ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী – অনিরুদ্ধ সুব্রত

দ্বিতীয় পৃথিবী (প্রথম পর্বঃ)
অনিরুদ্ধ সুব্রত


“ঘর আছে বা নেই, ফেরা তবু আছে
পথ তো পথেই শুয়ে থাকে —
শীত আর শিশিরে গাছেরা জাগে রাত
অন্ধকার তার চির ভালো লাগে…”

এটাই ক্যাপশন দিয়ে সুমিত ফেসবুকে পোস্টালো প্লাটফর্ম নম্বর নাইনের শুনশান একটা লং শট মোবাইল ক্যাপচার। এইমাত্র রাত নটা তেরোর আপ পলাশপুর লোকালটা দৌড়ে ধরলো সে। শিয়ালদহ থেকে নটা তেরোতে ছাড়লেও ট্রেন পলাশপুর পৌঁছাতে মাঝরাত। সে কথা আর নতুন কী।
এই শহরের দিকে ভোর হতেই এমন দূর দূর পলাশপুর থেকে ঝাঁক ঝাঁক মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসে। রুটি রুজির সন্ধান থেকে শুরু করে রুচি, ইচ্ছে অথবা একেবারে এমনিই আসে কাতারে কাতারে। ফেরাটা অবশ্য যার যার মতো। সুমিতও আজকে দুপুরের দিকে এসেছিল শহরে। এখন ফিরছে পলাশপুরের উদ্দেশ্যে।
রাতের লোকাল ট্রেনেও যথারীতি ভিড়। প্রথম চাঞ্চে সিট পেল না সুমিত। বসে থাকা যাত্রীদের পা সরিয়ে সরিয়ে গলিতে গলে গিয়ে মোটামুটি দাঁড়ানোর গ্যারান্টি পেয়ে আপাতত খুশি সে।
চারদিকে ঘরে ফেরা মানুষের আংশিক দোদুল্যমান স্ট্যাচুর বাগানে সুমিত নিজেকে কেন যেন এই মুহূর্তে আলাদা হয়েই আছে। আড়াইঘন্টার উপর ট্রেন জার্নি করে তবে পলাশপুরে পা দিতে পারবে, এটা আকাঠ সত্যি। সুমিত তাই সেটা নিয়ে ভাবছে না। সামনের সিটে বসে ক্লান্ত যাত্রীর ঘুমে ঢলে পড়া দেখে কেন যেন এখন তেমন হাসি পাচ্ছে না সুমিতের। এতো রাতে লোকাল ট্রেনে ফেরিওয়ালা নেই কেন, তা নিয়ে জিজ্ঞাসা মনে এলেও স্থায়ী হচ্ছে না বেশিক্ষণ।
ফেসবুকে বিচ্ছিন্ন দুটো লাইন সঙ্গে একটা ছবি পোস্টানোর পরও বার বার দেখছে না, বন্ধুরা কে কি রিয়্যাক্ট করল। দিন শেষে মোবাইলের ব্যাটারি লো হয়ে গেছে, তাতেও যেন তেমন খারাপ লাগছে না সুমিতের আজ। বরং মনে মনে সে এখন নিজেই সেই অন্ধকার পথ, যে শীত আর শিশিরে ভিজছে। ট্রেনের কামরায় শীত থাকলেও শিশির নেই। কিন্তু তার যাপন যেন সে টের পাচ্ছে। আশ্চর্য ! মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহ, জাঁকিকে ঠাণ্ডা, সুমিতের অন্তর্গত তাপে সে যেন মামুলি। সে এখন দারুণ উষ্ণ।
বাঁ হাতটা ট্রেনের বাঙ্কারে, কাঁধে ঝোলা ব্যাগটা হালকা দোল খাচ্ছে। কান গলা মাফলারে পেঁচানো, একটু একটু ঘাম হচ্ছে যেন চোয়ালের নিচে। ডান হাতে ‘বহ্নিশিখা’ পত্রিকার শীত সংখ্যা, অমৃতা বলল তো,
“—- তোমার একটা লেখা আছে এতে, আমারও।
—- বাঃ ! প্রচ্ছদটা দারুণ তো !
—- মনে ছিল না তাই একটা কপি কিনেছিলাম
তুমি নিয়ে যাও।
—- কোথায় কোন পত্রিকায় লেখা বেরয়, খেয়াল রাখো না, পত্রিকা গুলো গুছিয়ে রেখো
—- গুছিয়ে ? হা হা হা
—- সব কিছুতে আড্ডা ?
—- না, এই দুপুর বেলায় কী গোছানো যাবে আর…
—- গল্পটা যদি দুপুর বেলাতেই শুরু হয়, তবে কি গুছিয়ে লিখবে না !
—- হুম “
ডান হাতটায় অমৃতার দেওয়া পত্রিকা ধরা। সুমিত ঝুঁকে থাকা চোখের সামনে পত্রিকাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবার দেখে। যেন এই মুহূর্তে এই পত্রিকাটাই অমৃতার মুখ। বইমেলার মাঠ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো টুকরো মেঘের মতো অন্ধকারে মিশে গেছে হাজার বইপ্রমী মানুষ। কাছে দূরে শহরে গ্রামে গর্তের মতো ঘরের দিকে। অমৃতার সদ্য ছোঁয়া পত্রিকাটাই এখন একরাশ আনন্দ। আর এই ডান হাতের উপর-তালুতে ,যেখানে বইমেলার ভিড়ের মাঝখানে কখন হঠাৎ করে চুমু খেয়েছিল অমৃতা, “তুমি যে এই হাতেই লেখো তাই”। পাশাপাশি এই দুই অমৃতা-স্পর্শে সুমিত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের মধ্যে অন্যতম। টানা আধঘণ্টা ট্রেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সে আছে স্বতন্ত্র সুখে। গায়ের মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবির উপর পাতলা পুরনো সোয়েটার ভেদ করে ঢুকছে তীব্র শৈত্য দাপট। সুমিত তবু অমৃত-উষ্ণতার সেই আবহ থেকে বেরোতে পারছেনা। বলার মতো কিছুই নেই তার কাছে, কিন্তু এই উষ্ণতাটুকু সোনার দানার মতো। মুহূর্তের ক্লান্ত অস্তিত্বে যেন জ্বল জ্বল করছে। আর সেই মূল্যবান আভায় মধ্য চল্লিশের ধ্বস্ত অখ্যাত কবি সুমিত বুকের মধ্যে অনুভব করছে সবুজ সবুজ গন্ধ।
পলাশপুরের ঘন শীতল অন্ধকারের পথে সুমিত যেন সেই সব গাছের একজন, যারা সূর্য থেকে তাপ নিয়ে জমিয়ে রাখে চিরকাল। যা আকাশের খোলা শামিয়ানার নিচে অনন্তকাল রাত্রির শীত শিশিরে সম্পূর্ণ মৃতের মতো শীতল করে দিতে পারে না।
নগ্ন ও নগন্য জীবনের কাঁথা কম্বলের হিসেব নিকেশ তো সুমিতের মুখস্থ। কিন্তু অমৃতা তার অন্তর্গত উত্তাপ। যার ওম তাকে এবারের বইমেলায় প্রথম কবিতার বই প্রকাশে একেবারে বাধ্য করে ছেড়েছিল। অখ্যাত পলাশপুরের সুমিত রায়ের কবিতা চর্চার ইতিহাস না হয় পরে জানব, কিন্তু ফেসবুকের দুনিয়া না এলে তার বর্তমানই বা ক’জন জানতো। পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখছে সে দুই দশকের বেশি। তবু আস্তো একটা কবিতার বই সুমিত ভাবতে সাহস করেনি কখনও। সোশাল মিডিয়া হারোনো অমৃতাকে অমৃতের মতো খুঁজে দিয়েছিল সুমিতকে, জীবনের মধ্যাহ্নে। আর সেই অমৃতার উদ্যোগে সুমিতের প্রথম কবিতার বই। বই মেলার লিটলম্যাগ টেবিল থেকে ছোটো ছোটো প্রকাশনার স্টলে অমৃতা সুমিতের হাত ধরে টেনে নিয়ে তার নতুন কবিতার বই কিছু কিছু করে রেখে এসেছে। বই এখন বিপনন, তার অ্যাপ্রোচ বদলেছে, অমৃতা বোঝে। কলেজে পড়ায়, শহরতলীর বর্ধিষ্ণু এলাকায় থাকে। লেখালিখিও তার আর এক অভ্যেস। অমৃতা জানে ক’জন লেখক বেঁচে খাকতে কতটুকু মর্যাদা পান। বড় বড় নৌকোয় পা রেখে কত লেখক অনায়াসে বেয়ে যাচ্ছেন।

সুমিত রায় অমৃতার প্রচ্ছন্ন অতীত, প্রকৃষ্ট বর্তমান। তার দৃঢ় প্রত্যয়— সুমিত এই সময়ের অন্যতম ভালো কবি। কিন্তু তার লেখা পড়েছে ক’জন, তাকে চিনেছে ক’জন। অথচ ভালো সৃজন কর্ম সভ্যতায় খোদিত না হলে, সেই বিস্মৃতি অভিশম্পাত করে যাবে যে। আর শুধুই সেই দায়বদ্ধতা নয়, আজ অমৃতার জীবন সুমিতের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। সেই ভালবাসা থেকে সুমিতের লেখা যখন ছাপা হয়ে মলাটবন্দি হলো, অমৃতার কী যেন সে এক আনন্দ। সে আনন্দ তো অন্যকে বোঝানোর নয়।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকার পর সুমিত বসার সুযোগ পেল। ট্রেনের ভিড় তখন বেশ ফাঁকা হয়ে এসেছে। সিটে বসা যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। ঘড়িতে দশটা বাজে। এমন রাতের লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা সুমিতের আকছার হয়। আজও তেমনই। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটা সিগারেট ফোকে। তিনটে কিনেছিল বিকেলে, একটা এখনও পাঞ্জাবির পকেটে আস্তো বাক্সে গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রসঙ্গ আসতেই আবার অমৃতার কথা মনে পড়ে সুমিতের । তার ফুক ফুক করে বিড়ি টানা আর ভক ভক করে গন্ধ ওগরানো অভ্যাসটা এই অমৃতাই একদিন বন্ধ করে দিয়েছিল। সে এক বছর আগের কথা। দেখা হতেই মুখ থেকে বিশ্রী বিড়ির গন্ধ পেয়ে এমন রিয়্যাক্ট করেছিল, যে সুমিত প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম।‌ পরে অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিল, “খুব ইচ্ছে করলে একটা সিগারেট, কিন্তু দিনে দুটোর বেশি না।” সংখ্যা মাত্রা যথাযথ পালন না করতে পারলেও খুব বেশি মাত্রা ছাড়ানোর ক্ষমতাও সুমিতের নেই। পলাশপুরের আনন্দ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের জীবন বিজ্ঞানের প্যারাটিচার সুমিত রায়ের পকেট অন্তত সিগারেটে বিলাসী টান সমর্থন করতে পারে না।

সিটে বসতে পেরে সুমিতের শরীরে ক্লান্ত বোধ প্রথম আসে। গোটা কতক হাই তুলতে তুলতে হঠাৎ মনে হলো অমৃতাকে একবার ফোন করা উচিৎ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুমিত দেখল– সামান্য একটু চার্জ অবশিষ্ট। ভাবল খুব সংক্ষেপ, দু’এক কথা। অমৃতার নম্বরে রিং করল।

” —- হ্যাঁ, আমি বেশ কিছুক্ষণ হলো পৌঁছেছি। তোমার কতদূর ?
ও হো ! এখনও এক ঘন্টার বেশি !
ও , হ্যাঁ শোনো একটা কথা ….
যা ! সুইচ অফ… ধুর… চার্জ গেছে নিশ্চিত “
হাউসকোটের পকেটে মোবাইল, কানে ইপি, মাইক্রোওয়েভ এর দরজা খুলে গরম করা খাবার বের করে টেবিলে রাখলো অমৃতা। এটা তার নিজের খাবার, পানিরের একটা পদ আর কিছুটা ভাত। অভীক রাতে কী খাবে— সে প্রশ্ন অবান্তর। সে একটু রাত বাড়লে ড্রইং এর নীল আলোটা জ্বেলে সামনের জানলার পর্দা সরিয়ে কাঁচের ভিতর দিয়ে দূরে এয়ারপোর্ট এর দিকে তাকিয়ে মাত্র দু’পেগ নেয়। এই একান্ত ব্যক্তিগত সময়ে এই বাড়ির বাকি দুই সদস্য— স্ত্রী অমৃতা এবং সদ্য চাকরিতে ঢোকা আই টি ইঞ্জিনিয়ার ছেলে অনিকেত ড্রইং রুমে সচেতন ভাবেই যায় না। অভীক চার্জড হওয়ার পর তার রাতের মেনু জানতে পারে অমৃতা। এবং সেই মতো কিছু একটা করে দেয় বা গরম করে দিতে হয়। বাইরে থেকে আনানো খাবারও ঘরে থাকে মাঝে মাঝে। অভিক অল্প খেলেও বাইরের রেডি খাবারে তার আগ্রহ একটু বেশি। অমৃতা অবশ্য ফ্রিজে সব রকম কমন উপকরণ রাখে। অনিকেতের নানা রকম খাবার বায়না আগে ছিল। এখন সেও বাবার পথ নিয়েছে। প্রায়ই সে নিজের মতো অর্ডার করে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নেয়। মাকে খাওয়াতেও চায়। অমৃতা অবশ্য সবসময় বাইরের খাবার পছন্দ করে না, তার গ্যাস অ্যাসিডের সমস্যা। আজকাল ডাক্তারের ডায়েট চার্টের বাইরে খুব একটা বেরয় না। মা জিজ্ঞেস করলে অনিকেত জানায়, সে সন্ধেবেলা এতো খেয়েছে, রাতে কিচ্ছু খাবে না। অমৃতা চেয়ার টেনে ডাইনিং এ বাঁ দিকে মোবাইলটা রেখে ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে খেতে শুরু করে। স্ক্রোল করতে করতে সুমিতের পোস্ট টা সামনে।
শিয়ালদহ স্টেশনের একটা প্রায় ফাঁকা প্লাটফর্ম, এতো ফাঁকা অমৃতা কখনও দেখেনি। রাতের বলেই হয়তো। হঠাৎ করেই ছবিটা দেখতে দেখতে অমৃতার মনটা কেমন একটা খারাপ লাগায় ভরে যায়। এ যেন সুমিতের মনের ছবি। কেমন একটা বিষাদের শূন্যতা বহুদূর পর্যন্ত ওর বুকের মধ্যে দেখা যায়। ও যখন কথা বলে তার বিচ্ছিন্ন ভাবখানা নানা ভাবে বেরিয়ে আসে। ক্যাপশনের কথা গুলো, হয়তো পুরোপুরি কোনো কবিতা নয়, তবু শব্দের সরণীতে বিষাদ বিষাদ ছায়া। অমৃতা ফেসবুক বন্ধ করে । সামনের খাবার তাড়াতাড়ি শেষ করে উঠতে যায়। একটা ফোন আসে। দুর্গাপুর থেকে শ্বশুর বাড়ির পক্ষে এক আত্মীয়ের ফোন। খেতে খেতে কথা বলতে বলতে, খাওয়া শেষ করেও অনেকক্ষণ সেই আত্মীয়ের সঙ্গে কথা চলতে থাকে। কলকাতার নামি হাসপাতালের এক ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট করে দিতে হবে। অমৃতা জানায় সব ব্যবস্থা করে জানাবে। ইতিমধ্যে অভীক ডাইনিং -এ আসে। ফ্রিজ থেকে চিকেন কারি বের করে গরম করে টেবিলে দেয় অমৃতা। কাছে এগিয়ে দেয় গরম রুটির ক্যাসেরোল । অভীক তার থেকে দুটো রুটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে। অমৃতা হাতে একটা জলের বোতল নিয়ে তার ছোট্ট বই-এর ঘরে চলে যায় । সেখানে এখন সে ঘন্টা খানেক থাকবে। হয় লিখবে, না হয় পড়বে অথবা একান্ত বই এর দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। আর পকেটে তো মোবাইল আছেই, রবীন্দ্রসঙ্গীত তার সবসময়ের সঙ্গী।
বই-এর ঘরে ঢুকে অমৃতা থপ করে বসে চেয়ারে । শরীরটা আজ যেন একটু বেশিই ক্লান্ত। রাতের খাবার নেবার পরে বেশ ভারি ভারি লাগছে শরীরটা। মনে মনে একবার ভেবে নেয়, ওজনটা বাড়ছে না তো ! কিন্তু সে তো বিরাট কনসাস, তাহলে ? না না এসব এমনি মনে হওয়া। ঠিক আছে শোবার আগে আয়নায় একবার নিজেকে ঘুরিয়ে দেখে নেবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে ঝুপ করে মাথায় এসে দাঁড়ায় আজকের বিকেল,সন্ধে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে চলে যায় মন, ” ইস্ সুমিতটা এতক্ষণে পৌঁছেছে কি পলাশপুর ? ” কৈশোরে যাকে প্রেমিক ভাবতে ইচ্ছে করেনি,সেই আজ মন জুড়ে। কী যে আশ্চর্য লাগে অমৃতার। সত্যিই জীবনের পরতে পরতে কত যে অজানা আবিষ্কার অপেক্ষা করে থাকে। সময়ের বাঁকে না পৌঁছলে সেই দূর দূর কালো দিগন্ত থেকে প্রাণের পরম বোধ জাগে না। একদিন পলাশপুরে যে অবহেলা অনায়াস ভাবে করতে পেরেছিল অমৃতা, আজ যেন অজান্তেই তার পায়শ্চিত্ত করিয়ে নিচ্ছেন ঈশ্বর। যদিও ভালবাসা কোনোদিন প্রায়শ্চিত্ত হাতে পারে না। হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে সুমিতের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল, সময়, অহং আর প্রচলিত পারিবারিক সামাজিক আবহ সেই সূক্ষ্ম শব্দ শুনতে পায় নি। বরং কৌতুহল আর অবহেলার মধ্যে দিয়ে অল্পবয়সী আনন্দ ঘটিয়ে দিয়েছিল সেদিনের ট্রাজেডি।
ধুর, এসব এখন ভাবতে ভাল্লাগছে না অমৃতার। বরং যে সুমিতকে গত দুই বছর আবিষ্কার করতে করতে অমৃতার নতুন জীবন ভাবনার প্রতিষ্ঠা ও তৃপ্তি, তাতেই তার দুঃখ, বেদনা, আনন্দাশ্রু একাকার হয়ে গেছে। আজকের অমৃতা বোঝে, মানুষকে কীভাবে চেনা যায়। বোঝে, জীবন আসলে কী চায়। ভাবে জীবন প্রকৃতই কী ও কেন।
সুমিতের জন্য এই মুহূর্তে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে অমৃতার মনে। ছেলেটা প্রতিভাবান অথচ যেন নিঃস্ব । মানুষের অবহেলা থেকে তার যেন মুক্তি নেই। আরও কিছুক্ষণ পরে সুদূর অন্ধকারের পলাশপুর স্টেশনে রাত বারোটা অতিক্রম করে শুনশান প্লাটফর্মে পা রাখবে সে। তারপর এক কিলোমিটার হেঁটেই তাকে ফিরতে হবে বাড়িতে। অমৃতা পলাশপুরকে খুব চেনে। রাত বারোটার পর সেখানে স্টেশন, রাস্তা চলে যায় ঘন অন্ধকারের দখলে। দূর শহরের বইমেলা, কবিতার বই আর ধুলোবালিছাই গায়ে মেখে ও কয়েকটি আপ্তবাক্য শুনে সে ফিরছে তার নিজস্ব অন্ধকারে। ক্লান্তির পাশে সেখানে শান্তির স্পর্শ বড় দরকার ছিল তার। অথচ সুমিত যেমন বলে,
” জানো অমৃতা, দুঃখে আহত হই ঠিকই তবু দুঃখই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি তাকে প্রিয় করেছি, কারণ সে আমাকে চাবুকে চাবুকে লেখায়, লিখিয়ে ছাড়ে।”
কথা গুলো মনে হতে অমৃতার বুক হঠাৎ খুব ভারি হয়ে ওঠে। টেবিল ওয়াচে চোখ পড়তে দেখে ঠিক বারোটা। অমৃতা ভাবে শরীরের রেস্ট দরকার। কাল সকালে কলেজ যেতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে যায় অমৃতা। ঠিক তক্ষুনি মোবাইল বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর। অমৃতা রিসিভ করতেই,
” —- আচ্ছা, ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’ বইয়ের কপি গুলো আমাদের অফবিটের স্টলে আপনিই রেখেগিয়েছিলেন ?
………”

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

4 thoughts on “ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্বিতীয় পৃথিবী – অনিরুদ্ধ সুব্রত

  1. শুরুটা বেশ । পুরোটা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

  2. শেষের লাইনগুলো আগ্রহ বাড়ালো পরবর্তী অধ্যায়টা একনিঃশ্বাসে পড়ার ।

  3. চমৎকার লেখা। সুন্দর এগিয়ে চলেছে । অনেক শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *