আত্মজ
দেবাংশু সরকার
এক
তিনটে ভলবো বাস এসে দাঁড়িয়েছে কলেজের গেটের সামনে। ছাত্র ছাত্রীরা উঠে নির্ধারিত সীটে বসছে। ফোর্থ সেমিস্টার আর সিক্সথ সেমিস্টারের ছাত্র ছাত্রীরাই যাচ্ছে। সেকেন্ড সেমিস্টারের মাত্র চারজন। চলেছে এস্কার্সানে। কিছুটা যাওয়ার পর বাস দাঁড়ালো। প্রথম বাসে তমাল উঠলো। এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে একটা ফাঁকা সীটে বসলো। পাশেই বসে আছে সেকেন্ড সেমিস্টারের উর্মি। চোখাচোখি হতে তমাল একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার কোন সেমিস্টার?”
উত্তরে উর্মি বলে, “আমার সেকেন্ড সেমিস্টার। আপনার?”
– “আমার, হিসেব করলে দাঁড়াবে টেন্থ সেমিস্টার।” একটু হেসে বুঝিয়ে বলে, “আমি দুবছর আগে এই কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। আপনাদের এস্কার্সানের দায়িত্ব যে ট্রাভেলিং কোম্পানীর, আমি সেখানে কাজ করি। অর্থাৎ আপনাদের দেখাশোনা, সেবাযত্নের দায়িত্ব আমাদের।”
– “সেবাযত্ন? দেখাশোনা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সেবাযত্ন, সেটা কিরকম?”
– “এই দেখুন।” তমাল তার ট্রলি ব্যাগটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, “ওটার মধ্যে একটা ফার্স্ট এড বক্স আছে। ভেবে দেখুন, কোনো রঙিন ফুলের সঙ্গে ততোধিক রঙিন প্রজাপতির সখ্যতা দেখতে দেখতে, আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আপনার নাকটা কেটে গেল। তখন কি হবে? কোথায় ডাক্তার? কোথায় বদ্যি? তখন কি সূর্পনখা হয়ে ঘুরে বেড়াবেন? ভরসা এই তমাল রায়ের ফার্স্ট এড বক্স।”
– “এই ব্যাপার।”
– “লিস্টে দেখলাম আপনাদের ক্লাসের পার্টিশিপেন্টের সংখ্যা খুব কম।”
– “হ্যাঁ মাত্র পাঁচজনের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার এক বান্ধবী শেষ মুহূর্তে নাম উইথড্র করেছে। তাই আমাদের ক্লাস থেকে মাত্র চার জন এসেছে। তিন জন ছেলে ওদিকে বসে আছে। আর আমি একা।”
– “এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। আমি একটা ফাঁকা সীট পেলাম। না হলে ড্রাইভারের পাশে নিজেকে গুঁজে দিতে হত। আর মুখে আঙুল দিয়ে চুপচাপ একা বসে থাকতে হত।”
– “কেন, আপনাদের অনান্য স্টাফরা যাচ্ছে না?”
– “যাচ্ছেতো। আরো দুজন যাচ্ছে। তারা অন্য বাসে উঠেছে। অর্থাৎ এই বাসে আপনিও একা, আমিও একা।”
– “আপনি এর আগে কোনো দিন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর গিয়েছেন?”
– “হ্যাঁ গেছি। এর আগে দুবার গেছি। অনেক বছর আগে একবার বাবা মায়ের সঙ্গে। তখন স্কুলে পড়তাম। আর একবার এই চাকরিটা পাওয়ার পর। একটা ট্যুর টিমের সঙ্গে।”
– “আপনার কি মজা! চাকরিও করছেন আবার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমারও ঘুরতে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। কখনো বাবা ছুটি পায় না। কখনো আমার পড়ার চাপ থাকে।”
– “ঠিকই বলেছেন। বিভিন্ন ট্যুর পার্টির সঙ্গে ঘুরে বাড়ানোই আমার চাকরি। কত কিছু দেখা হয়। এই যে আমরা বাঁকুড়া যাচ্ছি, দেখবো কত পুরানো মন্দির, পোড়া মাটির কত শিল্প সামগ্রী, প্রাচীন যুগের ব্যবহৃত কামান। এতো আমরা সবাই দেখবো। এর সঙ্গে হয়তো আরো অনেক কিছু দেখতে পাবো। হয়তো দেখবো কোনো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কোনো আদিবাসী যুবকের বাঁশির মেঠো সুর মিশে যাচ্ছে কোনো শ্যামল বরন কন্যার নূপুরের রিনিঝিনির সঙ্গে। শুধু দেখলেই হবে না, মনের রঙে রাঙিয়ে নিতে হবে সেই দৃশ্যপটকে। তবেই সার্থক হবে ভ্রমণ, দর্শন।”
– “একদিক দিয়ে ভালোই হল। আপনার দেখা জায়গা, জানা জায়গা। বাঁকুড়া পৌঁছানোর আগে আপনার কথা শুনতে শুনতে মানস চক্ষে দেখে নেবো বাঁকুড়াকে।”
এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে ছুটে চলেছে বাস। সদ্য পরিচিত দুই তরুণ তরুণী আপন মনে নিজেদের মনের ভাব বিনিময় করে চলেছে। একেই কি বলে ভালোলাগা? হয়তো! হয়তো আরো কিছুর পূর্বাভাষ।
হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো বাসগুলো। একশোর বেশি ছাত্র ছাত্রী এসেছে। এসেছেন কয়েকজন প্রফেসর। এতোজনের রুম অ্যালট করা, খাবার অ্যারেঞ্জ করা, সব দায়িত্ব তমালের ওপর। অবশ্য আরো দুজন সহকর্মী তার সঙ্গে আছে। হোটেল কর্মীদের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় আছে তমালের। ফলে সব ব্যবস্থা করতে বেশি অসুবিধে হয়নি।
সব কিছুর ব্যবস্থা করে লাঞ্চ সারার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিজের রুম থেকে বের হলো তমাল। দেখলো হোটেলের লনে উর্মি একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তমালকে দেখে এগিয়ে এলো। তমাল প্রশ্ন করলো,
– “কি করছেন?”
