সীমানা ছাড়ায়ে
অলকানন্দা ঘোষ সেনগুপ্ত
স্কুলের বড়দিদিমণি রত্নাবলী গত হয়েছেন। খবরটা বিশেষ বিশেষ খবরের মধ্যে পড়েনা! করোনার অতিমারিতে অনেক মানুষেরই এরকম হয়েছে, এই মারণ রোগে নাহলে অন্য রোগে ভুগে ! অকাল প্রয়াণ বড়দিদিমণির, কেউ শোকে মুষড়ে পড়েছেন, কেউ ভাল সামলেছেন, কারোর বিশেষ কিছু এসে যায়নি – যেমন পরিবারে, স্কুলে, বন্ধুবান্ধবের সমাজে – এমনই তো হয়, সাধারণত ! কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায়! মুশকিলটা হল আসলে খোদ রত্নাবলীকে নিয়েই !
সব ঘটনাটাই সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ! বিজ্ঞানের ছাত্রী, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, ভূত, প্রেত, আত্মার ধারণা থেকে শত হস্ত দূরে থেকে, যে কিনা সারা জীবন ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়ে এল বিজ্ঞানমনষ্কতা, তার জীবনে ( বা মরণে) এই অদ্ভুত ঘটনা? আশ্চর্য, ব্যাখ্যা করা যাচ্ছেনা। কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবে, তাও সম্ভব নয় ! ইহলোক নয়, যে ফোন তুলেই প্রশ্ন করা যাবে ! নতুন লোকে আলাপও হয়নি কারোর সাথে। চেনা পরিচিত যারা তার আগে এই লোকে এসেছেন, তেমন কাউকে পেলে হোত, তবে আপাতত যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তা অনন্য ! কলেজে ফিজিক্সের ক্লাসে পড়েছিল, রিলেটিভিটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার আগে মানুষের ধারণা ছিল মহাকাশের শূণ্যস্থানে আছে সর্বগামী ইথার । তারও কিভাবে সর্বগামিতার ক্ষমতা তৈরি হল – এটা অত্যাশ্চর্য হলেও বেশ উপভোগ্য।
আজ স্কুলে বড়ই শোরগোল, ব্যস্ততা।বড়দিদিমণির স্মরণসভা। করোনা পরিস্থিতি একটু সামলেছে, তাই লোক সমাগমও হয়েছ। সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। স্কুলের মেজদিদিমণিও ! চারিদিকে যুদ্ধকালীন অবস্থা ! কয়েকজন শিক্ষিকা মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত তদারকি করছেন, কাজটা ঠিকমত না করার জন্য একে তাকে ধমক দিচ্ছেন, প্রয়োজনে নির্দেশও দিচ্ছেন। বড় আনন্দ পেলেন রত্নাবলী দিদিমণি! এরা সবাই যদি এগিয়ে এসে কাজ করে তাহলে চিন্তা কিসের! অসময়ে চলে যাওয়ার যে শূণ্যতা, তা নিয়ে ভাবতে হবে না কাউকে !
স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি এলেন বেশ কয়েকজন অতিথিকে নিয়ে, মেজদিদিমণি আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! রত্নাবলী নিজেই এগিয়ে গেলেন সাহায্যের জন্য, নিজের অবস্থা এবং অবস্থান ভুলে। তারপর চটকা ভাঙতেই সরে এলেন ওখান থেকে। এসব দায়িত্ব তার নয় আর, এটা অভ্যাস হয়নি ! স্টেজের ডানদিকে বোগেনভিলিয়ার লতা দোতলার বারান্দার গ্রীল জড়িয়ে উঠে গেছে আরো ওপরে – তারই একটা ডালে বসতে গিয়ে একবার ভাবলেন, কলেজবেলার তণ্বী তো আর নন, তার ভারে হুড়মুড়িয়ে ছিঁড়ে পড়বেনা তো? পরক্ষণেই নিজের অশরীরি অস্তিত্বে নিশ্চিন্ত হলেন। ভালই হল, এখান থেকে দোদুল্যমান হয়েই অনুষ্ঠান দেখা যাবে!
স্টেজের ঠিক মাঝখানে টেবিলের ওপর রত্নাবলীর বড় একটা ছবি। একবছর স্পোর্টসের দিন গ্রুপ ছবি নেওয়ার পর জয়ন্ত তাকে একা চেয়ারে বসিয়ে ছবি তুলেছিল ।এই সময়ে কাজে লেগে গেল! রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ল রত্নাবলী, সবার প্রণাম আর ফুল মালা দেওয়ার বহর দেখে ! যে শিক্ষিকার প্রতি কথাতেই প্রতিবাদ, কোন নোটিশের বিরুদ্ধে উল্টো পথে হেঁটে সব পাল্টানোর চেষ্টা করত , সে রুমাল, মাস্ক কোন কিছু দিয়েই চোখ আর নাকের জল আটকাতে পারছে না। তার নিজের চোখেও জল আসার উপক্রম, অবশ্য চোখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার! অশরীরী অবস্থাটার সাথে বোঝাপড়াটা যে কিছুতেই হচ্ছে না ! কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হল অনুষ্ঠান। রত্নাবলীর পছন্দের গান হল কয়েকটা, অনেক ভাল ভাল কথা তার সম্বন্ধে বলা হল। ঝুলন্ত হলেও নিজের সম্পর্কে ভাল কথা যে কোন অবস্থাতেই কার না ভাল লাগে !
এবার চমকানোর পালা রত্নাবলীর! যে ভদ্রলোক স্টেজে উঠে এলেন তাকে দেখে মনে পড়ল – কিছুদিন আগেই বেরিয়েছে দুটি ক্লাসের রাজ্য বোর্ড পরীক্ষার ফল। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী। তাদের দেশেও একই অবস্থা। স্কুল কলেজ বহুদিন বন্ধ। ক্লাস হয়না, পরীক্ষা নেওয়াও সম্ভব হয়নি তাদের রাজ্যে, অথচ রেজাল্ট বেরিয়েছে।রাজ্যবোর্ড কর্তাদের মত ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব স্কুলের কাছে যা যা তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা তারা পাঠিয়েছে। তারপর বোর্ড ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিয়েছেন রেজাল্ট। দুদিন পর রত্নাবলী স্কুলে তার ঘরে বসে কাজ করছেন, এক ভদ্রলোক, হাতে মার্কশীট , সাথে তার মেয়ে এবং আরো দুজনকে নিয়ে, সোজা ঢুকে পড়লেন তার ঘরে। দাবী, যা নম্বর সে পেয়েছে অঙ্কে, তাকে বাড়িয়ে দিতে হবে। আশি শতাংশের ওপর নম্বর না দিলে কি অনার্স পাওয়া যায়? তাই সেই দাবী তিনি নরমগরম মেজাজে পেশ করে যেতে লাগলেন। রত্নাবলী বিজ্ঞানের শিক্ষিকা, ক্লাসে ও পরীক্ষায় মেয়েটির অঙ্ক বিষয়ে অপারদর্শিতার কথা ভালই জানেন, মেয়েটির অনার্স নিয়ে না পড়াই ভাল। আজকাল এত রকম আন্তর্বিষয়ক ক্ষেত্রে পড়াশুনা করা যায়, মেয়েটির উচিত সে সুযোগ নেওয়া। বড়দিদিমণি সেকথাই বললেন, কিন্তু মেয়েটির বাবা এবং সাথীরা নাকি এবিষয়ে অনেকই বেশি জানেন, তাই তা ফুৎকারে উড়ে গেল ! তিরিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমন নম্বরের দরদাম করার অভিজ্ঞতা কোন দেশে, কালে কারোর হয়েছে বলে শোনেন নি। চিরকাল জানেন নম্বর পরীক্ষার খাতায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে পেতে হয়। সেকথা বলাতে অন্য ভদ্রলোকটি বললেন যে নম্বর বড়দিমণির লকারের সম্পত্তি নয়। ক্রমশ তা অনুরোধের বদলে অবরোধের চেহারা নিল। শিক্ষিকাদের সাথে আলোচনা করে, সোজা কাউন্সিল সভাপতির কাছে ফোন করে বিষয়টি পাঠিয়ে দেন রত্নাবলী। তারা অবশ্য নম্বরের বদল করেন নি, তবে স্কুলে ফিরে এসে সেই অভিভাবক তাকে আইনে সিদ্ধ, অসিদ্ধ নানা বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন, মনে আছে। শেষ পর্যন্ত তার মেয়ে কী নিয়ে পড়ছে তা আর জানার সুযোগ হয়নি! আজকের অনুষ্ঠানে এত ভাল কথা বলে যাচ্ছেন যার সাথে রত্নাবলীর শেষ অভিজ্ঞতার কোন মিল নেই। এরকমই বোধহয় হয় ! বিগতের প্রতি ক্ষমাশীল হয় মানুষ, ভদ্রলোকও ব্যতিক্রম নন!
সরে আসবেন মনে করে যেই বোগেনভিলিয়ার ডাল থেকে নেমে আসতে যাবেন, আবার এক ভদ্রলোককে আটকে গেলেন। স্কুলের বারান্দায় উদভ্রান্তের মত ছুটে চলা লোকটি, স্কুলের থেকে দেওয়া সরকারি মিড ডে মিলের ব্যাগ টা কে বগলে চেপে হাতে কিছু কাগজ পত্র নিয়ে কোথায় যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। এগিয়ে বড়দিদিমণি প্রশ্ন করলেন, মেয়ের অ্যাক্টিভিটি টাস্ক জমা দেবেন? ভদ্রলোক এমন ভাবে তাকালেন মনে হল এরকম অদ্ভুত কথা কোনদিনও শোনেন নি। না না জমা টমা কিছু দেবনা, তবে যা যা নেওয়ার ছিল নিয়েছি। বড়দি বলেন জমা দেওয়ার একটা জিনিস অবশ্যই আছে, সেটা হল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক এর উত্তরপত্র – দিদিমণিরা খাতা দেখে ভুল শুধরে দেবেন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন কি সব টাকস্ মাকস্ – বলছেন, এসব আমি জানিনা, মেয়েও জানেনা ! আমি চাল ডাল আলু, সাবান – যা নেবার নিয়েছি, এবার আমার দরকার ব্যাঙ্ক একাউণ্টের খবর। সেইটা কোথায় পাব বলেন দেখি? ব্যাঙ্কের বই টা পাচ্ছিনা কেন? এরপর আমার মেয়ের টাকা গুলো যদি মার যায় তার দায় কে নেবে বলেন তো? সমস্যা গভীর ! মেয়ের পড়াশোনা যদি মার যায়, তাতে পিতা হিসেবে কোন মাথাব্যথা থাক না থাক, মেয়ের এই টাকা মার গেলে খুবই মারাত্মক হয়ে পড়বেন তিনি। আজকাল ছাত্রছাত্রীদের টাকা পয়সা পাওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। তাদের ছাত্রাবস্থায় এসব সরকারি অনুদান তো স্বপ্নেও ছিলনা। কেউ যদি দোকান থেকে কিছু আনতে দিলেও পাই পয়সার হিসাব বুঝিয়ে বলতে হোত৷ সদা সজাগ বাবা মায়েরা ছেলেমেয়ের টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে কোন রকম সংস্রব রাখতে দিতেই চাইতেননা। বাবা পদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন বলে রত্নাবলী ন্যাশনাল স্কলারশিপ পাননি। মন খারাপ করায় বাবা বলেছিলেন, যা তুমি নিজের যোগ্যতায় রোজগার করবে তাতেই তোমার অধিকার, শুধু এই সার্টিফিকেটে লেখা কথাগুলো তোমার জন্য। তাই জেনেই বড় হয়েছেন রত্নাবলীদের প্রজন্ম। চিন্তা হয় এই প্রজন্মের জন্য যারা এই অনুদান পাওয়া কে অধিকার বলে মনে করছে। অতিমারির আগে একটা খুব পরিচিত চিত্র ছিল, করিডোরে মেয়েদের ক্লাসের ফাঁকে চলাফেরা এবং তার কারণ অধিকাংশ সময়ে এই দেনাপাওনার ফর্ম জমা দেওয়া বা নেওয়ার জন্য। যাই হোক, মেয়েটির বাবাকে বুঝিয়ে বললেন ব্যাঙ্কের পাস বুক ব্যাঙ্ক থেকেই নিতে হবে। কাছেই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ব্যাঙ্ক। কিছুক্ষণের মধ্যে ফোন এল এস.আই অফিস থেকে। বড়দিমণির নামে নালিশ গেছে, সহযোগিতার অভাব। চার পুরুষের শিক্ষক বংশ তাদের। পূর্বপুরুষদের পায়ে মাথা ঠুকে রত্নাবলী তার কর্তব্য বুঝে গেলেন, এস.আই সাহেবও খুশি ! দিদিমণি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে ফোন করে সব খোঁজ খবর নিয়ে আর কী কী কাগজপত্র জমা দিলে একাউণ্ট খোলা সম্পুর্ণ হবে তা ভদ্রলোক কে বুঝিয়ে দিলেন। সেই মহার্ঘ বস্তু, পাসবুকটি যেদিন পাওয়া যাবে, সেদিন স্কুলের পিয়ন কে পাঠিয়ে আনিয়ে নেবেন, অভিভাবককে একবার কষ্ট করে আসতে হবে তা নেওয়ার জন্য। ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হলেন। শুধু যাওয়ার সময় বলে গেলেন, সহযোগিতা থাকলে তবেই তো ‘পরাসুনা” ভাল হয় ! যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি – বড়দিদিমণি বুঝলেন ‘পরাসুনা’ মানে শিক্ষা নয়, ‘পরাসুনা’ মানে ‘সহযোগিতা’।
অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বিগত কুড়ি বছরে ভরে উঠেছে নানান ঘটনায়। তাদের সময়কার স্কুল আর নেই। চরিত্রগত বদল শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাল হয়েছে না খারাপ তা তিনি বলতে পারবেন না, তবে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা অনেক স্মার্ট, নিজেদের ইমোশনটাতে রাশ টানতে জানে, অকারণ চক্ষুলজ্জা এদের নেই। নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন এবং সোচ্চার। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ আটকে গেল একটি মেয়ের দিকে, মেয়ে না বলে বেশ গিন্নীবান্নী বলাই ভাল, মাথায় কপালে বৈবাহিক চিহ্ণ প্রকট – এসে ঢিপ করে প্রণাম করল মেজদিদিমণিকে, দুঃখ করল বড়দিদি কে প্রণাম টা করা হল না বলে। মেয়েটির আহ্লাদী চেহারা দেখে তার মনের আনন্দ আন্দাজ করা যায়। মেজদিদিমণির প্রশ্নের উত্তরে জানালো যে কন্যাশ্রী প্রকল্পের পঁচিশ হাজার টাকা সে পেয়েছে। এই মেয়েটিকে স্কুল সুদ্ধু সব লোকই চেনে, দিনের পর দিন বিবাহিত হয়েও ‘অবিবাহিত’ শংসা নেওয়ার জন্য স্কুলে বসে থাকত মেয়েটি। কোথা থেকে এই শংসা জোগাড় করে মেয়েটি এই টাকা হস্তগত করতে পারল তা এখন আলোচনার বাইরে। শহরতলীর ছাত্রীবহুল একটি ভাল স্কুলে প্রধান হিসেবে দু দশকের পরিচালনার অভিজ্ঞতা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রায় একশো ভাগ সাফল্য পাওয়া, ছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ, প্রাইজের রমরমা, বাল্যবিবাহ ও পাচার রোধ করার জন্য ছাত্রীবাহিনী গঠন ও তাদের কার্যকলাপের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে থাকার পরেও এসব দেখে শুনে মনে হয়, হেরে গেলেন। যা করতে চেয়েছিলেন তা করা হয়নি। অবশ্য কী করতে চেয়েছিলেন তা গুছিয়ে বলাও সম্ভব নয়, কিন্তু যা হল তা মনোমত নয়।
ভাবছিলেন এই অঞ্চল ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন এবার। যাতায়াতের তো কোন হ্যাপাই নেই এখন, ভুতের রাজার বর পাওয়ার মত – যেখানে চাইবেন চলে গেলেই হল ! অবশ্য ভুতেরা কি ‘ভুতের রাজা’র বর পায়? তার অবস্থা টা ঠিক কী? বর্তমানে তো নেই, তাহলে ভূতেই আছেন ! যাব মনে করেও যাওয়া হয় না চট করে। কুড়ি বছরের চেনা পরিচয় ! একটা মিছিল দেখতে পাচ্ছেন যেন ! যার দিকে তাকাচ্ছেন তাকে ঘিরেই যে একটা ঘটনা মনে পড়ছে! সেই ছোট্ট মেয়েটা যে অঙ্ক ক্লাসে ভয়ে কেঁদে ফেলতো। ছুটির পরে কাজকর্ম সেরে রত্নাবলী স্কুলে ডেকে নিতেন মেয়েটিকে। গল্প করে, কাগজ কেটে নানা আকার বানিয়ে, ছবি এঁকে চলত দিদিমণিদের পরীক্ষা নিরীক্ষা। আস্তে আস্তে অঙ্কের দিকে মুখ ফেরানো গিয়েছিল। কিন্তু সময় পাওয়া গেল না বেশি। মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল। যে মেয়েটি সারা স্কুলজীবনের কোন পরীক্ষায় পাশ নম্বর পায়নি অঙ্কে, সে পেয়েছিল বাহান্ন। এটাই প্রাপ্তি। পাশ করার পর মা আর মেয়ের চোখের জল দেখে রত্নাবলীর মনে হয়েছিল, কোন কাজ কোথায় সার্থকতা পায় তা কোন অদৃশ্য জীবনীকার কি আগে থেকে লিখে যেতে পারেন? আর সেই রক্তাল্পতায় অসুস্থ মেয়েটি, জীবনের অবতরণিকাতেই যার যবনিকা পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল! বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ার একমাসের মধ্যে যার মা অ্যাকসিডেণ্টে প্রায় দু বছর শয্যাশায়ী ছিলেন! ছোট ভাই, সহ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব সামলে স্কুলে সময়মত আসার জন্য তার দরকার ছিল যে বাহন সাইকেলটা, সেটা যখন তাকে দেওয়া হল, কী অনির্বচনীয় এক আলো তার মুখে খেলে গিয়েছিল, রত্নাবলীর তা চিরকাল মনে থাকবে। সেই মেয়েটির চোখে আজ জল, মায়ের সাথে স্কুলের মাঠে। দেখলেন সেই লড়াকু ‘দিদা’ কে। বাবা মায়ের অবিমৃষ্যকারিতায় দুই নাতনী কে নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছিলেন, কিন্তু দমে যাননি। বাবা মা ছেড়ে গেছে সন্তানদের, বৃদ্ধা পারেননি। বাড়িতে আয়ার কাজ করে সপ্রতিভ ভাবে মানুষ করে তুলেছেন তাদের, যাদের একজন আজ স্কুলের ‘ঝাঁসীবাহিনী’, ছাত্রী সুরক্ষা টীমের ক্যাপটেন। শুধু বছরের শুরুতে ভর্তির সময় বড়দিদিমণির কাছে আসতে হোত, ভর্তি ফি মকুব করানোর জন্য। রত্নাবলী ও অপেক্ষা করতেন মনে মনে। সেই ‘দিদা’র কাছ থেকে পাওয়া অকুণ্ঠ আশীর্বাদ তার পাথেয়। তাকেও দেখলেন কান্নায় ভেঙে পড়তে। নাঃ! মনটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।
ভাল মন্দ সব কিছুই ঘটেছে এত বছরের কর্মজীবনে । মানুষের সাথে মাঠে নেমে আনন্দে কাজ করেছেন, উপভোগ করেছেন। এমন অনেক ছোট ছোট গল্প জমে আছে মণিকোঠায়, আজ যা মাঠময় ছড়িয়ে আছে। রত্নাবলীর ইচ্ছে ছিল অবসরের পর, বারান্দায় প্রিয় বেতের চেয়ার টায় বসে কলম ধরবেন। গল্প, উপন্যাসের উপকরণ তো কম নেই ! ছোড়দির ছেলে টোটোন বড় প্রেসের মালিক, ব্যবসাও ভাল করছে। মাসীমণির সাথে কথাও সব পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু লেখার পাণ্ডুলিপিও টোটোন কে দেখিয়ে রেখেছেন তিনি। সে তো দারুণ উত্তেজিত, হয়ে যাবে মাসীমণি, সামনের বুক ফেয়ারে উপন্যাস না হোক তোমার গল্প সংকলন বেরোচ্ছে। কথার অবশ্য খেলাপ করেছেন রত্নাবলী নিজেই। “ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল, শুক্লা দ্বাদশীর দিন, অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে….. তিরিশ বছর অপেক্ষায় আছি !” কেই বা কথা রাখে এ পৃথিবীতে?
বড় ভালো লাগলো।