দ্বিতীয় পৃথিবী: সপ্তম পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত
“একজন অন্য পুরুষকে নিজেদের ফ্লাটে এমন দিনে ডেকে নিয়ে আসছ, যেদিন তুমি ছাড়া পরিবারের বাকি দুই সদস্যের কেউ ফ্লাটে নেই। তাছাড়া এটা কোনো দশটা পাঁচটার অফিস বেলা বা দিবালোকে নয়, এখন রাত দশটা অতিক্রম করেছে। হ্যাঁ, তুমি হয়তো বলবে ব্যাপারটা জটিল করে ভাববার কী আছে ! অথবা বলবে— একটা মানুষ বিপদে পড়ার যেমন কোনো সময় নির্দিষ্ট থাকে না, তেমনি তাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রেও সময়টা বিবেচ্য হতে পারে না। বা এমন বলবে কি, যে এই রকম সংশয়াত্মক চিন্তা করাটাই বড্ড সেকেলে ! বন্ধুর বিপদে বন্ধু তাকে কাছে ডাকবে না, আশ্রয় দেবে না, কেবল তথাকথিত নৈতিক ফটোফ্রেমের দিকে নমস্কার ঠুকে চুপ ও উদাস থাকবে ! না তা থাকবে কেন, অমৃতা তুমি যদি সত্যিই এতোটা যৌক্তিক আর সুবিবেচক তবে তোমার কপালের তাপমাত্রা বাড়ছে কেন ? ভয়, সংকোচ, দুঃসাহস ? না স্বাভাবিক হতে পারছই না ? অথচ হতে চাইছ নিতান্তই মানবিক ? শান্ত হয়ে ভাবো। সুমিত আসছে । তোমাকে তো স্বাভাবিক হতেই হবে। না হলে সে বেচারা হয়েই তোমার চোখে অপরাধবোধ আর অনুগ্রহ দেখতে পাবে। তাতে সে আরও কুন্ঠিত হবে। তা তার নিজের কাছেও যন্ত্রণার হয়ে উঠতে পারে। যাও প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল, ফ্লাটের নীচে গিয়ে দাঁড়াও। অনভ্যস্ত সুমিতকে বন্ধুর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে এসো ।”
এমনই আত্ম কথোপকথনে জেরবার অমৃতা ঘন ঘন কপালে হাত ছুঁয়ে দেখছে,
” — হ্যাঁ, সত্যিই তো এ যেন উচ্চ রক্তচাপের মতো। কিন্তু কেন ? সুমিতকে একটা দুর্যোগের রাতে আমার ঠিকানায় আশ্রয় দিতে এতটা দ্বন্দ্ব আর তার জন্য এতো গোপন ভীতি কেন ? কেন ? এটুকু তো সেই স্বাধীনতারই প্রসঙ্গ। ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে কত কথা বলা, লেখা, পড়া, তা কি শুধু এমনিই ?”
আর নিজের সঙ্গে কথা বাড়ায় না অমৃতা। আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেয়। আত্মশক্তির ফুঁ দেয় নিজের মুখে নিজেই। চোয়াল একটু শক্ত হয়ে গেলে ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্লাটের দরজা ভেজিয়ে লক করে। এগিয়ে লিফটে প্রবেশ করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম ছুঁয়ে নীচে নামতে থাকে গতিশীলতায়।
ফ্লাটের নীচে পৌঁছে দারোয়ান এর সঙ্গে একটিই কথা হয়,
“—বেরচ্ছেন ম্যাম ?
— না, একজনকে রিসিভ করব ।”
সামান্য এইটুকুই। তাতেও অমৃতার ভাল্লাগলো না।
” দারোয়ানের আবার জিজ্ঞাসা করার দরকার কী ? বেরচ্ছি না ঢুকছি ?”
অথচ অমৃতা জানে, অমৃতাদের এই পাঁচতলা ফ্লাটের চারটে ফ্লোরে সব মিলিয়ে কুড়িটার মতো ফ্ল্যাট রয়েছে। যার প্রায় প্রতিটি লোককে দারোয়ান ছেলেটা চেনে। প্রত্যেকের রাত বিরেতে ওকে কখনও না কখনও প্রয়োজন পড়ে। অপরিচিত কেউ এলে রেজিস্ট্রার খাতায় নাম লেখাতে হয়। কিন্তু অনেক সময়ই আত্মীয় পরিজনের ক্ষেত্রে, সে সব ও উল্লেখ করে না। তাছাড়া কত সময় কত ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া হয় ওর কাছ থেকে। ও হাসি মুখে সে সব করে দেয়। এই সেদিন সেকেন্ড ফ্লোরের একটা ফ্লাটের অসুস্থ বৃদ্ধাকে নীচে নামাতে এই দারোয়ান ছেলেটিই কত উপকার করল। সে সব মুহূর্তে মনে করে, অমৃতা দারোয়ান ছেলেটির দিকে ফের একবার তাকিয়ে মৃদু হাসে। দারোয়ান ছেলেটা আসলেই একটু বেশি আন্তরিক, আলাপি। সে অমৃতার হাসি মুখ দেখে একটু এগিয়ে এলো,
” —-ম্যাম, যিনি আসছেন তিনি কি এই প্রথমবার ?
— হ্যাঁ, আমাদের গ্রামের আত্মীয়।
— আপনার ব্যাস্ততা থাকলে, চলে যান । আমি ঠিক পৌঁছে দেব ।
— না না, ঠিক আছে। আমার ব্যস্ততা নেই। এই তো এক্ষুণি চলে আসবে।”
দারোয়ান ছেলেটার কথা খুবই আন্তরিক। এই বাড়িটার অধিকাংশ ফ্ল্যাটের মালিক তাই বলে। অমৃতাও জানে। তবু সুমিতের মুখটা এর চেনা হয়ে যাবে, এটা ভেবে কেন যেন মৃদু অস্বস্তি রয়ে গেল।ক্যাব এসে থামতেই অমৃতা এগিয়ে গিয়ে সুমিতকে বলল, নেমে আসতে। উসকোখুসকো এবং একটা কাচুমাচু মুখ সুমিত রায় নিঃশব্দে ক্যাব থেকে নেমে অমৃতার পিছু নিল।
অমৃতাকে অনুসরণ করে সুমিত চুপচাপ লিফটের ভেতর । অমৃতা থার্ড ফ্লোরের বোতামে হাত ছোঁয়ানোর ফাঁকে দূরে দারোয়ান ছেলেটার মুখে এক পলক তাকাল । ছেলেটা তখনও স্বভাবসিদ্ধ সরল মুখে লিফটের দিকে তাকিয়ে ছিল।
স্পেশাল প্রিবুকিং এ অভীক থার্ড ফ্লোরের বিশাল আকারের এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছিল। দুটো প্রায় বারোশো স্কয়্যার ফুটের ফ্ল্যাট মিলিয়ে একটাই ফ্ল্যাট। নিজের পছন্দের চড়া দামি রং থেকে বার্মাটিক সেগুনের আসবাব। ড্রইং থেকে ডাইনিং, বেডরুম সব প্রয়োজনের তুলনায় বেশ বড়। বেশ কতগুলো আর্ট-পেইন্টিং নিজে অমৃতাকে নিয়ে গিয়ে অ্যাকাডেমির এক্সিবিশন থেকে কিনে এনে দেয়ালে দেয়ালে সুসজ্জিত ভাবে টাঙিয়েছে। নার্সারি থেকে অর্ডার দিয়ে আনানো কতগুলো ইন্ডোর প্লান্ট, ঢাউস পেতলের টবে ঘর বারান্দায় রেখেছে অভীক। অমৃতা নিয়ম করে সেগুলোতে জল দেয়।
কোলাপ্সিবল গেট টেনে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে অমৃতা। সুমিত যেন ইতস্তত। অমৃতা বলে,
” — কী হলো ভেতরে এসো ?
— হ্যাঁ, এই তো”
অমৃতা বেশ বুঝতে পারছে, সুমিত ভীষণ কুঁকড়ে আছে। কিন্তু কী কী কারণে সুমিত এতটা আড়ষ্ঠ অমৃতা জানতে পারছে না। তার শুধু একটাই ভয়, সুমিত যেন কোনো রকম হীনমন্যতায় না ভোগে। বার বার যে প্রশ্নটা অমৃতার মনে ছিলই, সুমিত সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ তাই সে যদি এই বিলাস বৈভবের ফ্ল্যাটে ঢুকে মানসিক অস্বস্তি আর হীনমন্যতায় দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে তা অমৃতার পক্ষেও চরম কষ্টের হবে।
তবু ফ্ল্যাটের ভেতর নিজেকে আর সুমিতকে ঢুকিয়ে নিয়ে অমৃতা দরজা লক করে দিয়ে যেন কী এক যুদ্ধে ক্লান্ত। থপ করে সামনের সোফায় বসে পড়ে সে। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয়। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় তখন সবেমাত্র তার কপালের ঘাম শুকোতে শুরু করেছে। হঠাৎ চোখ খুলে যায় অমৃতার। দেখে সুমিত তখনও ঠায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।
চমকে ওঠে অমৃতা।
“— কী হলো, তুমি বসলে না ? দাঁড়িয়ে কেন ওখানে ?
—- না, মানে ফ্রেশ না হয়ে… বাথরুমটা কোন দিকে ? “
মুহূর্তে অমৃতা সুমিতের মনোজগতের আড়ষ্ঠতা টের পায়। যে আশঙ্কা তার আগেই ছিল। কিন্তু অমৃতা কথা বাড়ায় না। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে।
সুমিতের কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিজেই ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের টেবিলের উপর রাখে অমৃতা। বলে,
“— ঐ দিকে এগিয়ে যাও, ওটা বাথরুম। ফ্রেশ হয়ে এসো ঘরোয়া পোশাক দেব চেঞ্জ করে তারপর এসে বোসো।”
অমৃতার কথা মতো সুমিত এগিয়ে যায় ফ্রেশ হতে। মনে মনে ভাবে সে, সারাদিনের ধুলো মাখা গা তার। মার্চের গরমের ঘাম, রোদ্দুরে দগ্ধ হওয়া শরীর। শিয়ালদহ স্টেশনে কাটানো যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে সেই কতক্ষণ। অমৃতার ফ্ল্যাটে নিজের গায়ের জামাকাপড়ও বড্ড বেমানান যেন। সব কিছুতেই সুমিত একটা আস্তো বেমানান মানুষ এই অমৃতা ব্যানার্জীর ফ্ল্যাটে।
তবু বাথরুমের জলের নব ঘুরিয়ে ঠাণ্ডা জল মুখে চোখে দিতে দিতে সুমিত কিছুতেই যেন নিজেকে টেনশনের উত্তাপ থেকে শীতল করে নিতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হলো, সে স্নান করবে। কিন্তু সঙ্গে যে তার অতিরিক্ত পোশাক নেই। মনে হতে সুমিত বাথরুমের দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে অমৃতাকে ডাকতে যাবে, কিন্তু দেখে এক সেট পাজামা আর পাঞ্জাবি নিয়ে বাথরুমের পাশেই অমৃতা দাঁড়িয়ে। দেখে অবাক হয়ে যায় সুমিত। মনে ভাবে,
“– অমৃতা এতো খানি বুঝতে পারে সব !”
মুখে বলে,
“দাও ওগুলো। স্নান সেরে নেবো ভাবছিলাম। সারাদিনের ধুলো বালি গায়ে।”
অমৃতা সুমিতের মনোভাব বোঝে।
বলে,
“— তা নয়, তোমার শরীরের ধকলের জন্য স্নানটা দরকার ছিল। তুমি এগুলো পরে এসো। আমি তোমার জামা প্যান্ট গুলো ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দেবো। চিন্তা নেই শুকিয়ে যাবে।
কাল পরে বেরতে পারবে।”
অভীকের জন্য আগে কতবার অমৃতা পাজামা পাঞ্জাবী কিনেছে। অভীকের অবশ্য পাজামা পাঞ্জাবী পরা ভীষণ হাস্যকর লাগে। বিয়ের পর দু’ একবার জোর জবরদস্তিতে পরেছে হয়তো, কিন্তু তারপর আর কখনও নয়। অমৃতা তবু বেশ কয়েক সেট কিনেছিল।
প্রত্যেকবার এক একটা নতুন ধরণের পাঞ্জাবী এনে ভেবেছে, এবার সে এটা নিশ্চয়ই অভীককে পরাতে পারবে। কিন্তু না, প্রতিবারই সে বিফল হয়েছে। তারপর একদিন অমৃতা অভীকের জন্য পোশাক কেনা ছেড়ে দিয়েছে। অভীক নিজেই সময় সুযোগে শপিং করে নেয় নিজের রুচি আর ইচ্ছে মতো। গেঞ্জি বা টিশার্ট আর জিন্স তার চির পছন্দের।
জমে থাকা সেই সব পাঞ্জাবী পাজামা থেকে একটা সেট আজ সুমিতের গায়ে চড়েছে। অমৃতা সুমিতকে এভাবে কখনও দেখেনি। বেশ অন্যরকম লাগছে সুমিতকে।
অমৃতা বলে,
” — নিজেকে খেয়াল করেছো আয়নায় ?
— হ্যাঁ, দেখলাম।
— বেশ দেখাচ্ছে তোমাকে সুমিত এই ড্রেসে।”
সুমিত মৃদু হেসে সোফায় বসে। মুখোমুখি অমৃতা । এই রকম একটা মূহূর্ত আসে, সুমিত এমন কল্পিত জগতে প্রবেশের সাহস কখনও দেখায় নি। তার ব্যক্তিগত ছন্নছাড়া জীবনের তিক্ত দিন গুলো শুধু দু’হাতে সাঁতারে পার হয়েছে সে। ভালো মানের পাজামা পাঞ্জাবী পরে সোফায় হেলান দিয়ে বসে মিষ্টালাপ তার অভ্যাসে নেই। তবু আপ্রাণ চেষ্টা করে অমৃতার বিলাসী আয়োজনের মাঝে যতদূর সে বেমানান না হয়ে যায়। কারণ অমৃতাকে যে সে সেই কোন কৈশোর থেকে ভালবেসে এসেছে। তবে এখনও অমৃতাকে সে তার সম্ভ্রম এর জন্য, ব্যক্তিত্বের জন্য বিশেষ ভয়ও পায়। একদিন এই মেয়েটিই তার প্রেমের কবিতাটি তুচ্ছ করে চরম অপমান করেছিল। একথা কিছুতে তার শিরদাঁড়া ছেড়ে যায় না।
অমৃতা সুমিতের চোখে ক্লান্তির ছাপ বোঝে। বুঝতে পারে, সুমিতের নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। সে খুব দ্রুততার সঙ্গে খাবার সাজিয়ে দিয়ে টেবিলে,সুমিতকে ডাকে।
সুমিতের সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ সুরে
সে বলে, ” — অভীক বাবু অফিস থেকে ফিরলে, তারপর না হয় খাবো। তাছাড়া তোমার ছেলেকেও তো দেখছি না। ওরা আসুক এক সঙ্গে না হয়…”
সুমিতের কথা শুনে অমৃতা এক মুহুর্ত চুপ করে থাকে। মনে ভাবে, সুমিতকে তাড়াহুড়োতে সে তো বলার সুযোগও পায় নি। তার পর সুমিতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
বলে,
“— ও ! তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, অভীক তো বাড়িতে নেই। মানে কলকাতাতেই নেই। আজ দুপুরেই ও জরুরি কাজে গৌহাটি চলে গেছে। আর ছেলে অনিকেত বিকেলে জানাল ওদের আজ এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে। কাল অফিস করে ফিরবে।”
অমৃতাকে কথা গুলো নিতান্তই সহজ ভাবে বলতে হলো। অমৃতা জানে, একথা আগে বললে সুমিত কিছুতেই এই বাড়িতে আসত না। সারারাত না খেয়ে ঐ শিয়ালদহ স্টেশনে শুয়ে বসে থেকে যেত। তাতে অমৃতা মনে মনে কষ্ট পেত, সে কষ্টের বেশিরভাগই অপরাধ বোধের।
অমৃতা সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, সুমিত যেন হা করে চেয়ে আছে। সুমিত যে কিছুটা আকস্মিক ভাবে কথাগুলো নিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবু অমৃতা চায়, মাত্র একটা দিনের জন্যে সে সুমিতকে এতটুকু উপকার করতে চেয়েছে । তাতে সুমিত যদি দ্বিধায় দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকে, তবে যে অমৃতা নিজেই অস্বস্তিতে ভুগে মরবে। তাই যতদূর সম্ভব অমৃতা চেষ্টা করে সুমিতের আড়ষ্ঠ মনকে স্বাভাবিক গল্প আর যত্ন দিয়ে সহজ করতে।
খেতে বসে সুমিত আবার কুঁকড়ে ওঠে। বড্ড দামি সুসজ্জিত আয়োজন। কিন্তু প্লেটে হাত ছোঁয়াতে গিয়ে ফিরে তাকায়,
“— তুমি খাবে না অমৃতা ?
— তুমি খেয়ে নাও, তারপর।”
অবাক হয়ে সুমিত অমৃতার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অমৃতা বলে,
” কী হলো, খেতে শুরু করো।”
সুমিতের গলার নীচটা হঠাৎই কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতরে কী যেন এক কাণ্ড ঘটতে থাকে। তখনও সে অমৃতার মুখের দিকে তাকিয়ে। এবার অমৃতা ওর বাম হাতটা সুমিতের পিঠে রাখে,
“— আমি নিজের হাতে, একটা দিন তোমাকে খাওয়ানোর সুখটা নিই। তুমি দ্বিধা কোরো না সুমিত, খেতে শুরু করো।”
চোখ নামিয়ে নেয় সুমিত। অমৃতার হাতের স্পর্শ তার পিঠে। এমন যত্ন করে কতদিন কেউ তাকে খাওয়ায় নি। ছোটো বেলার মায়ের কথা আর প্রথম দাম্পত্যের রণিতার কথা মুহূর্তে তার মনে ঝলক দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সে সব এখন বড়ই দূরবর্তী স্মৃতি। সময় সুমিতকে বড্ড একা করে দিয়েছে। বেশি রাতে ফিরলে, এখন প্রায়ই সে টেবিলে ঢাকা দেওয়া স্টিল গামলার ভিতরে একটা বাটিতে ঠাণ্ডা তরকারি খুঁজে পায়। তারই খানিকটা গোগ্রাসে গিলে সে মুখ ধুয়ে শুতে চলে যায় নিজের ঘরে। পাশে বসে যত্ন করে তাকে খাওয়ানোর মতো, অন্তত একজনও মানুষ, কতকাল সে পায়নি।
অথচ আকস্মিক ভাবে আজ অমৃতা তার পাশে দাঁড়িয়ে। সুমিত প্লেটের খাবারে হাত দিয়ে হঠাৎই এক অজানা কষ্ট আর আবেগে নিঃশব্দে হুঁ করে কেঁদে ফেলে।
তারই কয়েক ফোঁটা জল সুমিতের খাবার প্লেটে টপ টপ করে পড়ে। অমৃতা তাজ্জব বনে যায়। তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসে সুমিতের কাছে,
” — এটা কী হচ্ছে সুমিত ? আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে এতটুকু সুখ স্বস্তি দেব। দুঃখ দেব বলে তো এতো রাতে তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি।
— না, তা নয় অমৃতা।
— তাহলে তোমার চোখ থেকে জল কেন ?
বলো আমাকে ?
— জানো অমৃতা, তোমার মতো এই সপ্রেম, সস্নেহ আদরে আমাকে অনেক দিন কেউ খেতে দেয়নি । হঠাৎ সে কথা ভাবতেই…”
অমৃতা সুমিতের দুঃখি মনের উৎস্রোত টের পায়। তারপর হঠাৎই নিজের ডান হাত দিয়ে সুমিতের ডান হাতটা তুলে নিয়ে একটা চুমু খায়, হাতের উপর পাতায়। সুমিত আর নিজের ব্যাকুল আবেগ ধরে রাখতে পারে না চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে অমৃতাকে জড়িয়ে মাথাটা ওর গায়ে মিশিয়ে মৃদু শব্দে কাঁদে। অমৃতার চোখেও তখন জলের ধারা। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে, পরস্পরকে আশ্রয় করে।
কয়েক মুহুর্ত মাত্র। পরস্পরের বড্ড নিকট। তবে কি দুজনেরই সান্ত্বনা দুজনে। অথচ এ আকস্মিক নৈকট্য। বহিরাবরণের খোলস ফেটে গেলে, ভিতরে শূন্যতার দারিদ্র্য বড় সরল। এতটুকু ছায়া কাছে এসে দাঁড়ালে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে প্রাণ। তখন কে কেন কাকে কোথায়– এসব প্রশ্নের অবকাশ অবান্তর।
কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেলে সম্বিত ফেরে। বন্ধন ছেড়ে দেয় সুমিত। অমৃতা খাবার পরিবেশনের অছিলায় সরে দাঁড়ায়। সুমিত বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুছে নেয়। অমৃতা এগিয়ে যায় বেসিনের দিকে।
কিছুক্ষণ মুখে খাবার তুলতে তুলতে, সুমিত স্তব্ধতা ভেঙে বলে,
” তুমিও খেয়ে নাও অমৃতা। রাতের খাবার বেশি দেরিতে খেতে নেই।
— কিন্তু আমি তো এসব খাই না। আমিষ আমার অভ্যেস হয়নি তেমন। ছোটো বেলায় মাঝে মাঝে মা জোর করে খাওয়াত। কিন্তু বড় হতে হতে সে সব ছেড়েছি। “
অমৃতা এক বাটি সবজি আর চামচ নিয়ে সুমিতের মুখোমুখি বসে। বলে,
” ঠিক আছে, তোমার খাবার সতীর্থ দরকার যখন, বসলাম। তুমি কিন্তু সবটা খাবে সুমিত।
— অমৃতা তুমি তো জানো, নিয়মিত রাত জাগা আমার অভ্যেস। তাই রাতে অল্পই খাই। আর এই সব রিচ খাবার অল্পই ঠিক আছে। আমি চির পেটরোগা ।
— কিন্তু সারাদিন খাও নি, সেটা তো ঠিক ?সংকোচ কোরো না, খাও ।
— সংকোচ করব কেন ? তুমি কি পর ? আপন মানুষের কাছে কেউ সঙ্কোচ করে না।
— সত্যিই আমাকে আপন মনে করো ? সত্যিকার আপন ?
— করে ফেলেছিলাম তো তিরিশ বছর আগেই। কিন্তু সেদিন বিনিময়ে শুধু অপমান পেয়েছিলাম। শুধুই…
— ওসব আর বোলো না সুমিত, ও কথা আমি আর মনে করতে চাই না। বলো আর কক্ষনো মনে করবে না ? বলো..
— আচ্ছা ঠিক আছে, বলব না আর। ভুলে গেছি তো, তা না হলে কি…
— হ্যাঁ, আর কোনোদিন মনে করিয়ে দিও না। সে আমার অপরাধ ছিল, অহংকারও। সে আমাকে মনে মনে কুরে খেয়েছে অনেক দিন। তারপর একটা সময় এলো, যখন মনে মনে সংকল্প করেছি— কোনো দিন সুযোগ পেলে সে অপরাধ স্বীকার করে তোমার কাছে মার্জনা চেয়ে নেব।
— তবে কি এখনও ভাবো…
— এখন ? এখন তুমিই আমার আপন, অনেক। যা সেই অপরাধের উপত্যকা দিয়ে ঝকঝকে চওড়া একটা রাস্তা করে দিয়েছে।
— বাঃ ! দারুণ বললে তো।
— আচ্ছা সুমিত, আমরা কিন্তু আজকে রাতে অনেক গল্প করে কাটাতে পারি। কি পারি না ?
— হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই পারি।
তাছাড়া শিয়ালদহ স্টেশনে আমাকে তো মুখ বুজে কাটাতেই হতো। মশা আর মাছির সঙ্গে একটা সুসম্পর্কের রাত।
— ও ! আমার গল্পের প্রস্তাবে শিয়ালদহ স্টেশনের প্রসঙ্গ ? আমি কিন্তু সিরিয়াস সুমিত ! ওভাবে বোলো না..”
সুমিত হা হা করে হেসে উঠলো। অমৃতা জিভ বের করে খানিক ভ্যাঙালো। তার পর ওরা ধীরে খাওয়া শেষ করল।
রাতের খাবার শেষ করে সুমিত তার কাঁধ ব্যাগ হাতড়ে একটা আধ-ভিজে সিগারেট পেল। কিন্তু অমৃতাদের এই বিলাস বৈভবের ফ্লাটে দেশলাই জ্বেলে ফুক ফুক করে ধোঁয়া ছাড়ার জায়গা সে কিছুতে ঠিক করতে পারছে না। অমৃতা বলল,
” আমি একটু গুছিয়ে আসি সুমিত, তুমি বরং আমার বই-এর ঘরে গিয়ে বোসো। তোমার ভালো লাগবে।” কথাটা সুমিতের বেশ মনোমতো হলো।
অমৃতার বই-এর ঘরে ঢুকে সুমিত যেন চমকে উঠল ,
” সেই এক ধরণ ! অমৃতার ঠাকুরদাদার সেই পলাশপুরের লাইব্রেরী রুমাটার একটা ছোটো সংস্করণ ছাড়া কিচ্ছু নয়। সেই কোন কিশোর কালে দেখা কিন্তু সেই সব ঢাউস বই-এর বেশ কিছু আজ এখানে তেমন করেই যেন সাজানো। একটা লম্বা টেবিল মাঝখান বরাবর। আর চারপাশে শুধু থরে থরে বই। “
সুমিত মুহূর্তে তিরিশ বছর আগের পলাশপুরে গিয়ে হাজির। সেই মুখোমুখি টেবিলের ওপাশে ফ্রক পরা অমৃতা। সদ্য গোঁফ গজানো অঙ্কের টিচার খসখস করে সাদা কাগজে করে দিচ্ছে পরিমিতির সমাধান। অথচ মুগ্ধ মোহে ছাত্রীকে ভালোলাগার পরিমিতি বোধ ভুলে যাওয়া অঙ্কে প্রতিদিন নিজেই ফেল করে চলেছে সে।
অমৃতার এই বই-ঘরে নতুন অনেক কিছুই আছে। একপাশে অমৃতার লেখার ডেক্সটপ। পাশের কাঁচ ঢাকা লম্বা শো’কেজে বেশ কিছু পুরস্কার, সম্মান স্মারক, শংসাপত্র। বাঁদিকে উঁচু তাকের উপর একটা দামি সাউন্ড সিস্টেম। নীচে ডানদিকে একটা বেতের তৈরি সোফাসেট।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে সুমিত ধীরে বসে পড়ে সোফায়। অমৃতার আভিজাত্য আজ ছুঁয়ে দেখছে যেন, সাদামাটা এক অখ্যাত কবি, দূর পলাশপুরের সুমিত রায়।
হঠাৎ তার মনে হয়, এবার সে দেশলাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরায়। ভেবে দেশলাইটা ঠুকতে গিয়েই থমকায়। সুমিতের ঠিক সামনেই তখন একটা কাঁচের অ্যাসট্রে হাতে নিয়ে এগিয়ে ধরে অমৃতা।
সুমিত আশ্চর্য হয়,
“— কী করে বুঝলে, এখন এটাই খুব দরকার ছিল ? তুমি তো এই ঘরে ছিলে না ।
— ও ! আমার মনেরও তো একটা চোখ আছে !”
সুমিত সিগারেটে আগুন দিয়ে দেশলাই পকেটে রেখে অমৃতার হাত থেকে অ্যাসট্রেটা নেয়। তার পর বেশ একটা লম্বা টান দিয়ে ধীরে ধোঁয়াটা একটু আড়াল করে ছেড়ে
বলে,
“— সত্যিই অমৃতা তোমার মনের একটা চোখ আছে, আজ বেশ বুঝতে পারছি।”
অমৃতা সুমিতের মুখের দিকে গ্রীবা তুলে তাকায়। সুমিত দেখে অমৃতার চোখ। বেশিক্ষণ সেদিকে সে তাকাতে পারে না। বলে,
“— সিগারেটের গন্ধে তোমার সমস্যা হবে না তো ?”
অমৃতা বলে,
” — না না, অভ্যেস আছে তো। অভীক তো প্রায় চেন স্মোকার। ফলে আমিও প্যাসিভ হয়ে গেছি। কিন্তু তুমি যেন কী বলছিলে সুমিত ?”
সুমিত অমৃতার হাতটা ছুঁয়ে বলে আমার পাশে বোসো অমৃতা।”
অমৃতা তো বসবে বলেই এসেছে । তবু সুমিতের এই আপন করে বসতে বলাটা যেন কতকাল শোনেনি অমৃতা। একজন পুরুষের সঙ্গেই তার বসবাস। সে বড়ই ব্যস্ত আর নিজস্ব নিয়মে বোঝে সময়ের সদ্ব্যবহার। অমৃতার তার বিবাহ করা স্ত্রী । কিন্তু সেখানেই যেন সব বন্ধুত্বের অবসান।
“অভীক কোনো দিন অমৃতার বন্ধু হতে পারল না কেন ?” — এমন প্রশ্ন অমৃতা নিজেও কি নিজেকে বারংবার করে নি। অজস্র ছোটো বড় উত্তর পেয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে যে উত্তরটা একেবারে সামনের সারিতে থাকে—- সে হলো অভীকের ব্যবসায়ীক ফরমূলাতে বন্ধুত্ব একটি শব্দ মাত্র ; অথচ তার মনস্তত্ত্বে বন্ধুত্ব বলে আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। কতগুলি গতে বাঁধা সম্পর্কে অভীক বিশ্বাস করে। স্বামী-স্ত্রী তার মধ্যেই পড়ে। যা তার এথিক্সে অফিস-বস আর অধস্তন এমপ্লয়ির মধ্যকার প্রায় অফিসিয়াল নিয়ম রীতির অধীন।
সেখানে শরীরের উপস্থিতি মাত্র একটি শরীরের মতোই । ইন্দ্রিয় উত্তীর্ণ মানুষের ছোঁয়ার মতো যেন নয়। যেখানে হৃদয়ের কারবারে পুঁজি বিনিয়োগ চায়নি অভীক । তার মেধা তাকে তাই বলেছে । আর মন কী বলেছে, অভীক হয়তো কখনোই তা শোনার চেষ্টা করে দেখেনি। শুধু মাঝখান থেকে অমৃতা তার চির মননশীলতা নিয়ে মরমে মরে মরে, বিনিদ্র থেকে গেছে অগণিত রাত।
অথচ এই সেই কৌশোরের সুমিত, যে একমাত্র লেখে ভালো। আর তার বলার মতো তথাকথিত কিছু নেই এই মুহূর্তে। তবু তার কবিতার মতো কথারা অমৃতাকে কোথায় যেন নিয়ে ফেলে। নিঃস্ব সুমিতের মনে, একটা জাদু আছে যেন। তার পাশে বসতে বলার ভালবাসা আছে, সৌজন্য আছে, অপেক্ষা আছে, নীরবতাও আছে। এ গুলো কি সম্পদ নয় ? যদি হয়, তবে সুমিতও ধনী।
সুমিত পাশে বসতে বলায়, অমৃতার উন্নত গ্রীবার নীচে যেন মৃদু তরঙ্গ উঠে থামে। গলাটা সামান্য ধরে আসে। একবার গলার স্বরটা ঝেড়ে নিয়ে অমৃতা সোফায় সুমিতের কাছেই বসে।
বলে ,
” আমি আজ অন্তত অনেক্ষণ তোমার পাশে আছি সুমিত। তুমি বলো, তোমার কথা শুনি…”
সুমিত আবারও অমৃতার চোখের দিকে যেন চুপ করে তাকিয়ে থেকে ফের দৃষ্টি নাড়িয়ে
বলে,
” তোমার মনের চোখ থেকে আজকের এই ডাক, আমাকে তোমার এতো কাছে এনে দিয়েছে অমৃতা। তা না হলে আমার তো এতক্ষণ শিয়ালদহ স্টেশনে…”
সঙ্গে সঙ্গে অমৃতা যেন চরম অপছন্দের কথা শুনেছে, এমন হয়ে ওর ডান হাতের তালু দিয়ে সুমিতের মুখ আটকে দেয়।
বলে,
” আবার এক কথা। আর একবার যদি শিয়ালদহ স্টেশন তোমার মুখে আসে তো আমি…”
সুমিত নিজের হাত দিয়ে ধীরে অমৃতার হাতের আঙুল গুলো নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
” আচ্ছা বেশ, আমি আর একবারও বলব না।”
সুমিতের কথা শেষ হতেই, অমৃতা হঠাৎ করেই মুখটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে, সুমিতের চোয়ালে ‘উম্’ শব্দে একটা চুমু খায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় সুমিত প্রাথমিক ভাবে অবাক ও নীরব হয়ে যায়। হাতের সিগারেট যেন পুড়ে তার আঙুলে আগুন ছোঁয় । অ্যাসট্রেতে ফেলে দেয় অনায়াসে।
ফের তাকায় অমৃতার চোখে। অমৃতার চোখ তখন আনত কিন্তু অমৃতা তখনও ঝুঁকে সুমিতের দিকে। সুমিত অস্পষ্ট বুঝতে পারছে, নিজের বুকে কী একটা মায়াময় ঝড় শুরু হয়েছে তার। অমৃতার হাতটা ফের ধরে টানল সুমিত। অমৃতা চুপ অথচ শিথিল। সুমিতের হাত কাঁপছে। কী এক সংরাগে এগিয়ে গেল সুমিত।
তবু অমৃতার ঠোঁটের কাছে নিজেকে যেন কোনো ভাবেই নিয়ে যেতে পারছে না সুমিত । একেবারে নিঃশব্দ একই পৃথিবীর দুটি মানুষ। আর মাঝখানে দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের সংকীর্ত্তন জোর মৃদঙ্গে বাজছে।
সুমিতের ভালবাসার সঙ্গে, ইচ্ছে, আবেগের আর আড়ষ্ঠতার লড়াই স্পষ্ট দেখতে পেল অমৃতা।
স্তব্ধতা ভেঙে বলল,
” — আমাকে ভালোবসো না সুমিত ? কবিতায় যত লিখেছ, সব মিথ্যে ?”
সুমিত যেন অনেক নীচে থেকে ছুঁতে পায় এমনই একটি ধাপ বাঁধা মই দেখতে পায়।
অমৃতার ঠোঁট গুলো সে-ই তো প্রথম ফুলের পাপড়ির উপমায় লিখেছিল স্বপ্নময় কবিতার পঙক্তিতে, তিরিশ বছর আগের একদিন। আজ এই মধ্য চল্লিশের অমৃতার ঠিক এই মুহূর্তে মৃদু কম্পিত ঠোঁটে, সুমিত যেন সেই প্রত্ন কিশোরীর গুপ্ত অনুরাগ দেখতে পেল। চোখ বন্ধ হয়ে এলো সুমিতের। তারপর সে পারল অমৃতার অধর ওষ্ঠে ভালবাসা এঁকে দিতে। মনে মনে বলল,
” তোমাকে যে ভালোবাসি অমৃতা, এই ফকির জীবনে এক নির্বাক শান্ত নদীর চরে জোছনা অথবা অন্ধকারে, নিঃস্বের দুঃখ-সুখ যাপনের মতো।”
দুটো মানুষ যেন বড় তৃষ্ণার্ত পথ হাঁটছিল বহুদিন। শরীর ব্যতীত প্রাণ কোথায় । প্রাণের বাঁধ ভেঙে গেলে শরীরে বান ডাকে। প্লাবনে সব ছোটো বড়ো ভার ভেসে যায় । খড়কুটো ধরে ভেসে থেকে দেখা যায় হয়তো সে স্থাবর সম্পদের ভেসে যাওয়া, তবু সে দেখা প্লাবনের বেগ প্রতিহত করার জোর পায় না।
পরস্পর পরস্পরের কাছে আজ যেন দুরন্ত শিথিল হয়ে গেল ক্রমশ । সুমিত প্রায় ভুলতে বসেছিল রণিতার আদর। অমৃতা জৈবিক ক্রিয়ার সাক্ষী হয়ে থেকেছে তো কতকাল। ভালবাসার অশ্রু লালাতে শরীরকে এমন করে গান গাইতে দেখেনি কখনও।
কত নিঃশব্দ, মৃদু , তিরতির স্রোতে নদী তার গভীরে জোছনার আলো দিয়ে পথ করে দিল। নিঃস্ব ফকির তার দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, ধ্যান আর উদাত্ত গান গেয়ে নেমে এলো নদীর শরীরে। আশ্লেষে আশ্লেষে, শ্বাসে প্রশ্বাসে, নিংড়ে দেওয়া হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চয়ে, এক ধীর গম্ভীর উথালপাথালে দুটি প্রাণ শরীরের বনে পাহাড়ে গুহায় প্রপাতে বেড়াতে গেল, হাতে হাত ধরে। সেই সমসত্ব দ্রবণে যেন স্বপ্নের নতুন বুদবুদ— এক দূরবর্তী শূন্যে ধোঁয়া রঙের কোনো দ্বিতীয় পৃথিবী।
তারপর প্রাণ আর শরীরের আহারের ফাঁকে, সুমিতের খোলা বুক আশ্রয় করে অমৃতা প্রশ্ন করল,
” তুমি কি সত্যিই দ্বিতীয় পৃথিবী দেখতে পাচ্ছো সুমিত ?”
আলুলায়িত অমৃতার চুলে আঙুলে আঙুলে স্বপ্ন বোনার মতো আদরে, সুমিত ধীরে উত্তর দিল ,
“— আমার বোধ সেখানে যায় অমৃতা । সমান্তরাল সেই দ্বিতীয় পৃথিবীতে। কিন্তু চোখে তো তার সবুজ রূপ সুস্পষ্ট ফোটে না ! “
(এরপর আগামী পর্বে)