– “কি আর করবো! একা ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
– “কেন? কোনো বন্ধু…।”
– “না! আপনার সঙ্গে ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমার এখনো তেমন বন্ধুত্ব হয় নি।”
– “সেকি! আপনার ক্লাস মেটরা কোথায়?”
– “ওদের ভালো করে চিনিই না, তো বন্ধুত্ব!”
– “তাহলে আমার সঙ্গে চলুন। আসে পাশে একটু ঘুরে আসি। এখন আমার হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় আছে।”
– “চলুন চলুন। একা হাঁপিয়ে উঠেছি।”
– “এইটুকু সময়েই হাঁপিয়ে পড়লেন?”
– “আরে মশাই, নামেই এস্কার্সান। আমিতো ঘুরতে এসেছি। হৈচৈ করতে এসেছি। মজা করতে এসেছি। একা বসে ধ্যান করতেতো আসিনি। এই মুহূর্তে আপনি আমার কাছে এক টুকরো টাটকা বাতাস। আপনি না থাকলে হয়তো আমি এতক্ষণে নিজেকে আঁচড়াতাম, নিজের চুল ছিঁড়তাম।”
– “দাঁড়ান দাঁড়ান। এক্ষুনি এতটা উত্তেজিত হবেন না।”
– “দেখছেন আমরা লাল মাটির পথ ধরে হেঁটে চলেছি। কেমন অদ্ভুৎ রঙ এখানকার মাটির!”
– “কেবল মাটি দেখছেন? আকাশটাও দেখুন। সূর্যের শেষ কিরণগুলো ক্রমশ যেন লাল রঙা হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোও যেন পাল্লা দিচ্ছে। আকাশ, মাটি, গাছ চারিদিকে কে যেন মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে দিয়েছে!”
– “এই গাছগুলোর নাম কৃষ্ণচূড়া। রাধাচুড়া কোন গাছটা?”
– “ঐ যে দেখছো ঐ গাছটা। ফুলগুলো লাল হলদে রঙের। ওটা রাধাচুড়া।”
– “রাধা কৃষ্ণতো দেখলাম। এবার দেখাও ললিতাচুড়া, বিশাখাচুড়া বা সুদামাচুড়া। এমা!, তুমি বলে ফেললাম!”
– “আমিওতো আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি। তুমিতে যখন নেমেছি, আর আপনিতে উঠতে পারবো না।”
একমনে প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে উর্মি একটু যেন আনমনা হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা কয়েকটা লাল হলদে রঙের ফুল তুলে নেয়। হাসতে হাসতে বলে, “ওদিকে দেখো গাছদুটোকে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচুড়া গাছদুটো যেন গভীর প্রেমে মগ্ন। মাঝে ওটা কি গাছ? মনে হচ্ছে যেন ওদের প্রেমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওটা কি জটীলা কুটীলা ননদিনী চুড়া?”
তমালও মজা করে বলে, “হতে পারে! আবার অন্য কোনো নামও হতে পারে। যেমন কাবাব মে হাড্ডি চুড়া।”
লাল মাটির পথ ধরে হেঁটে চলেছে দুজনে, এলোমেলো কিছু কথাকে সঙ্গী করে। নিজেদের অজান্তেই কখন দুজনে দুজনের হাত ধরেছে। হাঁটতে হাঁটতে আবার তারা ফিরে এসেছে হোটেলের কাছাকাছি।
– “তমাল, আমরা হোটেলের কাছাকাছি এসে গেছি। এবার আমার হাতটা ছাড়ো।”
– “পারবো না।”
– “কেন?”
– “কারন আমি যেমন তোমার হাত ধরে আছি, তুমিও তেমনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছো। দয়া করে তোমার আঙুলগুলো একটু আলগা করো। তারপর দেখি তোমার হাত ছাড়তে পারি কিনা!”
দুদিনের এস্কার্সান শেষ হলো। কিন্তু তার রেশ থেকে গেল উর্মি, তমালের মনে। সারা সপ্তাহ পড়াশোনা, কলেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে উর্মি। তমাল ব্যস্ত থাকে নিজের কাজ নিয়ে। কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে রবিবারের জন্য। দুজনে দুজনের দেখা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এভাবে কেটে যায় সপ্তাহ, মাস, বছর। ক্রমশ দুজনে যেন দুজনকে কোনো এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলতে থাকে। দুজনেরই যেন মুক্তি নেই এই অমোঘ বন্ধন থেকে। অবশ্য কেউ চায় না মুক্তি পেতে।
নদী যেমন এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলে সাগরের দিকে। প্রেম তেমনি এগিয়ে চলে পরিনতির দিকে। প্রায় পাঁচ বছর উড়ে বেড়ানোর পর ঘর বাঁধতে চায় দুজনে। তমাল কথা বলে তার বাবা মায়ের সঙ্গে। উর্মিও বলে। একদিন তমাল তার বাবা মাকে নিয়ে যায় উর্মিদের ফ্ল্যাটে। কয়েক বছর আগের তৈরি মাঝারি মাপের আবাসনের দোতলায় উর্মিদের ফ্ল্যাট।
সন্ধ্যার সময়ে তমালরা পৌছালো উর্মিদের ফ্ল্যাটে। তমালের মা অনুরাধা উর্মির মা বিজয়ার সঙ্গে গল্প করছে। তমালের বাবা বিজন ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বিভিন্ন ছবি দেখছে। কিছুক্ষণ পরে অফিস থেকে ফিরলো উর্মির বাবা শ্যামল। শ্যামলকে দেখেই চমকে উঠলো অনুরাধা। যেন তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা শ্রোত নেমে গেলো। চিৎকার করে বলে উঠলো, “না, এ বিয়ে হতে পারে না! অসম্ভব! এ অনর্থ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।”
বিজন অনুরাধাকে বোঝাতে থাকে, “কেন হতে পারে না। অতীতটাকেতো আমরা সবাই স্পোর্টিংলি মেনে নিয়েছি। এতোদিন পরে আমার বা শ্যামলের মনেতো আর কোনো রকমের জটীলতা নেই। তাহলে কেন আমার ছেলের সঙ্গে শ্যামলের মেয়ের বিয়ে হতে পারে না?” শ্যামল কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কারো কথাই শুনছে না অনুরাধা। কেবল বলে চলেছে, “এটা হতে পারে না। এই বিয়ে হলে অনর্থ হয়ে যাবে।”
দুই
চাকরি পেয়ে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সহরে এসেছে বিজন। এক সহকর্মীর সাহায্যে একটা ভাড়া বাড়ি জোগাড় করে নিয়েছে। বাড়িওয়ালা খগপতি চ্যাটার্জি বয়স্ক মানুষ। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূকে নিয়ে দোতলায় থাকেন। খগপতি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী করনীক। সারাদিন ঘরেই থাকেন। তার ছেলে শ্যামল চাকরিজীবী। বেশির ভাগ সময়ে বাড়ির বাইরে থাকে। বছর চারেক হলো বিয়ে করেছে। কিন্তু এখনো সন্তানের মুখ দেখে নি। এনিয়ে একটা অশান্তি তাদের বাড়িতে রয়েছে। মাঝে মাঝে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। বিশেষ করে শ্যামলের মায়ের গলা মাত্রা ছাড়ায়। আস্তে আস্তে তখন খুলে যায় প্রতিবেশীদের জানালাগুলো। কৌতূহলী চোখগুলো উঁকি মারতে থাকে। কানগুলো খাঁড়া হয়ে ওঠে। খগপতি চেষ্টা করেন তার উত্তেজিত স্ত্রীকে শান্ত করার। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। আরো চড়তে থাকে শ্যামলের মায়ের গলা।
এক তলার তিনটে ঘরের একটা খগপতি খুলে দিয়েছেন বিজনের জন্য। বিজনের শিফটিং ডিউটি। কখনো সকালে, কখনো বিকালে আবার কখনো রাতে তাকে কাজে যেতে হয়। সন্ধ্যায় বা রাতে বাড়িতে থাকলে শ্যামলের মায়ের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যায় বিজনের। শ্যামলের স্ত্রী অনুরাধার চাপা কান্নার আওয়াজও তার কানে আসে। ঘরে আসা যাওয়ার পথে তার জল ভরা চোখ নজরে পড়েছে। সেই জলকে আড়াল করার অক্ষম প্রচেষ্টাও নজরে পড়েছে বিজনের। শখের বেহালা বাদক বিজন যখন বেহালার ছড়ে কোনো মিষ্টি করুণ সুর তোলে, হয়তো সেই সুর অনুরাধার চোখের জলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। বিজনের বেহালার সুরে যেন এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণ যেন আষ্টে পিষ্ঠে বেঁধে ফেলে অনুরাধাকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিজনের ঘরের দিকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। শুনতে থাকে সেই মিষ্টি করুণ সুর। নাকি ডাকাতিয়া সুর!
বিজনের বেহালার সুর যেমন বেঁধে ফেলেছে অনুরাধাকে, তেমনি অনুরাধার বাঁধ ভাঙা চোখের জল ভিজিয়ে দিয়েছে বিজনের মনকে। একা বিজন, সব কিছু থেকেও একা অনুরাধা যেন পরস্পর পরস্পরের কাছে আশ্রয় খুঁজে পায়। ক্রমশ চরম পর্যায়ে চলে যায় শ্যামলের মায়ের অশান্তি। অবশেষে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয় অনুরাধা। বিজনের সাথে ঘর ছাড়ে। বাধ্য হয় ঘর ভাঙতে। ঘর বাঁধতে।
ঘর ছাড়ে অনুরাধা, কেবল একা নয়, নিজের অজান্তে পৃথিবীর আলো না দেখা আরো একজনকে সঙ্গে নিয়ে। অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যে তার অস্তিত্ব টের পায়। সেকি তাড়াহুড়ো করে ফেললো? তাড়াহুড়োতে এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো? এখন কি করবে সে? কি করা উচিত? আবার কি ফিরে যাবে শ্যামলের ঘরে? সেটা কি সম্ভব? পরিস্থিতি তাহলে জটীল থেকে জটীলতর হয়ে উঠবে! নাকি বিজনের সঙ্গে জীবন কাটাবে? কিন্তু তাহলেতো অন্যের পিতৃ পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠবে তার অনাগত সন্তান! সেটা কি তার সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় অনুরাধার।
শ্যামলের মায়ের রাগ যেন কমতে চায় না। এবার রাগ গিয়ে পড়ে বিজনের ওপরে। থানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হন। শ্যামল কোনো রকমে ঠেকায় তার মাকে। মেনে নেয় ভবিতব্যকে। বিজনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসে।
শান্ত হন শ্যামলের মা। কিন্তু এক অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন শ্যামলকে গ্রাস করতে থাকে। সে ভাবতে থাকে কেন অনুরাধা তাকে ছেড়ে চলে গেল? সেতো কোনো দিন অনুরাধার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে নি, তাহলে কেন অনুরাধা তাকে ছেড়ে চলে গেল? ডাক্তার বলেছিলো কোনো সমস্যা নেই। তাদের বাবা মা হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। একথা জেনেও এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারলো অনুরাধা! এক হতাশা, হীনমন্যতা যেন কুরে কুরে খায় শ্যামলকে।
বছর ঘোরার আগেই বাবা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে বিজন। তার বেহালাতে বেজে ওঠে সাত সুরের সুর ঝঙ্কার। অন্যদিকে শ্যামলের মনের ঘা শুকোতে কয়েক বছর লেগে যায়। ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে সে। বিয়েও করে। লাভ করে এক কন্যা সন্তান।
সময়ের সাথে বেড়ে ওঠে অনুরাধার ছেলে তমাল, শ্যামলের মেয়ে উর্মি। দুজনের শরীরে বয়ে চলেছে এক রক্ত। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলি হেলনে, কোনো এক বিশেষ ক্ষণে দেখা হয় দুজনের।
অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অনুরাধা। ভাবতে থাকে এখন কি করবে? কি করে মেনে নেবে এই বিবাহ বন্ধন? এতো অনর্থ! এই বিয়েটাকে আটকাতে নিজের মান সম্মান খুইয়ে সত্যিটাকে সামনে আনবে? নাকি সন্তানের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে মান্যতা দেবে, সেই সঙ্গে রক্ষা করবে নিজের মান সম্মান? কিন্তু সেটা কি মঙ্গলজনক হবে তার সন্তানের পক্ষে? নাকি শ্যামলকে একান্তে জানিয়ে দেবে তার আত্মজের কথা। তারপর সরে যাবে দুরে, অনেক দুরে, জীবন থেকে দুরে! ভাবতে থাকে অনুরাধা।