বলিনি তোমায়
শিখা কর্মকার
বলিনি তোমায় কোনদিন । যতবার ঘরে ফিরি, থলে থেকে উঁকি দেয় সুগন্ধিত চালের পাশে কাজু ও কিসমিস, আনমনে বাগানে ফোটে গন্ধহীন সাদা ফুল, কুঁড়ির গুচ্ছ নিয়ে চারতালায় লতিয়ে ওঠে মালতীর পাশে গন্ধভাদুল, সারি সারি তালসুপারির মাথায় শব্দহীন পাখির পালক, মনে হয় ফোন করেছো, রিং বেজেই চলেছে, আর সাত সমুদ্র পেরিয়ে সেই ফোনের কাছে যেতে আমার শুধু দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
চিঠির পরে চিঠি খুলে চলেছি আজ এক সপ্তাহ হল। বুঝিনি তোমাকে আগে, কেন বুক ভেঙ্গে গেছে প্রিয় জমিজমা বেচে দিয়ে চলে আসতে শেকড়হীন শহরে। কেন উদাস হতে বাড়ির কথা বললেই। রক্তের ভেতর এত টান তোমার, ঘাসের স্পর্শ পাবার এমন উদগ্র কামনা, চেনা গাছেদের সঙ্গে অলিখিত প্রেম…কিছুই বুঝিনি। তোমার বলে যাওয়া গল্পগুলি প্রতিদিন নতুন করে এক একটা আকাশের ঢাকনা খুলে দেয়।
আজকাল বড় ইচ্ছে হয় আবার তোমার পায়ের কাছে বসে শুনি সোনার গৌরাঙ্গ ঘর ছেড়ে চলে গেলে কিভাবে ভুলুণ্ঠিতা শচীমাতার হৃদয় বিদীর্ণ করা কান্না বুক পেতে নিয়েছিল মা বসুন্ধরা । রাম চলে গেলে কিভাবে শোকের ছায়া রয়ে গিয়েছিল অযোধ্যার প্রতি ঘরে। কিভাবে রবিঠাকুরের সোনার দিনগুলি নিভতে নিভতে কিছু বাকি রাখেনি। কিভাবে সন্ধেবেলায় তুমি নিরক্ষর বোবা চোখে চেয়ে থেকেছিলে আমরা দেশ ছেড়ে যাবার মুহূর্তে ।
এখনো কত উৎসব আসে, যায় । ভিজি অস্ফুট ভালোবাসায়, স্নেহে, অকারণ বন্ধুত্বে । ধরে থাকে বাড়িঘরের নিখুঁত দেওয়াল, মূক অ্যালবাম, মনের কথাগুলি। যতবার কাছে যাই, প্রতিটি নদি, বনভুমি, পাহাড় ও পর্বতের, বাতাস এসে এক ঝাপটায় খুলে দেয় দ্বিধামাখা হাজার দরজা । মনে পড়ে হৃদয়ের আকাশ জুড়ে শুধু তোমার কথা। তোমাকে কোনদিন মুখ ফুটে বলে উঠতে পারিনি আমার অসহনীয় মনখারাপের কথা। বলতে পারিনি আমি এখনো নিষ্পাপ শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠি নিঃসঙ্গ প্রান্তরে, দিগন্ত ছোঁয়া কুয়াশার মাঝে। বলতে পারিনি ভালোবাসা দিক হারানো পাখির মত সময়ের দরজা পার হয়ে এসে ঘর বেঁধেছে বুকে।