একটি ভল্লুক অথবা নেশার গল্প
মলয় চৌধুরী
নীলুর আজ সন্ধেবেলা না বেরোলেই নয় ।যদিও টাউনে মাইকিং হয়েছে সন্ধের পর ঘরের বাইরে না বেরোতে , কিন্তু কি করবে নীলু ? টানা তিন দিন বইমেলার স্টল তৈরীর কাজ করেছে । দিন-রাত ধরে খাটতে হয়েছে । খাওয়া-শোওয়া সব ওখানেই ।আজ ছাড়া পেয়েছে ।হাতে বেশ কিছু টাকা । বাড়িতে তো বুড়ি মা আর নীলু । দুপুরে ঘরে ফেরার সময় চাল-ডাল-আলু-আটা-তেল-সব্জি-ডিম সব কিনেছে । যা বাজার করেছে তাতে দু তিন দিন চলে যাবে । মায়ের হাতে বাকী সব টাকাই প্রায় দিয়ে দিয়েছে । অল্প কিছু নিজের জন্য সরিয়ে রেখেছে ।ক’ দিন ধরে পার্কের পাশে সন্ধের ঠেকে যাওয়া হয় নি ।আজ যাবে ।একটু নেশা করবে ।ঘরে ফিরে মায়ের ধমক-ধামক শুনবে ।তারপর খেয়েদেযে ঘুমিয়ে পড়বে ।
সন্ধের মুখেই ঘর থেকে বেরল নীলু ।গলির মোড়ে রবির চায়ের দোকান তখন বন্ধ হচ্ছে ।এত তাড়তাড়ি! ভাবল নীলু ।দু চারজন ওখানে ছিল ।জোর আলোচনা হচ্ছে- ভালুকটাকে শিশু উদ্যানের কাছে দেখা গেছে । ভালুকটা নাকি ভুটান পাহাড় থেকে নেমে এসেছে!
নীলু অবাক হয় ।ভুটান পাহাড়! বাপরে ! সেতো বহুত দূর ! একবার ভুটান পাহাড়ের কাছে এক সিমেন্ট কারখানায় নীলু কাজ করতে গিয়েছিল ।পোষাল না! শুধু ধুলো আর ধুলো ।পুরো একটা মাসও কাজ করতে পারেনি । পালিয়ে এসেছিল । সেই ভুটান পাহাড়! ওখান থেকে চার পায়ে পায়ে চলে এল জানোয়ারটা ?
রাস্তা সুনসান ।অল্প অল্প শীত গায়ে ।বইমেলা চত্বরে আলো আছে, হইচই নেই ।সব বন্ধ ।নীলু বাঁধের উপরের রাস্তা ধরল । বাঁধের গায়েই শিশু উদ্যান ।সন্ধেবেলা এইসময় বাচ্চাদের ভীড় থাকে, আজ একেবারে ফাঁকা । টাউনটা সত্যিই তবে ঘরে ঢুকে পড়ল?
আর একটু এগোলে কতকগুলো সরকারি অফিস । তারপরই পার্ক ।পার্কটাকে বের দিয়ে ওপাশে গেলেই রতনের ঠেক । একটা বোতল নেবে নীলু ।ঠেকে বসে বোতলটা শেষ করেই ঘরে ফিরে যাবে ।অনেক দিনের অভ্যাস ।কখনো বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে নি ।
রতনের ঠেকও আজ বন্ধ ।অন্ধকার । তাতে কী? ঠেকের পিছনেই রতনের ঘর । ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এল ।
” তুই জানিস না ভল্লু বেরাইছে , দুকান-বাজার বন্ধ আছে ? এই আঁধারে তুই এলি ক্যান ? “
” তিন-চার দিন নেশা করিনি রতনদা, আজ এট্টা না হলি চলছে না ।আমারে এট্টা দাও ।”
রতনের আর কী! বিক্রি হলেই হল । ঘরের থেকে একটা বোতল এনে নীলুকে দিল ।
নীলু কিছুক্ষণ ভাবল । বোতলটা খাওয়ার একটা আড়াল লাগবে । সে ফেরার পথ ধরে হাঁটতে লাগল ।
প্রচুর গাছপালা এদিকটায় ।পাশেই নদী । একটু অন্ধকার দেখে বোতলটা নিয়ে বসে পরতে হবে । নীলু জায়গা খুঁজতে লাগল । পেয়েও গেল ।
কোন এক অফিসের খোলা বারান্দা । বড়ো বড়ো গাছপালার আড়াল । পরিস্কার আছে । এক কোণের আলো- আঁধারিতে দেওয়ালে পীঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো নীলু । বোতলটা খুলে পান করতে লাগলো । ধীরে ধীরে চোখের পাতা ভারী হয়ে এল । কখনো তো এমনটা হয় নি নীলুর ।রতনের ঠেক থেকে নেশা করে এতদিন সে দিব্যি সোজা পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরেছে । আজ কি হল ?
হয়তো টানা তিন দিন বইমেলার স্টল তৈরি করতে খেটেছে , রাতে ভাল করে ঘুম হয় নি । হয়তো ঠান্ডা ঠান্ডা এই সন্ধেতে বেশ কয়েক
দিন পরে আরামের নেশা ঘোর । নীলু আর নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল না ।
ঘুমের ঘোরে, নেশার ঘোরে মনে হল কে যেন তার হাত থেকে খসে পড়া বোতলটা নেড়েচেড়ে দেখল । কে যেন তার মুখে লালা লালা- ভেজা ভেজা কিছু বুলিয়ে দিল । আরো শীতল – আরো আরাম- আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল নীলু- সেই সকালের আলো ফোঁটা পর্যন্ত – যতক্ষণ না ঝাড়ুদার বিশারু তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল ।।