গল্পঃ তর্জন সিং আর গদাই – মলয় চৌধুরী (জলপাইগুড়ি)

তর্জন সিং আর গদাই
মলয় চৌধুরী

সক্কালবেলাতেই বনের রাজার মেজাজ গরম। কেন বলো তো?
কত গাছপালা জন্তুজানোয়ারে ভরা এই বন, আর এই বনের রাজা হল তর্জন সিং বাঘ। বিশাল তার চেহারা। হাঁড়ির মত মুখ, আগুনের গোলার মত দুই চোখ আর ঝাঁটার মত গোঁফ। গায়ে ভীষণ জোর। তাকে ভয় পায় না এমন প্রাণী এই জঙ্গলে নেই। তাহলে এত স্পর্ধা কার? কে তাকে অপমান করে?
সবাই জানে, রাজা তর্জন সিং ভোরবেলা জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে মিষ্টি জলের পুকুরটায় মুখ না ধুয়ে জলখাবার খান না। তার মুখ ধোয়ার বিশেষ একটা জায়গা আছে। সেই ঘাটে অন্য কোন জন্তু পা রাখবার সাহস পায় না। কিন্তু আজ!
তর্জন সিং অন্য দিনের মতোই ভোরবেলা সেই ঘাটে মুখ ধুতে গিয়ে দেখলেন আগে থেকেই কে সেখানে নেমে জল ঘুলিয়ে রেখে গেছে। ব্যাস, তর্জন সিং খেপে আগুন। ভীষণ তর্জন গর্জন শুরু করে দিলেন। মুখ ধোওয়া মাথায় উঠলো। তারপর মেজাজটা একটু ঠান্ডা হতেই ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন মাটিতে গোলগোল আর গভীর গর্ত। এতো হাতির গোদা পায়ের ছাপ! এই তাহলে ব্যাপার! তর্জন সিং চললেন হাতিকে খুঁজতে।
আসলে হয়েছে কি, গোদা গোদা পায়ের গদাই হাতি সকালে স্নান না করে জলখাবার খায় না। সে একটা বড় পুকুর দেখে বেশি ভাবনাচিন্তা না করেই জলে নেমে পড়েছিল। তারপর আর কি? হাতির স্নান ! জলটল ছিঁটিয়ে, পুকুরের পাঁক গুলিয়ে, গড়াগড়ি খেয়ে আর শুঁড় দিয়ে ফোয়ারার মত জল ছুঁড়ে গদাইয়ের স্নান হল। তারপর গদাই হেলতে দুলতে গিয়ে ঢুকলো এক কলা বনে। সুন্দর পাকা এক কাঁদি কলা দিয়ে সে জলযোগ সারতে লাগলো।
তর্জন সিং গদাইয়ের চিহ্ন ধরে খুঁজতে খুঁজতে ঠিক এসে পৌঁছল কলাবনে। তার মুখ ধোওয়া, খাওয়া কিছুই হয় নি, আর গদাই কিনা মহানন্দে কলা খাচ্ছে !
” এ্যাই গদাই, তোর এত সাহস৷! আমার মুখ ধোওয়ার জায়গা ঘুলিয়ে দিয়েছিস !” ভীষণ গর্জন করে উঠলো তর্জন সিং।
গদাই তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে থাকে নিজের মনে। শরীরটা আর কান দুটোই যা বিশাল, শুঁড় আর পাগুলোই যা চোখে পড়ার মত। চোখ দুটো তার ছোট ছোট। ভাল করে চারপাশ অত দেখা কি সম্ভব? সে থতমত খেয়ে বললো, ” কি হয়েছে মহারাজ? আমি কী দোষ করলাম? “
তর্জন সিং হুংকার দিল ” তুই জানিস না আমি রোজ সকালে ঐ জলে মুখ ধুই? তুই কেন ঐ ঘাটে জল ঘুলিয়ে এলি? এবার তোর মজা দেখাচ্ছি ! “
বিকট এক হাঁ করে তর্জন সিং গদাইয়ের দিকে তেড়ে এল।
গদাই কি করবে ভেবে না পেয়ে কলার কাঁদি থেকে এক ছড়া কলা ছুঁড়ে দিল তর্জন সিং এর মুখে। তর্জন সিংও কিছু বোঝার আগেই গপ্ করে সেই কলা গিলে ফেলল।
এমা, ছি ছি ! সকালে মুখ ধোওয়া হয় নি, তার আগেই খেয়ে নিল ! তর্জন পড়লো মহা মুশকিলে। বনের আর সব পশুরা এ কথা শুনলে কি বলবে? সবাই বলবে রাজা তর্জন সিং অসভ্য, মুখ না ধুয়ে খায়! এ কি কান্ড হল?
তর্জন সিং এখন সুর নরম করে গদাইকে বললো, ” ভাই গদাই, যা হয়েছে হয়েছে। ও নিয়ে আমরা আর ঝগড়া মারামারি করবো না। তুমি ভাই আমাকে একটু সাহায্য কর। “
গদাই তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। হলেও বা তার মস্ত চেহারা আর ভীষণ গায়ের জোর, বনের রাজা বাঘের সংগে লড়াই করতে ভয় লাগে না বলো? সে গদগদ হয়ে বললো, ” কি সাহায্য করবো মহারাজ ? হুকুম করুন । “
তর্জন সিং বললো, ” আমি যে সকালবেলা মুখ না ধুয়েই একছড়া কলা গিলে ফেললাম এই কথাটা কাউকে বোল না। “
গদাই বললো, ” কক্ষনো বলবো না। আমাদের ব্যাপার আমাদের মধ্যেই থাকবে। আপনি এ নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। “
তখন তর্জন সিং বললো, ” খুব ভাল, আজ থেকে আমরা তাহলে বন্ধু। “
গদাই বললো, ” আমিও আর আপনার ঘাটে স্নান করবো না। এবার থেকে পুকুরের অন্য দিক দিয়ে নামবো। “
ব্যস, ভাব হয়ে গেল তাদের। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই তাদের দেখা হলে তারা একটু গল্পগাছা করে। তারপর যে যার কাজে চলে যায়।
গদাই একদিন তর্জন সিংকে বললো ” তুমি খাবার জন্য কেন যে শুধু শুধু হরিণ, বরা শিকার কর বুঝি না। আমার মত শাক পাতা, কলা মূলো খেয়ে থাকতে তো পার ! “
তর্জন সিং বললো, ” তা কি করে হয় বলো, যার যেটা অভ্যাস। কলা- মূলো আমার হজমও হবে না, তা থেকে শক্তিও পাব না। “
গদাই বললো ” তুমি ফলমূল খাওয়া অভ্যাস করে দেখ, ভাল লাগবে। “
তর্জন সিং গদাইয়ের মন রাখতে তার সামনে ফলমূল খায়। তাতে তার মুখটা বিচ্ছিরি রকম বিস্বাদ হয়ে যায়। তা কাটাতে গদাইকে লুকিয়ে সে হরিণটা বরাটা মেরে খায়। গদাই ভাবে তর্জন এবার মাংস ছেড়ে তার মতো নিরামিষভোজী হয়েছে। তার খুব আনন্দ হয়।
একদিন গদাই একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে লতাপাতা খাচ্ছিল, এমন সময় একটা হরিণের আর্তনাদ শুনতে পেল, ” বাঁচাও, বাঁচাও! ” গদাই একটু এগিয়ে দেখল তার বন্ধু তর্জন সিং হরিণ শিকার করেছে। গদাই চুপ করে রইল।
এরপর একদিন গদাই ঝরনার জলে নেমেছে, এমন সময় একটা বরা প্রাণপণ দৌড়ে পালাচ্ছিল। তাকে তাড়া করছিল তর্জন সিং। গদাই বুঝলো, বাঘের পক্ষে মাংস ছেড়ে থাকা অসম্ভব। তাই তর্জনের সঙ্গে দেখা হলে সে আর খাওয়ার কথা তোলে না। অন্য গল্পগাছা করে কাটিয়ে দেয়।
একদিন সেই বনে এল আর একটা বাঘ। তার নাম ডোরাকাটা সর্দার। এসেই সে হাঁক ডাক ছেড়ে বললো ” আজ থেকে আমি এই বনের রাজা। সবাই আমাকে ভয় পেয়ে মেনে চলবে। “
বনের পশুরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। ছিল এক রাজা তর্জন সিং, এ আবার কোন্ রাজা এল? তারা তাড়াতাড়ি তর্জন সিং এর কাছে খবরটা পৌঁছে দিল।
সব শুনে তর্জন সিং তো রেগে লাল। বিকট গর্জন করে খুঁজে বেরাতে লাগলো ডোরাকাটা সর্দারকে। ডোরাকাটা তখন সবে একটা হরিণ ধরেছে। এমন সময় সেখানে তর্জন সিং হাজির।
” ছাড় হরিণকে। ও এই জঙ্গলে আমার প্রজা। খবরদার ওকে মারবি না! ” গর্জে উঠলো তর্জন সিং।
” যেখানে আমি যাই, আমিই সেখানকার রাজা হই। বাঁচতে হয় তো পালা এ বন ছেড়ে।” ৷ ডোরাকাটা সর্দার উল্টে তম্বি করে উঠলো।
তর্জন সিং এক লাফে ডোরাকাটার ঘাড়ের উপর পড়লো। ডোরাকাটা হরিণকে ছেড়ে দিয়ে তর্জন সিংকে মাটিতে আছড়ে ফেললো। লেগে গেল জোর লড়াই। সে কি কান ফাটানো গর্জন দুজনের আর সে কি হিংস্র কামড়াকামড়ি ! জঙ্গলের সব পশুরা ভয়ে সেই এলাকা ছেড়ে পালালো।
গদাই তখন এক কলা বনে খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল। একমনে খেয়ে যাচ্ছিল। ঝগড়া লড়াইয়ের কোন খবরই জানে না। একপাল হরিণ ছুটতে ছুটতে এসে বললো ” পালাও গদাইদা, পালাও। বাঘে- বাঘে জোর লড়াই লেগেছে। আর রক্ষে নেই।”
গদাই তাড়াতাড়ি তাদের পথ আটকে বললো
” কোথায় লড়াই লেগেছে রে? কখন থেকে? “
হরিণেরা বললো ” ঐ তো, ঝর্ণার ধারের উঁচু ঘাসজমিতে লড়াই হচ্ছে গো! অনেকক্ষণ হয়ে গেল। “
গদাই শুঁড় উঁচু করে সেদিক পানে দৌড় দিল তার বন্ধু তর্জন সিং এর খবর নিতে।
তর্জন সিং আর ডোরাকাটা সর্দার, দুজনের শক্তি প্রায় সমান সমান। তাই সহজে লড়াইয়ের ফয়সালা হচ্ছিল না। একটু করে জিরিয়ে নিয়ে বারবার তারা লড়াই শুরু করছিল। দুজনেরই গা রক্তে লাল, নখ আর দাঁতের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত। তবু তারা রণে ভঙ্গ দিচ্ছে না।
গদাই দেখলো মহা বিপদ। এমন চললে তর্জন সিং যদি জিতেও যায়, তাকে বাঁচানো যাবে না । গদাই তখন হুংকার ছেড়ে শুঁড় উঁচিয়ে ধেয়ে গেল ডোরাকাটা সর্দারের দিকে। তাকে শুঁড়ে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর তাকে তাড়া করে সেই জঙ্গলের বাইরে বের করে দিল।
তর্জন সিং এর কাছে ফিরে এসে গদাই দেখলো সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। গদাই তাকে খুব সাবধানে শুঁড়ে জড়িয়ে নিয়ে গেল ঝর্ণার ধারে। নরম ঘাসের উপর তাকে শুইয়ে দিল। শুঁড়ে করে জল এনে ছিটিয়ে দিল গায়ে, পরিস্কার করে দিল ক্ষতগুলো। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিতে লাগলো।
পুরো একবেলা পরে তর্জন সিং এর জ্ঞান ফিরলো। খুব দুর্বল তখন সে। গদাই বললো, ” বন্ধু, তুমি শুয়ে থাক। আমি তোমাকে জল এনে দিচ্ছি। “
গদাই ঝর্ণার জল এনে তর্জন সিংকে পান করালো। তর্জন সিং বললো, ” তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে বন্ধু।তোমার এ উপকার আমি জীবনে ভুলবো না। “
গদাই তখন তর্জনকে বললো, ” দেখ বন্ধু, তুমি মাংসাশী। হরিণ,বরা না মেরে তুমি বাঁচতে পারবে না। আমি নিরামিষাশী ; শাক, পাতা, ফলমূল খেয়ে থাকি। তোমাকে দেখলে হরিণ, বরা, মোষ সব পালিয়ে যায়। অথচ দেখ, হরিণদের কাছ থেকে খবর পেয়েই আমি তোমাকে বাঁচাতে এলাম। তাই ভাবছিলাম, আমাদের এই বন্ধুত্ব যে কোন দিন ভেঙে যেতে পারে। তার চেয়ে ভাল, তুমি তোমার পথে চল, আমি আমার পথে যাই। ” এই কথা বলে গদাই নিজের পথে চলে গেল। তর্জন সিং মুখ শুকনো করে সেই দিকে চেয়ে রইল।।

One thought on “গল্পঃ তর্জন সিং আর গদাই – মলয় চৌধুরী (জলপাইগুড়ি)

  1. প্রায় ১৬-১৭ বছর পরে পেলাম গল্পটা…….রাতে ঘুমনোর আগে, স্কুলে যাওয়ার সময় বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুনতাম এই গল্পগুলো…..☺️☺️ এইগুলোর মধ্যে দিয়েই আমার ৩-৪ বছরের ‘আমিটা ‘ বেঁচে থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *