পাঁচটি কবিতা: অনিরুদ্ধ সুব্রত
বৃত্ত
ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে নিলেই বৃত্ত বড় হয়ে যাবে ?
কিন্তু তার মধ্যে যে পৃথিবী, আকাশ
চৌকো, ত্রিভুজ নানবিধ অবকাশ
সভ্যতার নানা ছোটো বড় নিদর্শনের অংশ
পরিধি বুঝবে না যে পরিমিতি জ্ঞান
ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে নিলেই বৃত্ত বড় হয়ে যাবে ?
ছড়ানো নানা দেশ, বেড়া দিয়ে দিয়ে সীমারেখা
পরিচয়, পাসপোর্ট, ভিসা, উর্দি প্রহরা
নদী সে তো আঁকাবাঁকা, হিমবাহ হতে মোহনা
সমুদ্র কেবলই নুন, তরঙ্গের উপর জাহাজের তল
ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে নিলেই বৃত্ত বড় হয়ে যাবে না
মানুষের চেয়ে মানুষের মনের ঘন আসা যাওয়া
দীর্ঘ জীবনের সুদীর্ঘ সংগ্রহ সংগ্রাম তার
দরজার ঘাসফুল থেকে ঊর্ধ্বের নীল ধ্রুবতারা
ব্যাসার্ধ কমিয়ে নিলে, সার্থক হয় বৃত্ত আঁকা।
অশ্বখুর
মৃদু হাসলেন অশ্বারোহী রাজা
সেনাপতিকে বললেন, লক্ষ্য সামনে হোক
হয়তো উল্লেখ্য, তবে সময় অপব্যয় বৃথা
যোদ্ধা মনোভাবটি যতটা তীক্ষ্ণ, ততটা রোগা
প্রান্তিক চোখের মণিতে তা দেখে বিস্ময় জাগে
কিন্তু আভিজাত্যই পারে সহজ উপেক্ষা
তীর ধনুক ছিলা অরণ্য অহংকারে তপ্ত
সম্রাট দিগ্বিজয়ী, ইস্পাতের ধারে— তিনি দক্ষ
খুরের ধুলোয় বন্য-যোদ্ধা দিগন্ত দেখতে পেল না তাই।
ডিঙি
কবিতা ভাসমান, তাতে ডিঙির মতো ভাসা যায়
কিন্তু ভাসমান পৃথিবীতে মানুষ তো ডাঙা চায়
দূর থেকে ছবির মতো বাতাসের টান মানে
অন্ধকার ঘন হতে হতে আলো খোঁজে বৈঠা
পায়ে মাটি পেলে থেমে যায় জল বাওয়া
জীবনের সুখ দুঃখ যা জানে, শুধু পারই জানে
কবিতা মানুষ নামিয়ে দেয় ঘাটে, ফের ভাসে
জলে মেদুর জোছনার প্রতিফলিত মাত্রার কাছে
ভাসে কালো জলে আর পানার দখল ঘেঁষে
জীবনের ধারে কাছে সে শুধু পারাপারে আসে
কবিতা স্বপ্নযান, ছুঁয়ে দিলে আনন্দ-ধারাবিবরণ
চুপ করে থামে, যেন ঘাটে এসে নামে তারপর
তখনও কবিতা একা একা ভাসে অস্ত আকাশে
মন নেমে গেছে কবে, পাটাতন ভিজে আছে শিশিরে।
মুক্তি
চোখের অসহায়তা তার, কপালে ফুটেছিল দাগ
খুঁজছিলাম নরম মৃত্যুর বিষ— এক নগরের ভিতর
প্রার্থিত মায়া কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল অবলীলায়
শুকিয়েই থেকেছে কান্না, যেন এই-ই গ্রন্থি বিশ্বাস
মুছে নিতে হয়েছিল নিঃসৃত তরলের সমস্ত ফোঁটা
কী ভাবতে হবে— সেভাবে হাঁটতে হয়েছে রাস্তায়
মনের বিমূঢ় মুখ তার, চোয়ালে ফুটেছিল বারংবার
দেখছিলাম সৃষ্টির মোহনায় যুগপত স্বাদ ও বিস্বাদ-জল
মার্জিত মননে মেনে যায় ঠোঁটের রোগাটে ধূসর
রঙ আছে রাখা, যতদূর পারে রক্তিম করে আঁকা
চেনা পটচিত্রের হয়ে পুনরায় দেয়ালে দাঁড়াতে
নরম মৃত্যুর বিষে ধীরে শান্ত হলো অর্ধেক হৃদয়।
রূপের রূপান্তরে নরম শীত গায়ে দিল সে অন্তর
নগরের আলো ধুয়ে দিল তার নীলাভ অসুখ-অন্ধকার।
নিদ্রা
নিদ্রাভঙ্গ ও নিদ্রার পূর্বাহ্ন সবচেয়ে দীর্ঘ
আমরা আর জানিনা, কেবল আন্দাজ জুড়ে দেয়
যদি স্বপ্ন নামের একটি সাধের গল্প পাই
এঁকে নিই ভর্তি করা ফাঁক, আমাদের ইচ্ছের
অবিশ্বাস্য এইসব অর্বাচীন কাল।
ঘুমের মতোই ব্যুদ প্রতিটি মস্তিষ্ক খেকো সুখ
দেহের কোটর থেকে বিদেহী আত্মার ভুলো মন
লিখেও রাখেনা তার অঙ্গের কথোপকথন
প্রাণভর্তি করে প্রাণবায়ু শুধু নেয়, নেশাগ্রস্ত সুখে
যা অঘটন সব যেন ঘটতেই হবে আগে ও পরে।
নিদ্রার পূর্বাহ্ন মতে ক্রমশ আত্ম-বিশৃঙ্খলা, আর
নিদ্রাভঙ্গের পর দাহ্য স্তূপের ঘন বিষাদ কীর্ত্তন।
অনিরুদ্ধ বাবুর পাঁচটি কবিতাই অসাধারণ। তার মধ্যে “বৃত্ত ” কবিতাটি বিশেষ ভাবে মন ছুঁয়ে গেল। ❤️
অসাধারণ সব কবিতা!
পাঁচটি কবিতাই খুব সুন্দর। মন ভরে গেল।ধন্যবাদ ও অভিনন্দন কবিকে।