গল্পঃ ছায়ানট – অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

ছায়ানট
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

দৃশ্য -১

যেভাবে ভোর হয় রোজ। ধীরে ধীরে অন্ধকার মুছে। জড়তা ভেঙে গেয়ে ওঠা পাখিদের কণ্ঠে; ভোর হয়। প্রত্যুষ ছড়িয়ে দেয় তার কমলা রঙ। যে রঙ ছড়িয়ে পড়ে তার উঠোন ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, শহর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, একদেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশ পেরিয়ে অন্য এক জগতে। ওটা কি ঈগল পাখি ছিল? নাকি ফিনিক্স; নাইটইঙ্গেল। যে তার জন্য বয়ে এনেছিলো…..

— বিশুদ্ধ ফুলের গন্ধ। বেল গোলাপ জুঁই। প্রত্যুষ রোজ এমন করেই বলে উঠত, তিন ধরণেরই সেন্ট আছে দাদা বারো কাঠি দু টাকা, তিন প্যাকেট পাঁচ টাকা, এক ডজন পনেরো টাকা। এমনি চাইলে এমনি পাবেন মিলিয়ে চাইলে মিলিয়ে পাবেন। আচ্ছা আপনাদের মধ্যে কাউকে কি দেওয়া যায়? বেল জুঁই গোলাপ?

সত্যি কি এমন ভাবে জীবনটা কে মিলিয়ে দেওয়া যায়? প্রত্যুষ ভাবতে থাকে নিজের মনে। রবীন্দ্র সদন থেকে হাজরা বাসে রোজ এই লোকটাকে দেখত প্রত্যুষ।

দৃশ্য -২

পথ চলা বোধহয় এই ভাবেই শুরু হয়। প্রথমে একজন। যে ভাবেই হোক একজন কে নামতে হয় পথে। পিচের বা হার্ড ব্ল্যাক স্টোনে। কখনো চড়াই কখনো উতরাই, কখনো সমতল। কখনো শীতল একাকী ঘাসে লতায় গাছে সাজানো পথ। শুকনো পাতা পড়ে থেকে, হাওয়ায় ওড়ে পাক খায় আবার পড়ে যায়। দুপাশে মেঠো ফুল ফুটে থেকে। আবার কখনো ঝাঁ চকচকে অট্টালিকায় ঘেরা পথ। একফোঁটা ধুলোও ওড়ে না। হেমিলিনের বাঁশিয়ালা কি এই পথ দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে গিয়েছিলো কখনো কোনোদিন? নানা আনন্দ, দুঃখ কে সঙ্গে নিয়ে একজন। সেই আনন্দ আর দুঃখকে ভাগ করে নিতে চাইল আরও একজন বা দুজন। তারপর আরও দুজন তিনজন। ধীরে ধীরে মানুষের মিছিল। মানুষ কি তবে স্বাধীন হয়নি এখনো? শৃঙ্খলমুক্ত মানুষ কখনো মিছিল করেনা। কামারশালার দিকে ছুটতে থেকে প্রত্যুষ। দুটো হাতে চেপে ধরা বেড়িটা ভেঙে ফেলতে চায়। প্রাণ পন করে ছুটতে থাকে প্রত্যুষ। শহর পেরিয়ে, মাঠ ময়দান পেরিয়ে। প্রিজন ভ্যান থেকে নামে সরকারি পোশাক পরা আট দশ জন লোক হাতে পিস্তল রাইফেল

— যা বাড়ি যা তোকে ছেড়ে দিলাম। …. হল্ট। …. ফায়ার।

গর্জে উঠলো পিস্তল। লাল রক্তাক্ত আজ প্রত্যুষ। গাছে শান্তিতে বসবাসকারী পাখিরা উড়ে গেলো। যে পাখিদের কণ্ঠে প্রত্যুষ ছড়িয়ে দিয়েছিলো রঙ মাঠে ময়দানে। মাঠ ময়দান পেরিয়ে দিগন্তে।

দৃশ্য -৩

যে মানুষটাকে সে ভালোবেসেছিলো প্রাণ ভ’রে। যাকে নিয়ে এই কঠিন বাস্তবের মধ্যেও সে স্বপ্ন দেখেছিলো। মোৎর্জাট এর সিম্ফনি ফোরটি বুকে বেজে উঠতো তার কথা ভাবলে। চন্দ্রা একরাশ জ্যোৎস্নার আলো নিয়ে এসেছিলো প্রত্যুষের জীবনে এই কথা প্রত্যুষ ওঁকে যে কতবার বলেছিল কে জানে। এই এলোমেলো ভাবটা কাটিয়ে একটু সবকিছুকে গুছিয়ে নিয়েই দুজনে একসঙ্গে খোলা মাঠে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবে এমনটাই মনে মনে ভেবে রেখেছিলো। চন্দ্রা কাছে আসলে জুঁই ফুলের গন্ধে ভরে উঠত মন। কি অসম্ভব শুভ্র কমল। কিন্তু এই সব ভাবনা একদিন কাঁচের টুকরোর মতো খান খান হয়ে ভেঙে যায়। সেদিন সে রমণরত অবস্থায় চন্দ্রাকে দেখে অন্য এক পুরুষের সাথে। কোন কিছু না দেখে কোন কিছু না ভেবে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় প্রত্যুষ। চন্দ্রাও তার সব লাজ লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে বিবস্ত্র ছুটে যায় দরজা পর্যন্ত। প্রত্যুষ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। ও হয়তো সহ্য করতে পারবেনা। কিন্তু ও আমাকে একবারের জন্যও বুঝলো না। টাকাপয়সা না থাকার খিদেটা যে কি ভয়ঙ্কর ……। অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার পথের রেখার দিকে এক ভাবে চেয়ে থাকে চন্দ্রা।

— কিরে কি হল? আমারতো মাল এখনো পড়েনি

— যা যা আজ আর হবে না। তোর টাকা ওই তাকের উপর এখনো আছে নিয়ে যেতে পারিস।

— সাইড সাইড। সরে যান। সরে যান আমাকে একটু দেখতে দিন। হুম, কিছু পেলেন মিস্টার তালুকদার? এনি আইডেন্টিফিকেশান? তাহলে মর্গে আনআইডেন্টিফায়েড বডি’র ডেস্ক এ দিয়ে দিন। এভাবেই ভোর হয় রোজ। ধীরে ধীরে অন্ধকার মুছে। প্রত্যুষ ছড়িয়ে দেয় তার আলো ওই দিগন্ত পেরিয়ে। মাঠ পেরিয়ে। খেত খামার পেরিয়ে। স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে পেরিয়ে যায় ওই দিগন্ত। চন্দ্রা কে নিয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন। সন্তান সন্ততি নিয়ে ওরা দুজন আজ ধানকল পেরিয়ে গিয়েছে। এবার বসন্ত আসবে সম্ভাবনাহীন মাঠে ঘাটে, পথে প্রান্তরে, বনে বাদারে, বসতির গ্রামে গঞ্জে আবার বসন্ত আসবে ……

দৃশ্য -৪

রাস্তার উপরে পড়ে থাকা একটা দেহ। শহরের এক সুপরিচিত রেসিডেন্টশিয়াল কমপ্লেক্স থেকে তার অবৈধ কে বৈধ আদর সেরে বেরিয়ে আসলো প্রত্যুষ। দুরন্ত গতিতে ছুটে গেল একটা মাতাল ৪০৭। অবৈধ বৈধতা – বৈধ অবৈধতা সব কিছুর ইতি টেনে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এজন দুজন করে অনেক লোক জড়ো হতে লাগলো রাস্তার উপর পড়ে থাকা দেহটাকে ঘিরে। তারপর পুলিশ। কৌতূহলী লোকজন। নানা গুঞ্জন। অনেকের মনে উঁকি মারা প্রশ্ন, জমে থাকা জিজ্ঞাসা। কথা। জানা না-জানা অনেক কিছু।

— এই ভদ্রলোক আপনাকে কিছু বলতে চায় স্যার, উনি ওঁর পাশের ফ্লাটেই থাকেন।

— কি মনে হয়? লাইফ স্টাইল ঠিক ছিল না? মেয়েলি কেস?

— না স্যার লোকটা উপর থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় পেতো। পাঁচ তলায় ওনার ফ্ল্যাট। বারান্দায় এলে খাটের পায়ায় সঙ্গে দড়ি লাগিয়ে কোমরে বেঁধে বারান্দায় আসতো, যদি পড়ে যায়। অফিস বাড়ি সর্বত্র ওঁর পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল

— পড়ে যাওয়ার ভয়?

— হ্যাঁ স্যার

— তারপর? Psychomotor agitation কি ছিল? খুব restless খুব tension এ কি থাকতেন? কোন ক্লু

— মহিলা ছিল না; তবে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতেন। তবে থাকতেও পারে। আমার জানা ছিল না। স্যার মহিলা বলতে তো ছিল ওনার মা। তিনি তো বছর পাঁচে আগেই চলে গেছেন। আর মহিলা আর মহিলা….

চন্দ্রার কথা কেউ জানতোও না। যাকগে ভালোই হয়েছে একদিক থেকে। চন্দ্রার অনাবৃত শরীর এখনো ওঁর চোখে ভাসে। হয়তো চন্দ্রা আজও ভালোবাসে। ওর হয়তো কোন উপায় ছিলোনা। প্রত্যুষের নিজের পৌরুষের উপর বড় ঘৃণা জন্মায়। শুধু পৌরুষের উত্তেজনায় এমনটা সে করলো! কিন্তু কেন? অমাবস্যার পরই তো একটু একটু করে পূর্ণিমা হয়। প্রত্যুষ পূর্ণিমার আলোর শেষের ভোর। এমন ভোরে কি সে মাকে একলা ফেলে চলে যেতে পারতো। প্রত্যুষ হেঁটে যায় শুকনো পাতা পড়ে থাকা পথ ধরে শহরের কিংবা গ্রামের। গ্রাম ছেড়ে, শহর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, একদেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশ পেরিয়ে অন্য এক দিগন্তের দিকে –

“আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।

যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখদুটি রিক্ত হ্রদের মতো কৃপণ করুণ, তাকে তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি। এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায় বিঁধে কাতর হ’লো পা। সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।”

3 thoughts on “গল্পঃ ছায়ানট – অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

  1. অনবদ্য লেখা। গল্পটা অসম্ভব ভালো

  2. অসম্ভব সুন্দর লাগল। পুরো থিমটা অসাধারণ…

Leave a Reply to Rituparna Acharya Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *