ধারাবাহিক উপন্যাস: দ্বিতীয় পৃথিবী (৮ম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

ধারাবাহিক উপন্যাস: দ্বিতীয় পৃথিবী- ৮ম পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত

সেদিন রাতে ঋর মোবাইলে সুমিতের মেসেজ এসেছিল । রেল অবরোধ, কখন ফিরতে পারবে সে জানে না । ঋ বাবাকে শুধু সংক্ষেপে লিখেছিল, যেখানে যে অবস্থাতেই থাকো, কিছু খেয়ে নিও।
এটুকু কথা বিনিময়ে যেন বাবা মেয়ে দুজন দুজনের ভালবাসা, যত্নের পারস্পরিক টান সীমিত সুযোগে বাঁধে। রণিতা সে খবর সবটুকু না জানলেও কিছু একটা আন্দাজ তার আছে। রাতে খেতে বসে রণিতা ঋকে বলে,
“— তোকে ফোন করেছিল ?
— না
— তাহলে ?
— মেসেজ করে জানিয়েছে, ট্রেন চলছে না। এখন শিয়ালদহ স্টেশনে বসে আছে। আমি বলেছি কিছু খেয়ে নিতে।
— ও ! তা আমাকেও তো একবার ফোন করতে পারত ?
— তুমিও তো করতে পারতে। সারাদিনে করেছ একবার ?
— ঋ, তুই কি তোর বাবার কোনো দোষ খুঁজে পাসই না ?
— দেখো মা, আমি তোমাদের দোষ খুঁজতে যাব কেন ? বাবা মায়ের দোষ গুণ খোঁজায় আমার আগ্রহ নেই। ওটা তোমাদের ব্যাপার।
— বাঃ ! বেশ বড় বড় কথা শিখে গেছিস দেখছি!
তা উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টে এই বুদ্ধির প্রমাণটা থাকবে তো ?
— সব কথাতেই তুমি পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে কথা বলো মা, আমার ভাল্লাগে না।”
সদ্য সমাপ্ত উচ্চমাধ্যমিকের পর ঋ এখন একটা কম্পিউটার সেন্টারে যায়। সেখানেই দু’বছরের সিনিয়র এক দাদার সঙ্গে আলাপ হয়েছে ঋর, নাম গৌতম। বি কম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গৌতম দা ঋকে কথায় কথায় একটা চাকরির স্বপ্ন দেখায়। পাশাপাশি কম্পিউটারে বসে গৌতম দা ঋকে প্রয়োজনে সাহায্য করে শিখতে। খুব অল্প দিনের পরিচিত হলেও গৌতমের একটা আশ্চর্য প্রেরণা পেতে শুরু করেছে ঋ। ঋ এখন নতুন এক ব্যক্তিত্বের সন্ধানে নিজেকে আলাদা করে তৈরি করতে চায়। উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট হাতে পেলে সে কলকাতার কাছাকাছি কোনো কলেজে অ্যাডমিশন নেবে। সঙ্গে চলবে চাকরির কোচিং। গৌতম দা তাকে বলেছে,
“— এই পলাশপুরের মায়ায় পড়ে থাকলে জীবনে খুব বেশি কিছু হবে না।” এমনকি, গৌতম দা নিজেও গ্রাজুয়েশনের শেষ এক বছরটা কেটে গেলেই কলকাতার কাছাকাছি কোথাও মেসে চলে যাবে। ওর চাকরির পড়াশোনা অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। এরপর পুরো সময়টা দিতে পারলেই, জীবনের একটা হিল্লে। একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার।
গৌতম দার দেখানো পথটা ঋকে ভীষণ টেনেছে। তাই সামনে তার আর কোনো বিকল্প ভাবার ইচ্ছে নেই। শেষ তিন চার বছরে বাড়িতে অভাব অভিযোগের শব্দটা কমে এসেছে ঠিকই। কিন্তু বাবা আর মায়ের সম্পর্ক দিন দিন কেমন বিদঘুটে বিচ্ছিন্ন মতো হয়ে গেছে, ঋ বোঝে। অথচ সে যেন তার চরম যন্রণা ছিল এতো দিন। ছোটো বেলার বন্ধু # এর থেকে অসহ ব্যবহার ঋকে আঘাত করেছিল ভীষণ। কিন্তু সে ভেঙে পড়েনি। ধীরে নিজেকে সামলে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। আর এখন গৌতম দা তাকে যেন আর এক নতুন পথের সাহস যুগিয়েছে। যেদিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলে, বাবা-মায়ের বিষয় থেকে ধীরে ধীরে সে নিজেকে মুক্ত করার শক্তি পাবে। এসব যে তার আর সত্যিই ভাল্লাগে না।
রণিতার তখনও রাতের খাওয়া শেষ হয়নি। ঋ যেন একটু ব্যস্ত উঠে মুখ ধুতে চলে গেল। রণিতা খাওয়া থামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ঋর দিকে তাকিয়ে দেখল। ঋ যেন মায়ের দিকে ফিরে তাকাল না। সে চলে গেল পড়ার অছিলায়, ঘরে।
রণিতা লক্ষ্য করে, ঋ আর আগের মতো মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে হেসে লুটিয়ে পড়ে না। পাশাপাশি এক খাটে রাতে ঘুমোতে গেলেও ঋর কানে ইয়ারফোন, মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত। অবশ্য ইদানিং রণিতা নিজেও যথেষ্ট মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। ফলে রাতে শোবার বিছানায় মা মেয়ে পরস্পর দুদিকে মুখ করে মোবাইলে কাটিয়ে দেয় সময়। তারপর কে কখন ঘুমিয়ে পড়ে, সে শুধু সেই জানে।
তবু রণিতার যেন রাগ হয়, ঋর উপর। প্রোডাক্ট মার্কেটিং এর কাজে দিন দিন রণিতার ব্যস্ততা ভীষণ ভাবে বেড়েছে। সে আলাদা করে মেয়ের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় পায় কোথায়। অথচ সুমিতটা পুরো হোপলেস। সে তার এ পত্রিকা সে পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। রণিতা দিন দিন ব্যবসায় এতোটা ইনভলবড হলো কেন, সুমিত কি জানে না তার কারণ। জানে কিন্তু জেনেও অজানার ভান করে ঘুরে বেড়ায়। সেই কবে থেকে এই একচিলতে ভাড়া ঘরে এনে তুলেছে। পারল না নিজের মা বাবার সঙ্গে বোঝাপড়া করে একটা স্থায়ী ঘরবাড়ির স্বপ্ন দেখাতে। এমনকি মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুমিতের আদৌ কোনো রকম ভাবনা আছে কিনা, আজ পর্যন্ত রণিতা তা জানতে পারে নি।
“অথচ বিজনেসের প্রয়োজনে বর্ধমানে কেন হোটেলে রাতে থেকে গেলাম, এটাতে সুমিতের খেয়াল খুব ! বেশ করেছি হোটেলে রাত কাটিয়েছি ! তোমার কী ? বিয়ে করে, সংসার পেতে কাব্য কবিতা দেখাতে এসো না সুমিত। এটা বাস্তব জীবন। এখানে সবসময় প্রয়োজন হা করে আছে। সেখানে সাপ্লাই দিতে না পারাটা কাপুরুষের কাজ। তুমি প্রতিনিয়ত তাই করে গেছো। এখন বাপ্পাদিত্যর নাম শুনলে তোমার পৌরুষ নিঃশব্দ ক্রোধে চিড়বিড় করে ? করুক ! পারব না তোমার ঐসব ভিজে ভিজে কথা শুনতে। আমার আর ভালো লাগে না। বাপ্পাদিত্য আমাকে অনেক বেশি নিরাপত্তা দিতে চেয়েছে। সে আমার উন্নতির জন্য একশো শতাংশ দায়ী। কী ছিলাম আমি, সামান্য নড়বড়ে হাউসওয়াইফ! আজ মাসে মাসে যে কমিশন একাউন্টে ঢুকছে, সেটা ঐ বাপ্পাদিত্যর জন্যই।
তুমি, হ্যাঁ তুমিই, সুমিত জানতেও পারো নি, আমি প্রফুল্ল নগরে একটা নতুন হাউসিংএ সাড়ে সাতশো স্কয়্যার ফুটের একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি। সেটারও গ্যারান্টার ঐ বাপ্পাদিত্য। কিন্তু সে খবর তোমাকে বলার অবকাশও তুমি দাওনি সুমিত। তোমার প্রশ্ন, আমি কেন এবং কোথায় রাতে ছিলাম ! কাপুরুষ কোথাকার ! লজ্জা করে না !”
নিজের মধ্যে এতো রাগ, দুঃখের আত্মকথনে ঘেমে উঠেছে রণিতা। বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। ছোটো বারান্দায় পায়চারী করে। ঋ ঘুমিয়ে আছে এক পাশে। রণিতা বাথরুমে গিয়ে হাতে মুখে জল দিয়ে আসে। ঘুম আসে না তার। এতক্ষণ মোবাইল অফ করে রেখেছিল। ফের অন করে। দেখে বাপ্পাদিত্য অন। নক করে। কথোপকথন শুরু হয়। ঘড়িতে তখন দু’টোর কাছাকাছি।
এখন বাপ্পাদা বলে সম্বোধন করে না রণিতা। পরস্পর অনেক কাছাকাছি এখন তারা। শুরুতে বড্ড অসহায় বোধ করেছিল রণিতা। এক এক সময় তার মনে হয়েছে এইসব মার্কেটিং বিজনেস তার দ্বারা সম্ভব হবে না। মনে হয়েছে, যে কাজের মূল পুঁজি মানুষকে কনভিন্স করানো, তা কী করে তার দ্বারা সম্ভব ?
কিন্তু শুরুর দিন থেকে প্রতিদিন নানা ভাবে সাহস আর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান হয়ে পাশে থেকে গেছে বাপ্পাদিত্য। কত দূরে দূরে বিনা খরচে নিয়ে গিয়ে নতুন এজেন্টদের জয়েন করিয়ে দিয়েছে সে। কোম্পানীর উত্তর পূর্বাঞ্চলের ডাকসাইটে ডায়মণ্ড লেভেল মার্কেটিং সিনিয়র এই বাপ্পাদিত্য। মাসে তার কোম্পানী থেকে নিজস্ব ইনকাম বিরাট অঙ্ক। অথচ এক জন নতুন সাধারণ এজেন্ট রণিতাকে কী দারুণ ভাবে আগলে রেখে এগিয়ে নিয়ে গেছে লোকটা।
রাত বিরেতে পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। কিন্তু কখনও সুযোগ নেয় নি কোনো রকম অনৈতিক কাজের। সম্মান দিয়েছে যথেষ্ট। নাগাড়ে উপহার দিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস। অভাবের সংসারে প্রায় বলবার মতো কিছুই ছিল না। বাপ্পাদিত্য চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রয়োজন পুরণে ব্যবসায়িক টার্গেটই একমাত্র লক্ষ্য।
রণিতার পরিশ্রমের প্রতিটি মুদ্রায় বাপ্পাদিত্যর সহযোগিতা ছুঁয়ে আছে। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ির যে স্বপ্নটা রণিতা সারাক্ষণ লালন করে গেছে গোপনে, আজ তা বাপ্পাদিত্যর দেওয়া সাহসে ভর করে পা ফেলেছে। তাই রণিতা মনে মনে কৃতজ্ঞ হতে হতে একসময় কীভাবে ভালবাসা দিয়ে ফেলেছে,তা তার নিজের কাছেও যেন অজানা।
মোটরবাইক থেকে ফোর হুইলারে পাশাপাশি থেকে কাছাকাছি বসা— ধীরে প্রিয়তা তৈরি করতে পেরেছে। মানুষকে বুঝিয়ে ব্যবসায় যোগ করানোর এক জাদু বক্তৃতা জানে বাপ্পাদিত্য। কতবার অবাক হয়ে রণিতা নিজেই শুনেছে সেই আকর্ষণীয় কথা।
পুরুষ হিসেবে বাপ্পাদিত্যর উপস্থিতি অসাধারণ। দীর্ঘ দেহ, ফর্সা রং, শ্রুতিসুখকর কন্ঠ আর বলিষ্ঠ বাহু। সব সবই ধীরে ধীরে ভালবাসতে শুরু করেছে রণিতা রায়। সবচেয়ে বড় কথা বাপ্পাদিত্যর কেয়ারিং।
রোমান্টিক হিসেবে তার মতো পুরুষ রণিতা স্বপ্নে দেখেনি কখনও। যার সাহস আর সবসময় উদ্যমী উদ্দীপনা রণিতাকে চুম্বকের মতো টানে।
তাই তো আজ সে রণিতার বড় আপন জন। আজ সে সব ভাবনার সহমর্মী। দিন হোক বা রাত রণিতা ইচ্ছে হলেই খুঁজে পায় বাপ্পাদিত্যকে, ভার্চুয়াল যোগাযোগে। সব ইচ্ছে কষ্ট আনন্দ যেন ভাগ করে নিতে এমন একজন মানুষ প্রতিটা মানুষই চায়। রণিতাও জীবনের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তেমন এক মানুষের আজ প্রিয় মানুষ।
মধ্য রাত পেরিয়ে আজ বিনিদ্র রণিতা নক করতেই বাপ্পাদিত্য লিখে জানায়,
“— পেপার ওয়ার্ক করছিলাম। কিন্তু তুমি এখনও জেগে ?”
রণিতা লেখে,
“— ঘুম নেই তাই। ভাবলাম তুমি আছো হয়তো।
তাই..”
বাপ্পাদিত্য হাতের কাজ রেখে দেয়। লেখে,
“— এখন কাজ থাক। তোমার সঙ্গে কথা বলি।”
শুরু হয় ওদের কথোপকথন।
সুমিতের সঙ্গে প্রায় দুই দশকের মতো সময় অতিবাহিত করেছে রণিতা। সে যেন তার এক প্রকার তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে মনে হয় এখন। কারণ বহু চেষ্টা করেও সুমিতের মতো একগুঁয়ে লোকটাকে সে কিছুতেই বদলাতে পারে নি। শুরুতে তারুণ্যের মোহে একদিন রণিতা সুমিতের কবিতায় আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সে আকর্ষণের কেন্দ্রে রণিতার কোনো কাব্যবোধের স্বাদ বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না। ছিল শুধু তরুণ কবির নম্র নরম পেলব রোমান্টিকতা। সে একান্তই ফ্যান্টাসি । অল্প দিন পর থেকে রণিতা সংসার জীবনের ফাঁদে জড়িয়ে ঝটপট কম করেনি। ধীরে মেনে আর মানিয়ে নিতে একটা মানসিক রফা করেছিল নিজের সঙ্গে।
নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে, নিজের পরিবারের কাছেও অভিযোগ জানানোর তেমন সুবিধে তার আছে বলে বিশ্বাস হয়নি। ফলে এটাই তার জীবনের ভাগ্যলেখা বলে রণিতা ধরে নিয়েছিল। তবু সে সুমিতকে লাগাতার কবিতা প্রেম কমিয়ে অর্থ উপার্জন প্রেমে মনোনিবেশে উৎসাহ যোগান দিয়ে গেছে।
শ্বশুর বাড়িতে তেমন কিছুই মূল্য পায়নি রণিতা। শুরু থেকেই অসম্মান আর শেষ পর্যন্ত অ-সম্পদ করেছে। ফলে স্বপ্ন দেখার মতো নূন্যতম আশা ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে মরে গেছে রণিতার। আর ঠিক সেই রুঢ় জীবন-অভিজ্ঞতা তাকে যন্ত্রণাকাতর এক আপাত কঠিন রূপে আচ্ছাদিত করে রেখেছে দীর্ঘ দীর্ঘদিন। বিপরীতে সুমিত যে কে সেই। কবিতা কবিতা করে ছুটে বেড়িয়েছে সময়ের এপার ওপার।
রণিতা মনে করতে পারে না এখন এই মুহূর্তে, শেষ কবে সে সুমিতের সঙ্গে এক বিছানায় আদরে সোহাগে রাত কাটিয়েছে। হয়তো সে এক বা দেড় বছর হবে। নিজের ইচ্ছের পুরো উল্টো চলা লোকটাকে আর সহ্য করতে পারে নি রণিতা। বরং বিরক্তি বৃদ্ধি পেতে পেতে একদিন তা দূরবর্তী দুই মেরুর অবস্থান দিয়েছে।
দীর্ঘ দীর্ণ নদীতে অবশেষে একদিন সজল ধারা এসে ভরিয়ে তুলেছে। সমস্ত ফাটলের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে উত্থিত জলে ভরে উঠেছে শুকিয়ে যাওয়া নদী। স্রোতহারা হয়ে উঠেছে ফের স্রোতস্বিনী। পাথুরে চুনের পাহাড় গলতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। মাঝরাতের কথোপকথনে বাপ্পাদিত্য আর রণিতা এখন কত যে চেনা দুই মানুষের এক স্পন্দন। বাপ্পাদিত্য লেখে,
“— এখন তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না, জানো রণিতা।”
রণিতা লেখে,
” — তা বললে কি হয়, তোমার স্ত্রী পরিবার আছে। তারা তোমাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে।”
বাপ্পাদিত্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে লেখে,
” রণিতা, তুমি খুব সহজ, সরল তাই বোঝো না। আমার সব আছে, অথচ একজন রণিতা নেই।
— মানে ? ঠিক বুঝলাম না ? তোমার স্ত্রী তো সুন্দরী, শিক্ষিতা…
— হুম, সুন্দরী এবং শিক্ষিতা অবশ্যই। কিন্তু আমার টাকা ছাড়া তার আর আমার কাছ থেকে নেবার কিছু নেই।
— তোমার ছেলে তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে ?
— হ্যাঁ, ভালবাসে। সকাল হলেই টাকা দাও। আজ দশ হাজার,কাল পাঁচ হাজার। তারপর তার আর বাবাকে দরকার নেই। লেখাপড়া নষ্ট করে এখন শুধু বন্ধুবান্ধব নিয়ে পড়ে থাকে।
কিছু বলতে গেলেই ওর মায়ের সাপোর্ট। আমার বিরুদ্ধে মা ছেলে মিলে প্রতিবাদ। কার জন্য এই জীবন , আমি বুঝতে পারি না রণিতা !
— ভাগ্যের কি পরিহাস ! দেখো আমাদের দুজনেরই জীবনের শূন্যতা প্রায় একই। তোমার সামর্থ্য আছে, সাহচর্য নেই। আমার সামর্থ্য নেই বলেই সাহচর্যও নেই।
— সত্যি বলতে কি জানো রণিতা সুমিত হয়তো জীবন সম্পর্কে উদাসীন, তাই সে তোমাকে পায় না। অথচ দেখো এই মাত্র তিন বছরের মধ্যে তুমিই আমাকে নতুন করে জীবনের স্বাদ দিয়েছ।
— ওভাবে বোলো না বাপ্পাদিত্য, আমি আর তোমাকে কী দিতে পেরেছি। তুমিই তো অনেক দিয়েছ। আমি একান্তই দরিদ্র।
— এভাবে কখনও বলবে না রণিতা। তুমি আমাকে নির্ভেজাল ভালবাসা দিয়েছ। কখনও সেখানে দেওয়া নেওয়ার এতটুকু হিসেব ছিল কী ?
— না না, ছিঃ, আমি তা কখনও ভুলেও ভাবি না।
তুমি আমার পাশে এক আশ্রয় বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছ। সে শুধুমাত্র আশ্রই নয়, শীতল শান্তির এক ভরসার। তোমার উদারতায় আমি দিনের পর দিন শুধু মুগ্ধ হয়েছি। তারপর…
— তারপর কী বলো।
— তারপর একদিন নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারিনি বাপ্পাদিত্য। সমস্ত উজাড় করে দিয়েছি।
— কী সুন্দর সেই দ্বৈত মুহূর্ত তাই না রণিতা ?
— হ্যাঁ গো, আমার বুকের মধ্যে এখনও সেই স্পন্দন । তুমি আমার পরশপাথর বাপ্পাদিত্য।
— ওফফ্ ! আমাকে স্মৃতি সুধায় ভরিয়ে দাও তুমি। আমি কাঙাল হয়ে যাই রণিতা…”
সে রাতে কথার গা বেয়ে ওঠে আরও আরও কথা। হৃদয় আর তার আধার যে শরীর তা পরস্পর শ্বাসে আর বিশ্বাসে জড়াজড়ি করে ভাবের সৌধ নির্মাণ করে তোলে। ধীরে রাত পেরিয়ে হয় শুভ ভোর।
পরদিন সকালে ঋ কখন ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটার ক্লাসে চলে গেছে রণিতা দেখতে পায় নি। সে যখন বিছানা ছেড়েছে তখন ঘড়িতে নটা। আজ রণিতার বিজনেস ওয়ার্ক বিকেলে। তাই আজ সকাল দুপুরে সংসারের অনেক কাজ তাকে গুছিয়ে রাখতে হবে। চা ব্রেকফাস্ট সেরে রণিতা কিছু কাঁচা বাজারের জন্য বেরবে বলে নাইটি ছেড়ে একটা সালোয়ার পরে নেয়।
সালোয়ারটা গায়ে চড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজেকে বেশ ঘুরে ঘুরে দেখে রণিতা। নিজেই নিজেকে বলে,
“–দারুণ মানিয়েছে, সত্যিই।”
এটাই তো সেদিন বোলপুর থেকে বিজনেস মিটিং সেরে ফেরার পথে খোয়াইয়ের হাটে ঢু মারতে গিয়ে বাপ্পাদিত্য জোর করে কিনে দিল। তাঁতের কাপড়ের উপর ছোটো ছোটো অ্যাপলিকের কাজ।
তারপর চুল আঁচড়াতে গিয়ে হঠাৎ রণিতার মনে পড়ল,
“— সেদিন বাড়িতে ফিরে, ঋকে বলেছিলাম, এটা তোর জন্যে এনেছি ঋ। ঋ দেখল কিন্তু একবারের জন্যও বলল না, ওর পছন্দ হয়েছে। পরে যখন জানতে চাইলাম, ঋ বলল ওর অনেক আছে। বলল, ওটা তুমি পোরো মা।”
কথাটা মনে পড়তে রণিতার মনটা কেমন যেন অসহায় হয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবল,
“— ঋও কি আমাকে দূরে ঠেলে দেবে ? এই যে ওকে কম্পিউটার কোর্স করাচ্ছি, সে তো ওর জন্যই আমার স্বপ্ন। ওর বাবা কখনও তো এসব নিয়ে এতটুকু ভাবেনি। নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথায় না কোথায়। অথচ ঋ তা কি সত্যিই বুঝবে না। দিন দিন ঋ কেমন চুপ হয়ে যাচ্ছে। আমার আর ভালো লাগে না ঈশ্বর !”
এক হাতে একটা বাজারের থলে আর অন্য হাতে মানি-পার্স নিয়ে ঘরের চৌকাঠ পেরয় রণিতা। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে পিছন ফিরতেই দেখে একটা স্কুটি এসে গলির মোড়ে দাঁড়াল। আর সেই স্কুটি থেকে নামছে ঋ।
রণিতা মুহূর্তে থমকে গেল। গলা বাড়িয়ে দেখতে থাকল। ছেলেটি বেশ সুন্দর ঋর থেকে সামান্য বয়সে বড় হবে হয়তো। স্কুটি থেকে নেমে ঋ কিছুটা হেঁটে এসে আবার এগিয়ে গেল। ছেলেটি ডান হাতটা এগিয়ে কী একটা দিল ঋকে। ঋ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, সেটা হাতে নিয়ে ব্যাগে রাখল। রণিতার মনে হলো, চকলেট হবে হয়তো। তারপর ঋ টাটা করল এবং স্কুটি স্টার্ট করে ছেলেটি গলি ছেড়ে বড় রাস্তার দিকে চলে গেল। রণিতা শুধু মনে প্রশ্ন করল, ” ছেলেটি কে ?”

( এরপর আগামী পর্বে)
— অনিরুদ্ধ সুব্রত

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস: দ্বিতীয় পৃথিবী (৮ম পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. সুন্দর এগোচ্ছে। অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *