যৌথ সংকলন
কমলিকা দত্ত
(১)
—কিছু বলবে?
— হ্যাঁ, ক’টা কথা ছিলো
— একটু পরে বললে হবে? ( পেনটা কানের কাছে নাচাতে নাচাতে বলল উর্মি)
— হবে, চা খাবে?
— হলে, মন্দ হয় না।
— লিকার তো …
— হুম
— আনছি দাঁড়াও।
উর্মির সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয়েছিল তখন ওর বয়স মাত্র উনিশ। সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিয়েছে। আমার তখন সাতাশ।একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত।এখন অবশ্য সরকারি চাকরিতে আর নিজস্ব লেখালিখির জগত নিয়ে ব্যস্ত।নামডাকও হয়েছে বেশ। অনিরুদ্ধ বসু নামটা এখন অনেকেরই পরিচিত।
উর্মি খুব অল্প বয়সেই মা,বাবাকে হারায়। ও মামাবাড়িতেই মানুষ। ওকে বিয়ে করারও যে খুব ইচ্ছে আমার ছিলো– এমনটা নয়। শুনেছিলাম, আমার বাবা নাকি এককালে উর্মির বাবার কাছে খুব উপকৃত হয়েছিলেন। দীর্ঘ বন্ধুত্বের জীবনে উর্মির বাবা ত্রৈলোক্যনাথবাবু কোনোদিনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।
তাই এই বিয়ের নেপথ্যে আমার থেকেও আমার বাবা মার সংবেদনশীল মন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ততদিনে আমারও অন্য কারো প্রেমে পড়া হয়ে ওঠে নি। তবে, উর্মির মিষ্টি স্বভাব, শিষ্ট আচরণ আমার ভালোই লেগেছিল। পরিবারের একটা ইচ্ছে আর বিয়ে তো একটা করতেই হবে — এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে চারহাত এক হয়েই গেল। ওর সুন্দর মুখ, স্নিগ্ধ অবয়ব যে আমার নজর কাড়েনি এমনও নয়,তবে মানসিক বিনিময়ের জগতে আমি কোনোদিনই ওকে যথোপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। তাতে অবশ্য সংসার ধর্ম পালনে কোনো অসুবিধে হয়নি। হয়ত কিছুটা অনীহা বা ও অপরিণত — এই ধারণাতে ওকে নিজস্ব জগতে প্রবেশ করতে দিইনি। বা বলা যেতে পারে, নিজ নির্মিত ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি মানুষ হিসেবে তার অন্তর্দেশের গঠন প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থতাই অর্জন করেছিলাম।
মামাবাড়িতে উর্মিকে যে সবাই অবহেলা করত ঠিক তেমনও নয়,কিন্তু কোথাও একটা অনুভূত হয়েছিল বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে পারলে ওদের যেন স্বস্তি। বিয়ের পর ও কলেজে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে তিন্নি হওয়ায় উর্মি সামাল দিয়ে উঠতে পারল না। একদিকে সংসার, সন্তান, অন্যদিকে পড়াশোনা। অনার্সটা পেলেও রেজাল্ট ভালো হলো না ওর। চলুন গল্প করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকি। হুম আদাটা কোথায়… যাক্ পাওয়া গেছে।
হ্যাঁ যা বলছিলাম… ওহ্ ঐ ঘটনাটা থেকে তো শুরু করতে হবে। আমার যখন হাতটা ভাঙল… শুনুন বলছি।
(২)
সেদিন ছিলো হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার দিন।অনাকাঙ্ক্ষিত বাইক অ্যাক্সিডেন্ট। পনেরোটা দিন যাই হোক করে কাটিয়ে বাড়ি।
বাবা আর ছোট কাকু এলো আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফিরেও কি স্বস্তি! ডান হাতের হাড় ভাঙা,প্লাস্টার। কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। হসপিটালের বেড থেকে উঠে বাড়ির ঘরোয়া বিছানা — এইটুকুই যা শান্তি।
দক্ষিণ পূর্বের এই ঘরটায় আমি ও উর্মি থাকি। মিনিট কুড়ি শুয়ে থাকার পর মা এসে পূঙ্খানুপুঙ্খ খবরাখবর নিয়ে গেলো। অস্থি এবং মজ্জার জেরা করে রিপোর্ট নেওয়ার পর মা উঠে যেতে উর্মি এক কাপ চা নিয়ে এলো ঘরে। ইতিমধ্যেই পর্দার আড়াল থেকে দুএকবার ঢুঁ মেরে গেছেন তিনি। চায়ের কাপটা রেখে সহাস্য মুখে প্রশ্ন করল
— ব্যাথা কমেছে?
— আগের থেকে অনেকটাই
— বাম হাতে কাপটা ধরতে পারবে?
— পারব। তিন্নি কেমন আছে?
— দৌরাত্ম্য করে বেড়াচ্ছে। গোটা বাড়ি যেমন মাথায় তুলে রাখে তার কোনো অন্যথা নেই।
— আজ কি রান্না হচ্ছে?
— খাওয়ার সময় দেখো।তবে মুড়িঘণ্ট, চিংড়িমাছের বাটি চচ্চড়ি আছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসলাম। এটা হলো খাদ্যরসনা বৃদ্ধি সূচক বাক্য।
যাইহোক দিন চার পাঁচ এমন করেই কাটল।
তবে ভেতরে ভেতরে অস্থিরতাও বাড়ল। না পারছি অফিস যেতে, না পারছি লিখতে। ডানহাতটাই তো অকেজো হয়ে বসে আছে। কখনো গান শুনছি। কখনও তিন্নির রাজামারি বাদশামারি গল্প, কখনো পেপার … বাঁ হাত দিয়ে যতটুকু উল্টানো যায়।
সেদিন ছিলো রোববার। তিন্নিকে নিয়ে রতনকাকা সকাল সকাল মিষ্টির দোকানে গেছে।
উর্মি এসে চা দিয়ে গেলো আমাকে। যাওয়ার সময় বলে গেল
— আজ ভীষণ কাজের চাপ। নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই বুঝলে, তুমি চা বিস্কুট খাও। আমি ঘন্টা দেড়েক পর জল খাওয়ার আনছি।
উর্মির সাথে কোনো রোমান্স হয়না — এ কথা ভুল। তবে মনন জগতে কখনই সে নেই। ওটা যেন কেমন একটা নিয়মের মত আসে।এভাবেই কাটতে চলল বছর চারেক। অসুবিধাও নেই। স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরেও একটা নিজের নিজের জগত থাকে। সেখানে একে অপরের হাত ধরে তখনই যাতায়াত হয় যখন দুটো মানুষের মধ্যে সেই বন্ধুত্ব থাকে। আমি তো সেই বন্ধুত্বের হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিইনি কখনো । তাই নিজস্ব স্পেসটায় নিজের মতনই থাকি। সেখানের কোনো খবর উর্মি পায় না। আর উর্মিও হয়তো বুঝে গেছে। তাই কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
সংসারের দৈনন্দিন বিষয় বা কেজো কথা — ব্যস আর হয়ত তিন্নিকে নিয়ে কিছু কথা।
বালিশটা ঘাড়ের পেছনে ঠেকিয়ে শুলাম।যে উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছিলাম সেটা তো মাঝপথেই আটকে আছে ঘরের চারিদিকে চোখ পড়তে একটা বিষয় অনুভব করলাম– এই কদিন উর্মি বেশ নিজের মতন করে থেকেছে। ড্রেসিং টেবিলে একটা ফুলদানি — তাতে নানারঙের কোলাজ করা আছে। রং তুলি গুলো জানলার একধারে রাখা। মনে হয় এটা নিজের হাতেই এঁকেছে উর্মি। শোকেসের তাকে শেষের কবিতা, তার ভেতরে একটা পেন।
এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো যাই – লিখতে পারি নাই পারি — অর্ধ সমাপ্ত পান্ডুলিপিটা একবার উল্টে পাল্টে দেখা যাক্।
আস্তে আস্তে বিছানাটা ছেড়ে উঠলাম।বাঁ হাত দিয়ে এলোমেলো একগোছা কাগজ এনে বিছানার ওপর আরাম করে বসে পরপর পৃষ্ঠাগুলো উল্টোতে থাকলাম।
পড়তে পড়তে গল্পের প্লটটা আবার ভেসে উঠল। তবে এতদিনের ব্যবধানে বেশ কিছু ভাবনা আবছা হয়ে গেছে। যতটা লেখার পর হসপিটালের দ্বারস্থ হয়েছিলাম, অর্থাৎ কিনা উনত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠা — হুম এই তো এতটা পর্যন্তই লেখা হয়েছিল। পরের পৃষ্ঠাটায় বাঁ হাত দিয়ে তিরিশ লিখতে গেলাম।
প্রয়োজনই পড়ল না — আরে! এ কি!
কোনো পৃষ্ঠাই ফাঁকা নেই। গল্প চলছে দূরন্ত গতিতে। হাতের লেখা তো আমার নয়।
তবে কে?
যাই হোক, আগে পড়ি। পরে জানা যাবে কথকের নাম ধাম। এক এক করে উপসংহারে পৌঁছে আমি স্তম্ভিত। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি পৃষ্ঠাগুলোর দিকে।
— এই নাও তোমার জলখাওয়ার। আজ রুটি তরকারি।মিষ্টি একটা দিয়েছি। আর নিলে বোলো।
জলের বোতল আর গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখল উর্মি।
— নাও খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
উপন্যাসের মাঝখান থেকে শেষে তখনও দাঁড়িয়ে আছি আমি।
— দাঁড়াও রুটিটা টুকরো করে ছিঁড়ে দিই,তোমার সুবিধা হবে। তরকারিতে তো চামচ দেওয়াই…
— উর্মি এই উপন্যাসটা শেষ করল কে?
কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলাম ওর মধ্যে। আবারও জিজ্ঞেস করলাম
— এসব কাগজে তো কেউ হাত দেয় না উর্মি। এ ঘরে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ থাকি না। নিশ্চিত বাবা বা মা তো আর এইসব কাগজপত্র নিয়ে… তাহলে কি ধরে নিতে পারি…
— আমি
— তুমি!
একটা অপরাধবোধ নিয়ে উর্মি উত্তর দিলো
— হ্যাঁ আমি। হয়ত কাজটা ঠিক করিনি। মন চাইল, তাই…
তবে তোমার তো ল্যাপটপ খারাপ হয়ে পড়ে আছে। ওগুলো তো কাগজ কালিতে লেখা। ছাপা তো আর হয়নি। তুমি লিখে নিও তোমার মত করে। আমি তো এমনিই… মানে… কাজটা আমার ঠিক …
— তুমি এতো ভালো লিখতে পারো উর্মি! এত ভালো!
আমার লজ্জাবনত মাথা আর বাকরুদ্ধ ঠোঁটে কথাগুলো বললাম।
উর্মি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
— এটা অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। কি অপূর্ব লিখেছ! আমি কখনো এমন করে শেষ করতে পারতাম না বিশ্বাস করো।
— তোমার পছন্দ হয়েছে? সলজ্জ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল উর্মি।
— এটা পছন্দ, অপছন্দের জায়গায় নেই উর্মি। আমি তো ভাবতেই পারিনি যে সোমলতা আর মহীরুহের জীবনের এই গল্পটা এই স্রোতেও বইতে পারে। এই বাঁক… না না, আমার পক্ষে এভাবে ভাবা সম্ভব ছিলো না।
— কি যে বলো তুমি
— সত্যি উর্মি।
আমার চোখ ভিজে এলো। যে আমি কখন এই মানুষটাকে যোগ্য বলেই ভাবিনি সেই মানুষটা —
আজ অপরাধবোধে এতটাই ছোট হয়ে গেছি নিজের কাছে …
উর্মি একটা একটা করে রুটির টুকরো আমার মুখে পুরে দিল। কোনরকমে খেলাম।
একটা ভূয়ো ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি বুঝতেই পারিনি নিজের জীবনসঙ্গীকে। হয়ত সুযোগের অভাবেই এই মানুষটা নিজেকে প্রমাণ করতে পারে নি।আজ আত্ম অহংকার চুরমার করে দিয়েছে উর্মির এই নিঃশব্দ প্রত্যুত্তর।
নাহ্ এই পাপবোধ থেকে বেরোবার একটাই রাস্তা। একে ছাড়া যাবে না।
সংসারের হিসেব লেখার ডায়রিটার শেষের পৃষ্ঠাগুলোয় কি অনবদ্য রিভিউ লিখেছে উর্মি আমার প্রত্যেকটা উপন্যাসের। এমন বন্ধু তো জীবনে পাওয়া ভার!
এমন যোগ্য সঙ্গী লোকে কপাল করে পায়। কি উপলব্ধি! কি গভীরতা!
ছি ছি ছি অনিরুদ্ধ বসু। ধিক্ তোমার স্বামীত্বকে।
নাহ্। সিদ্ধান্ত অটল।
আমার কড়া নির্দেশ “খুন্তি ছাড়ো, কলম ধরো”
তিন্নির মা তিন্নিরই আছে। এছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ডে আমি, বাবা,মা,রতনকাকা তো আছেই। এখন আমার স্ত্রী আর উর্মি নয়– লেখিকা উর্মিমালা বসু।
যাই চা টা নিয়ে যাই। আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। উর্মির গল্পে এখন হয়ত টানটান উত্তেজনা চলছে। একটু ট্যানিন না হলেই নয়।
ও হ্যাঁ বলছিলাম যে সামনের বইমেলায় — আসছে যৌথ গল্প সংকলন — উর্মিমালা বসু ও অনিরুদ্ধ বসু।
— কি? কিনছেন তো?
খুব সুন্দর প্রেক্ষাপট । বাস্তবেও কত প্রতিভা সুযোগের অভাবে সুপ্ত থেকে যায় ।
অসাধারণ গল্প। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন