জেরিয়াট্রিক পপুলেশন
কাজল কান্তি সেনগুপ্ত
আজকাল জেরিয়াট্রিক পোপুলেশন বলে একটা কথা খুব চলছে। অর্থাৎ আমরা, যারা নিজেদের সিনিয়র সিটিজেন বলি, তার ই আরেক নাম। আমরা কারা? আমরা কি শুধু বয়সেই প্রবীণ এক দল মানুষ যাদের এখন আর সমাজ কে দেওয়ার মত কিছুই নেই এবং তাই এক প্রকারের সমাজের বোঝা হয়ে আছি? যদিও সমাজে এই মতবাদ পোষণ করার লোকসংখ্যা খুব কম নয়, তবু আমার মনে হয় এতটা নেতিবাচক হওয়া নিষ্প্রয়োজন এবং অবাঞ্ছনীয়। আমরা যতদিন বাঁচি, সমাজের সাথে, এবং তার মাঝেই বাঁচি। তাই সমাজের সাথে আদান-প্রদানও চলতেই থাকে। একে চাইলেও আমরা রোধ করতে পারিনা।
সমাজ সব বয়সের মানুষের কাছ থেকেই কিছু প্রত্যাশা রাখে। তবে বয়স, সংগতি, অবস্থান এর উপর নির্ভর করে প্রত্যাশা পাল্টায়। একটি শিশু, সে যখন নানা ভাবে নিজেকে গড়ে তুলছে, তার কাছে একরকমের চাহিদা, আবার আমরা যারা শেক্সপিয়ারের সেই সাতটি স্টেজের শষ্ঠ বা সপ্তম স্তরে আছি, আমাদের কাছে অন্য রকম। বয়সের সাথে সাথে কার্যক্ষমতা কমে গেলেও, অভিজ্ঞতা, জ্ঞ্যান, মনুষ্যত্ব বোধ – এই গুলো তো কমে না। শৈশব বা কৈশোরের অফুরান জীবনিশক্তি কে পাল্লা দেয় আমাদের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা নানা গঠনমুলক প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। যেকোনো কিছু গড়তেই লাগে শক্তি ও বুদ্ধি। বুদ্ধির জন্য লাগে অভিজ্ঞতা। কাজেই, আমরা নিজেদের সুদীর্ঘ সময় ধরে কার্যক্ষেত্রের ও জীবনের অন্যান্য সময়ের নানা অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগিয়ে নিশ্চয়ই নানা প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে পারি।
আরো একটা জিনিষ যা বয়সের সাথে সাথে বাড়ে, তা হলো স্নেহ। অল্প বয়সের অধৈর্য, অসহিষ্ণুতার বেড়াজাল পেড়িয়ে, মানুষের অপারগতা, অক্ষমতা কে স্বীকার করতে পারার ঔদার্যের সাথেই জন্ম নেয় অনুজদের প্রতি স্নেহ বা মায়া মমতা। আমরা সামাজিক ভাবে ক্রমশঃ যে বিচ্ছিন্নতার দিকে এগোচ্ছি, তাতে খুব শিঘ্রই এমন এক অবস্থা আসবে যে আমরা শুধু নিজের সাথেই থাকবো। যেহেতু মানুষ সমাজের মধ্যেই বাঁচে, এর ফলস্বরুপ একাকিত্ব বোধ ও তার সংশ্লিষ্ট মানসিক রোগ আমাদের চেপে ধরবে। এগুলোর থেকে বাঁচার সহজ উপায় – পরিবারের সানিধ্য। সেই সানিধ্য দিতে পারি আমরা। আজকের ব্যাস্ত সমাজে যেখানে মা বাবা দুজনেরই পর্যাপ্ত সময়ের অভাব, তখন একটি শিশুর সারাদিন টা যদি তার মা বাবা আর দাদু দিদার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়, তাহলে সেটা সকলের পক্ষেই সু্বিধের হয়।
আমাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করে দেখলে, তাই আমার মনে হয় বেশ কিছু অবদানের জায়গা এখনো রয়ে গেছে। তবে সারা জীবনের পরিশ্রমের পর, এখন অনেক সময় হয় যে কাজ করতে ইচ্ছে করে না। ধরা-বাঁধা ভাবে তো নয়ই। শরীর ও মন বিশ্রাম চায় এবং সেটুকু তাদের প্রাপ্যও। আর চায় নিজের পছন্দমত সময় কাটাতে। তাই সব থেকে ভাল হয় যদি এই সময়টাকে আমরা আমাদের পছন্দের কাজে ব্যায় করতে পারি। সারা জীবন ধরে সময় বা সুযোগের অপেক্ষায় যে ইচ্ছেগুলো মাটি চাপা পড়েছিল সেগুলোর ধুলো ঝেড়ে, আবার বাঁচিয়ে তুলি। বই পড়তে ভাল লাগলেও কাজ ও সংসারের জন্য সময় রেখে হয়তো পড়ার সুযোগই হয়নি। এখনি তো সময় আবার করে পুরোনো অভ্যাসে শান দেওয়ার। গাছ পালা ভালোবাসলেও বাগান করার সময় হয়তো সারা জীবনে পাওয়া যায়নি। বা এই রকম আরো কত ইচ্ছে মনের গভীরে থেকে যায়। এখন যেহেতু জীবিকার জন্যের ইঁদুর দৌড়ের বাইরে চলে এসেছি আমরা, এখনি সেই ইচ্ছে গুলো পূরণ করার সব থেকে ভাল সময়। যতটুকু সাধ্য, তার মধ্যেই আমরা ইচ্ছেপূরণের পথে পা বাড়াই। এই গুলো বেশিরভাগই মনের খোড়াক। আর যাতে শরীরের জ্বরাব্যাধি আমাদের বেশি কাহিল না করতে পারে, তাই শরীর নামক যন্ত্রটার ও খেয়াল রাখতে হবে। শরীর চর্চা সব বয়সেই প্রয়োজন, তবে আমাদের দেখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ও অনুপ্রাণিত হবে। তাই ঠিক মত, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে, একটা সুস্থ ও সুন্দর সময়ের দিকে এগিয়ে চলাতেই আমরা আমাদের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতে পারি।