হার
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না
বিকেলে বাড়ির কাছের পাকুড় গাছের তলায় মনিরুল দেখলে থিকথিক করছে ভিড়। গেরামের কেউ যেন বাকি নাই। কী হয় ওখানে!? পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলে একটা লোক মাইকে চেঁচিয়ে বলছে “রুবেল ভাই এর আশ্চর্য খেলা দেখেন আর খেলেন, কোনো টিকিট – টাকার ব্যাপার নাই। খেলে জিতে নিন তেল আটা চিনি ডাল আসেন আসেন আম্মা আসেন আপা আসেন ভাবী আসেন। আজকের খেলা শুধু মহিলাদের মানে মেয়ে মানুষের।” ও এই সেই রুবেল? এর কথা শুনছিল কাত্তিকের মুখে। গাঁ-গেরামের গরীব মানুষের পাড়ায় ঘোরে রুবেলের খেলা। পুরুষদের খেলাই বেশি। মনিরুল ভেবেছিল ওর পাড়ায় আসলে খেলবে।
মনিরুলের মেজাজটা এমনিই ভাল ছিল না। আজও হারান মিস্তিরি টাকা বাকি রাখল। ব্যাটা নিজে জোগালে থেকে মিস্তিরি হইয়েছে এখন আবার বড় বড় বাড়ির কনটাক নিচ্ছে। তবু শালা জোগালের দুক্কু কেউ বোঝে নে। চাপ দিলেই বসায়ে দেবে।’ হঠাৎ আমিনুল দেখল নাজিয়া মাথায় কাপড়টা দিয়ে দাঁড়ায় আছে।ঠিক ঘাড়ের ওপর ছেঁড়া। আমিনুলের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল। সামনের সপ্তাহে রমজান শুরু হবে। দেখ না দেখ ঈদ চলে আসবে। তার হাতে তো জমে না কিছু। রুবেল লোকটা মাঝারি দোহারা চেহারা। মুখে হাসি চৈত্ত মাসের বিকলে ঘামিয়ে একদম জব জব করছে। এমন মিনি মাগনা কেন দেয় এত কিছু? কাত্তিক বলছিল ওর পেছনে কম্পানী আছে। আমিনুল খেলা দেখায় মন দিল। এইমাত্র তার ভাবী ফরিদা শেষ হাঁড়িটায় বল ফেলে জিতে নিল ২কিলো ময়দা ২কিলো চিনি আর ১বোতল সাদা তেল আর ১কিলো ছোলা। আমিনুলের হাত চুলকায় খেলার জন্য। এত সহজ খেলা।
মনে পড়ল কতদিন পরোটা খায় নাই। সেই অগ্ঘান মসে শহরে হারানের মোটর ভ্যানে কালো আর ও কেমিকেল আর রং আনতে গেইছিল। আক্রাম মিঞার দোকানে গোস্ত আর পরোটা খেইয়েছিল ঝাল ঝাল গরম ঝোল আর তুল তুলে ময়দার পরোটা। সেদিন বড্ড মনটা টেইনেছিল নাজিয়ার জন্য। দুটো পরোটা আর এক ভাঁড় গোস্ত নেবার কথা ভাবছিল কিন্তু কালুর টিটকিরি আর পুরো পয়সা না থাকায় হলো না।
নাজিয়া কি খেলবে? বড্ড মুখচোরা। আমিনুলের ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে বলে, ” পারবি নাজু খেলে দেখ।” এর মদ্যে ইসরাফুলের মাও জিতে নিল ১কিলো ময়দা আর এক বোতল তেল। তেল তো কম নয় ১লিটারের বোতল। কম করে দশ /বার বার পরোটা হবে। মাইকে গলা ফাটিয়ে দাদিমাকে মোবারক বলছে ছোঁড়াটা। দাদিমার সামনের দুটো দাঁত নাই তাতেই তার মুখে আনন্দের হাসি যেন বেশি ফুটেছে হাততালি দিচ্ছে সক্কলে। এবার রুবেল ডাকতে থাকে “আসেন আসেন লাইনে দাঁড়ায়ে যান।” আমিনুল দেখল নাজিয়াকে ঠেলে লাইনে পাঠিয়ে দিল বিলকিস। রহমত চাচার বাঁজা মেয়ে বিলকিস তালাক পেয়েছে। খুব হাসি খুসি বিলকিস। কিন্তু আর নিকেয় বসেনি। বলে “মিঞা মানুষকে আর ভরসা নাই।”নাজিয়ার সাথে খুব ভাব সাব। একটু আগে বিলকিস পেয়েছে ১কিলো তেল আর ছোলা। নাজিয়ার হাতে বল, মাথার কাপড় সরে গেছে, ঘামে ভিজে কপালটা চক চক করছে। বড় বড় হাঁড়ি, ডিম পোনা রাখার। বর্ষা কালে বাঁকে এই হাঁড়ি ঝুলিয়ে ব্যাপারিরা আসে বেচতে। পোনা যাতে মরে না যায় তার জন্য নাগাড়ে হাত চালাতে থাকে জলে। নাজিয়ার সামনে আঁকা বাঁকা করে রাখা পাঁচটা হাঁড়ি। লাল রঙ দিয়ে ১,২,৩,৪,৫ লেখা। আমিনুলের পেটের মদ্যে কী যেন খলবলিয়ে ওঠে। খিদেই হবে নিশ্চয়ই। কখন সেই দুপুরে ভাত খেয়েচে। আলু ভত্তা আর চুনো মাছের ঝাল। নাজিয়া বলটা ছুঁড়ে দেয় জোরে। মাঠে লোকে চেঁচাতে থাকে। বলটা পাঁচ নম্বর হাঁড়ির কানা ছুঁয়ে মাঠের বাইরে। ফরিদের ফাজিল ছেলেটা “হ্যাই মারছে রে মারছে” বলে বল কুড়োতে গেল। মাঠের সবাই চুপ করে গেল হঠাৎ নাকি আমিনুলের কান ভোঁ ভোঁ করছে। ঘোর কাটতে দেখল নাজিয়ার হাতে একটা কোল্ডিঙ্কের বোতল ধরাচ্ছে রুবেল বলে লোকটা। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল আমিনুলের আর আবার চোখে পড়ল নাজিয়ার ঘাড়ের কাছে কাপড়টা ফাটা। বিড় বিড় করে “হায় আল্লা!” বলে আমিনুল বাড়ির পথে চলল। বাড়িই বটে! এখানে ওখানে চাঁছের বেড়া নষ্ট হয়েছে, সেই জায়গায় চট ঝুলিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে নাজিয়া। তবু ঘর দাওয়া নিকিয়ে একেবারে সাফ করে রেখেছে। আমিনুলের গামছা আর গাড়ু বসানো দাওয়ার ধারে। মুরগির ঘরে সব ঝাড়া মোছা। একটাই মোটে মুরগি। একটা মোরগ জোটাতে পারে নাই। শ্বশুর বাড়ি থেকে আনতে বলেছে কত বার কিন্তু আমিনুলের মানে লাগে। আমিনুল ছাঁচ তলায় দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়লে “নাজিয়া বেগম”। নাজিয়া পেছন পেছনই আসছিল তাই খুব আস্তে বলল,” এইতো”। আমিনুল ঘুরে দাঁড়িয়ে এক হ্যাঁচকায় নাজিয়াকে দাওয়ার দিকে টেনে এনে বলল,” বেহায়া মেয়ে মানুষ লাজ নাই, ছেঁড়া কাপড় পরে বেগানা পুরুষের সামনে খেলতে?” নাজিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে কোনো মতে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল, গিছি তো গিছি,” কাপড় দিছ যে সেটা পরে রঙ ঢং কইরব? সমসারের জন্যি গিছি, চিনি ছোলা তেল ডাল কী আনিছ যে দাওয়াত খাওয়াব?”
আমিনুল আরও চেতিয়ে বলল, “বেশি চেল্লাবি না, সক্কলে পারল আর তুই কেন পারলি নে? চোকে দেকিস নে, হাতে বল নাই? তোরে তালাক দেব কিন্তু আর একটা কথা বলবিতো।” সত্যিই তো চোকে দেখে নাই আর হাতেও বল ছিল নে জোরে পা ফেলে নাজিয়া দাওয়ায় এসে বলল,”দাওগা, বাপের ঘরে ভাত আছে আমার। খাটতে পাইরলে ভাবীরা ভাত দেবে। তোমার ঘরে তো কাল থিকে উপাশ আছি। আমায় তো আল্লায় রোজই রোজা করায়, খেয়াল করছো কিছু? বড় আইছে তালাকয়ালা! ছেলেটারে পয্যন্ত ল্যাখাপড়া ছাড়াইছো এখন তো পাঠাইছো ঠিকাদারের সাথে। অতটুকুন ছেলে পারে বল জোগালের কাজ? আমার আব্বা বলছিল না ওখেনের মাদ্রাসায় দিবে। তা তুমি হলে পাষান। শুধু নিজেরটা ভাব। তুমার তালাকে আমি ভয় পাই না।” আমিনুল বেবাক হয়ে দেখল যে নাজিয়ার মুখে একটা আদটা কথা থাকে সে আজ এমন ভাবে এত কথা বলছে! কত রাগ ওর ওপর। কিছ সময় থম মেরে বসে থাকে। আজান শোনা যায়। আমিনুল ঘরে এসে তক্তাপোশে লুটিয়ে পড়ে ডুকরে ওঠে হায় আল্লা আমি লুচি পরটাা খাবার লোভ করেছি আর নাজু দুদিন ধরে খায় না, সব ভাত আমারে গুছিয়ে দেয়! আল্লা তোমার কেমন দুনিয়া কেউ খায় কেউ মোটে পায় না? গুটি গুটি ঘরে এসে
নাজিয়াও আজ বিস্ময়ে বিমূঢ়। আমিনুল মিঞাকে সে কুনদিন কাঁদতে দেখে নাই। কেমন করে কাঁদে পুরুষমানুষ? এই লোকটার বুকে এত কান্না কবে জমল?