ছোটগল্পঃ তেইশ হেমন্ত পরের চিঠি – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

তেইশ হেমন্ত পরের চিঠি
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

আট দিন পর অফিসে ফিরে শেখরকে ডেকে পাঠাল কেয়া। শেখর ঘরে ঢুকল এক গাদা চিঠি পত্র আর ম্যাগাজিন নিয়ে। শেখর একাধারে তার আপ্ত সহায়ক, দ্বারপাল আর শুভানুধ্যায়ী। সিঙ্গাপুরে তার এবারের ট্যুরটা খুবই ওয়ার্থফুল হয়েছে। সকলে দুপুরের মিটিংটার জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েক জনের সৌজন্য সাক্ষাত, চা না কফি, জল, আর্জেন্ট ফাইল না সেলস্ রিপোর্ট এসবের পাট চুকলে পিঠটা টান করবে বলে চেয়ারে একটু হেলান দিল কেয়া,
টেবিলের ওপর রাখা এক ট্রে চিঠিপত্র ও ম্যাগাজিনের দিকে চোখ পড়ল। এত ই-মেলের পরেও এই হার্ড কপি গুলো চেক করতে হবে। পুজোর লেখার কাগজ পত্রগুলোও আসতে শুরু করেছে। আজকাল লেখালিখির একটা হঠাৎ চাপ এসেছে। লকডাউনের পর আবার প্রিন্টেড পত্রিকাগুলো বেরচ্ছে। এগিয়ে এসে কয়েকটা চিঠি হাতে তুলে নিতে নিতে দেখল একটা ম্যানিলা এনভেলপের ওপর চেনা হাতের লেখা। বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম। শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল। অফিসের ঠিকানা ও পেল কোথায়? অংশু নাকি ইয়ার বুক থেকে? এক সময় অজস্র চিঠি তার নামে এসেছে। ভালবাসার কথা,বিশ্ব সাহিত্য পাঠের কথা, নিজের কবিতার কথা আরও কত কী। তখন প্রেমে হাতে লেখা চিঠির ভূমিকা ছিল সব চেয়ে আকর্ষণীয়। কেয়া আর সুকান্ত যখন তখন কাগজ টেনে নিয়ে চিঠি লিখে ফেলত। উত্তর প্রত্যুত্তর অনুরাগ অভিমান সমর্পণে ভরা সেসব চিঠি।এখন ছেলেমেয়েরা ওয়াটসঅ্যাপ,মেসেঞ্জার আর ইন্সটাগ্রাম লম্বা ফোন কলে প্রেম করে।
এই তেইশ বছরে কেয়ার জীবন নানা খাতে বয়ে গেছে কোনো দিন তো পাশে পায়নি একে। তার ব্যক্তিগত শোক দু:খগুলোতে পাশে পেয়েছে ওদের কমন ফ্রেন্ড অংশুকে। জাম্প কাট করে মন চলে গেল সেই দৃশ্যে — তার বাড়ির সামনে দিয়ে সুকান্ত আর দেবিকা যাচ্ছে । খুব হাল্কা করে ধরে রাখা সাইকেল চলেছে পাশে পাশে, দেবিকার হাত জড়িয়ে রেখেছে সুকান্তর বাহু… ওরা কি পার্ক থেকে ফিরছে? কেয়ার হাতে সুকান্তর লেখা সেদিন সকালের চিঠি। দেবিকার গায়ে পড়া, জোর করে বাড়িতে এসে মায়ের সাথে ন্যাকামো করা, রুচির অমিল আর ক্লান্তির কথা। চাকরি পেলে তাড়া তাড়ি কেয়াকে বিয়ের কথা। দৃশ্য ২-পরদিন ঝড়ের গতিতে দেবিকার প্রবেশ, একরাশ অপমানজনক কথা, হুমকি, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি সেরে দ্বিগুণ গতিতে প্রস্থান। তারপর বাবার জেরা, মায়ের রাগ আর দাদার আস্ফালন। ঘটনার ঘ ‘না, সুকান্ত ঠিক দেবিকাকে এড়িয়ে তার কাছেই ফিরবে। কিন্তু এসব কিছুই ঘটেনি। দৃশ্য ৩- ওদের পাড়ার আধা চেনা দেবিকার চ্যালা অমল এসে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে সুকান্তর শেষ চিঠিটা দিয়ে গেছিল। সে চিঠিতে পরাজিত, হতাশ, ক্লান্ত সুকান্ত লিখেছিল অসহায় হয়ে সে কেয়ার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করছে। কেয়া যেন যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে।
তার বেশ কয়েক বছর পর ব্যাঙ্কচাকুরে, কবি সুকান্তর সাথে ‘কবি’ দেবিকার বিয়ে হয়। অংশুর কাছে শুনেছে সারা জীবন কাওরা ঝগড়া করেই কাটাল। সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে সুকান্তকে দেবিকা কেঁচে করে রেখেছে। সুকান্ত বহুদিন মদের আশ্রয়ে।
আজ হঠাৎ তাকে মনে পড়ার কারণ কী? বইমেলায় দূর থেকে দেখে এড়িয়ে চলে যেত সুকান্ত যেন ভুত দেখছে। কবিতা পাঠের আসরগুলোতেও তাই। সুকান্তর প্রতিটা কাব্যগ্রন্থ ও গল্পের বই অংশু এনে দিয়েছে। কেয়া জানে তার একটা বইও সুকান্তর সাহস হবে না ঘরে রাখার। এরকম একজন ভীতু, নীতিজ্ঞানহীন ছেলেকে কেয়া ভাল বেসেছিল ভাবলেই নিজের ওপর রাগ হয়। এখন ওদের জন্য এক ধরণের অনুকম্পা বোধ করে কেয়া। সুকান্ত -দেবিকার দেয়া অপমানের জেরে কেয়া আর বিশ্বাস করে কাউকে বিয়ে করল না।
খামটা খুলে বইটা বের করার পর এবার পাতা ওল্টাল কেয়া। সিগারেট প্যাকেট ছেঁড়া ছোট এক টুকরো শক্ত কাগজে লেখা ‘বইটা তুমি যদি মন দিয়ে পড়ো তাহলে আমার ভাল লাগবে। মতামত জানাতে হবে না, তোমার ভাল লাগাটা আমি অনুভব করতে পারব। ভাল থাকো।’ এখনো এতটা কনফিডেন্স যে ওর কবিতা কেয়ার ভাল লাগবেই! কেয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য- সমুদ্রের ঢেউ একরাশ চিঠিকে একবার টেনে নিচ্ছে আর বালির ওপর ফিরিয়ে দিচ্ছে। ঢেউগুলো আসছে আর যাচ্ছে অথচ একটু দূরে একজোড়া চোখ স্থির হয়ে আছে এক পরম শুন্যতার শরীরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *