যোগিনী
চিত্রাভানু সেনগুপ্ত
দশ বাই সাড়ে আট ফুটের ছোট্ট একফালি ঘরটা একজনের থাকার পক্ষে যথেষ্ট। অনাথবন্ধু মেমোরিয়াল সরকারি হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক শ্রী তিমির বরণ চক্রবর্তী মহাশয়ের ছোটখাটো ছিমছামের সংসারটা একজন বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া মানুষের জন্য দিব্যি চলনসই । ঘরে তাঁর একখানা ছোট তক্তপোষ, একটা কাঠের আলমারি, আর একটা প্লাস্টিকের টেবিল ছাড়া আসবাবও খুব বেশি ধরেনি। টেবিলে বইখাতার ঢিপি খুঁজলে গুচ্ছের দরকারি অদরকারি কাগজ, কিছু ভাঙাচোরা পেন আর রিফিল, বহু মূল্যবান অসাধারণ কিছু বই, একগুচ্ছ পুরানো পত্রিকা, আর জরুরি কিছু তথ্য সম্বলিত বেশ কিছু খবরের কাগজের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নিপাট সাম্যবাদী তারা, নামি-দামি বলে আলাদা মর্যাদায় তাদের পদোন্নতি হয়না কারো। কাগজ পত্রের কমতি নেই সে ঘরে। কিছু আছে খাটের ওপর ছড়ানো, আবার কিছু রাখা আছে তাকিয়ার তলায় লোহার তোরঙ্গের ভেতরে। ঘরের লাগোয়া একখানা ছোট এক চিলতে বারান্দায় চালডাল ফুটিয়ে খাবার মত অল্প কিছু বন্দোবস্তও আছে। চানঘরটা অবশ্য একটু দূরে, বাকি আরো ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। পাঁচঘর ভাড়ার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে থাকে চানঘর পরিষ্কার করার পালা। সে কাজে মাসে এক-আধ দিন তিমির বরণের দায়িত্ব পড়ে ঠিকই, কিন্তু সকাল হতে না হতেই পাশের বোস বাবু ডাক দেন……” মাস্টার মশাই আছেন? চানঘর পোষ্কার করে দিলুম। সামনের বার বেড়াতে যাবো ইচ্ছে আছে বুঝলেন? তেখন আমার হয়ে আপনি করে দেবেন, কেমন? আজ আর আপনার ওসব না করলেও চলবে।”
“কিন্তু অনিলদা, আপনি তো গেলবারও আমার কাজ করে দিয়েছিলেন। প্রতিবার এমন করলে চলে?” ” আহা! আপনি হলেন প্রকৃত গুণী মানুষ, মাস্টার। এসব ছোটখাটো কাজে হাত লাগানো কি আপনার সাজে? আমি থাকতে এসব আপনি কেন ভাববেন?”
“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু….” “কোন কিন্তু না, আপনাকে ছোট ভাই মেনেছি, আপনার মত ভাই থাকা কত গর্বের জানেন?”
তিমির বাবু হেসে বললেন” কিন্তু ভাই হয়ে দাদাকে খাটাবো, এ কেমন কথা? ” “বললাম তো! যেদিন ঘুরতে যাবো, সেদিন আপনার ভাগের কাজ কোরবেন, আমার ভাগেরও। কেমন?”
হাহা করে হেসে উঠে প্রতিবারই পাশ কাটিয়ে যান বোসবাবু। তারঁ বেড়াতে যাওয়ার দিনক্ষণ কখনোই তিমির বাবুর চানঘর ধোয়ানোর দিনের সাথে এক হবেনা, তা তিনি ভালোই বোঝেন।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে যাপন ধারার মধ্যেও তাঁর সংসারের পরিধি চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, নিত্যদিন বেড়ে চলেছে সংসারের আয়তন। প্রতি রোজে সন্ধ্যা নামলেই ভাড়া বাড়ির গলির মুখে ভির জমায় এক দঙ্গল অপেক্ষারত সারমেয়, তাদের অপলক করুণ চাহনির কারণ তিমির বাবুর জানা। অতএব তাঁর ভাঙাচোরা সংসারের হাঁড়ির খাবারে একলা একটা পেটের বরাদ্দ চাল চড়েনি কখনো। এই গুটিকয় চতুষ্পদ প্রাণী ছাড়া ঘরে ফেরার টান তাঁর নেই বললেই চলে। আপনভোলা এক মানুষ, পাড়াগাঁয়ে গিয়ে ছেলে পড়িয়ে আর দুস্থদের সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। ভালো মানুষ হিসাবে পাড়ার তাঁর সুখ্যাতি আছে বেশ, এলাকায় সকলে তাঁকে বেশ সমীহ করেন। এতো সবের পাশাপাশি চলে তাঁর উদ্দেশ্যহীন ভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ। ঘরে থাকলে সংসারে হাঁড়ি চড়ে দিনে মাত্র একবার। বাকিটা পথের দুপাশে গজিয়ে ওঠা খাবারে দোকানগুলো ভরসা। সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে আগাগোড়া চোখটা একবার বুলিয়ে নিয়েই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়া সারা দিনের মনে, এই এখন নিত্য দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিনেও অভ্যেস মত খবরের কাগজটা হাতে নিয়েই তারিখের কাছে এসে চোখ আটকে গেল। আজ ২৩ শে মাঘ ১৪২৮ , ইংরাজির ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২২। মনে মনে একটু হাসি পেল যেন। একঘেঁয়েমি জীবনে দিনক্ষণ আর তারিখের হিসেব থাকেনা এখন। রেখেই বা লাভ কি? নিচু হয়ে লোহার তোরঙ্গ হাতিয়ে পুরানো অ্যালবামখানা বের করে আনলেন তিমির। পাতাগুলি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে নেড়েঘেটে তুলছিলেন পুরানো দিনের কত জমানো স্মৃতি । ঘরের বাইরে থেকে একটা মহিলা কন্ঠস্বর ভেসে এলো…..” ভেতরে আসতে পারি মাস্টার মশাই।”
তিমির বরণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন একটা ছবির দিকে। সেখান থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন…..”হুমম, আসুন। আপনাকেই তো খুঁজছিলাম।”
ঘরে ঢোকার আগে মহিলাটি আশেপাশটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন, তারপর ক্ষীণ স্বরে বললেন…..” আমাকে? কেন?”
তিমিরবাবু হাসলেন ” ভাড়া নেবেন না? ” মহিলা তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললেন”আজ মাসের কত তারিখ বলুন তো? “
” হ্যাঁ, ছয় তারিখ। কিন্তু তিন মাসের ভাড়া বাকি। গতমাসে বললেন, পরে নেব। সেই যে গেলেন আর এলেন না। ” ” আমার সব সময় আসার সময় হয়না যে!”
তিমির একটু ফিরে তাকিয়ে হাসলেন।…..” আচ্ছা বেশ, আজ তিন মাসের টাকা একসঙ্গে নিয়ে যাবেন।”
” উহু, টাকা পয়সার দায়িত্ব আমি নেব না। যার বাড়ি তাকে দিন গিয়ে।” ” কিন্তু ভাড়া তো আপনাকেই দেন সবাই।”
হঠাৎই কথার খেই হারিয়ে অভিমানের সুরে ভদ্রমহিলা বলেন…..” এতো জেরা আমার ভালো লাগেনা। আমি আসলেই আপনার কেবল টাকার কথা মনে হয় বুঝি? এমন করলে আর আসবো না। “
তিমির হেসে বললেন….” বেশ বাবা, টাকার কথায় কাজ নেই। এই অসময়ে আপনার আবির্ভাব কারণ কি জানতে পারি?”
” অসময়ে না এলে আপনাকে পেতাম?” তিমির জিজ্ঞেস করলেন….” খুব জরুরী?” ” জরুরী নয় কিভাবে বলি? প্রথমেই তো বললাম, আজ কত তারিখ মনে আছে আপনার?”
” বললাম তো ছয় তারিখ।” ভদ্রমহিলা আঁচলের ঢাকা সরিয়ে একটা ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার বের করে এনে টেবিলে উপর রেখে বললেন….” শ্বাশুড়ি মা রান্না করে পাঠালেন । আজ না খেয়ে বেরোবেন না, কেমন!” ” কি এগুলো?”
মহিলা চোখের কোথায় দুষ্টু হাসি হেসে বললেন….” মুন্ডু আমার। আপনাকে খেতে দিলাম। “
তিমির টিফিন বাটিগুলো চট করে খুলে দেখলেন, তারপর বললেন….” পায়েস? লুচি? ছোলার ডাল? কি ব্যপার বলবেন? এতো আয়োজন কিসের? “
” কিসের আয়োজন বুঝি আমি বলবো? আপনি জানেন না? আজ তারিখ কত?” বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন তিমির। বললেল…..” আপনি জানেন? আমি কি আপনাকে কখনো বলেছি?” ” বিখ্যাত মানুষের জন্মদিন বলতে হয় না, জেনে নিতে হয় বুঝলেন ?”
তিমির বাবুর চোখে মুখে হঠাৎ একটা অস্বস্তি খেলে গেল….” আমি খুব সাধারণ মীরা। “
” মোটেই না, আপনি জিনিয়াস। আমার জিনিয়াস।” কথাটা বলেই লজ্জায় রাঙিয়ে উঠলো মীরার গাল দুখানা। তিমিরের চোখের থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে জানলার বাইরে চেয়ে রইল এক নাগারে। তিমির মীরার থেকে চোখ সরাতে পারেননি বেশ খানিকক্ষণ। বললেল….” এতো সকালে এতো কিছু রান্না করলেন? ” ” বললাম তো আমি করিনি। “
” আপনার শ্বাশুড়ি মা বড় দয়ালু বাড়িওয়ালী বলতে হবে। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া পাননি, তবু ভাড়াটিয়ার জন্মদিনে নিজের হাতে রান্না করে পাঠান! কেন যে বোসদা হাড় কেপ্পন বলেন? ” আচমকা একটু বিরক্তির সুরে মীরা বললেন….” আমি যাই।” ” শুনুন….একটু ঠিক করে বলবেন, রান্নাটা কে করেছে? “
” কেন? কি হবে জেনে?” ” রান্না খারাপ হলে বোসদার কাছে কার নামে নিন্দে করবো সেটাই জিজ্ঞেস করছিলাম। “
” ইসস! খুব খারাপ তো আপনি! আর কথা বলবো না। যাচ্ছি।” ” না। আমার কথা এখনো বাকি আছে।”
“বলুন।” তিমির দরজাটা আলতো ভেজিয়ে বললেন…..” কাল এতো চেঁচামেচি হচ্ছিলো কেন?” স্থির দৃষ্টিতে মীরা তাকিয়ে রইলেন জানলার বাইরে। চোখের কোনায় জমে ওঠা অশ্রুবারি চলকে পড়ল দুই গাল বেয়ে। ভাবাবেগে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠেছিল ক্ষণিকের তরে। নিচু গলায় কেবলমাত্র ….” বাদ দিন “, ছাড়া আর কিছু বলে উঠতে পারলেন না মীরা। ” ওরা কালও মেরেছে?”
” না তো! কে বলল আপনাকে?” ” আমি শুনেছি। কাল একটু রাত হয়ে গিয়েছিলো ফিরতে। আপনাদের ঘরের পাশে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম, ভাড়ার টাকা নিয়ে। ঢুকতে পারিনি।”
ঘরে বেশ খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল।তারপর তিমির বলে উঠলেন….”এতো চুপ থাকবেন না মীরা। আমার মনে হয় আপনার বাড়িতে জানানো দরকার।”
” আপনার মত যদি বেড়িয়ে পড়তে পারতাম! কি মজা আপনার! উঠলো ঝোলা, চলল ভোলা।” তিমির বললেন…..” সবাই তাই বলে।” ” সত্যি, আমি যে কেন আপনার মত হতে পারিনা! এখন তো আপনার সারাদিন কাজ, তাই না মাস্টার মশাই? “
” তা একটু আছে, কাল যেমন, একজন করোনা পেশেন্টের জন্য রক্ত জোগাড় করতে হল। নীল রতন থেকে রক্ত জোগাড় করে এস এস কে এমে পৌঁছতে হল সময়ের মধ্যে। কি জানেন, ঘরে ফেরার তাড়া নেই তো, তাই আর কি!” মীরা ভরা বিস্ময়ে অপলক তাকিয়ে দেখেছিলেন তিমিরের দিকে…..” আর আজ? আজ কোথায় যাবেন?” ” আজ তেমন কাজ নেই, একবার সল্টলেক যেতে হবে। একজন দশটা অক্সিমিটার ডোনেট করবেন, ওটা কালেক্ট করতে হবে। “
” আমাকে নেবেন আপনার সাথে? আমার খুব সাধ হয়, জানেন, আপনার মত দিনরাত ঘুরে বেড়াবো, আর দশের কাজে ঘুরে সময়ের হিসেব থাকবে না। জীবন স্বার্থক।” তিমির মাথা নিচু করে শুনলেন। বললেন” একটা কথা বলি? “
” হ্যাঁ।” ” আগে নিজের পায়ে দাঁড়ান। বুঝতেই পারবেন না কখন আমার সঙ্গী হয়ে যাবেন। “
মীরা হেসে বললেন….” স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু সংসার অতি বিষম বস্তু তিমির বাবু।”
” তিমিরের সাথে বাবু কেন? ওটা বাদ দেওয়া যায় না। ” ” নাহঃ! এমন স্বপ্ন দেখাবেন না। ভয় পাই। যা ফাঁটা কপাল আমার! হারিয়ে গেলে বাঁচবো কি নিয়ে।”
” হারাবে কেন?” খোলা জানালার পর্দাটাকে আলগোছে টেনে দিলেন তিমির। ঘরটা এখন বেশ অন্ধকার। ” আপনি স্বপ্ন দেখেন না? আপনার স্বপ্নে আমার জায়গা নেই বলছেন?”
” হয়তো আছে, কিন্তু আমি তো মীরা। আমি দূর থেকে পুজো করতে পারি। দেবতার অধিষ্ঠান আমার প্রাণে। বাস্তবে মীরা কখনো পায়নি তাঁর দেবতাকে। ” দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটাকে আড়াল করে নিলেন মীরা। তিমির বললেন…..” আমরা সাধারন মানুষ। সমাজ বাধানিষেধ বাতলে দেয়, অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে শেখায় না। মনকে আটকাতে চায়, অথচ মনের খবর রাখেনা। কি অদ্ভুত না?” মীরা মুখখানা ঢেকেই রইলেন, ভাঙা গলায় বললেন….” কিন্তু মন তো মানেনা তিমির বাবু” তিমির বললেন….” স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? থাকনা সেটা আমাদের মধ্যে বেঁচে। থাকতে পারে না?” ” আছে, থাকবেও।”
ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে বাইরে বেড়িয়ে এলেন মীরা। নিজের নামটা আজ হঠাৎ বড় ভালো লাগছে। কূল ও মানের হুশ্ আজ তাঁর কোথায় গিয়েছে হারিয়ে। রাস্তার পাশে ভাঙা ইটের টুকরোটা তুলে দেওয়ালে নিজের নামের পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলেন…..যোগিনী।
মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মন ছুঁয়ে গেল।