ঈদের খুশি
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

আমার আসানসোলের স্কুলে পড়াঈদের খুশির শেষ দিকটায় , সম্ভবত এগারো ক্লাসের বা শেষ বছরের দুবছর আগে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল কসাই মহল্লার বাসিন্দা মহঃ সামসুদ্দিনের সঙ্গে। কেন এবং কিভাবে সামসুদ্দিনের সঙ্গে প্রথম আলাপ তা’ আজ আর মনে নেই। ওর বিষয়ে কিছু কথা আগেও বলেছি। আজ ঈদ প্রসঙ্গে আবার ওকে মনে পড়লো।
নতুন সাদা ধবধবে পাজামা আর পাঞ্জাবি পরা সামসুদ্দিনকে দেখে খুব ভালো লাগছিলো। হাতে ততোধিক সাদা রঙের একটা প্যাকেট। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – আজ এটা তার নিচেই হবে।”
আমি বললাম – কী আছে এর মধ্যে ?”
ও এক গাল হেসে উত্তর দিয়েছিল – মিঠাই । আমি দিচ্ছি, তবে আমার মা-ই পাঠিয়েছেন। আজকের খুশির দিনে তোর মত বন্ধুকে খুশি করতে হবে না ? তোরা বাড়ির সবাই খাবি। দেখবি, খুব ভালো মিষ্টি, ‘নাগ মহাশয়’ থেকে আনা। টাটকা আর খাঁটি। “
আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললাম – তুইতো প্রায় প্রায় জনতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে খাওয়াস, অথচ আমি কখনো তোকে কিছু খাওয়াতে পারিনি।”
সামসুদ্দিন আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল – ওকথা বলতে হবে না তোর, কেউ কাউকে খাওয়াতে পারে না, ওপর ওয়ালাই আমাদের খাওয়ান। এবার তুই এই প্যাকেটটা নিয়ে ঘরে চলে যা। আমার এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে। মেহমানদের আসার কথা, মা একা সামলাতে পারবেন না।” বলেই সে হনহন করে নিজের নতুন সাইকেলে চড়ে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া।
সেই সামসুদ্দিন আর অন্যান্য ছেলেবেলার সব সাথীদের ছেড়ে অনেকদিন আগে আসানসোলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে এসেছি। পড়াশোনা, টিউশনি করতে করতেই ওপরওয়ালাই আমায় পছন্দ মত একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছেন। যেটার আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
অফিসের সহকর্মীরা আমায় খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা নানান নামের, নানান ধর্মের, নানান ভাষার, নানান তাদের পদবী। কেউ ঢালী, কেউ পুরোহিত, কেউ চতু্র্বেদী, কেউ আজাদ, এরকম হরেক রকমের পরিচিত সহকর্মীদের সঙ্গে একসাথে অফিসের কাজে, ন্যায়ের পক্ষে মিটিং মিছিলে যোগ দিতে দিতে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিতে পেরেছি।
শেষ বছরে একদিন দেখলাম আমাদের অফিসের উর্দীপরা কয়েকজন মাচায় করে নানান ফল আর মিস্টি নিয়ে হাজির। জিগ্গেস করলাম – ভাইরা, তোমরা এসব দিয়ে কী করবে ?”
ওঁরা হেসে বললেন – আলমদের রোজা শুরু হয়েছে। আমরা ওঁদের উপহার দিতে চাই। আমরা কয়েকজন মিলে এসবের ব্যবস্থা করেছি। পারলে আরও কিছু কিনতে পারতাম।”
আমি নিজেই স্বতস্ফূর্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই আমি কি এর মধ্যে থাকতে পারি ?”
ওঁরা একযোগে বললেন – নিশ্চয়ই সাহেব, আপনার যা খুশি তা-ই দিতে পারেন।”
আমার পকেটে টাকা বেশি ছিল না, মেয়ের জন্য কিছু প্রসাধনী কেনার ছিল। তবুও মাত্র দুশ টাকা বাড়িয়ে সসঙ্কোচে বললাম – ভাই সামান্য দিচ্ছি। আগে জানলে – “
ওঁরা আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই আবার একযোগে বললেন – কোনো সঙ্কোচ করবেন না।”
ওঁদের একজন বলল – পরের বছর নাহয় আগে থেকেই জানাবো। এ বছর যা নিজে থেকেই দিয়েছেন, তাতে আমরা সবাই খুব খুশি। “
মনে মনে বললাম – আনন্দ উদ্ যাপন কল্যাণময় হোক। আমার তো কয়েক মাস পর ই চাকরি জীবন থেকে রিটায়ার করার কথা। তবুও বললাম – ঈদ মোবারক।”
আজ ও যেন আমার সামসুদ্দিনের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে হয় – ঈদ মোবারক।
খুবই সুন্দর লেখা কাকু। মন ছুঁয়ে গেল। 🙏