আলিঙ্গন
চিত্রাভানু সেনগুপ্ত
পশ্চিমে ঘন নীল আকাশের বুকে দিন শেষের পরন্ত আলো এখনো পুরোপুরি ম্লান হয়নি। দূর নভোলোকে সদ্য বিবাহিতা বধূর সিঁথির চারিপাশে লেপ্টে থাকা উজ্জ্বল সিঁদুরের মত রক্তিম আভা এখনো হালকা বিদ্যমান। কাঁঠাল পাতার ফাঁক দিয়ে গোধূলির আলো-আঁধারি ছায়া ঘেরা উঠানে সন্ধ্যে নামছে ধীর পদে। বুড়ো বটের ঝুড়ি আর ডালপালার খাঁজে ঘরফেরা পাখিদের বিরামহীন কলতানে আর দিগন্ত জোরা আবির মাখামাখি প্রকৃতির মূর্ছনায় মিশে আছে এসরাজের ভৈরব তান। আর কিছু বাদে গোটা একটা দিনের আলো যখন আরো একটু নিভে আসবে কাজল রঙা গভীর শূন্যে মিটমিট করে জ্বলে উঠবে নক্ষত্ররাজি। সমস্ত চৌধুরী বাড়ির উঠোন , দালান, ঘর দুয়ারময় তিন তলার আবাসখানি জুড়ে ঘাড়ে-পিঠে বেয়ে নামা পাতলা তারের গায়ে ফুটে উঠবে ফোঁটা ফোঁটা আলোক বিন্দু। কাল এখানে নহবৎ বসেছিলো , আলোর মালায়, আত্মীয়া-অনাত্মীয়ার হর্ষধ্বনিতে, শঙ্খবাদনে, উলুধ্বনিতে মেতে উঠেছিলো গোটা বাড়ি, আজ সেখানে মিশে আছে কেবল বিচ্ছেদের বিষাদ মাখা সুর। কিছু আগে নিবেদিতা তার চির পরিচিতা জন্মভিটে ফেলে পতিগৃহে দিয়েছে পাড়ি। বাড়িটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। গৃহের সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, বসে থাকার জো নেই। আজ বাড়িতে অনেক কাজ।
বরণের কুলোখানা হাতে নিয়ে দোতলার দক্ষিণ কোনের ঘরে ঢুকলো সুতপা। মন্দিরাকে উদ্দেশ্যে করে বলল…..”ছোটমানি, কুলোটা কোথায় রাখি বল তো? একি! কি করছো তুমি?”
মন্দিরা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল….”এই তো, তেমন কিছু না।কেন রে? কোন কাজ আছে?”
—“আছেই তো! তত্ত্বের কত ট্রে এখনো সাজানো বাকি। ওদিকে ওগুলো তো সকালের মধ্যে তৈরি করতে হবে! কসমেটিক্স গুলো চট করে বের করে দাও। আর নারকেল বুড়ির জন্য দুটো নারকেল কি আনিয়েছ?”
–“এক্ষুণি আসছি।” বলতে গিয়েই নিজের আঁচলে বাঁধা চালের খোটের দিকে চোখ পড়লো মন্দিরার। —” এই চাল গুলোর কি করি বলতো?”
নিমেষে কেমন অদ্ভুত মায়াবী কান্নায় গলাটা জড়িয়ে এলো।—” কি অদ্ভুত নিয়ম তাই না? মেয়েটা দু মুঠো চাল ফেলে দিয়ে বলে গেল….তোমার সব ঋণ শোধ করলাম। সব ঋণ শোধ হয়ে গেল? এতো সহজ? “
–“যত্তোসব রাবিস! নবুও তো মানা করল কতবার। এই কথাটা নবুর একদম বলার ইচ্ছে ছিলো না। তুমিও তো বাধা দিলে না?”
—“বাড়ির গুরুজনেরা বলল যে করতে হয়। আমি কি সবাইকে টপকে বলতে পারি কিছু? যাক গে শোন, আর কটা ট্রে বাকি রে? “
–“কসমেটিক্স গুলো তো সবটাই বাকি। নারকেল বুড়িটাও বানাবো। ফলের ট্রেটা যা সুন্দর হয়েছে না! তাড়াতাড়ি এসো দেখাবো। “
মন্দিরা ব্যস্ত হয়ে বললেন…..”সংক্ষেপে যেটুকু হয় কর।বড্ড খাটনি যাচ্ছে তোর। মেয়েটাকেই তো ওদের দিয়েই দিলাম বল? আবার এতো সাজিয়ে দেওয়ার কি আছে বল তো ?”
এতোক্ষণে হাসলো সুতপা। মন্দিরার গলা জড়িয়ে বলল….” এই জন্য তোমায় আমি এত্তো ভালোবাসি ছোটমানি। তোমার সাথে আমার মত গুলো কেমন করে মিলে যায়। তবু কি জানো? তুমি তো মা, সাধ হলেই কত্তো কিছু গুছিয়ে দিতে পারো। কিছুতে কার্পণ্য তো করনি। আর আমি? অবশ্য তোমার সঙ্গে তুলনা কি? তুমি মা, আমি ওর জ্যেঠতুতো দিদি। তবু আপন বোন ছাড়া আর কিছু কি ভেবেছি ওকে? সেই ছোট্ট থেকে ঘাড়ে পিঠে কত বেয়েছে আমার। ওর পছন্দ গুলো আমিও তো জানি কিছুটা। তাই সাধ হল মনের মত একটু গুছিয়ে দিই। তুমি আর বসে থেকো না। আমি উপরের ঘরে চলে যাচ্ছি। যদি আর কিছু গোছানোর থাকে নিয়ে এসো।”
সুতপা উপরে যেতেই সকলে ছুটে এলো….”ও দিদিভাই, আর কি করতে হবে দাও। সেলোফেন পেপার তো কম পড়েছে। জরির ফুলও লাগবে। “
–” কি কি আনতে হবে লিস্ট কর দেখি! আমি বলে দিয়েছি ভাইয়াকে দোকান যেতে হব । আর একটা এক্সট্রা কাঁচি লাগবে। সবাই একটা নিয়ে টানলে হবে না। এবার আর কটা ট্রে আছে খুঁজে বের কর। কি কি আর বাকি রইল? মলি একটু এদিকটা দেখে নে। আর মৌ তুই আপাতত যে কটা বানানো হয়ে গেছে তত্ত্বের সূচিতে লেখ, নম্বরগুলো দিতে থাক।”
আজ ঘরের ভেতরটা বেশ সরগরম। গৃহস্থের সুখী গৃহকোণে নানান অবসরে আর অভিজ্ঞতার ফাঁকে গড়ে ওঠে, বেঁচে থাকে কত শৈল্পিক চেতনাবোধ এই তত্ত্বগুলি তার প্রমাণ। এই মুহূর্তে ঘরে উপস্থিত সকলের মিলিত চিন্তায় জন্ম নিচ্ছে এক একটা ছোটখাটো শিল্পকর্ম। মিনিট দশের মধ্যেই মন্দিরা ঘরে এলেন। দুই হাতে বহু যত্নে ধরা রয়েছে দুইখানা পুটলী। একটা পুটলী এগিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো রাখ, ওর সাজের জিনিস। অপর পুটলীখানা খুব সন্তর্পণে সুতপার হাতে এগিয়ে দিয়েও সরিয়ে নিলেন হাত। দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে মৃদুস্বরে বললেন….” এগুলো এনেছিলাম, এই টুকটাক সামান্য কিছু জোগাড় করেছিলাম আর কি! দেখতে পারিস, যদি তত্ত্ব সাজাবার কোন কাজে লাগে।”
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও হঠাৎ কৌতুহলী দৃষ্টিতে পুটলীটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সুতপা। মৌ ততক্ষণে একটু জোরেই হেসেই উঠেছে…..”এগুলো কি ছোটমানি?”
সুতপা সাত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় পুটলীটা টেনে নিলো মন্দিরার হাতের থেকে। বিরক্তির সুরে মৌ-এর দিকে চেয়ে বলে উঠলো ….” আহঃ! বড্ড বাজে বকিস।” পুটলীর মধ্যে ছিলো পুরানো একটা পুতুল, চুলগুলোও জটা পাকিয়ে রয়েছে। একটা খালি পাউডারের কৌট, একটা ছোট্ট রূপালী ট্রে, একটা রঙচটা গয়নার বাক্স, চকচকে কাঁচ বসানো একটা পাতলা চিরুনি আর আয়না, এমন আছে আরো কত কি! বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল সুতপা। মন্দিরাকে বেশ কুন্ঠিত লাগছে দেখতে। বললেন….
” আসলে এইগুলো দিয়ে ছোটবেলা খেলতো আমার নবুরাণী। সব সময় এই পাউডার কৌটটা ওর হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াত আর জিজ্ঞেস করলে বলতো, মেয়েকে পাউপাউ মাখাচ্ছি।” ” বাহঃ! বড্ড কাজের জিনিস এনেছো ছোটমানি। দেখি, কি করতে পারি এগুলো নিয়ে। কিন্তু এখানে শুধু আমার কাজ করলে চলবে না। তোমারো কাজ আছে।”
“আমি? আমি কি করবো।” ” গল্প লিখবে বুঝলে?”
” কিসের গল্প?” ” আছে। আগে তৈরি হতে দাও, তারপর বলছি।”
আজ গাঙ্গুলি পরিবারে বধূবরণ উৎসব। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। সকাল সকাল তৈরি হতে হবে নতুন বৌমাকে। একটু পরেই শুরু হবে ভাত কাপড় আর বৌভাতের অনুষ্ঠান। এদিকে বিলম্ব হয়ে গেলে বিকেলের সব কাজে দেরি হয়ে যাবে। খবর এসেছে মেয়ের বাড়ির লোকেরা ওদিক থেকে তত্ত্ব নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। দারুণ ব্যস্ততায় ভাত কাপড়ের থালা গোছাতে লেগেছেন অরুণিমা গাঙ্গুলি। পাশের মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন…..” হ্যাঁ রে, বৌমা তৈরি হয়েছে তো? যা একটু দেখে আয়।”
অকস্মাৎ উলুধ্বনি আর শঙ্খ বাদনে গোটা বাড়িখানা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঘরে উপস্থিত কুটুম্বদের মধ্যে নিমেষে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন কন্যাপক্ষ। হঠাৎ কেউ এসে অরুণিমা দেবীকে ডাক দিয়ে বললেন…..”বৌদি, ওঁরা তোমায় ডাকছেন।”
“এই তো আসছি ভাই। ওনাদের বসাও। আমি হাতের কাজটা সেরে এক্ষুণি আসছি।” ” না ওরা বলছেন মেয়ের মা একটা চিঠি দিয়েছেন তোমাকে। প্রথম তত্ত্বটা ওরা তোমার হাতেই দেবেন।”
কথাটা শুনে একটু অবাক হলেন অরুণিমা। বিস্ময় সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খানিক তারপর এগিয়ে গেলেন কন্যাপক্ষের দিকে। সুতপা একখানা তত্ত্বডালি এগিয়ে দিল অরুণিমা দেবীর দিকে। তত্ত্বটা বেশ একটু অন্য রকমের সাজানো, উপরে ঢাকা রয়েছে একটা নীলের উপর সোনালী আর গোলাপি দিয়ে কারুকাজে ভরা ব্রোকেটের আচ্ছাদনে। আচ্ছাদনের উপরে রাখা রয়েছে একটা গোলাপী সুগন্ধি খাম । আর তার উপরে লাল কলমে গোটা গোটা করে লেখা রয়েছে “আলিঙ্গন”।
….”এটা ছোটমানি, মানে নিবেদিতার মা পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। ওনার অনুরোধ, আপনি চিঠিটা পড়ার পর তত্ত্বের ঢাকনাটা সরাবেন।”
অরুণিমা একগাল হেসে খামটা হাতে তুলে নিলেন। নাকে ঠেকিয়ে দীর্ঘ একটা ঘ্রাণ টেনে বললেন….”আহঃ, ভারি মিষ্টি গন্ধ।”
খামের ফাঁকে লাজুক বধূর মত উঁকি দিচ্ছে একটা ছোট্ট চিঠি।
কল্যাণীয়া অরুণিমা,
আজ আনন্দের দিনে জানি আপনি খুব ব্যস্ত থাকবেন। তবু সামান্য কিছু সময় আপনার কাছে আবদার করছি। আমার এই চিঠি আপনাকে বেশ অবাক করবে তাও জানি। আমার সারা জীবনের সঞ্চয়ে সবথেকে মূল্যবান যা ছিলো তা আপনাকে দিয়েছি। আপনাকে যেটুকু দেখেছি, আপনি তাকে যত্নে রাখবেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্রও। তাই এই সামান্য উপঢৌকন আপনার হাতে তুলে দিলাম। এই আমার জীবনের সঞ্চিত ধন, মনি মানিক্য। আমার নবুর ছোটবেলাটা লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। এগুলোকে স্পর্শ করলে আমি ওর ছোটবেলাটা কে খুঁজে পাই। আপনি ওর দ্বিতীয় মা। তাই ওর ছোটবেলাটাকে আপনার সাথে ভাগ করে নিতে মন চাইলো। এবার থেকে ও আপনার সাথেই থাকবে বেশি। ওর দোষ-গুণ, ভালো অভ্যেস, বদ-অভ্যেস , বায়না, হাসি খুশি কান্নাকাটি, নখ খাওয়া, মোবাইল ঘাটা সবটা আপনার চোখের সামনেই ধরা পড়বে বেশি। তখন আপনি ওকে সামলে নিতে পারবেন এই আস্থা রাখি। আপনার গৃহে সকলের প্রতি আমার আন্তরিক শুভকামনা রইল। ভালো থাকবেন। ইতি….. মন্দিরা চৌধুরী।
হঠাৎ মনের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো অরুণিমার। তাঁর কন্যারত্নটিও তো একদিন এমনি করেই অন্য ঘরে গিয়েছিলো। আজও তো সেই মেয়ের বেড়ে ওঠা, খেলাধূলা হাসি ঠাট্টাকে অবিরাম অনুভব করে চলেন মনের মধ্যে। ব্রোকেটের আচ্ছাদনটা আলগা সরিয়ে ফেলে বেড়িয়ে এলো সেইসব মূল্যবান মুহূর্ত যার প্রতিটা কোনে সাজানো আছে এক মায়ের স্বপ্নের জাল বোনা। এর গুরুত্ব রে কতটা, তা এক কন্যা সন্তানের মা হয়ে বুঝবেন না এমনও কি সম্ভব? খামের উপর গোটা অক্ষরে লেখা “আলিঙ্গন” শব্দটায় আর একবার চোখ বুলালেন অরুণিমা। তারপর তত্ত্বের সাজিখানা আলতো করে জড়িয়ে নিলেন বুকের মধ্যে। ঝাপসা চোখে বলে উঠলেন….” সবাই একটু বসুন ভাই। মিষ্টিমুখ করুন। আমি আমার নতুন মেয়েকে নিয়ে এক্ষুণি আসছি, কেমন?”
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক শৈল্পিক কারুকাজে পরিপূর্ণ অসাধারণ গল্প!
অসংখ্য ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর মনছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়লাম। ধন্যবাদ , শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।