ধারাবাহিক উপন্যাসঃ অসম চতুর্ভুজ – অনিরুদ্ধ সুব্রত

ধারাবাহিক উপন্যাস: অসম চতুর্ভুজ
অনিরুদ্ধ সুব্রত

বোতলের ছিপিটা কীভাবে খুলতে হয় অরিন্দম হাতে নিয়ে খুলে দেখাল। কোটি অর্থের হাতের চওড়া সোনার কব্জিবন্ধ এমন ভাবে কেঁপে কেঁপে ঝুলছিল, তাতে প্রতিফলিত আলোর ঝলকানিটা ছিল দেখার মতো। যদিও দীপ্তরূপ আর নির্মাল্য প্রায় হা হয়ে অরিন্দমের হাতের কায়দাটা দেখল এবং পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করল। অরিন্দম কিন্তু ওদের দিকে তাকায় নি। বরং তার নিজের কাছে বহু পরিচিত এই বোতলটা, যা সে অনেক বার এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে খুলেছে । সেটা হাবে ভাবে বুঝিয়ে চাপা খুশিতে চোয়ালে ফুটিয়ে তুলেছিল শ্লাঘা।
নির্মাল্য হাতে নিয়ে দেখে হঠাৎ বলে উঠল,  
” আরে ছিপিটা তো কর্কের ! বেশ দারুণ তো ! আমি টেনে খুলতে পারব ?”
অরিন্দম মৃদু ত্যারছা হাসলো। বলল,
” দ্যাখ্ চেষ্টা করে ।” বলে নির্মাল্যর দিকে এগিয়ে দিল বোতল। 
দীপ্তরূপ তখনও চুপ। জোর করে ‘এটা তো ‘সামান্য ব্যাপার’ — এমন মুখভঙ্গি করে বসে আছে। ফাঁকে বুক পকেট থেকে উইলস ফ্লেক বের করে, তার একটা ধরাল। চোখের দৃষ্টি খানিকটা উপরে, ঠোঁট বাঁকা করে ধোঁয়া ছাড়ার কায়দার মতোই।
নির্মাল্য ছিপিটা মুড়িয়ে মুড়িয়ে খুলছে। অরিন্দম পকেট থেকে গোল্ডফ্লেক কিং সাইজ বের করল। দীপ্তকে বলল, 
” আরে, এখন তো এটাই খেতে পারতিস ?” 
দীপ্ত ফক করে খানিক ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
” দ্যাখ আমার শ্লা এটাই ঠিক আছে।
সিগারেটে পারতপক্ষে খুব একটা কম্প্রোমাইজ করি না । তা ছাড়া ওটা তোকে মানায়, এটা আমাকে।”
ততক্ষণে নির্মাল্য বোতলের ছিপি খুলে ফেলেছে,
” যাব্ বাবা আমি তো ভাবলাম ফস্ করে ওঠে কিনা…”
“— হা হা হা ! আরে সে তো শ্যাম্পেন ” বলে অরিন্দম কামানো গোঁফের চকচকে ঠোঁটের ছাদ খুলে নির্মাল্যকে ভিতরের দাঁত গুলো যেন দেখাল একবার।
নির্মাল্য বলল, 
” তুই অনেক দিন আগে একটা এই রকমই বোতল এনেছিলি, এবার মনে পড়েছে। এতো পুরু কাঁচের বোতল দেখলে আমার না ভীষণ মায়া লাগে রে ।”
নির্মাল্যর আশ্চর্য কাঁচের বোতলে মায়া লাগে’ শুনে দীপ্তরূপ এবার না হেসে পারল না। তারপর যেন খানিকটা তাড়ার সুরে বলল, 
” ন্যাকামি ছাড় নির্মাল্য, বোতলটা জড়িয়ে ধরে থাকবি ? না গ্লাসে ঢালবি ?”
“— নে ঢালছি, কিন্তু পকোড়া আসুক।” বলে পাশের কিচেনের দিকে আওয়াজ দিল,
” কী গো ভাজা হলো ?”
উত্তর এলো, 
” দিচ্ছি এক্ষুণি। একটু বোলো, এক মিনিট ।”
দীপ্ত বলল,
” বৌদি, আগে কিছু মুড়ি দিন, অল্প কিছু।”
উত্তর এলো,
” আচ্ছা, দিচ্ছি এক সঙ্গে।”
নির্মাল্য তিনটে সাধারণ খাড়া সোজা ধরণের কাঁচের গ্লাসে অল্প অল্প করে ‘ব্লাক ডগ’ ঢালতে শুরু করল। এর মধ্যেই সামনে চলে এলো একটা চওড়া বাটি ভর্তি মুড়ি আর একটা মাঝারি সাইজের ট্রেতে গরম চিকেন পকোড়া। ওগুলো টেবিলের উপর রেখে, ফিরে গিয়ে সুনন্দা স্যালাডের প্লেট আর টমেটো সস এর পাউচ এনে রাখল টেবিলে। 
সুনন্দা চলে যাচ্ছিল কিচেনের দিকে, অরিন্দম তৎপরতার সঙ্গে বলল,
” আরে দাঁড়ান একটু।” বলেই নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আচ্ছা এই পুরু কাঁচের বোতলে তুই মায়া খুঁজে পেলি কীসের খুলে বলতো ভাই একবার ?”
সুনন্দা সামান্য কপাল কুঁচকে বলল,
” ও কত কিছুতেই যে কত মায়া দেখে। কেবল ওর প্রতি কেউ তেমন মায়া দেখাল না। এমনকি আমিও নাকি মায়াহীন— এমনই তার বক্তব্য।”
সুনন্দার কথা শুনে অরিন্দম আর দীপ্তরূপ এক সঙ্গে হা হা করে হাসলো বেশ খানিকটা। নির্মাল্য মুখ তুলে সুনন্দার কথাটার দিকে যেন তাকিয়ে থাকল। যদিও সুনন্দা ততক্ষণে রান্নার দিকে ফিরে গেছে। ওভেনে তখন গরম তেলে ভাজা হচ্ছে পকোড়া। ছেলে মেয়েকে এই খোলা ভাজা হলে দিয়ে আসবে সে।
হাতের কাজ সামলাতে সামলাতে সুনন্দা কিচেন থেকেই যেন মৃদু কাঁচের চুড়ির মতো টুংটাং একটা শব্দ শুনতে পেল। বুঝল সে ব্যাটিং শুরু হলো। সঙ্গে একটা মৃদু সমবেত মন্ত্র—” চীয়ার্স ! “
চাঁদপুর, তেমন ইতিহাস প্রসিদ্ধ জায়গা নয়। নিকটবর্তী বনমালীপুর টাউনশিপের গায়ে লেগে থাকা জনপদ। পৌর প্রশাসনের অধীন হলেও সব গলি রাস্তায় আলো আর তস্য প্রান্তে পৌর পরিষেবা এখনও ঠিক ঠাক পৌঁছায় নি। তবু সুযোগ সুবিধা আর আধুনিকতার প্রায় সকল ছোঁয়া এখানে কিছুটা হলেও পাওয়া যায় । মধ্যবিত্তের আধিক্য স্বীকার করেও বলা যায়, বেশ সংখ্যক দিনমজুর, ছোটো ব্যবসাদার, আর বেশ কিছু প্রায় কর্মহীন মানুষের বাস এই চাঁদপুরে। 
রেলস্টেশন একটু দূরে। তবে জনপদের মাঝখান চিরে চলে গেছে কলকাতাগামী চওড়া জাতীয় সড়ক। সীমান্ত লাগোয়া বনমালীপুর। শহরের আসপাশে এমন কিছু ব্যবসা বাণিজ্যও হয় , যার সঙ্গে আমাদানি রপ্তানির একটা প্রত্যক্ষ যোগ আছে। ফলে এখানকার জাতীয় সড়কের দুপাশে ঢাউস ঢাউস ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে সার সার। এলাকার অর্থনৈতিক নাড়ী পরীক্ষায় এর অনুভব সহজে টের পাওয়াও যায়। যদিও চাঁদ পুরে এই বাণিজ্য দাপট আজ থেকে বছর তিরিশ চল্লিশ আগে এমন মোটেই ছিল না। হালে একটু বেশিই মাত্রা পেয়েছে এসবের।
বড় রাস্তার দুপাশে কোনো ফাঁকা জমি অবশিষ্ট নেই আর। অধিকাংশ কোনো না কোনো গ্যারেজ, হোটেল বা রপ্তানি দ্রব্যের আড়ত হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। চাঁদ পুরের দৈনিক জীবনে তাই বিগত তিন দশকে এসেছে নতুন মোড়। অথচ কোনো এক সময়ে অরিন্দম, দীপ্তরূপ, নির্মাল্যরা এই চাঁদপুরের হাইস্কুলের মাঠে বর্ষার দুপুরে ভিজে ভিজে ফুটবলে লাথি মারতেই ব্যুঁদ থাকত বেশি।
প্রথম পেগের চুমুক শেষ করে দীপ্ত আর অরিন্দম প্রায় এক সঙ্গেই। ঠক করে গ্লাস রাখল টেবিলে। দীপ্ত লক্ষ্য করে দেখল— নির্মাল্যর গ্লাস তখনও অর্ধেকের বেশি ভর্তি, দেখে সেটা আবার ইশারা করে দেখাল অরিন্দমকে। দুটো পকোড়া একসঙ্গে মুখে দিয়ে অরিন্দম খোঁচা মারল নির্মাল্যকে আঙুল দিয়ে,
” কী রে ও সব ফেসবুক ধ্যাতরামো রাখ এখন। গ্লাস শেষ কর আগে। যতক্ষণ আমরা এক সঙ্গে থাকব, ততক্ষণ তোর ফেসবুক সাম্রাজ্যের পাওয়ার— অফ করে রাখবি ঠিক আছে ? “
উত্তরে নির্মাল্য, ” হ্যাঁ, মানে না রে, ধুর কী যে সব বলিস অরিন্দম…” 
ইত্যাদি ন্যাতানো কথা বলতেই দীপ্ত ক্ষেপে উঠল, 
” এই শোন কলির কবি, দীর্ঘ দেড় মাস পরে একটা সন্ধে, তিনজনে বসেছি। চার নম্বরটা তো রাজনীতি মারাতে মারাতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তুই শ্লা অতিরিক্ত মোবাইল এডিকটেড হয়ে গেছিস। রাখ ওটা এখন।”
নির্মাল্য মোবাইল অফ করে সরিয়ে রাখল,
” এ এই রাখলাম, নে হলো তো ? এখন শুধু এনজয় ঠিক আছে ? রণজয় এলে পুরো জমে যেত রে ভাই— আমাদের সেই পুরনো চতুর্ভুজ।”
ঠিক এই সময় ফোনটা একটা সুন্দর রিং টোনে বেজে উঠল অরিন্দমের। পকেট থেকে ফোন বের করে অন করেই জম্পেশ একখানা খিস্তি ঝাড়ল অরিন্দম। 
দীপ্ত বলল,
” এই অরিন্দম আস্তে। ওদিকে বৌদি আর বাচ্চারা রয়েছে। “
অরিন্দম কথা বলে যাচ্ছিল,
” তোর যে শ্লা জ্ঞান যে হবে না জানতাম। ঐ পার্টিই তোর মাথা থেকে জ্ঞানগম্যি সব মগজধোলাই করে ছেড়েছে। এখন ঐ দামড়া মাথায় জাস্ট ভূসি ভর্তি। দশ মিনিটের মধ্যে না পৌঁছলে দ্যাখ্ তোকে কী করি । কিন্তু মনে রাখিস, নির্মাল্যর বাড়িতে ঢুকবি তুই একা, তোর সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গো থাকলে চরম ক্যালাবো কিন্তু। রাখলাম। এসে থার্ড পেগে চান্স পাবি।”
ছোটো বেলা থেকে এদের মধ্যে সব থেকে মেধাবী আর পড়ুয়া ছিল দীপ্তরূপ। খেলাধুলা নাম মাত্র কিছু করলেও পড়াশোনায় বরাবর সিরিয়াস সে। দীপ্তর বাবা ছিলেন হাইস্কুলের অঙ্কের ছিলেন। ছেলেকে রাখতেন কড়া নজরে। বিএসসি পাশ করেই বিসিএসে কোয়ালিফাই। তারপরই সোজা প্রশাসনিক আধিকারিক। রাজ্যের নানা প্রান্তে পোস্টিং হয়েছে। এই মুহূর্তে ওর পোস্টিং উত্তরবঙ্গে। পরিবার নিয়ে সরকারি বাংলোয় থাকে। ডিসম্বরের এই শেষ সপ্তাহটা বরাবর বাকি বন্ধুদের মতো দেশের বাড়িতে। আজ সেই বন্ধু মিলন সন্ধে। 
অরিন্দম মাঝামাঝি রকমের ছাত্র ছিল। সেরা ডানপিটে। দারুণ ফুটবল খেলত। সেই বারো তেরো বছরের সি-টিম থেকে শুরু করে এ-টিম পর্যন্ত অরিন্দম পাড়ার সবুজ সংঘের বেস্ট প্লেয়ার। উচ্চ মাধ্যমিকের পর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চান্স হলো না। চলে গেল শহর কলকাতায় দুঃসম্পর্কের মামার কাছে। অরিন্দমরা পারিবারিক ভাবেই ছিল দারিদ্র্য আক্রান্ত। এক কালে ওদের বড় পরিবারের নানা রকম দ্রব্যের ব্যবসা থাকলেও, পরবর্তী কালে ভাগ বাটোয়ারায় যা পেয়েছিল ওর বাবা, তাও রক্ষা করতে পারলেন না। ছাত্র বয়স থেকে মনে মনে একটা কিছু মিরাক্যাল ঘটানোর মানসিক জোর ছিল অরিন্দমের মনে। যদিও লেখাপড়াতে সেটা দেখাতে ব্যর্থ হলো সে। 
শহর কলকাতায় থাকতে থাকতে বিশালাকার ইমারত গুলো অরিন্দমকে অদৃশ্য একটা টান দিত। ও সে কথা বলত না কাউকে। নয়ের দশকের প্রথমার্ধেই গ্রাজুয়েশন শেষ করেই রাতারাতি সঙ্গ নিল জনৈক এক হাউজ বিল্ডিং কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে। দেখাশোনার কাজ। সামান্য মাইনে। তবু চরম এক কৌতুহলে আর মনে মনে শিক্ষানবিশি হিসেবে। পড়ে রইল একই কাজে দীর্ঘ কয়েক বছর। তারপরের কথা অনেক লম্বা। কিন্তু দীর্ঘ বছরের অধ্যাবসায় আর সাফল্যে অরিন্দম এখন কলকাতা শহরের একই সঙ্গে তিন চারটে সাইট চালানো তাবড় মাপের হাউজিং কন্ট্রাক্টর। কথা বার্তা হাবে ভাবে তার কিছু ছিঁটে ফোঁটা বেরিয়ে আসে ঠিকই, তবু সে নির্মাল্য বা দীপ্তর চিরকালের বন্ধু। দেশের বাড়িতে এসে বছরে এক দুটো দিন এমন সন্ধেয় বন্ধুত্ব এনজয় তার অত্যন্ত প্রিয়।
নির্মাল্যর ঘরের বাইরে হঠাৎ একটা গাড়ির হর্ন বাজল। শব্দ শুনে দীপ্ত উঠতে যাচ্ছিল ব্যস্ত হয়ে,
” ঐ যে রণজয় এলো মনে হয়।”
অরিন্দম তাড়া দিল রীতিমত, দীপ্তকে, ” তুই বোস। আগে ও পাঁচ বার হর্ন দেবে তার পর। তাছাড়া তুই না দীপ্ত— এতো বড় অফিসার হয়েও রণজয়ের মতো নেতা আসতেই একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলি কেন ? কীরে, অভ্যাস হয়ে গেছে নাকি …?”
সুনন্দা তৃতীয়বার হর্ন শুনে হাতের কাজ রেখে বাইরের ঘরের দরজার কাছে গেল। সুনন্দাও বুঝতে পেরেছে, চতুর্ভুজের চতুর্থ বাহু এসে হাজির হয়তো। কিন্তু সুনন্দার হঠাৎ মনে হলো— ” এই শব্দটা তো রণজয়ের গাড়ির নয়, তাহলে কে এলো ?”

(এর পর আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *