আদিশূর বিস্মৃত হবার নন
রাধাকৃষ্ণ(রাধু) গোস্বামী
ছোট বেলা থেকে রাজা আদিশূরের নাম শুনে আসছি। অথচ একটু বড় হতে হতে শুনতে শুরু করলাম যে, আদিশূর নামে কোনো রাজপুরুষ আদৌ ছিলেন কিনা তা’ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নিজে যে খোঁজ করবো তার জন্য সময় কোথায় ! ইতিহাসের মধ্যে দখল থাকলে বা ইতিহাসের ছাত্র হলে নাহয় চেষ্টা করে দেখা যেতো। বন্ধু বা সহকর্মীদের, যাঁদের ছেলেরা ইতিহাসের উচ্চতর পড়াশোনায় ব্যস্ত তাঁদের কাছে একাধিকবার বিষয়টি ছেলেদের বলার জন্য বলেও কোনো সুরাহা পাইনি।
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে, অতীতের ঐতিহাসিকরা যে রাজন্য বর্গের বৃত্তি পেতেন তাঁদের পছন্দসই ইতিহাস লিখতেন, কাউকে ইতিহাস থেকে বাদ দিতেন বা যথেষ্ট নিন্দনীয় চরিত্র হিসাবে অঙ্কিত করতেন। চিরকাল এই ধারা চলে আসছে। বৃটিশ শাসকদের অগ্রগণ্য ঐতিহাসিকরা তাঁদের পক্ষ নিয়ে ইতিহাসের কম বিকৃতি ঘটান নি। সে সব বিস্তারিত করার যোগ্যতা বা সময় এটা নয়। বিষয়টা আদিশূর নিয়ে আলোচনার। তবে হ্যা, এক্ষেত্রে আমরা একদা বাঙ্গালার রাজা শশাঙ্কের ইতিহাস নিয়ে জানতাম যে তিনি সম্রাট হর্ষবর্ধনের চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন। আর সেজন্যই সম্রাটের প্রিয় ইতিহাসবেত্তারা এমনকি হর্ষচরিত রচয়িতা বাণভট্ট সম্রাটের ভূয়সী প্রশংসা না করে কী আর করবেন? তখনকার ঐতিহাসিকরা বাঙ্গালার রাজা বীরশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা শশাঙ্ককে কোনও সম্মান জনক জায়গায় না বসিয়ে বরং দুধর্ষ ডাকাত বা মাস্তানের ভূমিকায় অঙ্কিত করে রেখে গিয়েছেন। রাজা শশাঙ্কের রাজত্ব কাল ৫৯০- ৬২৫ খ্রী. বাঙ্গালার মানুষের নিজ নিজ বিষয় ছাড়া এসব বিষয়ে মন বা সময় দেবার অবসর নিতে পারেন নি। তার ও অনেক আগে রাজা আদিশূর। তখনকার ইতিহাস কে আর লিখবে ?
একথা ঠিক ইতিহাসে একাধিক আদিশূরের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশেষ করে কামরূপপতি ভাস্করবর্মা, সূর্য বংশীয় জয়ন্ত, সেনবংশীয় বিজয়সেন, শূরবংশীয় আদিত্যশূর নিজেদের আদিশূর নামে অভিহিত করতে পছন্দ করতেন।
ইতিহাসে যতটুকু পাই তা হলো খ্রী. ৮ম শতাব্দীর মধ্যভাগে পালবংশীয় শেষ রাজা ন্যায়পালকে পরাজিত করে সেনবংশীয় বীরসেন সমগ্র গৌরবঙ্গ অধিকার করেন। ঐতিহাসিক গণ বলেন বীরসেন ও আদিশূর একই ব্যক্তি । জেঃ কানিংহাম এবং জেঃ ডি. মার্শম্যান মত প্রকাশ করেন যে, বীরসেন সেনরাজাদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন।
প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বলেন রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরী মতে আদিশূর আর জয়ন্ত এক ই ব্যক্তি এবং ৭৩২ খ্রী. আদিশূরের রাজ্যাভিষেক হয় আর তার পরে ৭৭৩ খ্রী. তিনি বঙ্গের অধীশ্বর হন। তিনি কারো মতে ৩৫ বৎসর, ‘ আইন-ই-আকবরের ‘ মতে ৭৫ বৎসর রাজত্ব করেন।
এই আদিশূর পালরাজাদের প্রভাবে বৌদ্ধদের বাড়বাড়ন্ত কমিয়ে গৌড়দেশ থেকে বিতাড়িত করে নিজেকে পঞ্চগৌরেশ্বর ঘোষণা করেন। তখনকার পঞ্চগৌড় ছিল সারস্বত, কান্যকুব্জ, গৌড়, মৈথিল আর উৎকল নিয়ে গঠিত ছিল। পরবর্তীকালে আদিশূরের অধীনে ছিল অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, কর্ণাট, কর্ণসুবর্ণ, কামরূপ, সৌরাষ্ট্র, মগধ, মালব ও জাহুব।
এই আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে রাজা বীরেন্দ্র সিংহের কাছে সাতশত জন স্থানীয় ব্রাহ্মণ কে গো আরোহনে পাঠিয়ে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনিয়েছিলেন।
তবুও Wikisource – এ দেখা যায়, কুলপঞ্জিকাতে আদিশূরকে পাওয়া যায়। হতে পারে এসব প্রমাণমূলক না হলেও জনশ্রুতিনির্ভর। আর অনেক জনশ্রুতি পরবর্তীকালে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
রাঢ়ীয় কুলজ্ঞগণের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি ছিল :-
“আসীত পুরা মহারাজ আদিশূর প্রতাপবান্।
আনীত দ্বিজান্ পঞ্চ পঞ্চগোত্র সমুদ্ভান্।।”
বারেন্দ্র কুলজ্ঞগণের গ্রন্থে আদিশূর ও রাজা বল্লাল সেন সম্পর্কে লেখা আছে :-
” জাতো বল্লাল সেনো গুণি পণ্ডিতস্তস্য দৌহিত্র বংশে।”
আদিশূরের পঞ্চ গোত্রের পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়ন ও দৌহিত্র বংশে বল্লাল সেনের উদ্ভব বোঝা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে জানা যায়, দেশীয় রাজারা গৌরবঙ্গে ব্রাহ্মণ চেয়ে বলেছেন –
” শুনহে বল্লাল সেন, তোমার মাতামহ কুলোদ্ভব আদিশূর পঞ্চ গোত্রে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়া গৌড়মণ্ডল পবিত্র করিয়াছেন।”
“গৌড়ে ব্রাহ্মণ ” গ্রন্থে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে – বেদবানাঙ্ক-শাকেতু গৌরে বিপ্রাঃ সমাগতাঃ” অর্থাৎ ৯৫৪ শাকে বা ১০৩২ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ে ব্রাহ্মণ গণ আগমন করেছিলেন।
এছাড়া ৩য় বিগ্রহ পালের রাজত্ব কালে কর্ণাটক রাজকুমার বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে বল্লাল সেনের পূর্ব পুরুষের গৌড়ে আগমন কালের সঙ্গে মিলে যায়।
এছাড়াও ১ম রাজেন্দ্র চোলের তিরুমালয় লিপিতে জানা যায় দক্ষিণ রাঢ়ের অধিপতি রণশূরের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। আদিশূরকে রণশূরের পুত্র বা পৌত্র মেনে নিলে আর কোন গণ্ডগোল থাকে না। তবু,বল্লাল সেন যে আদিশূরের পরবর্তী একথা মেনে নিতেও কোনো কষ্ট থাকে না।
যতদূর জানা যায়, আদিশূর এবং শশাঙ্ক পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। তবে আমরা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করতে পারি যে আদিশূর নামে এক শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন যিনি কান্যকুব্জ রাজার কাছ থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ এনেছিলেন আর প্রচলিত কাহিনীটি একেবারে অলীক নয়।