সম্পাদকীয়ঃ পৌষ ১৪২৯ – মন্দিরা গাঙ্গুলী

সম্পাদকীয়

রাজা একটি পুষ্পমাল্য দিয়ে কবিকে বরণ করে নেন। রাজা কবির প্রত্যাশা জিজ্ঞাসা করলে, কবি বলেন
আর কিছু নাঞি চাই করি পরিহার।
যথা যাই তথায় গৌরবমাত্র সার॥
কবির উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাঁকে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দেন। রাজার আদেশে রচিত হয় কবি কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালি। 
কৃত্তিবাস ওঝা ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়া গ্রামে বাস করতেন। সঠিক জানা না গেলেও আনুমানিক ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ জন্ম হয় এবং আনুমানিক ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু ধরা হয়। গৌড়েশ্বর গনেশনারায়ণ ভাদুড়ির পৃষ্ঠপোষণায় তিনি বাল্মীকি রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন। বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও রুচির দিক লক্ষ্য রেখে সর্বজনবোধ্য পদ্যে মূল সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদ করায় কৃত্তিবাসী রামায়ণের ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ ঘটে।
কৃত্তিবাসের কালনির্ধারণে সাহায্য নেওয়া হয় ‘রামায়ণের’ কোন কোন সংস্করণে মুদ্রিত “আত্মবিবরণী”-র। এই “আত্মবিবরণী”-টির প্রামাণিকতায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। অনেকে এটিকে আধুনিক কালের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু সব সত্ত্বেও এর মধ্যেই কৃত্তিবাসের পরিচয় আছে বলেই মনে হয়। মনে হয় কৃত্তিবাসের মূল রচনাটিতে আধুনিক কালের কেউ অনেক কিছু জুড়ে দিয়েছেন। এটি ছাড়া কৃত্তিবাসের সম্পর্কে অন্য কোন কিছু থেকে জানবার উপায় নেই।
কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা ছিলেন পূর্ববঙ্গের বেদানুজ রাজার অমাত্য। তাঁরা ছিলেন “মুখুটি” (মুখোপাধ্যায়) বংশজাত রাঢ়ীয় বা রাঢ়দেশীয় ব্রাহ্মণ। পারিবারিক শিক্ষকতা বৃত্তির জন্য “উপাধ্যায়” পদবি লোকমুখে বিকৃত হয়ে হয় “ওঝা”। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নরসিংহ ওঝা কর্মস্থল ত্যাগ করে নদিয়ায় চলে এসে ফুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পুত্র গর্ভেশ্বর। গর্ভেশ্বরের পুত্র মুরারি। মুরারির সাত পুত্রের অন্যতম ছিলেন কৃত্তিবাসের পিতা বনমালী। কৃত্তিবাসের মায়ের নাম ছিল মালিনী। কৃত্তিবাসেরা ছিলেন ছয় ভাই। তাঁদের এক বৈমাত্রেয় বোনও ছিল। ভাইদের মধ্যে কৃত্তিবাস ছিলেন জ্যেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা অধিক গুণবান।
বারো বছর বয়সে কৃত্তিবাস গঙ্গা নদী পার হয়ে উত্তরবঙ্গে গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষা করতে যান। শিক্ষাশেষে রাজপণ্ডিত হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে গৌড়েশ্বরের রাজসভায় উপস্থিত হন এবং একটি সরস শ্লোকরচনা করে রাজাকে তুষ্ট করেন –
রাজ পণ্ডিত হব মনে আশা করে,
পঞ্চ শ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌরেশ্বরে। তারপর রাজা সন্তুষ্ট হয়ে প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে তিনি কী বলেছেন তার উল্লেখ আগেই একবার আছে।
এবার আসা যাক কবি কৃত্তিবাসের সৃষ্টি নিয়ে কিছু কথা। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি পাঁচালীর আকারে পয়ার ছন্দে রচিত এবং মূল সংস্কৃত রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। উপরন্তু কৃত্তিবাস রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্প এই অনুবাদে গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি, তিনি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি বাল্মীকি-রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাল্মিকী রামায়ণ অপেক্ষা ভিন্ন। যেমন রামায়ণের মূল রচয়িতা বাল্মিকী তাঁর রচনায় রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ করেন নি, এমনকি রামায়ণের অন্য কোনো অনুবাদেও তা দেখা যায় না। কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে এটি কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণের চরিত্রগুলো তৎকালীন সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মিকী রামায়ণে বর্ণিত একই চরিত্রের সাথে একই রকম নয়। তার মানে এমনটা বলাই যায়, মা দুর্গার অকাল বোধন যা শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক সূচনা হয়েছিল বলা হয়, তা আসলে কবি কৃত্তিবাস ওঝার অবদান। কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ বইটি আজকের যুগেও বেস্টসেলার। এমন একজন কবি স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেনও।
অবেক্ষণ পত্রিকার ‘পৌষ ১৪২৯ সংখ্যা’ কবি কৃত্তিবাস ওঝাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশ করা হল।
পত্রিকার পক্ষ থেকে সমস্ত পাঠক এবং লেখককে নতুন ইংরেজি বছর সূচনার শুভেচ্ছা জানাই। ভালো হোক ২০২৩। ভালোবেসে লিখুন ভালোবেসে পড়ুন। নমষ্কার।

তথ্য সংগ্রহঃ উইকিপিডিয়া

3 thoughts on “সম্পাদকীয়ঃ পৌষ ১৪২৯ – মন্দিরা গাঙ্গুলী

  1. বাঙালি আদি কবিকে স্মরণ করে পত্রিকাটি করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  2. বাঃ খুব মূল্যবান। ‘অবেক্ষণ’-এ লিখতে ভাল লাগে। ভাল থাকবেন সুসম্পাদক । সকল সদস্য ও লেখকবৃন্দ । সমৃদ্ধ পত্রিকা। ভাল থাকবেন। নতুন বছরের অগ্রিম শুভেচ্ছা নেবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *