মুক্তগদ্যঃ কবিতার বিষয়ে দু চারটে কথা ২ – অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

কবিতার বিষয়ে দু চারটে কথা ২
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

“Nainam chindanti śastrāNi nainam dahati pāvakah.

na cainam kledayantyāpo na śoshayati mārutah…”

The so described Aatman cannot be harmed by weapons – and since it is formless and shapeless – it cannot be cut into pieces by any instrument. In the same way, fire cannot burn it or destroy it. Water cannot wet it because water can only act on elements which have a physical description or dimension. For the same reason, wind cannot dry it or exert any force on it. Thus the Aatman is beyond the influence of all the three primary forces (fire, water and wind) which can affect entities having physical form and description.

কথোপনিষদ কে মেনে যদি এগিয়ে যাই তাহলে এক ধারনার জন্ম হবে, যাকে আমরা বলি মনন। অসীম এর ভেদ শক্তি। অগ্নির চেয়েও তীব্র, জলের চেয়েও শান্ত, শীতল ও গভীর, বায়ুর চেয়ে ও গতিশীল। এই মননই এক অনন্য বোধের জন্ম দেয় যা এই ইহ জগতের চিন্তার থেকে অনেক দূরে। মানে দেবলোক, ইন্দ্রলোক, বিষ্ণুলোক ইত্যাদি এও মানুষের মনন সৃষ্ট আবার কেপলার ২৬কে যেহেতু পৃথিবীর মতো হতে পারে বলে নাসার যে বিজ্ঞানী বলছেন বা সেই কল্প-পৃথিবী সম্পর্কে যে ছবিটা আমাদের সামনে তুলে ধরছেন তার বাস্তব রূপ তেমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। আর এখানেই মনের অস্তিত্ব। কবিতায় ও এই মনের বা মননের রূপ ও অরূপের মধ্যে মিশে থাকা বারংবার দেখা গেছে বিভিন্ন কবির কবিতায়।  এবার সেই কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টাকে একটু বুঝতে সুবিধের জন্য কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “জরাসন্ধ” কবিতাতাকে যদি দেখি, “আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখিনা পা দেখিনা / তখন তোর জোরায় ভর করে এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলি?” এই যে “কোথায় নিয়ে এলি” এটা হচ্ছে সেই খোঁজ। সেই আত্মার, সেই মননের যা আমাদের এই পার্থিব জগত বা ইহ জগতের বাইরে। একজন কবি তার শব্দবন্ধের চয়নে সেই অপার্থিব কে জগত সংসারের মানুষের কাছে পার্থিব  করে তোলেন। হয়তো পরিষ্কার করে না হলেও তবু বেশ খানিকটা তাকে চিহ্নিত করতে পারছে। হতো কবির মতো নয়, কিন্তু তবু বলবো পারছে। যথার্থ কবিতা এই শুদ্ধ আত্ম চিন্তন আমাদের সামনে তুলে ধরে তার নিজস্ব আঙ্গিকে। ফলে চিন্তা, অর্থাৎ যার শেষ নেই। যে শাশ্বত তার ক্ষয় নেই। সে শাশ্বত তার রূপের বদল ঘটে মাত্র। সে নির্জরা (শ্রুতি মাধুর্যের জন্য, আকার দিয়ে স্ত্রী লিঙ্গে রূপ দেওয়া হল), যা মৃত্যুর উর্ধ্বে অর্থাৎ মৃত্যুও যেখানে পৌছতে পারেনা।  মানে মৃত্যু হল জীবনের বা মানব জন্মের জীবিত অবস্থার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, এটা বাস্তবিক কারণ মানুষ স্বচ্ছ ভাবে এতদূর পর্যন্ত দেখতে পায়।  অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের দৃষ্টি বা বোধ যেতে পারে।  একমাত্র মন এই বাস্তবিক দর্শনকে ছাপিয়ে যেতে পারে অসীম পর্যন্ত। ওই যে বললাম  ‘কেপলার ২৬কে’ তাকে পর্যন্ত কল্পরূপ দিচ্ছে এই পৃথিবীতে বসে।  তাই বলতেই পারা যায় যে হয়তো বা একমাত্র কবি মনই পারে মানুষকে বা পাঠককে অসীমের দর্শন ঘটাতে জরাকে অতিক্রম অর্থাৎ মৃত্যু কে অতিক্রম করে।

“Avyakto.ayamacintyo.ayamavikāryo.ayamucyate.

tasmadevam viditvainam nānuśocitumaharsi…”

The Aatma cannot be known or understood by purely using the brain and its mental powers. Hence it is known as ‘avyakta’ or indescribable – that which defies description. It cannot be known purely by meditating or thinking upon it (’chintan’) – hence it is known as ‘achintya’, that is beyond ’chintan’.

এই চিন্তনের ভেদ শক্তি প্রবল আর তাকেই কথোপনিষদ বলছে অচিন্ত্য। পৃথিবীর কোন কিছুই “অচিন্ত্য” এর পরিমাপ দিতে পারবেনা, রূপের বর্ণনা দিতে পারবে না। এর আকার আকৃতির কোন ব্যাক্ষাও দিতে পারবে না। ফলে মনন এবং অচিন্ত্য এই দুইই তো কবিতার মূলে। ফলে কবিতার চিরন্তনের ভেদ শক্তি প্রবল সেই সঙ্গে কবিতা শাশ্বতও বটে, যার ভেদ শক্তি প্রবল। আর এই যে পথে আমরা এগিয়ে চলেছি এর কোথা থেকে শুরু আর কোথায়ই বা শেষ এই একটা প্রশ্নের উত্তর আজও সকলেই খুঁজে যাচ্ছে প্রত্যেকের মতো করে, তা তিনি সে যে মাধ্যমকেই অবলম্বন করুন না কেন। কবিতা যেহেতু ফাইন আর্ট এর বিষয় আর এখানে যেহেতু কবিতা নিয়ে বলতে বসেছি তাই ফাইন আর্টই আমার বক্তব্যের মুল বিষয়। (বহুচর্চিত ও বহুশ্রুত বৈদিক শ্লোক) আলো থেকে অন্ধকার আবার অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রাই হল কর্ম অতিক্রম করে মোক্ষের পথে যাত্রা। একই সঙ্গে আবার বলা যেতে পারে এই যাত্রাকে দার্শনিক দিক থেকে দেখলে তা হল জন্ম থকে মৃত্যু বা মৃত্যু থেকে জন্মকে অতিক্রম করার যাত্রা। ভারতের দর্শনশাস্ত্রকে যদি অবলম্বন করি তাহলে বলতেই হবে যে এই যাত্রা অনন্ত, এর শুরু বা শেষ কেউ জানে না (যা জন্মান্তরবাদের জন্ম দেয়)। এই দর্শনকে যদি সত্য ও শাশ্বত বলে মানি তাহলে জন্ম হল আলোক বা উচ্ছলতা, আর মৃত্যু হল অন্ধকার বা বিষাদ। এই ভাবনাটা ভারতীয় বৈদিক ঋষিদের মনে হয় সবার কাছেই কম বেশি প্রায় একই রকম। অসংখ্য কোটি কোটি শব্দ ব্যবহৃত করা হয়েছে এই এই অনঙ্গকে অঙ্গ দানের আশায়, এই অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টায়। মানুষ তার সকল ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তার স্বরূপকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার অনুধাবন করা রূপটাকে যথার্থ ভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। জানিনা পারা সম্ভব কিনা – ওই যে আমরা বলে থাকি শিল্পীর মন বা শিল্পী মন সর্বদাই অতৃপ্ত, অর্থাৎ একজন শিল্পী অনুভব করতে পারেন কিন্তু সেই অনুভূতিকে পূর্ণ রূপ দিতে পারছেন না। একটু বিষয়টাকে যদি অন্য ভাবে দেখি, আমার এই জাগতিক অবস্থার পূর্বাবস্থা কেমন ছিল? তাকে হয়তো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ছুঁতে পারা যায় কিন্তু সঠিক রূপদানের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্নচিহ্ন অবশ্যই তৈরি করে। তাহলে বলা যেতেই পারে আমরা সকলেই যে পথের মধ্যে দিয়ে চলেছি তার কিছুটা অংশ আমাদের কাছে দৃশ্যত আর বিস্তীর্ণ অংশ অ-দেখা বা দৃশ্যত নয়। ভারতীয় দর্শন যাকে পূর্বজন্ম আর পরজন্ম বলে চিহ্নিত করেছে। আমরা ওই যে বলে থাকি একজন কবি বা শিল্পী সাধারণের চেয়ে কয়েক যুগ এগিয়ে দেখেন বা থাকেন, মনে হয় এই ভাবনাটার ফসলই হল এই কথাটা। একজন কবি এবং তার কবিতা হয়তোবা এই জায়গাতেই একজন দার্শনিককে বা আর দর্শন-লব্ধ জ্ঞানকে অতিক্রম করে যান এবং এক অনন্ত অজ্ঞানের দৃশ্যমান্যতার দিকে ধাবিত হয়। যদি এই ধারনাকে বিশ্বাস বা অবলম্বন করি তা হলে অবশ্যই বলা যাবে যে পূর্বের এক কালখণ্ডকে অতিক্রম করে আমারা মাতৃ-গর্ভে জন্ম নিই। ওই কালখণ্ড হল প্রায় দৃশ্যত বা হয়তো অনুভব যোগ্য। তারপর এই যে প্রায় দশমাস কাল সেই প্রাণ বা সেই স্পন্দন একটা পথ অতিক্রম করে জাত হয় মাতৃগর্ভ হতে যাকে আমরা সাদা চোখে জন্ম বলে থাকি। যদি ধরেই নিই মাতৃগর্ভ ওই কালখণ্ডের একটা আধার তাহলে এই পরিক্রমা পথটি মাতৃগর্ভের আগেই শুরু হয়েছে যা আমাদের কাছে প্রায় দৃশ্যত বা অনুভব যোগ্য। মাতৃগর্ভ হতে সেই প্রাণ বা স্পন্দন ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলে মৃত্যুর দিকে। তারপর মৃত্যু। মাতৃগর্ভে প্রবেশের বা কালখণ্ডের আধারে প্রবেশের আগের যে পথটা সেটা ফিকে হলেও প্রায় দৃশ্যত বা অনুভব যোগ্য বলে যেমন মনে হয়, ঠিক তেমনই মৃত্যু পরবর্তী পথও প্রায় দৃশ্যত বা অনুভব যোগ্য। ফলে এই পথ দৃশ্য অর্থাৎ এই পথটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সে স্বচ্ছ হোক বা ফিকে। এটা বস্তুগত তাই আমরা এই পথটাকে দেখতে পাচ্ছি বা আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূত হয়। দর্শন ও জ্ঞান এর সাহায্যে আমারা এতদুর অবধি দেখতে পাই। এর পর হতে যা দেখি বা দেখতে পাই তাহা কবিতা। কবিতার বাহ্য দর্শন এবং অন্তর দর্শন দুই বিরাজমান আর এই দুয়ের ভারসাম্য সেই শিল্পী বা কবিতা লেখক।  

এতক্ষণ এই যে ভ্যান ভ্যান করে গেলাম এটা হচ্ছে এবার যে বিষয়ে কথা বলবো তার ভূমিকা। এই কথা গুলো না বললে কবিতা আমার কাছে ঠিক কি সেটা হয়তো বোঝানো কঠিন হয়ে পড়তো। এমনিতেই কবিতাকে সঠিক ভাবে বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন কাজ কারণ কবিতা এমন একটা অনুভূতি যাকে বর্ণনা করা বা চিত্রিত করতে যাওয়াটাই একটা কবিতা। তবু একটা প্রয়াসের লক্ষে এই লিখতে বসা এবং সম্পূর্ণ আমার মতো করেই এই ভাবনা। জানিনা এই পথে কবিতা দেখার প্রয়াস সঠিক কি না। প্রত্যেকেরই দেখার আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং প্রত্যেকেরই অন্তর-দর্শন অন্যের থেকে আলাদা, ওই “ যত মত তত পথ” এর মতো। আমার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ অনেক বড় বড় নক্ষত্রেরা কবিতা বিষয়ে তাঁদের মত প্রকাশ করে গেছেন তাঁদের মতো করে। এই লেখার অর্থ আমি তাঁদের কোন ভাবেই ভুল প্রমান করেতে বসিনি। আমি শুধু আর একটা দিক/পথ কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। যদি আমি ধরে নিই আমাদের দৃশ্যরূপ মৃত্যু-জন্ম-মৃত্যু অর্থাৎ মৃত্যু থেকে জন্ম, জন্ম থেকে মৃত্যু। এটা যদি একটা পরিক্রমা পথ হয়ে থাকে বা প্রথম মৃত্যুর আগে যে পথ দেখা যায় এবং এই শেষ মৃত্যুর পর জন্ম, এই এতো দূর পথ অবধি যদি দৃশ্যত হয় তাহলে কবিতা হল এই দুই দিকের দুই দৃশ্যমান বিষয়কে বা অবস্থানকে অতিক্রম করে দেখা। আর একজন কবি ওই অনঙ্গ ও অদৃশ্য কে পাঠকের চোখের সামনে চিত্রিত করেন বা আঁকেন, “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে……”। একজন কবি মনে হয় এই দেখাটাকেই অতিক্রম করেন। কখনো কখনো মনে হয়, হয়তো বা sub conscious mind state বা  Unconscious mind state থেকেই কবিতার জন্ম হয়। যাবতীয় চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে উঠতে বোধহয় একমাত্র একজন কবিই পারেন। তাই হয়তো মৃত্যুর শমন মাথায় নিয়ে যখন মৃত্যুর যন্ত্রণাকে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে করতেও যিনি লেখান – যখন দু হাতে তোমার তারা (নক্ষত্রিক আলো বিশিষ্ট মহাজাগতিক বস্তু) ভরা মুখ তুলে ধরি বা এটাও বলা যেতে পারে যখন দু হাতে তোমার নক্ষত্রখচিত মুখ তুলে ধরি – তখন কি বলবো কবি তাঁর দেখার উর্ধ্বে বা এই ইহ জাগতিক দেখাকে অতিক্রম করতে পারেননি! প্রেমের এই অনন্ত যাত্রা। কবি দেখালেন যে এই সাধারণ ইহ জাগতিক প্রেম কি অমোঘ ছোঁওয়ায় মহাজাগতিক প্রেমে পরিণত হল যা শাশ্বত চিরন্তন। তিনি কি একটা স্টেশান পার করে আর একটা স্টেশান কে আমাদের চোখের সামনে ফুটিয়ে তুললেন না? আমি ধরে ধরে কবিদের নাম বলে এই দৃশ্যপট দেখাতে চাইলে এই লেখা আর শেষ হবে না। ফলে উদাহরণ দিতে আর চাইনা, কিন্তু ইহা সত্য যিনিই মহৎ কবি, যিনি সাধক কবি বা ধ্যানী কবি তিনি এই কাজটাই করেন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে। আর এই মহাবিস্ময়ের জগতের তো কোন শেষ নেই, তিনি অনঙ্গ তাঁর ব্যাখ্যাও নেই। তাই কবির লেখাও থামেনা। সে এক বিস্ময় থেকে আর এক বিস্ময়ের পর্দাকে ভেদ করতে চান। তিনি এক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আর এক বিস্ময়ের ঘোরে আবিষ্ট হতে চান। এটাই তাঁর অর্থাৎ একজন কবির পার্থিব চাহিদা। এই যে দেখার ব্যাপ্তি এটাই তো একজন কবি পাঠককে দেখান। সাধারণ পার্থিব বিষয়কেও এক অনন্য মাত্রায় উন্নীত করে তাঁর দর্শন ও বোধের মধ্যে দিয়ে। “ ওই ঘরে সজল থাকতো, সজলের বউ আর মেয়েটিও থাকতো। ওঁরা আজ ধানকল পার হয়ে চলে গেছে ……” এই যে পার হয়ে যাওয়া এটা কি পার্থিব পারাপার বা পার হয়ে যাওয়া? না অন্য এক বিস্ময়ের জগতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তারপর যখন লেখেন, “ তুমি তোমার ব্যক্তিগত বসন্ত দিনের চটি হারিয়েছ বাদাম পাহাড়ে/ আমি আমার ব্যক্তিগত লিখন ভঙ্গিমা হারালাম ……” কি হারালেন কবি উৎপল বসু? কোথায় হারালেন? হারানোর জায়গাটা কি আমরা সত্যি দেখতে পাই? এমন কি চোখ বন্ধ করে ও কি দেখতে পাই? না পাইনা বোধহয়। শুধু অনুভব করি এমন জায়গা হয়তো আছে। কবির সঙ্গে চলে যেতে চাই সেই বাদাম পাহাড়ে। কিংবা কবি যখন লেখেন “ শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকবো”। এই সময়টার ব্যাপ্তি কতোটা? এই সময়টা কি শুধুই তিন মাস? নাকি এই তিন মাস অন্য একটা কালখণ্ড যাকে কবিই এক মাত্র তাঁর মানস চক্ষে উপলব্ধি করেছেন। আমরা শুধু একটা স্টেশানকে দেখার চেষ্টা করলাম মাত্র। হয়তো বা পুরোটা পারলাম না। তবু যেন কিছু দূর তো দেখতে পেলাম। এই দৃশ্যের অন্তরকে খুলে দেওয়াই একজন কবির কাজ বলে আমার মনে হয়।  তবে যারা এই ভাবে দেখেন না তাঁরা বা তাঁদের লেখা কি সেই মার্গ স্পর্শ করতে পারল না তাহলে? কেন পারবে না, নিশ্চয়ই পারে। শ্রমিকের রক্তদিয়ে লেখা ইতিহাসও তো শাশ্বত বার্তা দিতে পারে। বাস্তবিক এই বস্তুজগতের ভিতরেই আর এক অনন্ত বিস্তৃত বস্তু জগত আছে। যে জগতে আমাদের এই রোজকার সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়ার কথা, তার অনুভূতি পট চিত্রের মতো আঁকা আছে। এই পৃথিবী বারবার রক্তাক্ত হয়েছে, একজাতি অন্য জাতির দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে তার যন্ত্রণার অনুভব এমন একটা স্তরে লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যা জীবন দর্শনকে এক অন্য মার্গে পৌছে দিয়েছে। কত যন্ত্রণা থাকলে একজন সাধারণ ঘরের সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মহিলা বা পুরুষ বন্দুক হাতে তুলে নেয়, হত্যা করে, কাকে হত্যা করে? এই বোধে যখন সে উন্নিত হয় তখন সেই চাঁচাছোলা বস্তু জীবনের কথা এক অনন্য মাত্রা যোগ করে চেতনার জগতে। ফলত এই লেখা, বলা ভালো কবিতা গুলোও কি বোধের জগতে এক অন্য মার্গ দর্শনকে আঙুল দিয়ে দেখালো না? বা মার্গ দর্শনে উন্নিত করল না? -স্বচক্ষে নিজের সন্তানকে বুলেটে ঝাঁঝরা হতে দেখা কুর্দিশ মায়ের হাত থেকে যে লেখা বেরিয়ে এসেছে তার দার্শনিক ভূমি হয়তো নেই কিন্তু জন্ম মৃত্যুর অতীত কোন এক স্তরে নিয়ে যাওয়া কবিতা। দুর্ভিক্ষ কবলিত লাতিন আমেরিকাতেও সেই সময়ে এমন অনেক লেখাপত্র পাওয়া যায়। একমাত্র স্প্যানিশ ছাড়া সব কবিতাই আমি ইংরাজি অনুবাদ পড়েছি। তবে যে সমস্ত ভালো লেখা যা আমার হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে তার প্রত্যেকটাতেই মনে হয়েছে লেখক তার লেখাকে কাল উত্তীর্ণ করতে পেরেছেন, মনে হয়েছে লেখাগুলো শাশ্বত এক অনন্তের পথে যাত্রা আছে লেখাগুলোতে। মানে কবিতাগুলো এতোটাই শক্তিশালী যে বোধ অনুভূতির সমস্ত স্তর কে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হয়েছে অনায়াসে। আমাদের অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষের যেহেতু একটা দেখা নিজেদের মতো করে রয়ে গেছে, মানে ওই আধপূর্ণ গ্লাসের মতো কেউ বলবেন অর্ধেক পূর্ণ কেউ বলবেন অর্ধেক খালি, কিন্তু কোন একটা কবিতা সেই দেখাটাকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হয় তখন সেই লেখা আমার কাছে প্রকৃত অর্থে কবিতা বলেই বিবেচিত। এই লেখাগুলোর মধ্যে এক নিমজ্জিত আত্ম-দর্শন নিহিত থাকে যা ওই দেখতে পাওয়া শেষ স্টেশানটাকে অতিক্রম করে যায় অথচ আমি তাকে ছুঁয়েও ছুঁতে পারলাম না। যা এক বোধ কে অতিক্রম করে অন্য এক বোধের জন্ম দিলো বা আমাকে উন্নিত করল অন্য এক বোধের জগতে।  এই যে দর্শনকে অতিক্রম করা এটাই কবিতা, শাশ্বত কবিতা। যা পাঠ করলে জ্ঞান আলোক প্রাপ্ত হয়, চেতনা বিশুদ্ধ হয় নিজের মধ্যেই একটা ঘোর কাজ করে অর্থাৎ এক আত্মমগ্নতায় ডুবে যাওয়া থাকে।  কবিতা আমাকে কাছে ওই দেখার বা স্টেশন পেরিয়ে যাওয়া বা উত্তরণ।  

4 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ কবিতার বিষয়ে দু চারটে কথা ২ – অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

  1. ভীষণ ভাল লাগল আপনার ভাবনা-চিন্তা। ঋদ্ধ হলাম… 🙏🌼🙂

    1. অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। ভালো থাকুন আনন্দে থাকুন

  2. অত্যন্ত মূল্যবান লেখা। কবি কে তাই কবির মনীষী বলা হয়। বৈদিক যুগে শ্রুতি গুলো কে দেখতে পেতেন কবিরা।

  3. ভীষণ গভীর ও বিশ্লেষণ মূলক একটা গদ্য যা পাঠে মন ও মনন সমৃদ্ধ হয়। কবি কে ধন্যবাদ আমাদের এমন গদ্য উপহার দেওয়ার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *