দুটি কবিতাঃ তুহিন বন্দ্যোপাধ্যায়
নিজেরই ছায়ায়
গম্বুজের সৌকর্যে, পথ ভুলে ক্রমাগত সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছি চূড়ায়, মাথার খুব কাছে ঝুলে আছে আকাশ,
চারপাশে নির্জন চরাচর, আমি উপভোগ করছি রক্তপাতে ভয়ঙ্কর, চূড়ার সৌন্দর্য l
কিন্তু আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না এই আত্মগর্বি উচ্চতায় কেননা নিচে এইমাত্র নামান হল অপরূপ মেয়েটির ধর্ষিত, পেট্রলে পোড়া অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ,,
এই চূড়া থেকেও ব্যাকুল বিষাদে আমি দেখি মেয়েটির নিষ্পাপ খোলা চোখদুটি, তার রক্তের ভিতর জেগে ওঠা ক্রোধ, হাহাকার যেন আমাকে প্রশ্ন করে, কেন আমাকে মরতে হল?
কেন আমাদের মরতে হয় এইভাবে ? শুধু মেয়েজন্ম বলে?
আমার বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুনের তল থেকে উঠে আসা শব্দেরা উগরে দেয় অন্ধকার… নিকষ অন্ধকার l
তবুও সাড়া দিতে পারিনা নিচের ডাকে কারণ আমি কিছুতেই ছাড়তে পারিনা চূড়ায় আমার এই মোহময় অবস্থান,
শুধু বলি, হে মৃত্যু,হে রূপবতী কন্যা,পারলে আমায় ক্ষমা করো,কেননা আমি অপারগ,এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে আপন পুরুষাঙ্গ কর্ত্তনে l
বস্তুত আমরা কোনও প্রতিবাদই করতে পারিনা কেননা আমরা জড়, অন্ধ, অনিচ্ছুক,
আমরা ভালবাসি, ইনোসেন্স, নক্ষত্রসন্ধির তরল আগুন অথবা তমসা নরক রাত্রি l
আমাদের রক্তে সর্বদা খেলা করে,পুরুষতন্ত্রের অহংকার,
দেলাক্রোয়ার ক্রুদ্ধ ক্ষমতামত্ত অশ্বারোহী l
তাই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিকৃতির শিকার হয়ে তোমরা নিয়ত এইভাবে ভেসে যাও আগুনভেলায়, অথবা শুয়ে থাক কবরের বিষণ্ণ অন্ধকারে l
তবুও আমার হেমন্তলীন সত্তায় ওঠে তীব্র আলোড়ন l
আমি সাড়া দিই অবতরনের ডাকে, ঝাঁপ দিই ত্রস্ত হওয়ার ডানায় l
আমাকে টেনে নেয় কুয়াশালীন খিন্ন রাত্রি, গভীর বেদনায়, যুগপৎ অশ্রু ও চুম্বনে l
আমি পড়তে থাকি নিচে… আরও নিচে….মেয়ে তোমারই পাশে ,ঝর্নাপথের সমীপে নিজস্ব মাটির টানে l
উন্মোচন
স্পষ্ট মনে পড়ে এইখানেই মাটি খুঁড়ে পেয়েছিলাম জননীর মৃত হাড়,
কিছুদূরে সমুদ্রতটে দেখেছিলাম শ্রেণি সমাধি,
সারি সারি চিহ্নহীন নির্জন কবর l সেদিন ঝড়ের রাতে ডুবন্ত চাঁদের আলোয় ঢেউ ভাঙছিল ক্রমাগত,
আর ঢেউয়ের মাথায় উঠে এসেছিল অজস্র সাদা হাড়,
হিম কঠিন সাদা হাড় l
ঢেউয়ের ফুঁসে ওঠার শব্দে জাগছিল চাপা সন্ত্রাস আর অদ্ভুদ প্রেতস্বর l
সেকি মায়া? দিশেহারা আমি শেষহীন ক্ষয় আর আতঙ্ক বুকে নিয়ে চাইছিলাম উন্মোচন, এই মায়া আবরণের l
অদূরে পড়েছিল আমার কবিতার খোলা খাতা, জটিল, দুর্বিষহ, রঙিন মলাটের নিচে আত্মগর্বিত নীরব
সন্তানবতী অক্ষরেরা সাদা পাতায় শুয়েছিল দুঃখে গোপন আশঙ্কায়,ওরাও চাইছিল উন্মোচন l
আমার তখন মনে পড়ছিল, অন্ধকারে ছাতিম গাছে ঝুলে থাকা সৈদা বিবিকে,
সেও ছিল সন্তানবতী কাছে গেলে বলেছিল, কেন এলে, ঝুলন দেখতে?
বলছি বটে স্পষ্ট মনে পড়ে, আসলে আমার কিছুই মনে পড়ে না,
শেষ নিশীথের অন্ধকারে পাখি উড়ে যায়, ডানার রক্ত ঝরে পড়ে আমার নিষ্ফল ভবিতব্যে, শেষ অপমান মুছে নিয়ে, সীমাহীন কুয়াশার মাঝে
মনে হয় আর কি কেউ কখনও মাটি খুঁড়ে পেয়েছিল অমন হৃদয় পোড়ানো বহ্নি হাড়? মায়ের চাপা কান্নার শব্দে জেগেছিল কি অন্য কোনও জলজ শূন্য ব্যথা?
শূন্যেও কি উঠেছিল ঢেউ?
জেগে উঠি নিশিজাগরুক ঘন্টার শব্দে, দূর নীলিমায় জ্বলে ওঠা আনবিক ছটায়, নক্ষত্রের অনন্ত পতনে l
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন | খুব সুন্দর হয়েছে পত্রিকাটি সব বিভাগেই ৷ প্রচ্ছদটিও বেশ আর্কষণীয় ৷