দ্বিতীয় পৃথিবী– চতুর্থ পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
আমার ভালো টিম ওয়ার্কের জন্য। লাস্ট তিনমাসে আমার টিম যেভাবে টার্গেট ফুলফিল করেছে, বাপ্পাদার আর কোনো টিম সেটা আগামী ছ’মাসেও পারবে কিনা ঠিক নেই।
—- আচ্ছা , কিন্তু সেটাও তো একটা ভালো কাজের স্বীকৃতি, মানে এটাও একটা প্রাইজ।”
বাবা মা যখন গিফট আর প্রাইজ নিয়ে কথা বলছে, ঋ ঘর থেকে এসে প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। সুমিত ঘড়ির বাক্সটা ঋ এর হাতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। রণিতা আর ঋ এরপর গিফট আইটেম গুলো নিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকে।
আরও একটা দিন কেটে গেল সুমিতের বইমেলা যাওয়া হলো না। অফবিট স্টলে দ্বিতীয় বারের জন্য কিছু বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে অমৃতা। প্রকাশককে ফোন করে অমৃতা আরও দু-তিনটি স্টলে কিছু কিছু করে বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে নিজের উদ্যোগে। রোজ রাতে ফোনে স্টল গুলোতে কথা বলছে সে।
দীর্ঘ সাতাশ আটাশ বছর পর অমৃতা সুমিতকে আবার মুখোমুখি পেয়েছে। তবে এ যাত্রা তিক্ততার নয়, ভালবাসা আর সম্মানের। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে সুমিতের প্রোফাইলে চোখ পড়েছিল অমৃতার।
মাঝে পলাশপুরে দু’একবার বেড়াতে গিয়ে দূর থেকে সুমিতকে দেখেছে অমৃতা। কিন্তু সেও বছর দশ বারো আগের কথা। তারপর পাকাপাকি ভাবে পলাশপুরের পাট চুকিয়ে চলে আসে ওদের পরিবারের বাকি সদস্যরা কলকাতার কাছেই। ফলে স্মৃতি যখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ধরে নিয়েছিল, ঠিক তখনই ফের ডিজিটাল প্রেক্ষায় দেখা।
অথচ নতুন করে পরিচয় হবার পর আজ প্রায় আড়াই বছর হলো। অমৃতা এখন সুমিতের কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে যেন বদ্ধপরিকর। সুমিতের সঙ্গে তার আজকের সম্পর্কের ধারটা যে কতটা ধারালো, তা বেশ অনুমিত এই কবিতা পাগলামি থেকে।
হঠাৎ একদিন ফেসবুকে ‘নৌকো জীবন’ শিরোনামে একটা কবিতা পড়েছিল অমৃতা। কবিতাটা ছিল সুমিতের। পড়তে গিয়ে যেন কোথাও কবিতার মধ্যে নিজের অতীত জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনার ব্যথিত ইঙ্গিত খুঁজে পায় অমৃতা। যেন মনে হয়,
“এতকাল মনে লুকিয়ে রাখা একটা অপরাধ বোধ এই কবিতা যেন নতুন করে জাগিয়ে দিল।”
তৎক্ষণাৎ সুমিতের প্রোফাইল সার্চ করে ধরে ফেলে অমৃতা, এই সেই সুমিত রায়। যার প্রতি প্রায় তিন দশক আগে এমন এক দুঃসহ ব্যবহার করেছিল অমৃতা, যা মাঝে মাঝে এখনও তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়।
অমৃতার মনে পড়ে যায়, দাদু অমিত্রসূধনের লাইব্রেরি ঘরের পড়ার টেবিলে সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কথা।
প্রতি রবিবার সকাল এগারোটায় ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র সুমিত রায় অঙ্ক শেখাতে আসে অমৃতাকে। দাদুর বিশাল লাইব্রেরি ঘরের মাঝখানে লম্বা টেবিল। তার এক পাশের চেয়ারে পলাশপুর অঞ্চলের বিশিষ্ট অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক সত্তরোর্ধ্ব অমিত্রসূধন চক্রবর্তীর একমাত্র আদুরে নাতনি অমৃতা, ক্লাস নাইনের ছাত্রী। আর অন্য পাশে সাদামাটা সদ্য কচি-গোঁফ সুমিত। নিয়মিত অঙ্কের পাঠ, অনুশীলন। পাটিগণিত, বীজ গণিত আর জ্যামিতির উপপাদ্য সম্পাদ্য। অমৃতা সুমিতের মুখোমুখি বসে অঙ্ক করে। সুমিত দেখেদেয় ভুল ঠিক। ভুল করলে খাতা টেনে নিয়ে সুমিত নিজেই করে দেয় অঙ্কটা।
অমৃতা মাথা তুলে তেমন তাকায় না সরাসরি সুমিতের চোখের দিকে। সুমিত অঙ্ক বোঝাতে গিয়ে প্রায় একাই বকবক করে যায়। সব কথায় অমৃতা সাড়াও দেয় না সুস্পষ্ট। তবু ক্লাস চলে সপ্তাহে একদিন। রবিবার। সুমিত অঙ্ক করাতে এসে রোজ চা বিস্কুট পায়, কখনও কখনও ভালো জলখাবারের প্লেট আসে। গরম লুচি হালুয়া অথবা কচুরি তরকারি আর মিষ্টি সাজানো প্লেট থেকে গন্ধ ছড়ায়। সুমিত মনে মনে খুশি হয়, উপরি পাওনা এই জলখাবারে । দ্রুত অঙ্ক সরিয়ে খাবারটা শেষ করে সে। দারুণ তৃপ্তি সহকারে মনে ভাবে,
“অমিত্রসূধনবাবু শুধু শিক্ষানুরাগীই নন, নিঃসন্দেহে চমৎকার খাবারে অতিথিপরায়ণ।”
সবেমাত্র একটা ঘন কালো রেখার মতো গোঁফ, সুমিতের নাকের নীচে । মাত্র তো ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। স্কুলের সেরা ছাত্র। অথচ গোপনে সে কবিতার সংক্রমণে আক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ রেখে যতীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু রেখে জীবনানন্দ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে নেশার মতো পড়ছে।
অমিত্রসূধন চক্রবর্তীর নাতনিকে টিউশন পড়াতে এসে সাহিত্য পড়ার সমুদ্র-স্বাদ তার জিভের ডগায়। প্রতি রবিবার একটা করে কবিতার বই সুমিত নিয়ে যায় অমৃতার দাদুর লাইব্রেরি থেকে। পরের রবিবার সেটা ফিরিয়ে দিয়ে নিয়ে যায় আর একটা।
সাকুল্যে সাত আট মাস, সুমিত অমৃতাকে অঙ্ক শিখিয়ে ছিল। একটা আকস্মিক ঘটনার জেরে হঠাৎ করে একদিন এই সুন্দর পাঠশালাটি ছেড়ে পালিয়ে গেল সুমিত। আর কখনও সে অমিত্রসূধন চক্রবর্তীর বাড়ির দিকে ফেরেনি।
‘বনলতা সেন’ কাব্যটির প্রায় প্রতিটি কবিতা তখন সুমিতের মুখস্থ। মনে মনে কবিতা আওড়ে সে তখন জীবনানন্দে পাগল। অমৃতা সামনে বসে একমনে অঙ্ক করে যখন, সুমিত কেমন তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে অমৃতার দিকে। হঠাৎ চোখ তুলে মুহূর্ত তাকাতেই অমৃতার চোখে চোখ পড়তেই সুমিত দৃষ্টি সরিয়ে লাইব্রেরির বই-এর দিকে মুখ করে তাকায়। এই অপ্রস্তুত হয়ে পড়া বা গোপনে অমৃতাকে দেখা নিশ্চয়ই বয়সে ছোটো অমৃতার চোখ এড়ায় না।
ক্লাস নাইনের ছাত্রী অমৃতা, পারিবারিক শিক্ষা আর আভিজাত্যে তার চেতনা আগে থেকেই যথেষ্ট তীক্ষ্ণ ও স্বচ্ছ। দাদু যেদিন এই ছেলেটিকে ডেকে এনে তার অঙ্কের অতিরিক্ত শিক্ষক নিযুক্ত করেন, সেদিন থেকেই ছেলেটাকে একটু হলেও আড় চোখে দেখে এসেছে অমৃতা। কিন্তু পছন্দ না হলেও এমন অল্পবয়সী ক্যালাস মার্কা প্রাইভেট টিচার শুধুমাত্র দাদুর কথায় মেনে নিয়েছে অমৃতা। দাদু যে তার আদর্শ।
মা বা বাবা অমৃতাকে যতটা না প্রভাবিত করতে পারে, দাদু তার চেয়ে অনেক উপরে। এই লাইব্রেরি ঘরে দাদু অসংখ্য বই দেখিয়ে যেমন অমৃতাকে পড়তে উৎসাহিত করেন কথায় কথায়, তেমনি সময় সুযোগ হলে ইংরেজি সাহিত্যের নানান গল্প দাদুর মুখে। অমৃতা রামায়ণ, মহাভারত কখনও ছুঁয়ে দেখেনি এই কিশোরী বয়সে। কিন্তু দাদু তাকে এতবার এমন করে সেখান থেকে কাহিনী, তাৎপর্য শুনিয়েছে, যে অমৃতার মনে হয় সে নিজেই সে সব পড়েছে।
ফলে এই সামান্য বয়সেও অমৃতা প্রখর নীতি আদর্শ বোধের একটা নিজের মতো মানসিক কাঠামো যেমন তৈরি করতে পেরেছে, তেমনি তার একটা নিজস্ব রুচিবোধ সবসময় জাগ্রত থেকছে।
কিশোরী বয়সের প্রথম মানসিক রসবোধের আবিষ্কার তার হৃদয়ে জায়গা পেলেও তা সুরক্ষিত, কোনো স্বপ্নের রূপকথায়। সে তার কাছে এক-জীবন অপেক্ষার আনন্দ। ধারণা তার ভাব কল্পনাকে নিয়ে গেছে এক উত্তুঙ্গ রূপবান, সুরুচিপূর্ণ স্বর্গিয় ভবিতব্যের চাপা বিশ্বাসে।
কিশোরী অমৃতার বিশ্বাস, একদিন ঠিক সময়ে ঠিক মানুষটি তার সামনে এসে এগিয়ে দেবে হাত। যা ভাবতে গেলে লজ্জা হয় তার। খুব ইচ্ছে করে সচরাচর সে ভাবতে চায় না সেকথা। যেন একান্ত তুলে রাখার মতো মহা মূল্যবান এক চির গুপ্ত কক্ষের ভাব ও ভাবনা সেসব।
তাছাড়া সে নিজে যথেষ্ট জানে, এখন সে মাত্রই কিশোরী। আগে দাদুর মতো জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিতা হতে হবে। সম্মানীয় এক প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি চরিত্রের স্বকীয়তা যে তার সবচেয়ে বড় সখের । তাই সহজ ও সচরাচর কোনো সাধারণে চোখ পড়লেও দৃষ্টি আটকায় না তার । যথারীতি সরে যায় পরবর্তী দৃশ্য পটে।
এখন তার ফুল দেখে খুশি হওয়ার কাল, ফুল চয়নের দিন নয়।
সুমিত বয়সে সদ্য তরুণ। টেবিলের ওপারে কিশোরী অমৃতা যেন তার চোখে এক সদ্য ফোটা গন্ধরাজ। যার উচ্চকিত রূপ লাবণ্য সুমিতের নতুন লিখতে চাওয়া কবিকল্পনাকে চুরমার করে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে ঠিক উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত উপমা রূপক বিশেষণ খুঁজেই যেন পায় না। যা দিয়ে অমৃতাকে সে বর্ণনা করতে পারে।
তার সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে গড়ে ওঠা রুচিবোধ সে অভ্যাস সরবরাহ করতে পারে না, পর্যাপ্ত কাব্য রসের শব্দ, ধ্বনি। তবু এই তরুণ বয়সের সূচনায় অমৃতা যেন তার, হাজার বছর পথ হেঁটে আসা অন্তিম ঘোষণা। যেন এখানেই সে খুঁজে পেয়েছে পাখির নীড়ের মতো চোখ । যেন এ-ই সেই বনলতা সেনের সমস্পর্ধী সদ্য নারী-রূপগামী স্বপ্ন-কুমারী । সুমিত তাকে আপন মনের সুচেতনার মানবী রূপ বলে মানে মনে। মাঝে মাঝে সুমিতের মনে হয়,
” অমৃতা তুমি দূরতর দ্বীপ নও।”
প্রায় সাত আট মাস নিয়মিত পড়াতে এসে এখন অমৃতা তার বড় বড় চোখ তুলে সোজাসুজি তাকায় সুমিতের দিকে। বিদিশার নিশার মতো ঘন কালো একরাশ ভর্তি চুলের ধারা কখনও পরিপাটি, কখনও আলুলায়িত। বিকশিত অঙ্গ সৌন্দর্য পর্যন্ত সুমিতের দৃষ্টি পৌঁছাতে পারে না। তার বহু পূর্বেই সে একজীবন শান্তির ছায়াতলে আত্ম সমর্পণ করে ফেলে। মনে মনে পক্ষীরাজ ঘোড়ার লাগামে হাত দিয়ে পৌঁছে যেতে চায় একাকি রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে।
ইতিমধ্যে স্কুল পত্রিকায় প্রথম সুমিতের দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। দুটিই উচ্চমাধ্যমিক সিলেবাসে থাকা ইংরেজি কবিতার বাংলা অনুবাদ। সুমিত নিজেই তার সাধ্যমতো অনুবাদ করেছে । লেখা জমা দেবার আগে একদিন অমিত্রসূধনবাবুকে লেখা দুটো দেখায় সুমিত। দু তিনটে শব্দের প্রয়োগগত ভুল শুধরে দিয়ে অমিত্রসূধনবাবু সুমিতের প্রশংসায় রীতিমতো পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। অমৃতাকে ডেকে বলেন,
” দেখ্ অমৃতা সুমিত কী দারুণ অনুবাদ করেছে দু’দুটো ইংরেজি কবিতা। এইটুকু বয়সে এতো ভালো অনুবাদ কবিতা লেখা, আমি তো ভাবতেই পারছি না। সুমিত তুমি শুধু অঙ্কে জিনিয়াস নও, কবিতা রচনার একটা অনায়াস প্রতিভা তোমার মধ্যে আছে। হ্যাঁ ,আছে বলেই আমার বিশ্বাস। “
সুমিতের সেই প্রশংসা অমৃতা শুনেছে। ভালো লেগেছে। বলেছেও সে কথা পড়তে বসে সুমিতকে,
” শুভেচ্ছা জানবেন, ভালো কবিতা লেখার জন্য এটা।”
সুমিত অমৃতার মুখে মিষ্টি একটা হাসির সঙ্গে শুভেচ্ছা পেয়ে যারপরনাই বিগলিত হয়েছে। তারপর বাড়ি ফেরার পথে বার বার ভেবেছে। তারপরের দিন এবং তারও পরের পরের দিন খুব খুব ভেবে গেছে— অমৃতার প্রশংসা। খুঁজে পেয়েছে মহা মূল্যবান অমৃতার মার্জিত হাসিটুকু। সারারাত জেগে থেকে খুব করে ভাবে,
“নিজেকে মেলে ধরে একটা লেখা লিখতেই হবে তাকে।”
ভাবে, এমন একটা কবিতা অমৃতাকে পড়াতে চায় সে, যে লেখা পড়ে অমৃতা তার অধর ওষ্ঠে অমৃত বর্ষণ করে স্বর্গিয় হাসি হাসবে। ভাবতে ভাবতে শেষে, শব্দ আর পংক্তির ভাঙা গড়ার খেলায় খেলতে খেলতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাবুডুবু খেয়ে শেষ রাতে ঘুমিয়েছে সুমিত ।
তারপর এক সপ্তাহ পর আবার রবিবার সকাল এগারোটায় অমিত্রসূধনবাবুর বাড়ির দোতলার লাইব্রেরি ঘরের টেবিলে মুখোমুখি।
সুমিত যথারীতি যুগপত কম্পিত এবং আনন্দ বিষ্ফোরনের তাপে ঘেমে নেয়ে একসা। সেদিন অঙ্ক করতে বসে শুরুতে একটা অঙ্ক অমৃতা ভুল করতেই সুমিত বলে,
” ঠিক আছে, অঙ্কটা আমি করে দিচ্ছি। তুমি এটা একবার পড়ে দেখো। তোমার জন্য লিখেছি ।”
বলে জামার পকেট থেকে ভাঁজ করা রাত জেগে লেখা কবিতার কাগজটা অমৃতার দিকে তুলে ধরে সুমিত। অমৃতা সুমিতের মুখের দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে তারপর কাগজটা হাতে নেয়। সুমিত আর অমৃতার মুখের দিকে তাকায় না। নিচু হয়ে অঙ্কটা করে দিতে চায়।
অমৃতা প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে দেখে। পড়ে, অনেকক্ষণ ধরে নিঃশব্দে পড়ে। তারপর সুমিতের দিকে বেশ ক’বার তাকায়। সুমিত মুখ তুলছে না বলে অপেক্ষা করে।
এবার সুমিত মুখ তুলে অমৃতার দিকে তাকালে। অমৃতা কবিতা লেখা কাগজটা ফের ভাঁজ করে তুলে ধরে,
” এটা আপনার পকেটে রেখে দিন। বাংলা কবিতা এই অল্প বয়সে আমিও একেবারে কম পড়িনি। তাছাড়া কবিতার বিষয় যা এখানে, তাতে এটাকে কবিতা বলা যায় না ; এটা তো রীতিমতো প্রেমপত্র !”
সামান্য থেমে অমৃতা বেশ একটু মেজাজী হয়ে আবার বলে,
“আমাকে দিতে চান ? আপনি তো আমাকে অঙ্ক শেখাতে এসেছেন, তাই নয় কি ? দাদু আপনাকে স্নেহ করেন এবং বিশ্বাসও । তা বলে সামান্য লেখার প্রশংসা পেয়ে, তারই নাতনিকে প্রেমপত্র ? কী ভাবেন নিজেকে ? আমাকেই বা কী ভেবেছেন ? বয়সের কথা মাথায় আসে না আপনার ?”
টেবিলের উল্টো দিকে মাথা নিচু করে সুমিত। কাঁপছে, ঘামছে আর নীচে নামছে অপমানে।
কিশোরী অমৃতা যেন রীতিমতো পরিণত। সে ঐ একই রকম শান্ত অথচ চরম আর নির্মম কন্ঠে আবার বলতে থাকে,
“এখন তো মাত্র ইলেভেনের ছাত্র আপনি ! আমিও সবে চোদ্দ বছরের মেয়ে ! আর একটা কথা মনে রাখবেন, প্রত্যেক মানুষের যোগ্যতা এবং পার্সোনাল স্ট্যাটাস তৈরি করতে হয় । তার জন্য সময় লাগে । কবিতা ছেড়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করুন । এসব কথা হয়তো দাদুকে না বলে পারব না । তারপর পারবেন তো তার সামনে মুখ তুলতে ?”
অমৃতার কাটা কাটা সুস্পষ্ট ,তীক্ষ্ণ ও তীব্র কথা শুনতে শুনতে সুমিত ধীরে শক্ত পাথর হয়ে যাচ্ছিল । অমৃতার মুখের দিকে তাকানোর শক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলেছিল সে । হঠাৎই সুমিতের চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল টপ টপ করে ঝরে পড়ে অঙ্কের খাতার উপর । যা মোছার সাহসও তার নেই। লজ্জা আর অসম্মানে সুমিত দাহ ছেড়ে দূর হতে চায়।
আকস্মিক ভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে লাইব্রেরি ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে চলে যায় সে। দৌড়ে নামে সিঁড়ি বেয়ে একতলায়। উঠোন পেরিয়ে পাঁচিলের ধার । সাইকেলটা কোনোমতে টেনে নিয়ে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে গেট পার হয়ে রাস্তায় নামে । সাইকেল প্যাডেলে দ্রুত জোর বাড়িয়ে বাড়ি পৌঁছে, আশ্রয় নেয় বিছানার । সেদিন সারারাত প্রায় নিঃশব্দ সে, লিখতে পড়তে না পারা অসুস্থতা । শেষে দু’দিন টানা জ্বর । ভেঙে চুরমার সুমিত জ্বরে খুব দুর্বল হয়ে পড়ে । লঘু মন তার ছুঁতে চেয়েছিল আশ্চর্য অনধিকার । ধীরে সুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভাঙতে থাকে তার । নিজের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে নতুন চেতনা তাকে বাঁধে ধীরে ধীরে ।
সেই শেষ, আর কখনও সুমিত অমৃতাকে অঙ্ক শেখাতে যায় নি । অমিত্রসূধন চক্রবর্তী লোক মারফত দেখা করার খবর পাঠালে, সুমিত ভয়ে সিটিয়ে গেছে । কিন্তু সেমুখো হয়নি আর ।
অমৃতার এসবের খোঁজ রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না । রাখেও নি সে জনৈক সুমিত রায়ের কোনো সংবাদ । জীবনে দাদুর মতো জ্ঞান আর বিদ্যার সওয়ার হয়ে একটা সম্ভাব্য উচ্চতায় পৌঁছানো তার দৃঢ় শপথ । পলাশপুরের পড়ার পাঠ তার শেষ হলো উচ্চমাধ্যমিকে । জেলার মধ্যে প্রথম সারির উল্লেখযোগ্য রেজাল্ট নিয়ে অমৃতা পড়তে চলল কলকাতার কলেজে । অবশ্য মাধ্যমিকের পর অঙ্ক পড়া তার আর হয়নি । লক্ষ্য যে ইংরেজি সাহিত্য ।
একদিন কলেজ ছেড়ে ইউনিভার্সিটি । ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করে পি এইচ ডি । দাদু কিন্তু এরপর আর দেখে যেতে পারল না । দাদু অমিত্রসূধনের মৃত্যুর পর চক্রবর্তী পরিবার পলাশপুরের বাড়িটা বেঁচে দিল স্থানীয় এক ব্যবসাদারের কাছে । তখন অমৃতা শুধু বাবা কাকাকে অনুরোধ করেছিল,
” দাদুর লাইব্রেরিটা আমার চাই।”
কলকাতার কাছেই, চক্রবর্তীদের নতুন বাড়ি । যদিও বাবা কাকা ইতিমধ্যে আলাদা আলাদা বাড়ি কিনেছেন । দাদুর মৃত্যুর পর বংশগত সম্পত্তি সব ভাগ হলো । অমৃতা দাদুকে রাখতে চাইল তাঁর স্মৃতিময় বিরাট সেই সংগৃহীত বইয়ের ভিতর দিয়ে। কিন্তু সব বই তার সংগ্রহে পাওয়া হলো না।
“–নতুন বাড়িতে এতো বই রাখার জায়গা কোথায় ?”
বাবার এই প্রশ্নের সঙ্গত উত্তর ঠিক তক্ষুনি দিতে পারে নি অমৃতা। কারণ নতুন বাড়িটা বাবার কেনা। একটা ষোলো ফুট বাই চব্বিশ ফুটের ঘর শুধুমাত্র বই রাখার জন্য, সে বাড়িতে কোথায় !
ফলে অর্ধেকের মতো বই বেছে নিয়ে বাকি গুলো দান করে দেওয়া হয়েছিল প্রফুল্লনগর কলেজের গ্রন্থাগারে। তবু একদিক থেকে সেটা ভালো কাজ হয়েছে, অমৃতা সান্ত্বনা পেয়েছিল। কেননা প্রয়াত অমিত্রসূধন ঐ কলেজেই দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা করেছেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁর ভালবাসাও ছিল গভীর। তাঁর সংগ্রহের বই পরম্পরায় ছাত্র-ছাত্রীদের কাজে এলে ভালোই— অমৃতা ভাবে।
তবু অমৃতা মনে ভেবে কষ্ট পেয়েছিল, যদি তার নিজের একটা বাড়ি থাকত ! তবে সেই স্বপ্নের বাড়িতে সবচেয়ে বড় লম্বা চওড়া ঘরটি হতো লাইব্রেরি।
পি এইচ ডি শেষ হলেও চাকরিতে হলো দেরি। তবু তাতে অমৃতার তেমন উদ্বিগ্নতা ছিল না। দিব্যি বই পড়ে গান শুনে আর একটু আধটু প্রবন্ধ লিখে কেটে যাচ্ছিল আত্ম অনুরাগে। কিন্তু পৃথিবীতে নিজস্ব স্বাধীনতা আর কতটুকু। বিঘ্নতা কেবল রূপ বদলে পর্যায়ে পর্যায়ে স্বমহিমায় আসে। বিয়ের প্রস্তাব এলো আকস্মিক ভাবে। অমৃতা মানসিক অপ্রস্তুতির মধ্যেই আকাশে দেখল সিঁদুরে মেঘ।
ক্লাস নাইনে প্রথম সেই টিউশন মাস্টার সুমিতের কবিতাঘাত। সেদিন সুমিতের সাহস দেখে, তরল আবেগ দেখে, অপরিণত বয়স দেখে কিশোরী অমৃতার কান লাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দাদুর শিক্ষায় সে অল্প বয়স থেকেই বেশ খানিকটা সমবয়সীদের থেকে স্থিরতায় আর দৃঢ়তায় এগিয়ে। সরাসরি সমান ও বিপরীতমুখী আঘাতে পেরেছিল সুমিতকে পূর্ণ প্রতিহত করতে।
যে চরম লজ্জা আর অপমানে জীবনে আর সুমিত অমৃতার সামনে আসেনি। অমৃতাও সেই প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ সরিয়ে রেখে নিজের জীবনের লক্ষ্যে থেকেছে অবিচল।
উচ্চমাধ্যমিকের পর অমৃতা কলকাতা চলে এসেছে উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে। সাফল্যের সার্টিফিকেট আজ তার ফাইলে বেশ কয়েকটি সাজিয়ে রাখা। জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর ধীর, ধৈর্য্যশীলতার যোগ্যতায় পরিবারে বাবা মা অন্যরাও তাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে এসেছে অমৃতা সেও অনেক দিন হলো । আজ সে নেট-কোয়ালিফাই, কলেজ-সার্ভিসের চাকরিপ্রার্থী। তবু এই জীবন কোথাও যেন বন্ধুহীন।
কখনও কখনও খুব একাকী মুহূর্তে একটা সামান্য শুকনো ক্ষুদ্র পাতার মতো, আলতো বাতাসে মনে মুহূর্তের জন্য ভেসে এসেছ কিশোরীবেলার একটি বিরক্তিকর স্মৃতি।
অমৃতা বড় একান্ত স্বগত বলেছে,
” — সুমিত একদমই ঠিক করেনি সেদিন। ভাবনা মাত্রই তাকে প্রকট প্রকাশে আনতে হয় ? মানুষের নৈতিক বোধের কোনো দাম নেই ! একটা হোপলেস কোথাকার।”
এমন সব কথা ভাবতে ভাবতেই কতবার অবাক হয়ে নিজেকেই বলেছে,
“—- ধুর এসব কথা আমিই বা ভাবছি কেন এখন ? যত্তসব ! একা বসে থাকলে কত্তসব এলোমেলো, গুরুত্বহীন কথা হঠাৎ চলে আসে মাথায়।”
আপাত সেই মুহূর্ত সরিয়ে, অমৃতা অনেকবার ভেবেছে,
” — আজ যদি দাদু বেঁচে থাকত, আমি কি সত্যিই এক পরিণত বন্ধু পেতাম না !”
আসলে অমৃতার পড়াশোনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর আজ সে উপলব্ধি করতে পারে একাকিত্ব। অথচ পিছনে ফিরে বন্ধুর মতো মানুষ হাতড়ে একটিও পায় না। এই দীর্ঘ লেখাপড়ার জীবন পেরিয়ে সে ভাবে, পেল কোথায় আর। যেমনটা সে ভাবত, তেমন কেউ ?
ভাবতে ভাবতে কোনো কোনো দিন আবার হঠাৎ সুমিতের কথা দুম করে মনে আসে অমৃতার। আপাত বিরক্তি সরিয়ে ভাবে,
” — তারপর যে সে এখন কী লেখে কে জানে ! কিন্তু বড্ড দুঃসাহসী ছিল সেদিন। লিখেছিল কিছুটা সরাসরি। কিন্তু লেখার হাতটা ওর বেশ পোক্ত ছিল। বনলতা সেন পড়ে প্রভাবিত হয়ে লেখা— সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।”
ভাবতে ভাবতে এখানে এসে থেমেছে বহুবার অমৃতা। তারপর ধীরে ভাবতে শুরু করেছে,
” — একটা আপাত নিরীহ সাধারণ, অথচ সে ছিল মেধাবী । না হয় ভুল করে লিখেই ফেলেছিল একটা কবিতা। তা বলে এতোখানি অপমান, রূঢ় ব্যবহার করে সেদিন আমি ঠিক করিনি। জানি না হয়তো সেদিন সেই ব্যবহারটা না করলে, সুমিতের ক্ষতিই হতো। কিন্তু আমার ?
আমার যে একটুও ভালো লাগত না— তা কি জোর করে বলতে পারি ? জানি না ধুর, জানি না।”
(এরপর আগামী পর্বে)
সুন্দর আর সাবলীল এগিয়ে চলছে গল্প।অভিনন্দন।