জেদ
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
ন্যাশনাল লাইব্রেরী থেকে বের হতে আজ একটু দেরিই হল অভীকের।এই সোমবারের সন্ধ্যাটাই
ওর নিজের কলসী ভর্তি করার সময়। বাবা বলতেন, কিছু দিতে গেলে আগে নিজের কলস পূর্ণ করতে হয়।বিদেশী পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত নতুন নতুন খবর পড়তে আসে অভীক। সারা বিশ্বে কোথায় কি নতুন কাজ হচ্ছে তার খবর ওকে রাখতেই হয়।অন্যদিনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজের চাপ থাকে খুব।তার ওপর বর্তমানে পাঁচজন ছাত্র- ছাত্রীর গবেষণায় পথ প্রদর্শক । নিজের জন্য কিছু করারই সময় হয়ে ওঠে না ওর।
ষ্টেশনে নেমেই একটা জটলা দেখে এগিয়ে গেল ও।উৎসুক মন পরিচিত কয়েকটা মুখকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল,চোর ধরা পড়েছে।তাই মারধর চলছে। জটলা সরিয়ে একটু সামনে এগোতেই দেখল চৌধুরীদের জিমকরা পেশীবহুল চেহারার পিন্টু একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলেকে প্রচন্ড মারছে।ছেলেটার জামাটা ছিঁড়ে গেছে। ভয়ার্ত চোখ।হাত জোড় করে কান্নাভেজা গলায় ছেড়ে দেওয়ার আকুতি ওর। উপস্থিত জটলার সকলে অতি উৎসাহী হয়ে মনোযোগ সহকারে যেন সার্কাস দেখে চলেছে। অভীকের খুব মায়া হল। এভাবে মারলে তো মরে যাবে ছেলেটা! অভীক চিৎকার করে উঠতেই জটলা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করল। পিন্টুর উদ্ধত চাহনি আরো মারতে চায় বোঝা গেল।আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সে নিজেই আইনের চোখে অপরাধী হয়ে যাবে,কথাটা বলতেই সে ও ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। অভীক ছেলেটাকে তুলে বসালো সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে। একটু জল ছেলেটার মুখে চোখে দিল। সারা মুখে লাল লাল দাগ মারের। একগ্লাস গরম দুধ ও একটা পাউরুটি খাবার পর ছেলেটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকলো।এক কাপ চা নিয়ে অভীক ওর পাশে বসল। অভীকের জিজ্ঞাসার উত্তরে ছেলেটা বলে গেল কালকের আম চুরির ইতিহাস।
চৌধুরীদের বাগানে হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমের কয়েকটা গাছে প্রচুর পাকা আম ঝুলছে দেখে কয়েকজন বন্ধু মিলে পাঁচিল টপকে আমচোর হওয়া। হঠাৎ বাগানে ঐ ষন্ডামার্কা ছেলেটা হাজির। ওরা তখন দে দৌড়।আজ মাঠ থেকে ফুটবল খেলে ষ্টেশনের পাশ দিয়ে কলোনিতে ফেরার সময় ধরে ফেলে কালকের ঐ পিন্টু।বাকি বন্ধুরা পালায়। শেষের দিকে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।এ কান্না অভীকের চেনা।যতো না কষ্ট ,তার থেকে বেশি অসম্মানের সংলাপ এ কান্নায়। আস্তে আস্তে ছেলেটার মুখটা বদলে যেন অভীকের নিজের ছেলেবেলার মুখ হয়ে যাচ্ছে।সেই ছেলেবেলা আগলে দাঁড়িয়ে আছে ওর মা। সেদিন ও তো এমন ঘটনাই ছিল।
অভীক তখন সপ্তম শ্রেণীতে। স্কুল থেকে ফেরার পথে পালেদের বাগানে ‘লিচুচোর’ হওয়া। সেদিনও তাড়া খেয়ে ওদের ছুট ছুট। সন্ধ্যায় খেলে বাড়ি ফিরলে দেখল স্বয়ং পালকাকু বাড়িতে হাজির ।লিচু চুরির কথা বলতে বলতে মাকে খুব অপমান করছিল। মায়ের অসম্মানে বুকের ভেতর মনখারাপের প্লাবন অভীকের তখন।নিরীহ ঠান্ডা স্বভাবের মায়ের সেদিনের রুদ্র মূর্তি মনে পড়ে ওর। উঠোনের পুঁই মাচা থেকে কঞ্চি নিয়ে প্রচন্ড মার ওকে। সারা গায়ে লাল লাল দাগ।রাতে ধুম জ্বর এলো ওর।মাথায় জল পট্টি দিতে দিতে মায়ের কান্নার আওয়াজ আজও ওর কানে বাজে।বুঝেছিল, মায়ের কান্না আসলে ঐ অপমানেরই প্রতিক্রিয়া। ছেলে চোর ,একথাটা মা মানতে পারছিল না। সেদিনই ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, নিজেকে এতো বড়ো করতে হবে যাতে ঐ পালকাকুও একদিন লজ্জা পায়। সেদিনের সেই জেদই ওর আজকের সাফল্যের রসায়ণ। ভাগ্যের কি পরিহাস !ঐ বাগানটাই পালকাকুরা একদিন বিক্রি করতে চাইল ওর কাছে।বাজারের প্রচুর দেনা মেটাতে ওদের তখন টাকার প্রয়োজন। সেদিন গর্বিত মায়ের মুখে এক অদ্ভুত আনন্দ দেখেছিল অভীক।
চোখের কোণটা একটু মুছে নিল ও।এই ছেলেটার মধ্যেও কি ঐ আগুনটা জ্বালানো যাবে? চোয়াল শক্ত করে ছেলেটার মুখে সেই জেদ খুঁজতে লাগল ও।