ করে
স্ট্রিং থিওরির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরেও চলনে বলে কী সাধারণ। আসলে আমি যখন
ছোটবেলায় পদার্থবিদ্যায় পড়ব বলে ঠিক করি তখন থেকেই আমার কল্পনায় বিজ্ঞানীরা ঠিক
এমনটাই ছিলেন।
লেকচারটা রেডি করে গেলাম গেস্ট হাউজে। ওখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা। পথে কে যেন ডাকল
বিজন!
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেই বলল
চিনতে পারছ না? ওই তো কোলকাতায় তোমার সেমিনারে ছিলাম। ক’ দিন থাকবে?
কাল সেমিনার। পরশু সকালে দিল্লি যাচ্ছি।
তাই বল। তাহলে কাল সেমিনারের আগেই ত্রিবেণী সঙ্গম আর আনন্দ ভবন মানে মতিলাল নেহরুর
বাড়িটা অন্তত দেখে যেও। আমি গেস্ট হাউজে বলে দেব। ওরা তোমাকে গাড়ি ডেকে দেবে।
গেস্ট হাউজে খাওয়া দাওয়া শেষে গেলাম মেইন বিল্ডিঙে। একটা সাঁকো পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়।
অনেকটা গ্রামের সাঁকোর মত তবে আধুনিক, ঝুলন্ত। ওখান থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল। আর
আমি যখন বেরোই গেস্ট হাউজের সামনেই ঘুরছিল এক সাদা ময়ূর। অনেকটা তপোবন তপোবন ভাব।
এখানেও বাইরে চায়ের ব্যবস্থা। চেন্নাই, পুনা আবার এখানেও দেখলাম সবাই একসাথে বসে চা খাচ্ছে
একটা নির্দিষ্ট সময়ে আর তখন যে যার মত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছে। বেশির ভাগই
পদার্থবিদ্যা বা গণিত নিয়ে। এটা আমার খুব মনে ধরল। বন্ধুত্বপূর্ণ আর ইমফর্মাল পরিবেশে খুব
কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মত বিনিময় করা। দেশে টি স্টলে বসে লোকজন যেমন রাজনীতি নিয়ে
আড্ডা দেয় ঠিক সে রকম, তবে এখানে আড্ডার বিষয়টা কথা বলার জন্য বলা নয়, গবেষণা। মনে মনে
ভাবলাম দুবনা ফিরে সেখানে এটা বলব। এরপর অশোকদার লেকচার শুনে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ও
গেলাম ক্যাম্পাসের ভেতরেই ঘুরে বেড়াতে।
কালিদাস পয়েন্ট
প্রয়াগ বা এলাহাবাদের হরিষ চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এইচআরআই গঙ্গার তীরে অবস্থিত।
ইনস্টিটিউট থেকে একটু হাঁটলেই গঙ্গা। সেখানে অনেকেই ঘুরতে যায় সূর্যাস্ত দেখতে। এই জায়গাটির
নাম কালিদাস পয়েন্ট। কেন সেটা জানি না, তবে সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে হয়তো
মহাকবি কালিদাস এখানে বসেই তাঁর মেঘদূত বা রঘু বংশ বা কুমারসম্ভব রচনা করেছিলেন। না করলেও
ভাবতে তো ক্ষতি নেই। আমি তাকিয়ে ছিলাম গঙ্গার দিকে। ওখানে ছোট ছোট নৌকা ভাসছে, মাঝে মাঝে
উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। সাঁঝ নামছে গঙ্গার উপর। ঘরে ফেরার সময়। নীচে সারি সারি কিসব যেন
শোয়ানো। পাশেই এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এসব মানুষের শব। অনেকেই মৃত দেহ চিতায়
দাহন না করে গঙ্গার তীরে রেখে যায়। অবাক হলাম শুনে। আমার ধারণা ছিল হিন্দুদের শব চিতার
আগুনে পোড়ান হয়। পরে শুনেছি অনেককেই এভাবে নদীর ঘাটে রেখে যাওয়া হয়, অনেককে আবার
সমাধি দেওয়া হয় জোড়াসন করে বসিয়ে।
ঐ ছেলেটা পশ্চিম বঙ্গ থেকে। এখানে পিএইচডি করছে। অনেক কথা হল ওর সাথে। আমি রাশিয়া থেকে
শুনেই লেনিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। কেন যেন মনে হয় নিজ দেশে আদর যত্ন কমে গেলেও বাইরে
তিনি এখনও জনপ্রিয়। আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। এক সময় দেশে তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসানো
হয়েছিল। এখন তিনি মানব রূপ ফিরে পেয়েছেন সব দোষ গুণ সব নিয়েই।
লেনিনকে নিয়ে কিছু বলুন? – সূর্য ডুবে গেলে প্রশ্ন করল ছেলেটি।
মনে পড়ছে সুকান্তের কবিতা “লেনিন ভেঙ্গেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ, অন্যায়ের মুখোমুখি
লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।” ভেবে দেখেছ লেনিনকে নিয়ে কত কিছু লেখা হয়েছে, কত গল্প, কত উপন্যাস,
কত নাটক? আমার বড়দার যাত্রার দল ছিল, অম্বিকা নাট্য প্রতিষ্ঠান। আমাকে খুব আদর করতেন।
আমিও ছিলাম সেই দলের এক টাকার মালিক। জানি না কাগজ পত্রে লেখা ছিল কি না, প্রতিবছর যখন
দলের কাজ শুরু হত আমাকে এক টাকার মুদ্রা নিয়ে সেখানে আসতে বলতেন আর সবার কাছে পরিচয়
করিয়ে দিতেন দলের স্বত্বাধিকারীদের একজন হিসেবে। আমার জন্মের পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আমি বড়দা আর বৌদির কাছেই মানুষ। সারাদিন ওখানে থাকতাম, রাতে ঘরে ফিরতাম। এক বাড়িই তো।
ওঁদের সন্তান ছিল না, আমাকে দত্তক নিতে চাইতেন। আমি রাজী হয়নি। গ্রামে আরেকটা দল ছিল –
কার্ত্তিক সাহার অন্নপূর্ণা নাট্য প্রতিষ্ঠান। পরে যাত্রা সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাসও আমাদের
এলাকায় তাঁর দল চারনিক নাট্য গোষ্ঠী নিয়ে ঘাটি গাড়েন। সেসব দলে বিভিন্ন পালা হত, তার একটা
লেনিন। অমলেন্দু বিশ্বাস নিজে সেখানে অভিনয় করতেন। যীশুকে নিয়ে যেমন বিভিন্ন রকমের কাহিনী
গড়ে উঠেছে লেনিনকে নিয়েও সেরকম অনেক কাহিনী গড়ে উঠেছে। তবে ব্যাপারটা শুধু লেনিনকে নিয়ে
নয়। সমাজতন্ত্র বা বলতে পার সোভিয়েত সমাজতন্ত্র লেনিনের মানসপুত্র। একে নিয়ে গড়ে উঠেছে
নতুন ধরণের সাহিত্য, নতুন ধরণের আর্ট, নতুন ধরণের সিনেমা। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম নামে
পরিচিত এ সব পৃথিবীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আভ্যানগার্ড
আর্টের জন্মও মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নেই। আমরা পেয়েছি নতুন ধরণের লেখক, নতুন ধরণের
কবি, আর্টিস্ট, সিনেম্যাটোগ্রাফ। এতে রাজা বাদশাহ নয় সাধারণ মানুষ স্থান পেয়েছে। সাধারণ মানুষ
ইতিহাস গড়েছে। প্রাচীন যুগে যেমন স্পারটাকাস, এ যুগে তেমনি হত দরিদ্র মানুষ ইতিহাস গড়েছে। এ
সবই কিন্তু লেনিনের লিগেসি। এক অর্থে আজকের যে পৃথিবী সেটা লেনিনের লিগেসি। হ্যাঁ, মার্ক্স এর
ভাবগুরু, কিন্তু লেনিনই প্রথম দেখান শ্রমিক শুধু পুঁজিপতিদের মুনাফা লাভের হাতিয়ার নয়, শ্রমিক,
কৃষক – সমাজ বদলের কারিগর। আইনস্টাইন ভরের সাথে শক্তির সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কার করেন,
ওপেনহাইমার সেই শক্তিকে মুক্ত করে জন্ম দেন পারমাণবিক বোমার। ঠিক একই ভাবে মার্ক্সের
তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে লেনিন জন্ম দেন বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ। আর ১৯১৭ সালের পর
থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যাকিছু ঘটেছে সেটা ঘটেছে সেই অক্টোবর বিপ্লবকে ঘিরেই, এখনও ঘটছে।
তাই লেনিনের লিগেসি অস্বীকার করা, এটা নিজেদেরকেই অস্বীকার করা।
কিন্তু অতীতকে অস্বীকার করার রাজনীতি তো লেনিন থেকেই শুরু।
সেটা ঠিক, কিন্তু সেটা আংশিক ভাবে সত্য?
যেমন?
দেখ, বিপ্লবের পর লেনিন বলতে গেলে দেশের অর্থনীতি ঢেলে সাজান। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা
মার্ক্স যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাতে সমাজের চরিত্র অর্থনীতি বা উৎপাদন সম্পর্কের উপরই নির্ভর
করে। তাই পুরনো অর্থনীতির সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে উৎপাদনে নতুন সম্পর্ক প্রণয়ন করেন।
কিন্তু সমাজ তো শুধু অর্থনীতি নয়। সেই সময়ের শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের দিকে তাকাও।
মেন্দেলিয়েভ, কাপিৎসা, ভাভিলভ, চেরেনকভ, লান্দাউ, ভেরনাদস্কি, বুনিন, গোর্কি, এসেনিন,
মায়াকভস্কি, পাস্তেরনাক, আখমাতভা, গুমিলেভ, কঞ্চালভস্কি, ৎসভেতায়েভা, বুলগাকভ,
আইজেনস্টাইন, স্তানিস্লাভস্কি, যোশেঙ্কো, মারশাক, বার্তো – যারা সোভিয়েত বিজ্ঞান, শিল্প,
সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন,
তারা কিন্তু বিপ্লব পূর্ব রুশ ধারার প্রতিনিধি। তার মানে এই যে লেনিন যদিও বিখ্যাত «দার্শনিক
জাহাজে» প্রচুর রুশ বুদ্ধিজীবীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তবুও সেটা সমূলে উৎপাটন
করেননি। তবে এটাও ঠিক নতুন বাস্তবতা তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। তাদের শিল্পের
বিষয়বস্তু পাল্টায়, পাল্টায় গল্পের নায়ক নায়িকা। এক সময় সাহিত্য ছিল দেবতা আর রাজা
বাদশাহদের জয়গাঁথা। তবে সাহিত্য এখান থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে। প্রকৃতি বা সুন্দরের
প্রকাশ ছাড়াও সাহিত্যে স্থান পেয়েছে সাধারণ মানুষ। গোগোল, দস্তইয়েফস্কি, তালস্তই, চেখভ এরা
তো সাধারণ মানুষের কথাও বলেছেন। লেনিন নিজে তালস্তইকে রুশ বিপ্লবের আয়না বলে আখ্যায়িত
করেছেন। সে সময় রুশ দেশে শ্রমিক শ্রেণী ছিল না বললেই চলে। তবে গোর্কি, অস্ত্রভস্কি তাঁদের
লেখায় সেই অভাবটা পুষিয়ে দিয়েছেন। নতুন বাস্তবতা নতুন ধরণের সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। সেটা
একদিকে ছিল নতুন রাজতন্ত্রের পূজা অন্যদিকে রুপকের আড়ালে নতুন ব্যবস্থার সমালোচনা।
বুলগাকভ এ ব্যাপারে খুবই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাই সোভিয়েত সমাজ রুশদেশেরে সব কিছু
সমূলে উপড়ে ফেলেছে বা ফেলতে পেরেছে – সেটা বলা ভুল। আর সে কারণেই হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন
এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থনীতিতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি, হয়তো এ
কারণেই শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত অর্থনীতি ব্যর্থ হয়। হয়তো সেটাই সোভিয়েত ইউনিয়ননের
অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ত্রিবেণী সঙ্গম
দেখতে দেখে আঁধারে হারিয়ে যায় গঙ্গা। শেয়ালের ডাক শুনতে শুনতে আমরা ফিরে এলাম লোকালয়ে।
পরের দিন সকালে যাব এলাহাবাদ ফোর্টে। ওখান থেকে শুরু হবে আমার নতুন করে পথ চলা। খুব ভোরে
উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। ব্রেকফাস্ট করতে না করতেই চলে এল গাড়ি। আমরা চলল প্রয়াগ তীর্থের
দিকে। নদীর তীরে লোকে লোকারণ্য। কত যে নৌকা। নৌকায় করে সবাই যাচ্ছে গঙ্গা আর যমুনার
মিলনস্থলে। সাধুরা বসে আছে এখানে সেখানে। কেউ বা হাত দেখছে আবার কোথাও বা সাধুরা গোল হয়ে
বসে গল্প করছে। ছোটবেলায় গোলকধাঁধা খেলতে গিয়ে কতবার যে এখানে এসেছি! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে
থেকে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম নৌকা করে যাব সেই সঙ্গমে। নৌকার ভাড়া দেড় হাজার থেকে তিন
শতে নামল। চারিদিকে শুধু নৌকা আর নৌকা। মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে গাংচিলের ঝাঁক। দূর থেকে
এলাহাবাদ ফোর্ট নব রূপে দেখা দিচ্ছে। ত্রিবেণী সঙ্গমে নারী পুরুষ সবাই স্নান করছে।
ত্রিবেণী সঙ্গম মানে তিন নদীর মিলন মেলা। গঙ্গা ও যমুনার দেখা মিললেও সরস্বতীর দেখা এখানে
কেউই পায়নি। এটা কি শুধুই কাল্পনিক নদী নাকি প্রাচীন কালে তার অস্তিত্ব ছিল? আমার মনে আছে
গয়ায় গঙ্গা স্নানের কথা। সেখানে গঙ্গা অন্তঃসলিলা। তাই আমরা অনেকটা বালু খুঁড়ে গর্ত করে
সেখানে স্নান করেছিলাম। কথিত আছে রামকে বনবাসে পাঠিয়ে রাজা দশরথ পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে
পড়েন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাণ ত্যাগ করেন। একদিন রাম আর লক্ষণ যখন খাদ্যের সন্ধানে
বাইরে গিয়েছিলেন দশরথ সীতাকে দর্শন দেন। দুই ভাই ফিরে এলে সীতা তাঁদের দশরথের আগমনের
কথা বলেন। দুই ভাই সে কথায় বিশ্বাস না করলে সীতা সাক্ষী হিসেবে ডাকেন তুলসী গাছ আর গঙ্গাকে।
তুলসী গাছ সীতার পক্ষে সাক্ষ্য না দেওয়ায় সীতা থাকে অভিশাপ দেন। সেই থেকে তুলসী গাছ দেখলেই
কুকুর তার উপর প্রস্রাব করে। আর সীতার অভিশাপে এখানে গঙ্গা অন্তঃসলিলা হয়। ঋগবেদ সহ
বৈদিক ও হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে সরস্বতী নদীর উল্লেখ থাকলেও এখনও পর্যন্ত এর দেখা
মেলেনি। কেউ কেউ ধারণা করেন ছায়াপথকে ত্রিবেণী সঙ্গমের তৃতীয় নদী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।
আবার অনেকের মতে যমুনা ও সুতলেজ নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় ভারত ও পাকিস্তানে প্রবাহিত
ঘাজ্ঞার-হারকা নদীই হয়তো সেই বৈদিক সরস্বতী। স্যাটেলাইট চিত্র সাক্ষ্য দেয় যে এক সময়
এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল যার ধারে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার অনেক বড় বড় জনপদ। আবার
অনেকের মতে আফগানিস্তানের হেম্লান্দ বা হারাক্সভাতি নদীই হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্রে
উল্লেখিত সেই নদী। তবে সে যাই হোক সরস্বতী নদীর গুরুত্ব মোটেই কমেনি বরং একবিংশ শতাব্দীতে
নতুন ভাবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে সিন্ধু সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা নামেও উল্লেখ করা
হয়। এই নতুন আপ্রোচ ভারতবর্ষে আর্য মাইগ্রেশনের ব্যাপারে নতুন চিন্তার খোঁড়াক যোগায়।
ছোটবেলায় মকর সংক্রান্তিতে কালিগঙ্গা নদীতেও লোকজন স্নান করত। কেউ কেউ যেত
শীতলক্ষ্যার তীরে লাঙ্গলবন্ধে। তবে এখানে এসব হয় সারা বছর ব্যাপী। সেখান থেকে দৃশ্যমান নতুন
তৈরি যমুনা সেতু। সময় থাকলে সারাদিন নৌকায় করে ঘুরে কাটানো যায়। কিন্তু এত সময় কোথায়?
সেখান থেকে আমরা গেলাম পাশের হনূমানের মন্দিরে। পরের ঠিকানা আনন্দ ভবন। যদিও আকারে
এলাহাবাদ ফোর্টের মত গুরুগম্ভীর নয়, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই ভবনের গুরুত্ব মোটেও কম
নয়। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রথিতযশা উকিল মতিলাল নেহরু। জহরলাল নেহরুর আত্মজীবনীতে এই বাড়ি
সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কংগ্রেসের প্রথম যুগে যখন মতিলাল নেহরু, দেশবন্ধু চিত্ত
রঞ্জন দাস ছিলেন এর কর্ণধার তখন যেমন তেমনি পরবর্তী কালেও এই আনন্দ ভবন ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখানেই ভারতের স্বাধীনতার উপর বিভিন্ন সভা
হয়েছে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিলও এখনেই লেখা হয়েছে। এখন এটা মিউজিয়াম। সেখানে অতি যত্নে
সংগৃহীত আছে জহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর বিভিন্ন জিনিসপত্র। একটা অংশ ছেঁড়ে দেওয়া
হয়েছে শিশুদের জন্য। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে লাগল। সেমিনারের সময় এগিয়ে
আসছে। এবার তাই ইনস্টিটিউটে ফেরার পালা।
সেমিনার বেশ ভালই হল। বিশেষ করে সেমিনার শেষে অশোকদার টিপস আমার পরবর্তী কাজে খুবই
সহায়ক হয়েছিল। সেমিনার শেষ টি পার্টি। সন্ধ্যায় আবার গেলাম সূর্য দর্শনে ঠিক যেমন করে দুবনায়
ভোলগার তীরে যাই। পরদিন সকালে যেতে হবে এলাহাবাদ এয়ারপোর্টে। সকাল সকাল রেডি হয়ে
আবার গেলাম সকালের গঙ্গা দেখতে। এখন সে বিকেলের মত এত রঙ্গিন নয়। তারপরও গঙ্গা গঙ্গাই।
দিল্লীতে আমার জন্য গেস্ট হাউজে সীট বুক করাই ছিল। তবে প্রথম দুদিন মানে শনি আর রবি বার
ছিলাম বন্ধু চঞ্চলের বাসায়। চঞ্চল আমার জন্য দিল্লি আর আগ্রা ভ্রমণের ব্যবস্থা করে রাখবে।
তাছাড়া ছুটির দিনে এই অজানা অচেনা শহরে একা আমি কীই বা করব। চঞ্চল বলেছে ও এয়ারপোর্ট
থেকে নিয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়া শেষে অভি নিশ্চিন্ত মনে রওনা হলাম এয়ারপোর্টের পথে।
দিল্লি – ইতিহাসের খোঁজে
এলাহাবাদ এয়ারপোর্ট যতদূর মনে হয় শুধুই ডোমিস্টিক পারপাসে ব্যবহার করা হয়। একটু টেনশনেই
ছিলাম সময় মত পৌঁছতে পারব কিনা। কিন্তু দেখা গেল বিমান লেট। এই প্রথম আমি এরকম অবস্থায়
পড়লাম। সবচেয়ে বড় কথা কখন প্লেন ছাড়বে তার কোন খবর নেই। জিজ্ঞেস করেও কিছু জানা যাচ্ছে
না। ওদিকে চঞ্চলের এয়ারপোর্টে আসার কথা। কয়েক ঘণ্টা পরে চঞ্চল ফোন করল
তুই কোথায়?
এলাহাবাদ এয়ারপোর্টে বসে আছি। প্লেন লেট।
প্লেন কখন ছাড়বে?
কে জানে?
তাহলে এক কাজ করি, আমি বাসায় চলে যাই। তুই এয়ারপোর্টে এসে একটা ক্যাব ভাড়া করে চলে
আসিস। ওসব অফিসিয়াল, তাই ঝামেলার সম্ভাবনা নেই। আবারও তোকে অ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি।
ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। পৌঁছে যাবে। সমস্যা হলে ফোন করব।
শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ল। দুপুরের পরে আমি পৌঁছুলাম ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।
সেখান থেকে একটা ক্যাব নিয়ে চলে গেলাম চঞ্চলের ওখানে। ও নীচে অপেক্ষা করছিল। অনেক দিন
পরে দেখা হল চঞ্চলের সাথে। ও আমাদের ব্যাচের। আমার মত ওর সোভিয়েত জীবন শুরু ১৯৮৩ সালে।
প্রিপারেটরি করেছে ক্রাস্নাদারে আর মূল পড়াশুনা খারকভে। মস্কো এলে রানার ওখানে উঠত। রানা
ছিল কোলকাতার ছেলে। বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছেলে এই তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়। তাই প্রথম দিকে
ইয়ারমেটরা ওকে একটু অন্য চোখে দেখত। পাভ্লবস্কায়ায় আমি আর রানা এক রুমে থাকতাম। তাই
পরিচয়টা বেশ গাড় ছিল। পরে আমরা যখন মিকলুখো মাকলায়া চলে যাই রানা আস্তানা গাড়ে এক তলায়
আর আমি পাঁচ তলায়। চঞ্চল মস্কো এলে দেখা করত। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দরাজ গলার গান শুনে
পেতাম চঞ্চলের আগমনী বার্তা। পাব্লভস্কায়া থাকার সময় প্রায়ই বিশ্বরূপ, রানা, পার্থ আর আমি
আমর ঘরের সামনে টেবিল টেনিসের কোর্টের ওখানে আড্ডা দিতাম। গীটার বাজিয়ে গান গাইতাম সবাই
মিলে। তবে চঞ্চলকে সেই আড্ডায় আমার মনে পড়ছে না যদিও চঞ্চলের ভাষ্য অনুযায়ী ও
পাভ্লভস্কায়া এসেছে, আমার রুমে রাত কাটিয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে এখন আমাদের বন্ধুত্বের
ঘনত্ব আরও বেড়ে যায়। চঞ্চল এখন ভারতের বিখ্যাত ভেটেরিনার। দিল্লীতে অনেক দিন। গত
কয়েকদিনের পথের ধকল, তার উপর অনেক দিন পরে দেখা, তাই ঠিক হল ওদিনটা আমরা বাসায়
আড্ডা দিয়ে কাটাব। পরের দিন চঞ্চল আমার জন্য শহর দর্শনের ব্যবস্থা করেছে।
দিল্লি। স্বপ্নের শহর দিল্লি। যুগ যুগ ধরে এই দিল্লিকে, দিল্লির সিংহাসনকে ঘিরে কত যে যুদ্ধ
বিগ্রহ হয়েছে তার হিসেব কে রাখে? ধারণা করা হয় খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দী থেকে এখানে
জনবসতি ছিল আর খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে এখানে নিরবিচ্ছিন্ন মানুষ বসবাস করে আসছে।
অনেকের বিশ্বাস মহাভারতের পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ এখানেই অবস্থিত ছিল। জতুগৃহ
থেকে পালিয়ে পাণ্ডবরা কুন্তীর সাথে বনে বাস করতে থাকেন আর এক পর্যায়ে পাঞ্চাল রাজকন্যা
দ্রৌপদীকে বিয়ে করেন। এরপর তাঁরা হস্তিনাপুর ফিরে এলে কৌরবেরা তাঁদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে
দিতে অস্বীকার করেন। তখন তাঁরা খাণ্ডব নামে এক বিশাল বন পুড়িয়ে সেখানে ইন্দ্রপ্রস্থ নগর
তৈরি করেন। ময়দানব তৈরি করে রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদের স্থাপত্যশৈলী দেবরাজ ইন্দ্রের
প্রাসাদকেও হার মানায়। এখানেই শ্বেতপাথরের তৈরি উঠান দুর্যোধন সরোবর বলে ভ্রম করলে
দ্রৌপদী হেসে ওঠেন। সেখান থেকেই শুরু হয় কুরু পাণ্ডবের নতুন শত্রুতা। এর ফল আমরা দেখতে পাই
কুরু রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ভীমের দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ আর দুঃশাসনের
রক্তপানের প্রতিজ্ঞার মধ্যে। এখানে প্রাপ্ত প্রাচীনতম স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ খৃস্টপূর্ব তৃতীয়
শতকের মৌর্য যুগের। সম্রাট অশোকের শিলালিপিও পাওয়া গেছে এখানে। বর্তমান দিল্লির দক্ষিণ
অংশে ঐতিহাসিক বিভিন্ন বড় বড় নগরীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। টোমারা বংশের আনাং পাল ৭৩৬
খৃস্টাব্দে লাল কট স্থাপন করেন। ১১৯২ সালে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে মোহাম্মদ ঘোরী
দিল্লিতে মুসলিম শাসনের শুরু করেন। এরপর একের পর এক বিভিন্ন মুসলিম সুলতান দিল্লির মসনদ
দখল করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কুতুব উদ্দীন আইবেক, ইলতুতমিস, সুলতানা রাজিয়া। ১৫২৬
সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে লোদী বংশের ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে বাবুর ভারতে মুঘল
সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। মাঝখানে বাবুর পুত্র হুমায়ূন কয়েক বছরের জন্য মসনদ হারালেও তা
অচিরেই পুনরোদ্ধার করেন। এরপর শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। আকবর, জাহাঙ্গীর,
শাহজাহান, আওরঙ্গজেব প্রায় সমগ্র ভারত দিল্লির অধীনে আনেন। এই মুঘলদের হাত থেকে ক্ষমতা
চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজ আমলে কোলকাতা হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, যদিও ১৯১১ সালে
ব্রিটিশ রাজ দিল্লিতে তাদের রাজধানী স্থানান্তরিত করে। এই সেই দিল্লী। পৃথিবীর প্রাচীনতম
শহরগুলোর অন্যতম প্রধান। এর প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে ইতিহাস।
পরের দিন সকালে চঞ্চল আমাকে পৌঁছে দিল কুতুব মিনারে। ও একটা গ্রুপের সাথে ঢুকিয়ে দিল
আমাকে। সেখানে পেয়ে গেলাম সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছে এমন এক পরিচিত বাংলাদেশীকে।
সারাদিনের শহর ভ্রমণ। কুতুব মিনার, লোটাস টেম্পল, ইন্দিরা গান্ধী মেমরিয়াল, রাজ ঘাটে মহাত্মা
গান্ধীর সমাধি, ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতির ভবন, চাঁদনী চক এসব ঘুরে শেষ হবে লাল কেল্লায়।
কুতুব মিনার। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ইটের মিনার। ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুব উদ্দীন আইবেক
১১৯৩ সালে আফগানিস্তানের জাম মিনারের অনুকরণে এই মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সাধক
খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামানুসারে এর নাম রাখা হয় কুতুব মিনার। কিন্তু তিনি শুধু এর
ভিত্তি স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী ও জামাতা সুলতান ইলতুতমিস আরও তিন স্তর
তৈরি করেন আর ১৩৬৮ সালে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলক পঞ্চম ও সর্বশেষ স্তর নির্মাণ
করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে এসব স্থাপত্য অনেক ভালো ভাবে সংগৃহীত। – বলল আমার নতুন সাথী কুতুব
মিনারের পাশে বিভিন্ন ভগ্নপ্রায় প্রাচীর দেখতে দেখতে।
কথাটা ঠিক আবার ঠিক নয়। আমরা কতুটুকু দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের? শুধু সেটুকু, যা দেখার
অনুমতি ছিল। এমন কী নতুন রাশিয়ায় আমরা কী খুব বেশি জায়গায় যাই? সবাই যায় ট্যুরিস্ট স্পটে।
আর সেখানে সবই ঝকঝকে তকতকে। সেটা যেকোনো দেশেই। তোমরা তো সবাই ঘোর অবিশ্বাসী ছিলে।
আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে মাঝে মধ্যে চার্চে যেতাম। না, প্রার্থনা করতে নয়। দেখতে।
ছোটবেলায় তো মায়ের সাথে বিভিন্ন তীর্থে ঘুরেছি, অনেক মন্দির দেখেছি। হিন্দু মন্দিরের সাথে
রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের অনেক মিল আছে। যেমন ধুপ ধুনো দেওয়া, মোমবাতি জ্বালানো। পাদ্রী
যখন ভরাট গলায় প্রার্থনা করেন সেটা শুনতে অনেকটা মন্ত্রের মত মনে হয়। আর আইকন। হিন্দু
মন্দিরে মূর্তি থাকে, ওদের আইকন। তবে আমাদের সব বাড়িতে মূর্তি থাকে কম, থাকে ছবি। আইকন
তো সে রকমই। ছাত্র জীবনে আমি আর আমার রুমমেট কুমার বিভিন্ন পার্বণে, যেমন ইস্টার,
ক্রিস্টমাসে যেতাম অক্টোবরস্কায়ায় ফ্রান্সের দুতাবাসের সামনে যে গির্জা আছে সেখানে। ওটা
মস্কোর কয়েকটা সক্রিয় গির্জার একটা ছিল। বুড়িরা মানে বাবুশকারা আড় চোখে তাকাতেন কিন্তু
বাধা দিতেন না। হয়তো ভাবতেন কেজিবির লোক। কিন্তু অধিকাংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিন্তু বিভিন্ন
ধরণের অয়ার হাউজ, ক্যাফে, বার ইত্যাদি হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখন তো আমি ছবি তুলতে বিভিন্ন
জায়গায় যাই। বিশেষ করে গ্রাম বা ছোট শহরে। সেখানে কত গির্জা যে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে
চিন্তা করতে পারবে না। জারের রাশিয়ায় বিভিন্ন ধরণের জনপদ ছিল। গ্রাম ছিল দু ধরণের।
দেরেভনিয়া আর সেলো। দেরেভনিয়া আকারে ছোট আর সেখানে লোক সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০০০ জন।
সেলোয় জন সংখ্যা এক হাজারের বেশি আর তার নিজস্ব গির্জা ছিল। গির্জা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
নয় বলতে পার এক ধরণের অফিস। কেননা এখানে বিয়ের ডকুমেন্টেশন হত। জন্ম মৃত্যুর সার্টিফিকেট
এখানেই দেওয়া হত। তাই রুশ সাম্রাজ্যের সেসব এলাকায় যেখানে খৃস্টানদের প্রাধান্য ছিল সেখানে
গির্জার ভূমিকা ধর্মীয় গণ্ডী ছাড়িয়ে যেত। যাহোক, তুমি বলছিলে ইতিহাস সংরক্ষণের কথা। যদি
গ্রাম এলাকায় যাও দেখবে সোভিয়েত আমলে জার রাশিয়ার ঐতিহ্য কীভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া
হয়েছে। জানি জাগোরস্ক বা সেরগিয়েভ পাসাদের কথা বলবে। কিন্তু এসব হাতে গনা, মূলত
প্রোপ্যাগান্ডার জন্য। এক সময়ের বিখ্যাত সব কেন্দ্র যেমন তরঝক, কাশিন, কালিয়াজিনের দিকে
তাকিয়ে দেখলে বুঝবে এ ব্যাপারে আমাদের ধারণা কত প্রতারণামূলক। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে
যে সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মের কোন স্থান ছিল না বাইরের এই প্রোপ্যাগান্ডা যেমন ঠিক নয় একই
ভাবে মস্কো, লেনিনগ্রাদ বা গোল্ডেন রিঙের শহরগুলো দেখে সব ঠিক ছিল বলাটাও ঠিক নয়।
পিতৃভূমির যুদ্ধে রাশান চার্চ খুব পজিটিভ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, চার্চের নামেও প্রচুর
মানুষ যুদ্ধ করতে গেছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। নতুন রাশিয়ায় অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, তবে খুব
ধীর গতিতে। যদিও গির্জার সম্পদ অনেকটাই তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে পুরনো গির্জার
রিকনস্ট্রাকশন তত দ্রুত হচ্ছে না। তার মূল কারণ সেলোগুলো প্রায় জনশূন্য। লোকজন আজকাল
চার্চে গেলেও বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় এদেশের মাত্র ২% থেকে ৪% মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে।
কুতুব মিনার দেখা শেষ করে আমরা গেলাম লোটাস টেম্পলে। এটা বাহাই সম্প্রদায়ের উপাসনালয়।
বাহাউল্লাহ জন্ম নেন ইরানে। তিনি বাহাই ধর্ম নামে এক ধর্ম প্রচার করেন। এখনও পর্যন্ত উত্তর
আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, উগান্ডা, জার্মানি, পানামা, সামোয়া ও ইন্ডিয়া – এই সাত জায়গায় সাতটি
বাহাই টেম্পল আছে, অষ্টমটি তৈরি হচ্ছে চিলিতে। অপূর্ব স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি এসব মন্দিরগুলো
পৃথিবীর নতুন আশ্চর্য আর একই সাথে দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠছে। দিল্লির মন্দির পদ্মের আকারে
তৈরি বিধায় এটা লোটাস টেম্পল নামে পরিচিত। আমি বাহাউল্লাহ সম্পর্কে প্রথম শুনি ১৯৯০ সালে
তুরস্ক যাওয়ার পথে। গিয়েছিলাম ট্রেনে। তিন দিনের জার্নি। ট্রেনেই পরিচয় জন নামে এক
অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোকের সাথে। তিনি বাহাই সম্প্রদায়ের। বাহাউল্লাহ সম্পর্কে অনেক গল্প
করেছিলেন আর বেশ কিছু বই দিয়েছিলেন। সেই দীর্ঘ যাত্রা পথে আমার সাথী ছিল জন আর বিভূতি
ভূষণের গল্পসংগ্রহ। অপুর কোলকাতা যাত্রার কথা পড়তে পড়তে ট্রেনে বসে আমার নিজেকেই অপু
মনে হচ্ছিল। সে সময় দিল্লীর এই লোটাস টেম্পল তৈরির কথা চলছিল। এখন আমরা সেই লোটাস
টেম্পলে। আমার মনে হচ্ছিল জনের কথা। বিশাল লাইন। অনেকটা সোভিয়েত আমলে লেনিনের সমাধি
দেখার মত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গোটা এলাকা। বাগান। ঝলমলে রাস্তাঘাট। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে
পদ্মাকার এই অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য। আমাদের তেমন সময় ছিল না ঘুরে ঘুরে সব দেখার। তবে যেটুকু
দেখলাম তাতেই মন ভরে গেল। আসলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দূষণ মুক্ত যে কোন জায়গাই মানুষকে
টানে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ইন্ডিয়া গেট। সেখানেও লোকের ভিড়। অনেক জিপসির আনাগোনা।
এ যে দেখতে অনেকটা মস্কোর কুতুজভস্কি প্রস্পেক্টের ট্রিউম্ফালনায়া আরকা মানে বিজয়
খিলানের মত। – আমার সাথী বলল।
তাতো বটেই। সব দেশেই বিজয়ের ব্যাপার স্যাপার এভাবেই প্রকাশ করা হয়। এখন অবশ্য মস্কোয়
ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগে ওখানে ছিল বারাদিনস্কায়া প্যানারমা। এখন সেই সাথে হয়েছে পার্ক
পাবেদি বা বিজয় পার্ক। তুমি দেখেছ মনে হয়। আমাদের ছাত্র জীবনে মহান পিতৃভূমির যুদ্ধে
অংশগ্রহণকারীরা মূলত বলশয় থিয়েটারের উল্টো দিকে কার্ল মার্ক্সের স্ট্যাচুর ওখানে বা পার্ক
কুলতুরিতে মিলিত হতেন। এখন তাদের মিলন কেন্দ্র পার্ক পাবেদি। সেখানে বিভিন্ন রকম মিউজিয়াম,
স্ট্যাচু। শুধু বিজয় দিবসেই নয়, বছরের যেকোনো সময়েই সেখানে প্রাণ ভরে ঘোরা যায়। এখনও মনে
আছে ১৯৮৩ সালে আমরা যখন মস্কো আসি, শীতের প্রারম্ভে আমাদের বাসে করে মস্কো দেখায়। ঐ
সময় আমাদের পার্ক পাবেদি নিয়ে যায়। তখন সেটার কাজ সবে শুরু হয়েছে।
এরপর আমরা গেলাম ইন্দিরা গান্ধী মেমরিয়ালে। এখানেই তিনি দেহরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারান।
সাদামাদা একটা বাড়ি। মানে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্বেও যথেষ্ট সিম্পল। জরুরী আইন
জারির কারণে ভারতে ইন্দিরা গান্ধিকে নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, তাঁর প্রতি আছে অনেক
বিদ্বেষ, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, যারা একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক,
সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বিশ্বাসী – তাদের কাছে ইন্দিরা গান্ধী
অসীম শ্রদ্ধার পাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবদানের ব্যাপকতার কাছে ভারতের রাজনীতিতে তাঁর
সমস্ত অগণতান্ত্রিক চর্চা বানের জলে খড়কুটোর মত ভেসে যায়। এখনও ঘরে ঘরে ঠিক সেভাবেই
রয়ে গেছে তাঁর ব্যবহৃত সব কিছু। সময় যেন এখানে থেমে গেছে। যে জায়গাটায় তাঁকে গুলি করা হয়েছিল
সেটা বুলেট প্রুফ কাঁচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। মস্কোয় যেমন অনির্বাণ শিখার সামনে সৈনিক দাঁড়িয়ে
থাকে এখানে ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে একজন ভারতীয় জওয়ান। উঠানে শত বর্ষের পুরনো বিশাল
বিশাল গাছ। সামনের রাস্তায়ও তাই। কোলাহল নেই। সব মৃত্যুপুরীর মত শান্ত।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল রাজ ঘাট। এখানেই অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন স্বাধীন ভারতের
আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা মহাত্মা গাঁধি। অহিংসা নীতির জন্য সারা বিশ্বে পূজিত। মারটিন লুথার কিং সহ
অনেকেই তাঁকে পথ প্রদর্শক মনে করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ায় উনি যথেষ্ট সমাদৃত।
মস্কোয় তাঁর স্ট্যাচু আছে ইউনিভার্সিটি হোটেলের সামনে। পরে রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে ইন্দিরা
গান্ধীর মূর্তি উন্মচন করা হয় আর জায়গাটির নাম রাখা হয় ইন্দিরা গান্ধী স্কয়ার। তবে An
experiment with the truth সহ গাঁধির বিভিন্ন বিভিন্ন বই পড়ে আর সে সময়ের রাজনীতির উপর
সুভাষ বোস, মৌলানা আজাদ, জহরলাল নেহরু, রামচন্দ্র গুহ, যশোবন্ত সিং সহ বিভিন্ন লেখকের বই
পড়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে এই দেবতা মাঝে মাঝে দানবের পাল্লায় পড়তেন। অনেক সময় ঠিক
আদর্শ বলব না, নিজের জেদের কাছে জিম্মি করতেন লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য। তিনি জঙ্গি ছিলেন না,
তবে অনেক সময়ই রাজনীতি আর ধর্মকে গুলিয়ে ফেলতেন। তিনি নিজেও লেভ তালস্তইয়ের প্রভাবের
কথা স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে তালস্তইয়ের “তোমার মধ্যে ঈশ্বরের রাজ্য” তাঁকে ভীষণ ভাবে
আলোড়িত করে। ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতি যদি রাজনীতির নিজস্ব গতিতে চলত, এর মধ্যে যদি ভালো
অর্থে গাঁধির ধর্মীয় প্রভাব না পড়ত, উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। মুসলিম লীগ বা
আরএসএস ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে রাজনীতি আর ধর্ম দুটোকেই পস্তাতে, এর বিপরীতে
তিনি চেয়েছেন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিকে দূষণ মুক্ত করতে। কিন্তু তিনি হেরে গেছেন। যদি
ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এদের অনুকরণে
তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাতেন তাতে মানবতার সেবা করার
তাঁর প্রচেষ্টা আরও কার্যকরী হত। রাজ ঘাটে মহাত্মা গাঁধির মেমরিয়াল অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি।
যমুনার পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ঘাটের আদি নাম পুরনো দিল্লি ঘাট বা শাহজাহানাবাদ
ঘাট। পরবর্তীতে গাঁধির মেমোরিয়ালও রাজ ঘাট নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানেই ১৯৪৮ সালের ৩০
জানুয়ারি আততায়ী নাথুরাম গডসের হাতে নিহত মহাত্মা গাঁধির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। খোলামেলা।
ঘণ্টার ধ্বনি। অনির্বাণ শিখা। জয় রাম লেখা বেদি। চারিদিকে ধর্মীয় আবহাওয়া বিরাজমান।
এরপর আমাদের নিয়ে গেল চাঁদনী চকে। দিল্লীর অন্যতম প্রধান বাজার। ট্যুরিস্টদের এখানে নিয়ে
যায় কেনাকাটি করার জন্য। কী নেই সেখানে? সারা ভারতের সব প্রদেশের জিনিসপত্র দিয়ে ভরা এ
বাজার।
দেখুন বাজার কাকে বলে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি এরকম কিছু থাকত হয়তো দেশটা ভাঙ্গত না। গুম,
ৎসুম – কত বড় বড় দোকানই না ছিল – জারের আমলে তৈরি গুমের সৌন্দর্য রাজপ্রাসাদকেও হার
মানায়, কিন্তু সামগ্রীর প্রাচুর্য ছিল না। মানুষকে আদর্শের বুলি দিয়ে খুব বেশি দিন খাওয়ান যায় না।
- টিপ্পনী কাটল আমার সাথী।
সেটা ঠিক। এজন্যেই তো পেরেস্ত্রইকা। প্রথমে তো সেটাই লক্ষ্য ছিল। খাদ্যে পণ্যে দেশকে
স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। মনে আছে গরবাচভের সময় কর্পোরেটিভের কথা? লেনিন কিন্তু নেপ করে সেটাই
করতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। তখন গরবাচভ প্রায়ই “ব্যাক টু লেনিন” বলতেন। কর্পোরেটিভ ছিল
লেনিনের সেই প্ল্যান বাস্তবায়ন করার একটা প্রচেষ্টা। তবে অর্থনীতির সাথে সাথে রাজনীতিকে
খুলে দিয়ে, দেশ শাসনে সিপিএসইউ এর একচ্ছত্র আধিপত্য উইথড্র করে তিনি আসলে প্যান্ডোরার
বাক্স খুলে দেন। রাজনৈতিক মুক্ত হাওয়া সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। শুরু হয় ক্যাওয়াস। ফলাফল –
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত – এ সব
নিঃসন্দেহে দরকার ছিল, কিন্তু এ ধরণের বিশাল কর্মকাণ্ড সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য যে ধরণের
বলিষ্ঠ ও দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন গরবাচভ তেমনটা ছিলেন না। তাঁর দুর্বল নেতৃত্বের কারণেই মাত্র
কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী একটা দেশ, মানব সমাজকে নিয়ে এক অভূতপূর্ব
এক্সপেরিমেন্ট শুধু ব্যর্থই হয় না, সারা পৃথিবীর জন্যে বয়ে আনে অভাবনীয় দুর্যোগ। ১৯১৭ সালের
মহান অক্টোবর বিপ্লব পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সেই বিল্পবের করুণ আত্মসমর্পণ
পৃথিবীকে আবার বদলে দেয় – জন্ম দেয় কিছু মনস্টারের। আজকে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি সেটা
গরবাচভের অদক্ষ ও দুর্বল নেতৃত্বের ফল।
কথা বলতে বলতে আমরা শাল, টুকিটাকি স্যুভেনির কিনে নিলাম। পড়ন্ত বিকেল। এখনও লাল কেল্লা
দেখা বাকী।
লাল কেল্লা বা রেড ফোর্ট। এই ঐতিহাসিক কেল্লা দিল্লীতে মুঘল সম্রাটদের প্রধান আবাস্থল।
সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ১৬৩৮
সালে এই কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তাজমহলের স্থপতি উস্তাদ আহমাদ লাহরি লাল
কেল্লারও স্থপতি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু
লাল কেল্লার লাহরি গেটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল কেল্লার প্রধান তোরণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এখান থেকেই
তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। আমরা যখন ট্র্যাফিক এড়িয়ে লাল কেল্লায় এলাম সূর্য পশ্চিম
দিকে হেলে পড়েছে। দুর্গের বিশালতা দেখে আমার মনে হল এর কাছে এমন কি মস্কোর ক্রেমলিন
ছোট্ট শিশু। সোভিয়েত স্থাপত্যে মনুমেন্টালিজমের প্রাধান্য সর্বত্র। কিন্তু মুঘল স্থাপত্যের কাছে
সেগুলো কিছুই নয় বলেই আমার মনে হল। কি নেই এখানে? রাজপ্রাসাদ, রঙ্গমঞ্চ, বিশাল উঠান,
উপাসনালয়! এখানেই এক বিল্ডিঙে যেন মেলা বসেছে। চাঁদনী চকের মত এখানেও বিভিন্ন স্যুভেনিরের
দোকান। আমার মনে হল কাজানের কথা। কাজান ক্রেমলিনেও এরকম অনেক দোকান আছে, যদিও
প্রাচুর্য এমন নয়।
আমাদের ট্রিপ শেষ হল সন্ধ্যে ৭ টার দিকে। আমি চঞ্চলকে ফোন করলাম। চঞ্চলের কথা মত চলে
এলাম একটা মেট্রো স্টেশনে। চঞ্চল, তৃণা আর ওদের মেয়ের সাথে আমি গেলাম সার্ক ইউনিভার্সিটি
এলাকায় আমাদের আরেক বন্ধু লেনিনগ্রাদের লিপির মেয়ে শুচিস্মিতার সাথে দেখা করতে। ও সেখানে
পড়াশুনা করে। চঞ্চলের ভাষায় শুচিস্মিতা আমাদের সোভিয়েততুত ভাগ্নি। ওর সাথে দেখা করা আর
কোথাও খাওয়া দাওয়া করা। এর মধ্যে চঞ্চল আমার আগামীকালের আগ্রা ট্রিপ কনফার্ম করেছে।
কাল খুব ভোরে রওনা হতে হবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দেওয়ার উপায় ছিল না।
ভালোবাসার শহর আগ্রা
খুব সকালে চঞ্চল আমাকে নিয়ে দাঁড়ালো পাশের রাস্তায়। সেখানে একটা অটো এসে আমাকে তুলে নিল।
এভাবেই ওরা দিল্লির বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রীদের তুলে নেয়। সবি জড় হয় একটা বড় বাসে। চঞ্চল
আমাকে বলে বিল জিজ্ঞেস করলে বলিস পশ্চিম বঙ্গ থেকে, তাহলে স্থানীয় টিকেটেই ঢুকতে পারবি
সব জায়গায়। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে দেশী ও বিদেশীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের টিকেট ছিল।
পথে একটা বিরতি ছিল ব্রেকফাস্টের জন্য।
আমাদের প্রথম স্টপেজ হল আগ্রা ফোর্ট। দেখতে অনেকটা দিল্লির লাল কেল্লার মতই। আসলে
এখান থেকেই সম্রাট শাহ্জাহান দিল্লিতে তাঁর রাজধানী সরিয়ে নেন আর তাজমহলের স্থপতি সেখানে
গড়েন লাল কেল্লা। আগ্রা দিল্লির নাম প্রায়ই এক সাথে উচ্চারিত হয় বলে আমার ধারণা ছিল শহর
দুটো সমসাময়িক। আদতে তা নয়।
আগ্রা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাক্তন রাজধানী। এখন মূলত তার খ্যাতি তাজমহলের কারণে। দিল্লির
তুলনায় যদিও শিশু, আগ্রার ইতিহাস তারপরেও প্রায় হাজার বছরের। রাজধানী দিল্লি থেকে ২০৬
কিলোমিটার দক্ষিণে এই প্রাচীন শহর আগ্রা যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। পারস্যের কবি মাসুদ সাদ
সালমানের ১১ শতকের লেখায় প্রথম আগ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। এটা ছিল গজনীর মাহমুদ কর্তৃক
রাজা জয়পালের আগ্রা দুর্গ আক্রমণের কাহিনী। এর পূর্বে আগ্রা সম্পর্কে কোন লিখিত তথ্য
পাওয়া যায় না। দিল্লিতে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক পরে ১৫০৪ সালে
দিল্লির সুলতান সিকান্দর লোদি তাঁর রাজধানী আগ্রায় স্থানান্তরিত করেন। সপ্তদশ শতকের কিছু
দলিলপত্র থেকে জানা যায় যে সিকান্দর লোদি যখন আগ্রায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তখন
সেখানে প্রাচীন জনপদের নিদর্শন থাকলেও সেটা ছিল বড়জোর একটা গ্রাম। তাই অনেক ঐতিহাসিক
সিকান্দর লোদিকেই আগ্রার প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করেন।
১৫২৬ সালে সিকান্দর লোদির পুত্র ইব্রাহিম লোদি প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের হাতে পরাজিত ও
নিহত হন। এভাবেই ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার
সাথে সাথে শুরু হয় আগ্রার স্বর্ণযুগ। সম্রাট বাবর যমুনা তীরে প্রথম পার্সি বাগান আরাম বাগের
ভিত্তি স্থাপন করেন। শের শাহ্ সুরি ১৫৪০ থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য সুরি
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও হুমায়ূন ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৫৬ সালে
দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আকবর পুনরায় আগ্রা দখল করে এর নামকরণ করেন আকবরাবাদ। এই
শহর সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহ্জাহানের রাজত্বকালে ১৫৫৬ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত
প্রায় একশ বছর ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। ১৬৪৮ সালে সম্রাট শাহ্জাহান রাজধানী দিল্লিতে
স্থানান্তরিত করার আগে পর্যন্ত আগ্রাই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান শহর। ফলে মুঘল আমলে এ
খানে বিভিন্ন নির্মাণকর্ম সাধিত হয়।
লাল কেল্লা বা আগ্রা দুর্গ তৈরি ছাড়াও সম্রাট আকবর আকবরাবাদকে শিক্ষা, শিল্প, বানিজ্য ও
ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত করেন। এ ছাড়াও আগ্রা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে ফতেহপুর
সিক্রিতে আকবর নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, তবে সেটা পরবর্তীতে পরিত্যক্ত হয়। আকবর পুত্র
প্রকৃতি প্রেমী জাহাঙ্গীর গাছপালা পছন্দ করতেন। ফলে লাল কেল্লা বা আগ্রা দুর্গের ভেতরে
বিভিন্ন বাগান গড়ে তুলেন। স্থাপত্য প্রেমী শাহ্জাহান আকবরাবাদ বা আগ্রাকে সবচেয়ে মুল্যবান
উপহার দান করেন। স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধি এই তাজমহলের কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। তবে এর
আগে ১৬৪৮ সালে শাহ্জাহান তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী শাহজাহানবাদে বা অধুনা দিল্লিতে নিয়ে যান।
কিন্তু তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব রাজধানী পুনরায় আকববাবাদে স্থানান্তরিত করেন। সে সময়
ক্ষমতাচ্যুত সম্রাট শাহ্জাহান আগ্রা দুর্গে বন্দী ছিলেন। কথিত আছে আগ্রা দুর্গে বন্দী অবস্থায়
শাহ্জাহান যমুনার অপর পাড়ে অবস্থিত তাজমহলের দিকে তাকিয়ে দিন কাটাতেন।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজন্যবর্গ দিল্লির
সম্রাটের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আগ্রা প্রায়ই এসব আক্রমণের শিকার হয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ
শতকে ভরতপুরের জাঠেরা মুঘল সাম্রাজ্যের উপর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে আকবরাবাদ দখল
করে। পরবর্তীতে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠিরা ভারতের অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
মারাঠিরা আকবরাবাদকে নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে এবং পুনরায় এর নাম রাখে আগ্রা।
পরবর্তীতে আগ্রা গোয়ালিয়র রাজ্যের অধীনে চলে যায়। আর ১৮০৩ সালে আগ্রা ব্রিটিশ ভারতের
অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৩৭-১৮৩৮ সালে আগ্রা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। সম্বত পঞ্জিকা
অনুযায়ী এটা ছিল ১৮৯৪ সাল, তাই লোক মুখে এটা চুরানব্বইএর মন্বন্তর নামে খ্যাত। এছাড়া আগ্রা
ছিল ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
আমরা আমেরিকাকে ইমিগ্র্যান্টদের দেশ বলি, কিন্তু ভারত কি কোন অংশে কম? নিজেকেই প্রশ্ন
করলাম আমি।
না, একদম না। আদিবাসী বলে একটা কথা আছে। আর সেটা প্রায় সব দেশেই আছে। এই শব্দটাই বলে
দেয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ইমিগ্র্যান্টদের হাতে তৈরি। শুধু কেউ এসেছে হাজার হাজার বছর আগে,
কেউ বা কয়েক পুরুষ আগে। তবে আমি সিওর নই আদিবাসীরা অভিবাসীদের কিভাবে দেখে – স্থপতি
হিসেবে নাকি বিনাশকারী হিসেবে। তবে সবার ক্ষেত্রেই এটা সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। আমেরিকার
আদিবাসীরা মানে রেড ইন্ডিয়ানরা সে দেশের সবচেয়ে অবহেলিত, নির্যাতিত জাতি। এমন কী তারা
ভোটাধিকার পেয়েছে মাত্র বছর পঞ্চাশেক আগে। ইউরোপিয়ানরা এখানে এসে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে
নির্মম ভাবে ধ্বংস করে। যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাদের পাঠায় রিজার্ভ এরিয়ায়। এটা স্তালিনের
গুলাগের চেয়ে কম কিছু ছিল বলে মনে হয় না। স্প্যানিয়ার্ডরা একই ভাবে শুরু করলেও এক সময়ে এসে
স্থানীয় জনগণের সাথে মিশে যায়। যার ফলে ল্যাটিন আমেরিকায় এসব জাতি ধ্বংস হয়ে যায়নি।
রাশিয়ায় এটা ঘটে একেবারে ভিন্ন ভাবে। রাশিয়ার জারেরা সাইবেরিয়ার ব্যাপারে কখনই তেমন আগ্রহী
ছিলেন না। এরমাকের মত কিছু দলছুট সেনাপতি একরকম বিনা যুদ্ধে এসমস্ত এলাকার জনগণকে বশ
মানায় আর জারকে রাজী করায় এসব এলাকা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করতে। যার ফলে কী জার আমল,
কী সোভিয়েত আমল, কী নতুন রাশিয়ায় আমরা দেখি এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
এসব ক্ষুদ্র জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা – ইত্যাদি টিকিয়ে রাখতে মস্কো সব আমলেই সচেষ্ট
ছিল। এখনও আছে। আসলে এটা ভালো বা মন্দের ব্যাপার নয়। এটা মনে হয় জেনেটিক্যাল কোড।
ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডেও কিন্তু একই ভাবে স্থানীয় জনগণকে নিশ্চিহ্ন করেছে
আবার ইন্ডিয়া বা আফ্রিকায় সেটা করেনি বা করতে পারেনি, যদিও দু জায়গা থেকেই অসংখ্য মানুষকে
দাস হিসেবে নিয়ে কাজ করিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায়। এর ফলে আমেরিকায় যেমন দেখা যাবে
আফ্রো-আমেরিকানদের, ক্যারিবিয়ায় তেমনি ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের। কিন্তু যদি ঘড়ির কাঁটা আরও
পেছন দিকে ঘোরাই চলে যাব সেই প্রাক-আর্য ভারতে, হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার যুগে। দেখব
ভারতের দিকে দিকে শুধুই দ্রাবিড় আর আদিবাসীদের রাজ্যত্ব। রামায়ণ, মহাভারতে যেসব রাক্ষস,
বানর, ভালুক (সুগ্রীব দোসর জাম্বুবান) ইত্যাদির কথা বলা হয় অনেকের মতে এরা আসলে স্থানীয়
জাতি উপজাতির মানুষ। এরপর এক সময় আর্যরা ভারত দখল করবে। দ্রাবিড়রা চলে যাবে দক্ষিণ
ভারতে। আর শত শত ক্ষুদ্র জাতি উপজাতি যারা এক সময় ছিল এ ভূমির একচ্ছত্র অধিকারী তারা
হয়ে যাচ্ছে অধিকারবিহীন উপজাতি বা আদিবাসী। হ্যাঁ, আমরা আমাদের দেশ গড়েছি, গড়ছি। কিন্তু
সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমাসহ শত শত উপজাতির কাছে আমরা হানাদার বই কিছু নই।
কিন্তু মুসলিম রাজন্যবর্গও তো ভারতবর্ষের জন্য অনেক কিছুই করে গেছেন। সেটাও তো অস্বীকার
করার উপায় নেই। – বলল আমার সাথী।
অস্বীকার তো কেউ করছে না। ইংরেজ আমলে কোলকাতা, মুম্বাই আর চেন্নাইয়ের মত শহর গড়ে উঠে
ছে, রেল লাইন, রাস্তাঘাট কত কিছুই তো তৈরি হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম আক্রমণ হয় ৬৩৬
সালে, মুম্বাইএর কাছে। এরপরে বিভিন্ন ভাবে আরব দেশ থেকে লোকজন ভারতে আসে ইসলামের
বার্তা নিয়ে। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে এমন কি ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পূর্বেও আরবের
সাথে ভারতের যোগাযোগ ছিল। আরব বনিকরাই ছিল ভারত ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্যরূপী
চিঠিপত্র আদান প্রদানের অন্যতম কবুতর। তবে প্রথম দিকে ভারতে ইসলামের প্রচার
হয় মূলত ধর্ম প্রচারকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এরপর বিভিন্ন সময় ভারতের উপর আক্রমণ
আসে। ১০০১ সালে গজনীর সুলতান মাহমুদ গান্ধাররাজ (বর্তমানে আফগানিস্তানের কান্দাহার)
জয়পালকে পেশোয়ারের যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই রাজা জয়পালের সাথে সুলতান মাহমুদের যুদ্ধ হয়
আগ্রা দুর্গের দখল নিয়েও। দশম শতকের শেষ দিকে গজনীর সুলতান বার বার ভারত আক্রমণ করে
ব্যাপক হারে লুটতরাজ চালায়। এসময় উত্তর ভারতে বিশেষ করে আধুনিক আফগানিস্তান ও
পাকিস্তানে একাধিক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। বিভিন্ন মুসলিম রাজন্যবর্গ নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের
জন্য একে অন্যের সাথে এসব যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১১৯১ সালে শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরি আজমীরের
তৃতীয় পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত হন। পরবর্তী বছর তিনি পুনরায়
তরাইনে সৈন্য সমাবেশ করেন। এবার তিনি জয়ী হয়ে পৃথ্বীরাজকে হত্যা করেন। লাহোরসহ উত্তর
ভারতের অনেকটা এলাকা নিজের রাজ্যভুক্ত করলেও তিনি গজনী ফিরে যান। ১২০৬ সালে শাহাবুদ্দিন
মোহাম্মদ ঘোড়ি নিহত হলে তাঁর সবচেয়ে দক্ষ সেনাপতি কুতুব-উদ্দীন আইবেক ভারতীয় প্রদেশসমুহে
নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন। তবে এর আগে
১২০১ সালে বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করেন। তাই অনেকের মতে ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে
মুসলিম শাসন শুরু হয়
১২০১ সাল থেকে। দিল্লির সুলতান, বিশেষ করে মুঘল আমলে ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি
বিস্তার লাভ করে। মুসলিম বিশেষ করে মুঘল সম্রাটরা ছিলেন সমরখন্দের। পিতার দিক থেকে তারা
ছিলেন চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি, মায়ের দিক থেকে তৈমুর লং-এর। তবে নিজেরা তুর্ক (এটা তুর্কি বা
অধুনা তুরস্কের অধিবাসী নয়, উজবেকিস্তান,
তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান – মানে সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায়
বসবাসকারী যাযাবর জাতি) বংশোদ্ভূত হলেও মনে প্রাণে চেষ্টা করেছেন ভারতীয় হতে। উল্লেখ করা
যেতে পারে রুশ দেশের জারেরা যেমন জার্মানির প্রিন্সেসদের রানী করতেন, মুঘল শাসকেরাও ঠিক
তেমনি করে রাজপুত রমণীদের রানী করতেন। ঠিক জানি না ইংরেজদের প্ররোচনায় কি না, এক সময়
মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত বোধ করতে শুরু করে। মুসলিম লীগ
মুঘলদের ঐতিহ্য নিজেদের বলে মনে করলেও নিজেদের ভারতীয় বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।
এখনও কী পাকিস্তান, কী বাংলাদেশ হতে পারে ভারতেরও মুসলমানদের একটা বিশাল অংশ তাদের
ভারতীয় অতীতকে অস্বীকার করে নিজেদের আরবদের উত্তরসূরি বলে মনে করে। আমাদের দেশের
অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার নিজেদের পূর্বপুরুষদের এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা বলে পরিচয় দিতে
লজ্জিত হয়। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে আরব ভূমি থেকে বিভিন্ন ভাবে আগত লোকজনদের নিজেদের
পূর্বসূরি ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আমার মনে হয় এটা এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ
ট্র্যাজেডি। যদিও প্রশ্ন করতেই পার হিন্দু বা বৌদ্ধরা নিজেদের আর্যদের উত্তরসূরি ভাবতে পারলে
মুসলিমদের আরবদের উত্তরসূরি ভাবলে দোষের কী আছে? ব্যাপারটা দোষ বা গুনের নয়। প্রাচীন কাল
থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতির আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাদের
একটা বিরাট অংশ এখানে রয়ে গেছে। গ্রীক আর ইংরেজদের বাদ দিলে এরা সবাই স্থানীয় জনগণের
সাথে মিশে নিজেদের ভারতীয় ভাবতে শুরু করেছে। ইউরোপ আমেরিকায় এখনও এ এলাকার মানুষকে
ভারতীয় বলেই উল্লেখ করা হয়, যদিও ভারতীয় বলতে তারা উপমহাদেশের কথাই বোঝায়। নিজেদের
ভারতীয় ভাবার অর্থ এই নয় যে আমাদের দেশকে ভারতের অংশ হতে হবে, কথা হচ্ছে এই ভাবনার
মধ্য দিয়ে আমরা নিজেরা হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ হতে পারি। কই, আমরা তো
ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক বলতে দ্বিধা করি না, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলতে দ্বিধা করি না।
দক্ষিণ ভারতে তুলনামূলক ভাবে কম, তবে উত্তর ভারতের তথা বাংলার সংস্কৃতি, স্থাপত্য এসবই
প্রাচীন ভারতীয়, আরব্য, পারস্য – এসবের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। একটাকে বাদ দিয়ে তুমি অন্যটা
নিতে পার না। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর একটাই – ওই সময়ের মুসলিম শাসকেরা নিজেদের ভারতীয়
মনে করতেন আর এই মনোভাব নিয়েই এদেশের সবকিছুকে নিজেদের মত করে গড়ে তুলেছিলেন আরবি
আর পারসিক উপাদান মিশিয়ে। সেটা খাবার বল, মিউজিক বল আর স্থাপত্যই বল। তাছাড়া সেসব রাজা
বাদশাহরা আরব বা পারস্য থেকে নিয়ে আসা শিল্পকলাকে ইসলামি শিল্পকলা না ভেবে আরব্য বা
পারসিক বলেই মনে করতেন। আরবে বা পারস্যে ইসলাম আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই উন্নত
স্থাপত্য শিল্প ছিল। মিশর, সিরিয়া বা অধুনালুপ্ত ব্যাবিলনের সভ্যতা সে কথাই বলে। হ্যাঁ, দরবারের
ভাষা ছিল ফার্সি, তবে মনে রাখা দরকার প্রথম দিকের মুসলিম শাসকেরা হিজরি পঞ্জিকা ব্যবহার
করলেও সম্রাট আকবর নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন যেটাকে আমরা বর্তমানে বাংলা পঞ্জিকা হিসেবে
ব্যবহার করি। ওনার অভিষেক হয়েছিল ৯০০ হিজরি সালে। এ পর্যন্ত দুটো পঞ্জিকাই হাতে হাত রেখে
চলে আর এর পর থেকে তাদের পথ বেঁকে যায়। হিজরি পঞ্জিকা আগের মতই চাঁদের সাথে পথ চলে আর
বাংলা পঞ্জিকা সূর্যের সাথী হয়। এর কারণ ছিল অর্থনৈতিক। আমার বিশ্বাস আরবে কৃষিকাজ হয় না
বলে সৌর পঞ্জিকার প্রয়োজন সেখানে ততোটা ছিল না, বরং ব্যবসায়ীদের কাফেলা রাতের বেলা এক
জনপদ থেকে অন্য জনপদে যাতে নির্বিঘ্নে যেতে পারে সে জন্যে চাঁদের গুরত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু
ভারত ছিল কৃষি নির্ভর, আর জানই তো কৃষিকার্যের জন্যে সূর্য অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর। এই
সূর্যের অবস্থানের উপর নির্ভর করে শস্যের চাষাবাদ, নির্ভর করে রাজকোষের খাজনা। তাই সম্রাট
আকবরকে সৌর পঞ্জিকা করতে হয়েছিল। অর্থনৈতিক কারণে হলেও মুসলিম রাজন্যবর্গকে ভারতীয়
অনেক রীতিনীতি মেনে নিতে হয়েছিল। তাই আমি অবদান না বলে বলব মানিয়ে নেওয়া আর পরস্পরকে
ঋদ্ধ করা। মনে আছে ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম বাংলা ভাষার বিকাশে মুসলিম সুলতানদের বিশেষ করে
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্এর অবদানের কথা? কিন্তু এখন দেশে অনেকেই সেটা ভুলে গিয়ে বাংলা ভাষা,
বাংলা সংস্কৃতিতে শুধুই হিন্দুয়ানী দেখে।
এভাবে কথা বলতে বলতে আমরা হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম আগ্রা দুর্গের মিউজিয়াম যেখানে সাজিয়ে
রাখা আছে সে আমলের পোশাক আশাক, অস্ত্রশস্ত্র। ছিল আর্ট। হঠাৎ আমার সাথী বলে উঠলো
দেখুন দেখুন, যমুনার ওপারে তাজমহল দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ, এই সেই তাজমহল। আমার মনে পড়বে ছোটবেলায় শোবার ঘরে তাজমহলের ছবির কথা।
তাজমহলসহ বিভিন্ন ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল দেওয়ালে। আমি মোটা কাগজে সেগুলো আঠা দিয়ে লাগিয়ে
দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। আগ্রা দুর্গ আর তাজমহলের মাঝে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী। এখন অবশ্য
অনেকটা শুকিয়ে গেছে। শীতকাল বলে, নাকি দেশের নদীগুলোর মত যমুনাও আজ দৈন্য অবস্থায় ভুগছে
কে জানে? তবে এলাহাবাদে তাকে এত অভাবী মনে হয়নি। নদীর এ পাড়ে বিশাল চর। সেখানে গরু আর
মহিষ চড়ে বেড়াচ্ছে। সম্রাট শাহজাহান দেখলে নিশ্চয়ই কষ্ট পেতেন। দু একটা হাঁস সাঁতার কাটছে
যনুমার জলে। «ওগো নীল যমুনার জল» কথাটা এখানে বড়ই বেমানান মনে হচ্ছে। সকালের রোদে ঝলমল
করছে তাজমহলের মিনারগুলো।
জান, এখানে বসেই নাকি গৃহবন্দী সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের দিকে তাকিয়ে জীবনের শেষ বছরগুলো
কাটিয়ে দিয়েছিলেন। বাদশাহী আমলে এখানে তো দূরের কথা, দুর্গের আশেপাশে আসার কথা চিন্তা
করতে পারতে না।
আগ্রা ফোর্ট অনেকটা দিল্লির লাল কেল্লার মতই দেখতে। মনে হয় উস্তাদ আহমাদ লাহোরি আগ্রা
ফোর্টের অনুকরণেই লাল কেল্লা তৈরি করেছিলেন। লাল রঙের বলে আগ্রা ফোর্টকেও লাল কেল্লা
বলা হত। বিশাল চত্বরের উপর তৈরি এটা দুর্গ তো নয় ছোট খাটো একটা শহর। জলসা ঘর বা নাট্য
মঞ্চ। সেখানে কী একটা অনুষ্ঠান মত হচ্ছিল। মাঠ, মসজিদ আর বিভিন্ন মহল। রং বেরঙের মানুষ
এদিক সেদিক ঘুরছে। সারা বিশ্বের লোক যেন মিশে গেছে এই আগ্রায়। আজ আমাদের বিশাল
প্রোগ্রাম। ফতেহপুর সিক্রি ছিল না বলে আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ, তবে সেটা থাকলে কোন কিছু ভালো
ভাবে দেখা হত না বলেই মনে হয়। এখান থেকে আমরা যাব পাশেই কোথাও লাঞ্চ করতে। এরপর কয়েক
ঘণ্টা তাজমহলে। সেদিন পূর্ণিমা রাত। কী লোভই না হচ্ছিল পূর্ণিমা রাতে তাজমহল দেখতে! তবে সে
সুযোগ নেই। এরপর আমরা যাবে মথুরা আর বৃন্দাবন। যতদূর মনে হয় আমাদের সাথীরা ট্যুরিস্ট কাম
তীর্থযাত্রী। তাই এই ব্যবস্থা। আগ্রার দুর্গ থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম একটা মার্কেটে। সেখানে
স্যুভেনির জাতীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা আর খাওয়া দাওয়া। দেখে মনে হয় ট্র্যাভেল কোম্পানিগুলো
আগে থেকেই এদের সাথে কথা বলে রাখে, আর ওভাবেই নিয়ে যায় যাতে যতদূর সম্ভব অল্প সময়ে
খাবারের কাজটা সারা যায়।
তাজমহল
তাজমহলের গেটে আমরা প্রথম বারের মত কড়া চেকিং-এর সম্মুখীন হলাম। সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের
ফলে এখন সব জায়গায়ই বেশ কড়াকড়ি। তবে এখনও পর্যন্ত এয়ারপোর্টের বাইরে আমরা তেমন কোন
চেকিং-এর মুখোমুখি হইনি। তাজমহলে অবশ্য অন্য ব্যাপার। চেক পোস্টের পরে অনেকটা হেঁটে যেতে
হল আরেকটা গেটের সামনে। দেখে মনে হয় তাজমহলে ঢোকার তোরণ। অনেকটা বিভিন্ন দেশে বিজয়
তোরণের মত। ওখান থেকে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে তাজমহল। সামনে একের পর এক ফোয়ারা, তাদের
দুই ধারে রাস্তা। অনেকটা সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে যেমন। তবে এ এক অন্তহীন পথ। লাল কেল্লায়
ঢুকে যেমন এখানেও তেমনি মনে হল মুঘল স্থাপত্যের বিশালতার কথা। মনে পড়ল মস্কো আর সাঙ্কত
পিতেরবুরগের ক্রেমলিন আর শীত প্রাসাদের কথা। কিন্তু লাল কেল্লা, আগ্রা দুর্গ বা তাজমহলের
কাছে সব যেন ম্লান হয়ে যায়। যদিও মস্কোর ক্রেমলিনের সাথে রেড স্কয়ার, গুম এসব যোগ করলে
অথবা সাঙ্কত পিটারবুরগের শীত প্রাসাদের সাথে দ্ভরৎসোভায়া প্লোসাদ মানে প্যালেস স্কয়ার
যোগ করলে অনেকটা এ রকমই হবে। তবে আমার মনে হয় দিল্লির বা আগ্রার লাল কেল্লা বা
তাজমহলের টোটাল কমপ্লেক্সের সাথে তুলনা করা যায় পিতারগফকে। আমি মনে মনে তাজমহলের
একটা ছবি এঁকেছিলাম সেই ছোটবেলাতেই, কিন্তু এটা যে এত বিশাল সেটা কল্পনা করতে পারিনি।
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি তো তাজমহল এমনি এমনিই হয়নি! বিভিন্ন দেশে আমি এরচেয়ে উঁচু,
এরচেয়ে বড় স্থাপত্য দেখেছি, কিন্তু তাজমহলকে কোন কিছুর সাথেই তুলনা করা যায় না, সে
অতুলনীয়, অন্য এক গাম্ভীর্যে ভরপুর। এখানেও বিশাল লাইন। আমার মনে পড়ল সোভিয়েত আমলে
লেনিনের মাউসিলিয়ামের দীর্ঘ কিউয়ের কথা যেখানে শীত নেই গ্রীষ্ম নেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে
দাঁড়িয়ে থাকত লোকজন লেনিনকে একটু দেখার জন্য। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে আমরা উঠলাম
তাজমহলের বেদিতে। অন্যদের বলে লাইনে জায়গা রেখে বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তুললাম তাজমহলের
মিনারগুলোর, ছবি তুললাম যমুনা নদীর। তবে ভেতরটা আমাকে ততটা নাড়া দিল না যতটা দিয়েছিল
মস্কোর রেড স্কয়ারে শায়িত লেনিন। হয়তো রাজনৈতিক সিম্প্যাথি তখন লেনিনের পক্ষে ছিল বলে।
এখানেও বিরাজ করছে পিন পতন নীরবতা। সবাই নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে মমতাজ বেগমের কবরের পাশ
দিয়ে।
বাইরে এসে আমরা আর নিজেদের গ্রুপের কাউকে খুঁজে পেলাম না, আসলে আমাদের গ্রুপের কথা মনেই
ছিল না। মনের আনন্দে শেষবারের মত দেখছিলাম অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঝলমলে তাজমহল। এমন
সময় দিল্লি থেকে ফোন এলো বন্ধু চঞ্চলের।
তোরা কোথায়?
কেন, তাজমহলের ওখানে। অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি।
তোদের জন্য গাড়ি ছাড়তে পারছে না। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গেটে চলে যা।
নইলে দিল্লি ফেরা আর হবে না।
অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠিক কোন দিকে যেতে হবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ দেখি দূরে
আমাদের গ্রুপের আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। পা চালিয়ের হাঁটলাম আমরা। গাড়ির ড্রাইভার বা
হেল্পারের কাছে আমার নম্বর ছিল না। চঞ্চল টিকেট কেটেছিল আর নিজের নম্বরটাই দিয়েছিল। তাই
ওরা ওকেই ফোন করে। যাহোক শেষ পর্যন্ত আমরা গাড়িতে এসে বসলাম। যাত্রা শুরু হল মথুরা আর
বৃন্দাবনের পথে।
মথুরা
মথুরার কথা আমি রামায়ণ আর মহাভারতেই পড়েছি। কথিত আছে ইক্ষাকু বংশের রাজকুমার রাম
লক্ষণের ভাই শত্রুঘ্ন এখানে লবনাসুর নামে এক রাক্ষসকে হত্যা করে এলাকাটি দখল করেন। ঘন
অরণ্যের কারণে এর নাম ছিল মধুবন। পরবর্তীতে প্রথমে এর নাম হয় মধুপুর আর এই মধুপুর থেকেই
কালক্রমে তা মাথুরা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মহাভারতের যুগে মথুরা ছিল কংসের রাজধানী। বোন
যশোদার পুত্রের হাতে নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী শুনে মথুরারাজ কংশ তাঁকে কারাবন্দী করেন।
কংসের কারাগারেই এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। সেদিক থেকে মথুরা নিয়ে হিন্দুদের
আবেগ রাম জন্মভূমি অযোধ্যার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মথুরা ছিল
সুরসেন বংশের রাজধানী। পরবর্তীতে মথুরা মৌর্যদের অধীনে চলে যায়। ধারণা করা হয় এক সময়
মথুরা ভারতীয় গ্রীকদের অধীনে ছিল। পরবর্তীতে মথুরা কুশানরাজ কনিষ্কের অধীনস্থ হয়। ১০১৮
সালে গজনীর মাহমুদ মথুরা আক্রমণ করে অনেক মন্দির ধ্বংস করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে
দিল্লির সুলতান সিকান্দর লোদি মথুরা আক্রমণ করেন। মুঘল সম্রাট আরঙ্গজেব এখানে শাহী
ইদগাহ মসজিদ তৈরি করেন এবং মথুরার নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। মথুরাকে ব্রজভুমির হৃদয়
বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়া মথুরা ও বৃন্দাবন শহর দুটোকে যমজ শহরও বলা হয়।
মথুরার পথে যাত্রা শুরু করে আমি ফোন করল কলিগ অনিরুদ্ধকে। ও মথুরায় একটা কলেজে আছে। তবে
অনিরুদ্ধ ছিল না, কোথাও এক বিয়েতে গিয়েছিল। পথে আমরা পড়লাম ট্র্যাফিক জ্যামে। আসলে
সন্ধ্যার পর পর যেকোনো শহর থেকে বেরুনো বা শহরে ঢোকা খুবই সমস্যার। বিশেষ করে মথুরা আর
বৃন্দাবন ছিল আগ্রা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে। অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে আমরা যখন মথুরা এলাম বেশ
রাত হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আমরা এলাম এক বিশাল মন্দিরের সামনে। আমার ধারণা
দিনের বেলায় এলে আমি এর বিশালত্ব দেখে নতুন করে অবাক হতাম। মন্দির তো নয়, এক অবরুদ্ধ
দুর্গ। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাজমহল তো দূরের কথা দেশ বিদেশের এয়ারপোর্টের চেকিং-কে হার
মানায়। এমন কি মস্কোর ক্রেমলিনে ঢুকতে এত তাল্লাসীর সম্মুখীন হতে হয় না। সাথের ছোট বড়
সমস্ত ব্যাগপত্র তো স্ক্যানিং করেই, মানুষকে বিভিন্ন ভাবে চেক করে। ভগবান যে ভক্তদের এত
ভয় পায় আমার সেটা জানা ছিল না। অনেক সময় বিভিন্ন তারকারা ভক্তদের মানে ফ্যানদের হাত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত দেহরক্ষী রাখে। কে জানে কলিযুগে ভগবানও তারকাদের অনুকরণে
এসব করেন কি না। তবে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা আজকাল যে ভাবে পরস্পরকে আক্রমণ করে
তাতে শুধু ফ্যান নয়, প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপার আছে। তাছাড়া ভক্তদের
নিরাপত্তার ব্যাপারটাও অগ্রাহ্য করা যায় না। এক কথায় উপাসনালয়গুলো আজকাল শুধু শান্তির নীড়
নয় যুদ্ধের ময়দানও। দেখে মনে হল মন্দিরটা ইদানীং তৈরি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভেতরে ঢুকেই জুতা
রাখার সুন্দর ব্যবস্থা, অনেকটা রেলওয়ে স্টেশনে লাগেজ রাখার মত। বোঝাই যাচ্ছে কৃষ্ণের
ভক্তদের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার মতই দিনকে দিন বেড়েই চলছে। মন্দির তো নয়, বিশাল থিয়েটার।
বহুতল। অন্যান্য মন্দির যেখানে প্রাচীন কালের স্থাপত্য দিয়ে দর্শকদের অবাক করে মথুরা মন্দির
মানুষকে আকর্ষণ করে আধুনিকতায়। ঠিক যেমনটা করেছিল দিল্লির লোটাস টেম্পল। অল্প সময়ের
মধ্যে বিভিন্ন তলায় ঘুরাঘুরি করে আমরা এসব দেখলাম। ছবি তুলতে পারছি না বলে মনে একটা
অতৃপ্তি রয়েই গেল। তাছাড়া কোথাও যাওয়া মানে তো সেখানকার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান দেখা নয়,
সেখানকার লোকজন দেখা, একটু হলেও জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হওয়া। কিন্তু শুধু কোন রকমে এই
মন্দির দেখার মধ্য দিয়েই ওদের মথুরা ভ্রমণ শেষ হল।
বৃন্দাবন
মথুরা থেকে আমরা রওনা হলাম বৃন্দাবনের পথে। বৃন্দাবন মথুরা জেলার ব্রজভূমিতে অবস্থিত।
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের একটা বিরাট অংশ এখানে কেটেছে বলে ধারণা করা হয়। এটা বৈষ্ণবদের
সবচেয়ে পবিত্র ভূমি। বৃন্দাবনের কথা রামায়ণ বা মহাভারতে পড়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। দেশে
নারায়ন সাহার বাড়িতে কৃষ্ণলীলা হত, সেখানে রাধা-কৃষ্ণ আর চৈতন্য দেবের উপর বিভিন্ন কীর্তনের
পালা হত। সেসব পালাতেই আমি বৃন্দাবনের কথা জানতে পারি। এই বৃন্দাবনেই রাধার সাথে কৃষ্ণের
প্রেম। সাধারণ মানুষ প্রেম করে, অবতারেরা করেন লীলা। সেই থেকেই কৃষ্ণের প্রেম হল কৃষ্ণলীলা।
তাছাড়া আমার বাবার নাম বৃন্দাবন। তাই মা বৃন্দাবনকে বলতেন বড় তীর্থ। ছোটবেলায় মনে হত এটা
হিন্দুদের প্রধান তীর্থ বলে। বড় হয়ে বুঝেছি সেটা আসলে মা বাবার নাম নিতেন না বলে। তাই কখনও
এদিকে না এলেও জায়গাগুলো আমার অজ্ঞাত ছিল না। বৃন্দাবনের পথে আমরা আবার পড়লাম বিশাল
ট্র্যাফিক জ্যামে। ঘণ্টা দুই তো হবেই। শেষ পর্যন্ত যখন এসে পৌঁছুলাম রাত জেঁকে বসেছে। অনেকটা
অনিচ্ছা সত্বেও অন্যদের সাথে গেলাম। এখানে কোন মন্দির আছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। কোন এক
গলির ভেতর দিয়ে আমরা এসে হাজির হলাম একটা বিশাল ঘরে। দক্ষিণ ভারতে আমি অনায়াসে জুতো
খুলে মন্দিরে ঢুকেছি। এখানে সেই পরিষ্কার পরিচ্ছনতা আর নেই। এক ধরণের অস্বস্তি নিয়ে আমি
ঢুকলাম সেখানে। তবে সেখানে দেখলাম একেবারেই ভিন্ন জিনিস। ঘরে বলতে গেলে কোন মূর্তি নেই,
দেওয়ালগুলো ছোট ছোট শ্বেত পাথরের প্লেট দিয়ে ভরা, অনেকটা নেম প্লেটের মত। সেখানে বিভিন্ন
ভাষায় বিভিন্ন কিছু লেখা। এক সময় আমার চোখে পড়ল বাংলায় লেখা প্লেট। সেখানে কেউ বাবা মার
জন্য স্বর্গ কামনা করেছে। আমার চোখে পড়ল নিজের এলাকা মানিকগঞ্জের কার লেখা একটা প্লেট।
এরপর খুঁজতে শুরু করলাম পরিচিত কোন নাম আছে কি না। পেয়েও গেলাম পরিচিত এক লোকের নাম
লেখা প্লেট। বুঝলাম গয়ায় মৃতদের উদ্দেশ্যে পিন্ডিদানের মতই এখানেও লোকজন আসে মৃত আত্মীয়
স্বজনের শান্তি কামনা করতে। অন্তত ঐ মন্দিরে সবকিছু দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছে। বৃন্দাবনে
আমাদের আর কোন জায়গায় নেওয়া হয়নি। তাছাড়া আমি কোথাও যাই মূলত ছবি তুলতে, রাতে যেহেতু
সেই সুযোগ নেই – আমার আর আগ্রহও তেমন ছিল না। পরে অবশ্য দেখেছি দুটো শহরেই বেশ কিছু
সুন্দর সুন্দর মন্দির আছে। আছে দেখার মত স্থাপত্য। এ জন্যে হলেও আবার কখনও এসব জায়গা
ভ্রমণ করার ইচ্ছে আছে আমার। বৃন্দাবন থেকে বেরুতে বেরুতে রাত প্রায় বারোটা। চঞ্চলকে ফোন
করে জানিয়ে দিলাম। দিল্লি ফিরতে আরও ঘন্টা দুয়েক।
চঞ্চল রাস্তা থেকে আমাকে নিয়ে গেল। পরের দিন সোমবার। ও চলে গেল অফিসে। আমি জামিয়া
ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স সেন্টারে। আমি চাইছিলাম ট্যাক্সিতে যেতে।
চঞ্চল বলল একটা স্কুটার নিয়ে চলে যেতে। দিল্লিতে তখন বেশ ঠাণ্ডা। মস্কোর মত না হলেও
কনকনে বাতাসে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। সোজা চলে এলাম ওদের গেস্ট হাউজে। কিছুক্ষণ পরে
ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর সামি এলেন। উনি মস্কোয় পড়াশুনা করেছেন। সেই সূত্রে অনলাইনে আলাপ
ছিল। এবার মুখোমুখি দেখা। বললেন নীচে চলে আসতে। ওখানে লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। নীচে গিয়ে
দেখি অন্যদের সাথে অঞ্জনও আছে। অঞ্জনের কথা পুনার গল্পে করেছি। এরপর ওর সাথ আমার
দেখা রোমে। আমি আইসিটিপি থেকে মস্কো ফেরার পথে এক রাতের জন্য কৌশিকের বাসায় ছিলাম।
কৌশিক তখন রোমে পোস্টডক করছিল। সেই সময় অঞ্জন ওখানে এসেছিল আইসিটিপি যাবে বলে।
সেখানে আমার একটা সেমিনার ছিল। ইতিমধ্যে আমার আরেক কোলাবোরেটর অনিল এসে দেখা করে
গেছে। এবার কোলকাতা ফেরার পালা। ভেবেছিলাম ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্ট হয়ে যাব। তবে একটু
খোঁজ নিয়ে দেখি প্লেন যাবে পালাম এয়ারপোর্ট থেকে। পরের দিন সকালে রওনা হলাম এয়ারপোর্টের
উদ্দেশ্যে। কল্যাণ দা দমদম এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবে। সেখানে আরও কয়েকদিন থেকে ফিরব
বাংলাদেশ। সেখান থেকে মস্কো।
আবার কোলকাতায়
কল্যাণ দা আগেই এসেছিল। এখানে তেমন কোন কাজ নেই একটু ঘোরাফেরা করা আর সায়েন্স কলেজে
একটা সেমিনার দেয়া ছাড়া। কল্যাণ দাই আমাকে সায়েন্স কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল।
সেখানে সেমিনার দিলাম। এরপর খাবার ব্যবস্থা ছিল। এরপর কল্যাণ দা আমাকে নিয়ে গেল যাদবপুর
ইউনিভার্সিটিতে। এটা কাল্টিভিশনের ঠিক উল্টো পাশে। ইচ্ছে ছিল আমার কোলাবোরেটর ফারুক আর
শৈবালের সাথে দেখা করার। ওরা কেউ তখন ছিল না। তবে সুপ্রিয় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
ওখানে চা খেলাম। অসীমকে ফোন করলাম যদি দেখা করতে পারে। ও ব্যস্ত ছিল। তাই সুপ্রিয়র হাত
থেকে ব্যাগ নিয়ে চললাম কল্যাণ দার ওখানে। বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে সেমিনার দিয়ে বেশ কিছু টাকা
পেয়েছিলাম। কেনাকাটি ইতিমধ্যে শেষ। ভাবলাম তাহলে বাকি টাকাটা ডলারে কনভার্ট করে নিয়ে যাই।
এখানেই পড়লাম বিপদে। আমাকে টাকা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাথে কোন কাগজপত্র দেয়নি। অথবা
দিলেও আমি রাখিনি। ফলে ব্যাংকে গিয়ে দেখলাম সেটা কনভার্ট করা যাবে না। কি করা? ফোন করলাম
রিঙ্কুকে। সব বুঝিয়ে বললে ও বলল টাকাটা ওর দাদাকে এখানে দিয়ে দিতে। ও আমাকে মস্কোয় দিয়ে
দেবে। ভালোই হল ওনার সাথে আলাপ হয়ে। উনি এক সময় কাল্টিভিশনে কাজ করতেন। আমার বন্ধুদের
অনেককেই চেনেন। পৃথিবী সত্যিই গোলাকার। এদিকে সব কাজ শেষ। এবার দেশে ফেরার পালা। সেখানে
২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ফেরত বাংলাদেশীরা একত্রিত হয়। তাছাড়া সেদিন আমার জন্মদিন। দেশে
কয়েক দিন থেকে ঐ পিকনিকে অংশ নিয়ে আর ২৬ তারিখে জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাড়িতে একটু হই
হুল্লোড় করে ২৮ তারিখে মস্কো ফিরব। সামনে নববর্ষ। ওখানে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে।
স্ত্রীও।
ভারত ভ্রমণের সময় আমার বিভিন্ন লোকের সাথে কথা হয়েছে। অনেকেই জানতে চেয়েছে
রাশিয়ার কথা। আমিও আমার মত করে সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। একই সাথে ভারত
সম্বন্ধেও আমার কিছু মতামত গড়ে উঠেছে। আসলে মানুষের শরীরে যেমন কোন অংশই গৌণ নয়
সবই মুখ্য, কেউ মনে করতে পারে হৃৎপিণ্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেউবা মনে করতে পারে
মস্তিস্ক, বাস্তবতা এই যে এরা সবাই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, সবাই মিলেই পূর্ণাঙ্গ
মানুষের সৃষ্টি করে। একই ভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা-বাদশা একটা দেশ শাসন করে এবং
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয় দেশ, দেশের ইতিহাস। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা কেউ
কেউ ভারতের ইতিহাস কে শুধু হিন্দুদের ইতিহাস হিসেবে দেখতে চাই আবার কেউ কেউ
মুসলমানদের ইতিহাস। এখানে মুসলিম শাসন কায়েম হয়েছে হিন্দু শাসকদের দুর্বলতার কারণে।
পরবর্তী শাসকদের বর্বর বলে পূর্ববর্তী শাসকদের অযোগ্যতা, দুর্বলতা ঢেকে রাখা যায় না।
পূর্ববর্তী সমস্ত শাসক সে হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, মুসলিম হোক বা খ্রিস্টান হোক, সেই
শাসক সুশাসক হোক আর অত্যাচারী হোক, আমাদের বর্তমান তাদের সম্মিলিত লিগেসি বা
উত্তরাধিকার। এটা যদি আমরা মেনে নেই তবে অনেক সমস্যা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে, দেশ
থেকে সাম্প্রদায়িকতা কমবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেটা যেমন ভারতের ক্ষেত্রে সত্য তেমনি
সত্য পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।








