মেঘে ঢাকা
নরেশ মল্লিক
টিউশনি ছুটি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি শ্রাবণের আকাশ কালো রূপ ধারণ করে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তাই সাইকেলটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। আজ মাসের তিন তারিখ ভেবেছিলাম টিউশনির মাইনেটা আজ পাব। কিন্তু আমার ছাত্রীর বাবা বা মা সেই বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। আমার পকেটে পড়ে থাকা একশ টাকার নোটটা হাত দিয়ে দেখলাম, না সে ঠিক আছে। কয়েক দিন ধরে মায়ের শরীরটা খুব দূর্বল। তাই মায়ের জন্য কিছু ফল কিনে নিয়ে যেতে হবে। এই ভেবে আর আসন্ন বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে দ্রুত সাইকেল চালাতে লাগলাম।
কিন্তু বিধি বাম কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে আসার পরেই বৃষ্টিটা শুরু হল। সঙ্গে ছাতাও ছিল না। অগত্যা একটা পরিত্যক্ত ঘরে এসে ঢুকলাম। সাইকেলটা পাশেই হেলান দিয়ে রাখলাম। বৃষ্টিটা এখন বেশ জোড়ে নামলো। সঙ্গে হাওয়া। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে ধাক্কা মারছে। কিছু পরে একটা বুড়ি মা একটা তল্পি নিয়ে এই ঘরেই ঢুকলো। বুড়িমা বৃষ্টির সৌজন্যে অনেকটাই ভিজে গেছে। তল্পি থেকে একটা রঙচটা গামছা বের করে হাত, মাথা, মুখ মুছতে লাগলো। আমি এক দৃষ্টিতে বুড়িমার দিকে চেয়ে রইলাম। মাথা, মুখ মুছে গামছাটা আবার তল্পির ভিতর ঢুকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল –
— বাবা এখন কটা বাজে?
আমি আমার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম,
— সাড়ে পাঁচটা।
জুলাইয়ের শেষ। বেলা একটু ছোট হয়েছে। আবার বুড়িমা বলল,
— এখান থেকে পারুলিয়া যেতে কতক্ষণ লাগবে?
— বাস তো চলছে না টোটোতে গেলে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট। আমি বললাম।
— না না বাবা, আমি হেঁটে যাবো। টোটোতে যাবার পয়সা আমার নেই। বুড়িমা করুন সুরে কথাটা বলল।
আমি চমকে উঠলাম। এতখানি রাস্তা এই অশক্ত শরীর নিয়ে বুড়িমা হেঁটে হেঁটে যাবে! সে কথা বলতেই বুড়িমা বলল,
— মেয়ের ঘরের নাতনীটার কদিন ধরে খুব শরীর খারাপ। জামাইও এক বছর হলো মারা গেছে। দেখার কেউ নেই। ওকেই দেখতে যাচ্ছি।
বলতে বলতে বুড়িমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। আমি বুড়িমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনার ছেলে নেই?
— একটাই ছেলে। কাজের চাপে সেও যাবার সময় পায় না। বুড়িমা একই ভাবে উত্তর দিলেন।
বৃষ্টি একটু কমেছে। তবুও একটু অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই একটা টোটো এল। টোটোটাকে দাঁড় করালাম। বুড়িমাকে টোটোতে তুলে দিয়ে বললাম,
— আপনার মেয়ের বাড়িতেই নিয়ে যাবে। নিশ্চিন্তে যান। সব ঠিক হয়ে যাবে।
টোটোওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সাইকেলটা নিয়ে আমিও বাড়ির দিকে রওনা হলাম। মায়ের জন্য আর ফল কেনা হলো না। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকালাম। অঝোর কান্নার পর সে যেন এখন একটু শান্ত।