মুক্তগদ্যঃ শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচৈতন্যদেব – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচৈতন্যদেব – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

পূর্বতন গৌড়বঙ্গ তথা বাংলার শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যিনি সন্ন্যাস নেবার সময় নাম পান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য । তিনি শ্রীচৈতন্যদেব নামে সারা দেশে এমনকি প্রায় সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে আছেন।তিনি নাকি কোন এক সময় বলেছিলেন ” ভাগবতে মোর নাহিক অধিকার”। এই কথায় তিনি তাঁর বিনয় প্রকাশ করেছিলেন। এ কথা তিনি বিনয় প্রকাশ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রেই বলতে পারেন না, বলেনওনি। শ্রীমদ্ভাগবত তাঁর জীবনের প্রধান উপজীব্য ছিল। তাঁর চলনে বলনে সব সময় শ্রীমদ্ভাগবত যেন মূর্ত হয়ে উঠত। তাঁকে আর শ্রীমদ্ভাগবতকে বৈষ্ণব ভক্তরা, বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবজনেরা আলাদা চোখে দেখেন না। 
হরিনাম মহাযজ্ঞ পরিচালনা করে তিনি দীনদরিদ্র ধনী পণ্ডিত মূর্খ শূদ্র অন্ত্যজ কায়স্থ ব্রাহ্মণ সকলকেই এক ছাতার তলায় হরিনাম সংকীর্তনে আহ্বান করে এনেছিলেন অর্থাৎ জাতি বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষের মধ্যে একতার বীজ বপন করেছিলেন। 
শ্রীচৈতন্যদেব  চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কান্তকবি জয়দেব, রায় রামানন্দের রচনা, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য গ্রন্থ নিত্য আস্বাদন করতেন। শ্রীকৃষ্ণবিজয় শ্রীমদ্ভাগবতের দশম-একাদশ-দ্বাদশ স্কন্ধের  ও বিষ্ণু পুরাণের আর হরিবংশের অনুবাদ সহ রচিত হয়েছিল। এই শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্যের আরেক নাম গোবিন্দ মঙ্গল। এছাড়া, শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, তাঁর পক্ষে মূল শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ পাঠ করা আগেই সাঙ্গ হবার কথা। কাজেই শ্রীমদ্ভাগবতের মত সুললিত ছন্দে অমৃতসমান মূল্যবান গ্রন্থটির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার অন্ত না থাকাই স্বাভাবিক। 
শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর অধিকার নেই, বলার মধ্যে তাঁর বিনয় প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু একেবারেই ছিল না। সন্ন্যাস নেবার পর পুরীতে থাকাকালীন সময়ে অপরাহ্নে তিনি প্রায় প্রতিদিন  নিজ তৎকালীন বাসস্থান “গম্ভীরা” থেকে প্রায় দু কিলোমিটার পায়ে হেঁটে “টোটা গোপীনাথ” মন্দিরে যেতেন তাঁর প্রিয়তম সখা শ্রীগদাধর পণ্ডিতের মুখে শ্রীমদ্ভাগবতের অমৃত কথা শুনতে, মাঝে মাঝেই তিনি শ্রীকৃষ্ণ চিন্তনে শ্রীমতী রাধারাণীর গভীর প্রেমের অনুভবে কাঁদতে থাকতেন, অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে পড়তো সেই গ্রন্থের উপর। শ্রীগদাধর পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে অশ্রু বিসর্জন না করে থাকতে পারতেন না। দুইজনের অশ্রুতে গ্রন্থের পৃষ্ঠা গুলো ভিজে যেত। পরবর্তীতে অনেক ভক্ত সাধক সেই ভিজে যাওয়া শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থগুলির পৃষ্ঠাগুলি দর্শন করেছেন। মাঝে মাঝে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রতি প্রেমে আবিষ্ট হয়ে তাঁর শরীরে অশ্রু সহ অষ্টসাত্বিক লক্ষণ দেখা দিত।তিনি মূর্ছা যেতেন। এমনকি শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে গম্ভীরায় ফেরার পথে জঙ্গলের কাঁটা ঝোপের উপর পড়ে তাঁর সোনার বরণ শরীর ক্ষত বিক্ষত হোত। সঙ্গী গোবিন্দ, রামানন্দ একবার পুরীতে আসা শ্রীঅদ্বৈত প্রভুও তাঁকে তুলে ধরে গম্ভীরায় ফিরিয়ে আনতেন। কখনো তিনি পথের পাশে কূপের মধ্যেও পড়ে যেতেন। সঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গে তুলে আনতেন।
এছাড়াও,আমরা অনেকেই সেই বিখ্যাত তৈলচিত্রটি দেখে থাকব, যে নরেন্দ্র সরোবরের ধারে গাছের তলায় শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর গৌড়বঙ্গ থেকে আসা সঙ্গী শ্রীঅদ্বৈত, শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীশ্রীবাস, ব্রহ্ম হরিদাস ও অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে শ্রীগদাধর পণ্ডিতের সুমধুর কন্ঠের শ্রীমদ্ভাগবতের অমৃত রস আস্বাদন করছেন কথা আর কলিঙ্গরাজ প্রতাপ রুদ্র সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে আছেন। এটা তো ঘটনা। তা স্মরণীয় করতে ঐ  তৈলচিত্রটি তৈরী করিয়েছিলেন স্বয়ং রাজা প্রতাপ রুদ্র। তাই শ্রীচৈতন্য দেবের শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের প্রতি লালসা বা আসক্তির বর্ণনা করা  সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তিনি ভাগবতে তাঁর অধিকার নেই বলার মধ্যে লুকিয়ে আছে অন্য অন্তর্নিহিত মর্ম। সে মর্ম সাধক ভক্তরা বুঝতে পারেন। ভাগবত বোঝার জন্য ভক্তির প্রয়োজন। শুধু পাণ্ডিত্যের কাজ নয়। তখনকার বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেবানন্দ শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করতেন, তিনিও শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন –                             ” শুন দ্বিজ ভাগবতে এই বাখানিবা ।                  ভক্তি বিনা আর কিছু মুখে না আনিবা।।”                                                      (বৃন্দাবন দাস কৃত শ্রীচৈ ভা. অন্ত্য খ. অ.৩)
শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ তো ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্’। পূর্ববর্তী বেদসমূহ, উপনিষদ সমূহ, রামায়ণ, মহাভারত ও আরও বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ, অজস্র মুনিঋষি, রাজা ও রাজপরিবার, দেবতা -দেবী ও অসুরের কাহিনীতে সমৃদ্ধ এই শ্রীমদ্ভাগবত। দশম স্কন্ধে শ্রীকৃষ্ণের নানান লীলার সঙ্গে সেই ‘অনয়ারাধিতা শ্রীমতী রাধারাণী সহ অজস্র গোপরমণী গোপীসহ ভগবানের অনন্ত প্রেমলীলার গূঢ় রহস্য ভক্তি ছাড়া উপলব্ধ হবার নয়। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের অপার্থিব চিরন্তন লীলার গূঢ় রহস্য সকলের বোধগম্য হবার নয়। দেবানন্দ পণ্ডিতকে বোঝাতে চেয়ে বলেছেন –                       ” ভাগবত বুঝে হেন যার আছে জ্ঞান।                          সেই না জানয়ে ভাগবতের প্রমাণ ।।”                                                                                 (ঐ)
আপনাদের হয়তো মনে আছে, এই বরানগরে।। গঙ্গার ধারে পাঁচশ বছর আগে শ্রীগদাধর পণ্ডিতের কাছে দীক্ষিত  রঘুনাথ উপাধ্যায় সাধন ভজন নিয়ে থাকতেন। শ্রীচৈতন্যদেব এক যাত্রায় নৌকায় শান্তিপুর থেকে খড়দহ পানিহাটী রাঘব পণ্ডিত আলয় হয়ে বরানগরে রঘুনাথের কাছে এক রাত্রি, সারারাত্র ভাগবত পাঠে ও সঙ্কীর্তনে অতিবাহিত করেন। রঘুনাথ উপাধ্যায়ের ভক্তিসহ সুললিত  কন্ঠে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি তাঁকে ” ভাগবতাচার্য ” উপাধিতে বিভূষিত করেন আর বলেন –                   “এতেকে তোমার নাম ভাগবতাচার্য।                   ইহা বিনা আর কোন না করিহ কার্য।।”              (বৃন্দাবন দাস কৃত শ্রীচৈতন্য ভাগবত অন্ত্য ৫ অধ্যায়)তিনি বলতেন – –              “অতএব গোপীভাব করি অঙ্গীকার।                  রাত্রিদিনে চিত্তে রাধাকৃষ্ণের বিহার।।”         (কৃষ্ণদাস কবিরাজ কৃত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মধ্য ৮ পরিচ্ছেদ)
শ্রীচৈতন্যদেবের মধ্যে ছিল অফুরন্ত প্রেম যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্য তেমনই তাঁর সৃষ্ট জগতের সবার জন্য। তাই শ্রোতাদের ভক্তদের আনন্দ দিতে পাণ্ডিত্যের বিপরীতে অগাধ বিনয় প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেন না। তাঁর এই বিনয় প্রকাশ বারবার লক্ষ্য করা গেছে। সেসব বিবরণ অন্যত্র দেয়া যাবে। 
জয় গৌর। জয় গৌরগদাধর।।

One thought on “মুক্তগদ্যঃ শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচৈতন্যদেব – রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী

  1. আরেকটি সংযোজন পরে দিয়েছি। সেটা সম্পাদক পরের বার দিতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *