দীর্ঘ কবিতাঃ নীল নীরবতা – অনিরুদ্ধ সুব্রত

নীল নীরবতা
অনিরুদ্ধ সুব্রত


তখনও সন্ধের অছিলা ধার করতে পারে নি উপায়
মুখোমুখি, আশ্চর্য বেঁকে যাচ্ছে ভালবাসার মুখটি।
প্রদীপের সলতের মতো, যার আলোতে দেখা, আর
আবহে, একটি কচি বাতাসের লক্ষ্যে, বেঁকে যাচ্ছে
সেই আলো। অথবা তার কেঁপে ওঠা তরঙ্গ রূপের,
নিস্ততরঙ্গ-দৈর্ঘ্য। ক্ষীণতর হতে হতে, দপ করে ওঠা।


পৃথিবীর যৎসামান্যটুকু দেখা, হলো না এখনও শেষ।
আমারই প্রেক্ষিত দিয়েছে যেটুকু সময়, এই তার হাত,
মিশ্র জানাশোনা। এখনও ঘন বিশ্বাসের উপর পতিত
লঘু বৃষ্টি । কঠিন পাহাড়ের চূড়োয়— অস্পষ্ট কুয়াশা।
যা থেকে এক পশলায়— ঘোলাটে কাটায় প্রায়শ মেঘ,
প্রত্যেকবার ধূসর সন্ধিতে তাই জন্মেছে নতুন পাতা।


যে রাস্তা ধরে আসছিলাম, দু’পাশে তার বালি স্তূপ বা
বরফ ছিল ঢাকা। হঠাৎ ‘হয়তো’-র মতো শব্দকে দিয়ে
এক অপুষ্ট সংশয় নিজের বুকের উপরে রাখা। নয়তো
দিই নতুন করে আচ্ছাদনের আড়াল। যদি পরম নরম
বলে কোথাও দাঁড়াবে না, যদি চরম গতি স্খলিত থাকা।
তবে সত্যিকে নতুন করে, মিথ্যে করা, প্রশ্ন ব্যতীত প্রশ্নে
হলো নিঃশব্দের মধ্যবর্তী সুড়ঙ্গে ক্ষীণ যাওয়া আসা।


পুরো চরাচর বাহুল্য সারা, পুরনো পোশাকটি খোলা,
নগ্ন শিশুর— অবাধ অশ্রু লালা । অতল রক্ত এসে
গোপন কষ্টে, চোখ ভর্তি হয়ে আসা। কান্না ফেলে শেষে
সমস্ত রপ্ত রোম, চেতন-চর্ম খোলা । স্নায়ু-গায়ে স্নেহ জমা
জলে, খেলেছে শুকনো হ্রদের মাছ। বলেছে— পুনর্জন্ম
এই-ই। অথবা অতীত শূন্য, ভবিতব্য শূন্য— পূর্ণব্রহ্ম নহে।
অনন্ত-কন্ঠ প্রেম, সে-ই জয়, সুদূর থেকে দীর্ঘতম দিনে
জীবন ভেঙে জৈব, তাকেই কেন বহন করে আনা।


সন্ধের অছিলা, প্রসঙ্গের অছিলা, প্রাচুর্যের অছিলা যত,
জ্বালাতনী জ্বালা। বসন্ত নিয়ে হাজার কথা বলা। কালো
কোকিল, অভ্যাস ফসিল, দোয়েলের জন্য একটা ছোটো
জানালা। নদী, জল, জলজ প্রাণ, গাছের ছায়া, মায়ার
মঞ্চ, কথা বলা মাছরাঙা। ধীরে মুখস্থ ধূসর, ধূ ধূ অথবা
চকিতে চাওয়া— ধাবমান একটি নতুনতর জল কণা।


এই গ্রহ চিনি না, বিগ্রহ চিনি না, পূজা এতো যে অচেনা।
স্তব ভুল, স্তরীভূত ভুল ? ভূ-ভ্রান্তির চির শান্তি, বৃথা সমস্ত
ভাবা, সমগ্র বৈপরীত্য। চেতনায় নিয়ত নিয়তির সাদা–।
যে ফুল, নীরব স্থির প্রজ্ঞায় দেয় কাঁটা। বেঁকে যায় চোখ
তারা, কৌণিক ছোঁয়— রোগা এক বোধ। সে ফিরে আসা
কপাট বন্ধ করে, সলতের কালি পড়া মুখ, ঊর্ধ্ব মাথা।


সব জয় কুয়াশা কুয়াশা হয়ে মেঘে মেঘে হলো ঢাকা।
যে রাস্তা ধরে আসছিলাম, সে পথে গোপন রৌদ্র ফোটা।
বরফ অতলে কত কত শীতল বসবাস, কত গলিত ঘর
বাড়ি। সরু পাতা, রোগা গাছ, ন্যাড়া এক পাহাড়ের চূড়া।
বালি ওড়া মরু, শুধু ঊর্ধ্বমুখী গ্রীবা নিয়ে দূরে চলে যায়
বোবা উট। ঝড়ে ওঠে ধুলো, পুনরায় বাদামি হয়ে ঢাকা।


পৃথিবীর যৎসামান্যটুকু দেখে, পৃথিবীকে বেশি কেন যে
ভালোবাসা। ঘন নীল নেশা হয়ে গিয়ে, রক্ত-বমিতে মরা।
গাছেরা নিজস্ব মাটিতে দাঁড়িয়ে এখনও, তোমাদের মতো
হয়ে, হাঁটছ তোমরাও, আমি কি প্রকৃতি-গতি খুঁজে সারা ?
যে নদীর কেবল স্রোতস্বিনী বুকে যাওয়া, যে পাখির পুরো
আকাশ, ফুলের নিজস্ব ঘ্রাণের দোল, ভ্রান্ত মোহিত হওয়া।
জানি না বলে, থামবার আগে, একটি মিনিট নীল নীরবতা।

2 thoughts on “দীর্ঘ কবিতাঃ নীল নীরবতা – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. অপূর্ব ! কিছু বলার নেই। নীল নীরবতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *