মুক্তগদ্যঃ ও চাঁদ – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না ( সোনারপুর)

ও চাঁদ
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

আমার এক নিজস্ব চাঁদ আছে। হয়তো সকলের আছে। বিশেষ করে কবি লেখক আর চিত্রশিল্পীদের চাঁদ অনেকটাই ব্যক্তিগত। একেবারে আপনার। যার সাথে সুখে দু:খে পুলকে শোকে কথা বলা যায়। কবিতায় গানে ছবিতে আগে সে নিজের হয়ে আসে। তারপর চন্দ্রালোকিত সেই নিজস্ব পরিসরে অন্যের চোখ পড়ে তাও যদি মন চায় তবেই তাকে দেখা যায়। খানিকটা যোগগ হয়। পাঠক শ্রোতা দর্শকও হাতে এক চাঁদ পায় যা একই সঙ্গে ব্যক্তির আবার বহুজনের।
কবেকার ফেলে আসা বাল্যকালে তার কত রূপ ছিল। দিগন্ত ছোঁয়া মাঠের ঢাল থেকে কখনো উঠে আসতো সে গায়ে ফিনফিনে ঘিয়ে রঙের উত্তরীয়। দূরে দূরে ছায়া ছায়া গাছ। মনে হতো কী যেন ঘোষণা করবে সে মন্দ্র স্বরে। আবার কখনো সে তালসারি ঘেরা পুকুরের চারপাশে এক রহস্য বুনে দিত। নিরীহ কলাপাতাকেও করে তুলতো অশরীরী। তখন সারা সন্ধে মন ছমছম,গা শির শির। কিশোরীর পূর্ণ চাঁদ ছিল গান ওয়ালা। দোল পূর্ণিমা আর বৈশাখী পূর্ণিমায় সে আসতো সাজ গোজ করে, ঝিরিঝিরি বাতাসের সঙ্গে। অমনি মন বলতো “এ শুধু গানের দিন”। তারপরের সময় গুলোতে সে আসতো একলা ছাদের আলসেতে। মনের ভার বাড়ত। তারপর এক সময় উড়ন্ত মেঘের আড়ালে আড়ালে ভাসতে ভাসতে চলে যেত। সেই সব উদাস চাঁদের সাথে মাঝে দেখা হয়ে যায়। তখন ভেতর ঘরে হুহু করে ওঠে অকরুণ হাওয়া। জানলার কপাট দড়াম করে ওঠে। দেয়াল থেকে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়,”তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে”…
তাই বলে কি একটুও ফুর্তি হয় না? এই তো কটা বছর আগে বাঁকুড়ায় বনের পথে আমাদের কবিদের ছোট্ট দলটা পড়ে গেল
ধৃতি না কি শশিনীর সামনে। কথা বলত বলতে খেয়ালই করিনি। আমার চাঁদ অর্ধ নারীশ্বর। তাই কলা নামে নারী আর পূর্ন পরিচয়ে চন্দ্র অথবা সন্ধ্যাকর। তা সেই হাল্কা আলোয় মোরাম পথে তার হাত ধরে চললাম খানিক। কেউ দেখতে পেল না শুধু সে আর আমি জানলাম। দূরে মাঠে কে যেন ক্ল্যারিনেট বাজাচ্ছিল। সবার মাঝে এক গোপন সম্পর্কের ছোঁয়া। আর একবার “ভাল পাহাড়ে” সোনাঝুরি ঘেরা সেই বিশাল বিপুল মাঠে একদল রসিক সুজন নাচল গাইল কল কল করে কত কথা হল। হিরণদা (হিরণ মিত্র),তপনদা (তপনকর ভট্টাচার্য), শ্যামল ( শ্যামল গায়েন), নমিতাদি ( নমিতা চৌধুরী), শুভেন্দুদা( শুভেন্দু দাশগুপ্ত) ,জগন্নাথ প্রবীর, ব্ল্যাঙ্ক ভার্স,বন ফায়ার, ধামসা, খোল, দোতারা আর চাঁদ। সে দিন সে বিশ্বদাতা। সর্বজনীন। আরও যারা ছিল তাদের নাম না বললেও সবাই সেদিন চাঁদে পাওয়া।
এখন মন হলো তো নিয়নের পাশে পরিণত চাঁদের ছবি তুলি। নিঝুম রাতে চাঁদের নরম দাক্ষিণ্য শয্যায় বিছিয়ে থাকে। ক্লান্ত মাথাটা বালিশে রেখে জানলার ওপারে স্মিত হেসে আশ্বাস পাঠায়। তাকে দেখতে দেখতে ঘুম নেমে আসে।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ ও চাঁদ – ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না ( সোনারপুর)

  1. একদম অন্য ধরণের লেখা। শুরুটাতে মনে হয়েছিল মনোলোগ ধর্মী লেখা, লেখা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগলো না এটা গল্প ধর্মী লেখা আরো এগোতেই মনে হল দুটোর টুইস্ট আছে লেখাটায়। অসাধারণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *