গল্পঃ অদিতির চোখে জল – অমিত মজুমদার (বেথুয়াডহরি, নদিয়া )

অদিতির চোখে জল
অমিত মজুমদার

পরিকল্পনাটা অদিতির মাথা থেকেই এসেছে। অবশ্য এমন যাবতীয় ভাবনা চিন্তা ওর মাথা থেকেই বেরোয়। তবে বেশীরভাগই পরিকল্পনাই বাস্তবে সফল করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই প্রস্তাবটা শুনেও মুখ হাঁ হয়ে গেলো সুমনের।
কোচিং থেকে বেরিয়েই সুমনকে অদিতি বললো, “শুনছি ষোলো তারিখ থেকে স্কুল খুলে যাবে আমাদের।”
“হ্যাঁ তেমনই তো শুনছি। পেপারে টিভিতে তাই দেখলাম।”
“অন্যান্য বছর তো এই সময় সব ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। এই বছর তো সেটা নেই।”
“সে তো কোভিড পরিস্থিতিতে গত বছরেও ছিলো না৷”
“তা ছিলো না। কিন্তু গত বছর তো আর নভেম্বর মাসে স্কুল খোলেনি। তাই আমি একটা কথা ভাবছিলাম।”
“বলে ফেল কী ভাবছিলি।”
“সামনের চোদ্দই নভেম্বর তো শিশু দিবস।”
“হ্যাঁ ঠিক। আর আমাদের মধ্যে তুই শিশু। ওইদিন তোকে একটা বেলুন কিনে দেয়া হবে।” কথাটা শুনে রাগ করলো না অদিতি। কেই ইয়ার্কি করলে সে দুম করে রেগে যায় না। রাগের কথা শুনলেও সে হেসে পরিস্থিতি হালকা করে দেবার চেষ্টা করে। একটা সিনেমায় সে এমন ব্যাপার দেখেছিলো। বললো,“শোন না। আমাদের এখানে তো কোনোদিন শিশুদিবস পালন হয় না। তাই এই বছর আমরা যদি শিশুদিবস পালন করি তাহলে কেমন হয় ?”
“শিশুদিবস পালন ? কোথায় ?” সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো৷
“কেনো আমাদের এই কোচিং সেন্টারে। আমাদের ঘরটা তো বেশ বড়। অনেকজনের জায়গা হবে। স্যারকে বললে স্যার রাজি হয়ে যাবেন নিশ্চয়ই।”
“অদিতি আমাদের এটা ক্লাস নাইনের ব্যাচ। এখানে শিশু কে আছে বল ? স্যারের কোনো ব্যাচেই তো শিশুরা পড়তে আসে বলে শুনিনি।”
“আমাদের ব্যাচে কেউ নেই একথা ঠিক। তবে আমাদের ব্যাচের অনেকেরই ছোটো ছোটো ভাইবোন আছে। ওই দিনটায় তাদের নিয়ে আসা হবে। ছোটো একটা অনুষ্ঠান হবে। বাচ্চাদের হাতে আমরা রাখী পরিয়ে দেবো আর একটা করে চকলেট দেবো।”
“আর এই অনুষ্ঠানের খরচা কে দেবে শুনি ?”
“আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে দেবো। আমি হিসেব করে দেখেছি দশ টাকা করে দিলেই হয়ে যাবে৷”
“আহা রে! বন্ধুদের কাছে প্রস্তাব দিয়ে দেখ ক’জন টাকা দিতে রাজি হয়।”
“দেবে না কেনো রে ? মোটে তো দশ টাকা ?”
“আমার কথাটা মিলিয়ে নিস।” বলেই সুমন আর দাঁড়ালো না। সাইকেলে উঠে পড়লো।
সুমনের কথাটা সত্যিই মিলে গেলো। পরের দিন কোচিংয়ে এসে অদিতি সবার সামনে প্রস্তাবটা দিতেই সবাই বিষয়টা এড়িয়ে গেলো। এমনকি স্যারের সামনে কথাটা বলার পরে স্যারও গুরুত্ব দিলেন না কথাটায়। অদিতির মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। ভেতরে ভেতরে দমে গেলেও কিন্তু সে ভেঙে পড়লো না। বরং বাইরে এসে বন্ধুদের শুনিয়ে দিলো সে একাই বাচ্চাদের নিয়ে কিছু করবে।
কিন্তু কিছু করবো বললেই এই অজ গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে কিছু করা সহজ না। প্রাইভেট ব্যাচ আর খেলার মাঠ ছাড়া পাঁচটা বাচ্চাকেও পাঁচ মিনিটের জন্যেও এক জায়গায় আনা খুব কঠিন। অদিতি অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করলো বাচ্চাদের আঁকা ছবি দিয়ে একটা চিত্র প্রদর্শনী করবে চোদ্দ তারিখ। এই গ্রামে বাইরে থেকে একজন স্যার আঁকা শেখাতে আসেন। কিছু বাচ্চারা শেখে স্যারের কাছে। অদিতি নিজেও শেখে। কে কেমন আঁকে সেটা অদিতি জানে। তাদের মধ্যে কুড়ি জনকে মনে মনে বাছাই করলো সে। চিত্র প্রদর্শনী করতে হলে একটা আর্ট গ্যালারি লাগে। কিন্তু সে আর্ট গ্যালারি পাবে না। সে ঠিক করেছে প্রদর্শনীটা দেয়াল পত্রিকার আকারে হবে। দুটো আর্ট পেপার পাশাপাশি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেবে। আর তার মধ্যে ছবিগুলো আঠা দিয়ে সেঁটে দেবে। প্রতিটা ছবি হবে পোস্টকার্ড সাইজ। পোস্টকার্ড সাইজে আর্ট পেপার কেটে সে নিজেই পৌঁছে দেবে বাচ্চাগুলোর বাড়ি। তারপর তাদের আঁকা হলে আবার নিয়ে আসবে। এখনও দিন পনেরো সময় আছে। হয়ে যাবে। সব ছবি যোগাড় হয়ে গেলেই সে সেগুলো দিয়ে সুন্দর করে একটা ছবির দেয়াল পত্রিকা তৈরী করে ফেলতে পারবে৷
পরিকল্পনা ভালো ছিলো অবশ্যই কিন্তু সেটাও খুব সহজ হলো না। এখানে দুর্গাপুজোর পর লক্ষ্মীপুজোর মেলা হয়। পাঁচদিন মেলা থাকে। এরপর কয়েকদিনের মধ্যেই কালিপুজো ভাইফোঁটা। স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাদের এই সময় আঁকার বিষয়ে আগ্রহ থাকলো না। তাছাড়া এরা আঁকা শেখে বটে কিন্তু আঁকার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ তাদের নেই। ভাইফোঁটা শেষ হবার পর আর যখন সপ্তাহ খানেক সময় আছে তখন তার হাতে এলো গোটা পাঁচেক ছবি। এই দিয়ে দেয়াল ভরানো যাবে না। আরও ছবি লাগবে। কিন্তু সেই ছবি কিভাবে যোগাড় হবে ? এদিকে ওর কোচিংয়ের বন্ধুরা সবাই জেনে গেছে অদিতির প্রকল্পের কথা। কারো সঙ্গে দেখা হলে যেই জিজ্ঞাসা করছে, কাজ কতদূর। অনেকের কথায় কিছুটা ব্যাঙ্গও আছে। অদিতিও ঘোষণা করে দিয়েছে চোদ্দ তারিখ সন্ধ্যে ঠিক ছটার সময় কোচিং সেন্টারের দেয়ালে সে, বাচ্চাদের চিত্র প্রদর্শনী টাঙাবে। বিষয়টা এখন পুরোপুরি প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছে। ছবি তাকে যোগাড় করতেই হবে৷ সে যেভাবেই হোক।
আর এক সপ্তাহে বাকি আছে। অদিতির মনে হলো বাচ্চাদের ছবির আশায় বসে থাকলে হবে না। যা করার এবার নিজেকেই করতে হবে৷ নিজের পড়াশোনা বন্ধ হলো। কোচিংও বন্ধ হলো। মা অবশ্য প্রথম প্রথম একটু আপত্তি তুলেছিলেন। মৃদু বকাও দিয়েছেন কিন্তু তাতে সে থোড়াই কেয়ার করে। যে যে বাচ্চাকে ছবি আঁকতে দিয়েছিলো তাদের বাড়ি গিয়ে নিজে বসে থেকে ছবি আঁকিয়ে নেয়া শুরু করলো। এই কাজটা মোটেও সহজ না। অনেককেই বাড়িতে পাওয়া যায় না। গ্রামের ছেলে। এদিক সেদিক খেলে বেড়ায়। তাদের খেলা থেকে ধরে এনে বসানো কম ঝামেলার বিষয় না। সেই সব বাচ্চারাও এমন কিছু চিত্রকর হয়ে যায়নি যে কাগজে রং ছোঁয়ালেই ছবি হয়ে যাবে। প্রায় সবার কাছেই বেশ কিছু কাগজ নষ্ট হলো। তারপর কিছু একটা ছবি হলো। বেশীরভাগই বাড়িঘর, ফুলফল, পশুপাখি। কেউ কেউ সিনারিও আঁকলো। কয়েকজন আঁকতেই পারলো না। তাদের ড্রয়িং বুক থেকে মাপমতো ছবি কেটে নিলো অদিতি। সব ছবি যখন হাতে পেলো তখন চোদ্দ তারিখ সকাল দশটা বেজে গেছে। এখন এই ছবিগুলো আর্টপেপারে লাগিয়ে তার ওপর সুন্দর ডিজাইন করে পত্রিকাটার ফিনিশিং টাচ দিতে হবে। মাঝে মাঝে কিছু লিখতেও হবে। বিভিন্ন কোটেশন সে খাতায় লিখে রেখেছে।
সারাদিন অসম্ভব পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটার দিকে সে তার কাজ শেষ করলো। প্রতিটা ছবি সুন্দর করে সাজালো। ছবির নীচে কালো স্কেচপেন দিয়ে লিখলো শিল্পীর নাম ও বয়স। এখনই সন্ধ্যা হবার কথা না। কিন্তু বেলা ছোটো হয়ে আসায় এখনই প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। হালকা ঠাণ্ডাও পড়ছে। কাজটা শেষ করে সে বেশ তৃপ্ত। যা আশা করেছিলো তার থেকেও অনেকটা ভালো কাজ হয়েছে। সারাদিন ঠিকঠাক খাওয়া হয়নি। স্নান করেছে কোনোরকমে। পত্রিকাটা এবার কোচিং সেন্টারের দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে আসতে হবে৷ এই বছর শিশু দিবস রবিবারে পড়েছে। রবিবারের সন্ধ্যায় স্যারের কোনো ব্যাচ থাকে না। স্যারের বাড়ি পাশেই। স্যারকে ডেকে পত্রিকাটা সে সেলোটেপ দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে ফিয়ে আসবে। সে পত্রিকা আর সেটা লাগানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে কোচিংয়ের দিকে রওনা হলো।
কোচিংয়ের সামনে এসেই ভালোরকম অবাক হয়ে গেলো অদিতি। আজ রবিবারেও ঘর খোলা। ভেতরে ছেলেমেয়েরা আছে। দরজা বেলুন দিয়ে সাজানো। তাহলে কি ভেতরে অনুষ্ঠান হচ্ছে ? কই সে তো কিছু জানে না।
অদিতি বাইরে চটি খুলে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো। দরজা পেরোতেই একটা বড় বেলুন ফাটার শব্দ হলো। শব্দটা মিলিয়ে যাবার আগেই অদিতি শুনতে পেলো সুমন বলছে, “কোচিং সেন্টারে অদিতি ম্যামকে স্বাগতম। আর বাকি সবাইকে অদিতি ম্যামের পক্ষ থেকে শুভ শিশুদিবসের শুভেচ্ছা জানাই।”
অদিতি এবার ভালো করে ঘরের চারপাশে দেখলো। দেখে সে পুরোপুরি হতভম্ব। ঘরে ওদের ক্লাসে ছেলেমেয়েরা যেমন আছে তেমন অন্য ব্যাচের কিছু ছেলেমেয়েও আছে। আবার তাদের সঙ্গে ছোটো ছোটো বাচ্চারাও আছে। ঠিক যেমনটা অদিতি চেয়েছিলো। সবাই যতটা পেরেছে সাজগোজ করে এসেছে সেখানে অদিতিই একেবারে সাধারণ। সে সুমনকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হচ্ছে এখানে ?”
“কি হচ্ছে মানে ? তুই যা যা চেয়েছিলি তাই তাই হচ্ছে। তুই তো আর এলিই না। তাই আমরা পরে আলোচনা করে ঠিক করলাম শিশু দিবস পালন হবে। আমি সবাইকে বোঝালাম ব্যাপারটা। জানিস তো এই বোঝানোর ব্যাপারে আমি এক্সপার্ট। তুই এই এত পরিশ্রম করে বাচ্চাদের আঁকা যোগাড় করে এত সুন্দর একটা পত্রিকা তৈরী করেছিস সেটা কি চুপচাপ দেয়ালে লাগিয়ে দিয়ে চলে যাবি ? তাই হয় নাকি ? ওটা উদ্বোধন হবে এখানে তারপর টাঙানো হবে।”
“কিন্তু ?”
“কোনো কিন্তু নেই এর মধ্যে। তুই যা যা চেয়েছিলি সবই হবে। ছোট একটা অনুষ্ঠান, সবার টিফিন, রাখী সব ব্যবস্থাই হয়েছে।”
“কিন্তু টাকা ?”
“ভালো কাজে কখনও টাকার অভাব হয় না রে। সব ডিটেইলস শোনার পর স্যার নিজেই গোটা অনুষ্ঠান স্পনসর করছেন। স্যার এখনই আসবেন। অনুষ্ঠান শেষে সবার হাতে কেক দেয়া হবে। আর বাচ্চাদের হাতে কেকের সঙ্গে একটা করে কলম। ভাগ্যিস তোর মাথায় এই চিন্তা এসেছিলো। তুই না থাকলে স্কুল খোলার আগে এই মজাটাই হতো না। নে রেডি হ। অনুষ্ঠানে তুইও দু চার কথা বলবি। তোর জন্যই এই অনুষ্ঠান।”
“কই আমাকে তো কেউ বলেনি এই কথা ?”
“এটা তোর জন্য আমাদের সারপ্রাইজ ছিলো। তুই যা পরিশ্রম শুরু করেছিলি তাতে আমরা চেয়েছিলাম পত্রিকা টাঙাতে এসে তুই হতভম্ব হয়ে যা। এই লড়াই তুই একা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তোর একার ছিলো না। আমাদের সবারই ছিলো। কিন্তু তুইই জিতেছিস। দেখ ভালো করেই অনুষ্ঠান হচ্ছে৷”
অদিতির চোখে জল আসছে। এই লড়াইটা শেষ পর্যন্ত সে জিততে পেরেছে শুধু এই আনন্দেই চোখে জল নয়। সে জিতলেও অন্যান্যবারের মতো এবারেও ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের ট্রফি সুমন নিয়ে গেছে। কিছুটা জল এই দুঃখেরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *